অত্যধিক গরমের দিনে কংক্রিট কাস্টিংয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয়সমূহ

অবকাঠামোর যেকোনো অংশের ঢালাইয়ের অপরিহার্য উপাদান কংক্রিট। গতানুগতিক ধারণা রয়েছে যে কংক্রিটের ঢালাই দ্রুত রোদে শুকিয়ে গেলে ঘরও প্রস্তুত হয়ে যাবে দ্রুত, এতে অনেক সময় বাঁচবে। আসলে কি ব্যাপারটা তেমন?

উত্তর- “না”। অত্যধিক গরমে দ্রুত কংক্রিট শুকিয়ে যাওয়ায় ভালোর চেয়ে মন্দের সম্ভাবনাই বেশি, এবং এতে ঝুঁকির পরিমাণও বেশি। অধিক গরমে কিংবা শুষ্ক আবহাওয়ায় দ্রুত শুকিয়ে যাওয়া কংক্রিটে নিম্নোক্ত সমস্যাগুলো হতে পারে।

কংক্রিট স্ট্রেংথ কমে যায়

দ্রুতগতির খরগোশ আর ধীরগতির কচ্ছপের গল্প আমাদের সবারই জানা। বাস্তবজীবনে এ গল্পের বহু প্রয়োগের মাঝে একটি এই কংক্রিটের শুষ্ককরণ প্রক্রিয়া। অধিক তাপমাত্রায় কংক্রিট যত দ্রুত শুকিয়ে যায়, এর শক্তিবৃদ্ধিও তত কম হয়। অন্যদিকে, অল্প তাপমাত্রায় ধীরে ধীরে শুকানো কংক্রিট বেশ শক্তিশালী হয়, এবং টেকেও দীর্ঘদিন।

ফাটল ধরার ঝুঁকি

দ্রুত কংক্রিট শুকিয়ে গেলে তাতে কয়েকটি কারণে ফাটল ধরার ঝুঁকি দেখা দেয়। এর একটি হলো সংকোচন। অত্যধিক গরমে দ্রুত শুকিয়ে যাওয়া কংক্রিট বেশি মাত্রায় সংকুচিত হয়ে যায়, এবং প্রাথমিকভাবে উপরিতলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফাটল দেখা দেয়। প্রথমে সেগুলো উপেক্ষণীয় মনে হলেও পরে তা দিয়ে পানি বা অন্য কোনো রাসায়নিক প্রবেশ শুরু হয়।

তবে উপরিতলের সংকোচনের চেয়ে বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করে কেন্দ্রের প্রসারণ। কংক্রিট যখন শুকোতে থাকে তখন এর কেন্দ্রে তাপ সঞ্চিত হয়। উপরিতলে বায়ু প্রবাহের কারণে ও তাপমাত্রা নিঃসরণ করতে পারায় ঠাণ্ডা এবং শক্ত হয়ে যায়। কিন্তু ঢালাইয়ের কেন্দ্রে কংক্রিট অধিক তাপে প্রসারিত হতে পারে। ফলে ওপরের জমে যাওয়া কংক্রিটে ফাটল সৃষ্টি হয়।

স্পষ্টতই অধিক তাপে কংক্রিটের দ্রুত শুকিয়ে যাওয়া অবকাঠামোর দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য ক্ষতিকর। তাই অত্যধিক গরম আবহাওয়া এড়ানোর সুযোগ থাকলে সেটি গ্রহণ করতে হবে। যদি অবকাঠামো গরম এবং শুষ্ক আবহাওয়াতেই নির্মাণ করতে হয়, তবে জেনে নিতে হবে কীভাবে ফাটল ধরার ঝুঁকি এড়ানো যাবে।

দ্রুত ঢালাই

কাঠফাটা রোদে এবং গ্রীষ্মের শুষ্ক আবহাওয়ায় কংক্রিট ঢালাই করলে প্রথমেই যেদিকে খেয়াল রাখতে হবে তা হলো কংক্রিটের মিশ্রণ তৈরির পর সেটি দ্রুত ঢালাই করে ফেলা। তাই শুরুতেই সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করে ফেলতে হবে। কংক্রিটের মিশ্রণ তৈরি ঢালাইয়ের যথাসম্ভব নিকটে করতে হবে, এবং দ্রুত ঢালাই করে ফেলতে হবে।

ঢালাইয়ের পূর্বে পানি ঢালা

গরম আবহাওয়ায় এবং প্রখর সূর্যের তাপে ঢালাইয়ের স্থানটুকু অর্থাৎ স্টিলের কাঠামো কিংবা কোনো বেজমেন্ট যদি হয়, তা ভীষণ গরম হয়ে থাকে। এর ওপর কংক্রিট ঢালা শুরুর আগপর্যন্ত কিছুক্ষণ পর পর পানি ঢেলে একে ঠাণ্ডা রাখতে হবে। উল্লেখ্য, পানি বাষ্পীকরণে ঢালাইয়ের পৃষ্ঠতল তাপ নিঃসরণ করে ঠাণ্ডা হয়।

তাপ ও বাতাস আটকানোর ব্যবস্থা

আবহাওয়া পরিবর্তন করা সম্ভব না হলেও আবহাওয়ার প্রভাব কমানো সম্ভব পর্যাপ্ত প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে। অনেক কনস্ট্রাকশন সাইটেই এখন ঢালাইয়ের পৃষ্ঠতলের ওপর পাল টেনে সূর্যতাপের প্রভাব কমানোর ব্যবস্থা করা হয়। তবে গ্রীষ্মকালে অত্যধিক সূর্যতাপ যতটা ক্ষতিকর কংক্রিটের জন্য, শুষ্ক বাতাসও ঠিক ততটাই। কারণ এটি দ্রুত কংক্রিটের উপরিতলের আর্দ্রতা শুষে নেয়, এবং সংকোচন ঘটায়। তাই পুরো ঢালাইয়ের কাজের অংশকে বড় তাঁবু দিয়ে ঘিরে ফেলা আবহাওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব কমানোর সর্বোত্তম উপায়।

শীতল কংক্রিট

কংক্রিট শীতল করার উপায় কি বেশি করে পানি মেশানো? না। প্রয়োজনীয় অনুপাতের চেয়ে অধিক পানি মেশালে কংক্রিট শক্ত হবার পর তা যতটা শক্তিশালী হবার কথা ততটা হতে পারে না। তাই অধিক পানি মেশানো নয়, বরং পর্যাপ্ত পানিতেই কংক্রিট শীতল রাখতে হবে।

আর এর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো কংক্রিটের মিশ্রণে হিমশীতল পানি ব্যবহার করা। যদি কংক্রিটের মিশ্রণ তৈরির স্থানটি ঢালাইয়ের স্থানের কাছাকাছি না হয়, এবং তা কংক্রিট বহনকারী ট্রাকে করে আনতে হয়, সেক্ষেত্রে মিশ্রণে বরফ মেশানো উত্তম। তবে বরফ মেশাতে হবে এমন অনুপাতে যেন তা ঢালাইয়ের স্থানে পৌঁছানোর আগেই ট্রাকের ভেতরে গলে যায়। কোনো অবস্থাতেই বরফের টুকরোসমেত কংক্রিট দিয়ে ঢালাই করা যাবে না।

এয়ার ফগিং

এয়ার ফগিং (Air Fogging) হলো পানিকে ক্ষুদ্র ছিদ্রের মধ্য দিয়ে দ্রুত নির্গত করে একপ্রকার ধোঁয়াশার মতো তৈরি করা। ঢালাই হয়ে গেলে উপরিতলে এয়ার ফগিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে সদ্য ঢালাই হওয়া কংক্রিটের উপরের বাতাস আর্দ্র থাকবে, এবং তা কংক্রিট থেকে পানির দ্রুত বাষ্পীভবন রোধ করবে।

হাইড্রেশন স্টাবিলাইজার

কংক্রিটের সাথে অধিক পানি ধরে রাখতে পারে এমন বস্তু মেশানোকে হাইড্রেশন স্টাবিলাইজার (Hydration Stabilizer) বলে। সাধারণত ছাই ব্যবহৃত হয়ে থাকে এক্ষেত্রে। উল্লেখ্য, এর ব্যবহার কংক্রিটের শক্তি ক্ষয় বা বৃদ্ধি কোনোটিই করে না। তবে পানি ধরে রেখে দ্রুত শুষ্ক হওয়া রোধ করে।

বাষ্প নিরোধক আবরণ

এটি সর্বাধিক ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলোর একটি। ঢালাইয়ের কিছুক্ষণ পর যখন পৃষ্ঠতল খানিকটা শুকিয়ে আসে, তখন এর আর্দ্রতা ধরে রাখার জন্য প্লাস্টিকের পলিথিন, শিট কিংবা সাদা সূর্যালোক প্রতিফলক আবরণ ব্যবহার করা হয়। এছাড়া, ভেজা চট ব্যবহারও জনপ্রিয় পদ্ধতি।

সন্ধ্যা কিংবা রাতে ঢালাই

ঋতুবদলের জন্য অপেক্ষা না করলেও অন্তত সন্ধ্যা বা রাত হবার জন্য অপেক্ষা করাই যায়। সারাদিনে ঢালাইয়ের সব আনুষঙ্গিক কাজ সেরে ফেলে রাতে অপেক্ষাকৃত কম তাপে ঢালাই করা শ্রেয়। তথাপি, পরদিন সকালের সূর্য থেকে বাঁচতে বাষ্প নিরোধক আবরণ জরুরি।

প্লাম্বিং পাইপের রকমফের

প্রাচীনকালে, যখন মানুষ সবে প্লাম্বিং করতে শিখলো, ক্লে আর লেড (সীসা) পাইপই ছিল প্লাম্বিংয়ের জন্য একমাত্র বিকল্প। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে, বাসাবাড়ি নির্মাণশিল্পে আধুনিকতার ছোঁয়া আসবার পর প্লাম্বিংয়ের পরিধি বেড়েছে। পানি সরবরাহ আর পয়োঃনিষ্কাশন ছাড়াও বাসাবাড়ির ফিটিং কিংবা উষ্ণ পানি পরিবহনের জন্য ভিন্ন পাইপের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে লাগলো। তাছাড়া সীসার পাইপের দীর্ঘকাল ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট বিষাক্ততার ব্যাপারও মানুষকে ভাবিয়ে তোলে।

ফলে প্লাম্বিংয়ের জন্য এক-দুটি পাইপের ব্যবহার ছেড়ে নানারকম পাইপের ব্যবহার শুরু হয়। চলুন জেনে নেয়া যাক সর্বাধিক প্রচলিত প্লাম্বিং পাইপগুলো সম্পর্কে।

কপার (Copper) বা তামার পাইপ

প্লাম্বিংয়ের জন্য সর্বাধিক ব্যবহৃত পাইপগুলোর একটি হলো কপার পাইপ। সাধারণত দুই ধরনের কপার পাইপ প্লাম্বিংয়ে ব্যবহৃত হয়– কঠিন ও নমনীয়। পানি সরবরাহের জন্য কঠিন কপার পাইপের ব্যবহার আর সংযুক্তিতে নমনীয় কপারের রিভেট বা সংযুক্তি ব্যবহার করা হয়। তবে পানির কল তৈরিতেই নমনীয় কপারের ব্যবহার সর্বাধিক। উভয় প্রকার পাইপ ১৫, ১৮ আর ২২ মিলিমিটার ব্যাসে পাওয়া যায়। তবে বৃহৎ পরিসরে কাজের জন্য ১০৮ মিলিমিটার ব্যাসের কপার পাইপও হয়।

কপার পাইপের সবচেয়ে বড় সুবিধা এর দীর্ঘস্থায়িত্ব। ৫০ বছর পর্যন্ত টেকসই হতে পারে ক্ষয়নিরোধক এই পাইপগুলো। এদের ভেতর কোনোপ্রকার শেওলা বা ব্যাকটেরিয়া বাসা বাঁধতে পারে না, তাই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। পাশাপাশি এই পাইপ অত্যধিক তাপ সহনশীল।

অসুবিধা বলতে কপারের পাইপ তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল। এছাড়াও পরিবেশবিদরা অতিরিক্ত পরিমাণে ভূগর্ভস্থ কপার উত্তোলনের বিরোধিতা করেন, কেননা এটি পরিবেশের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর।

গ্যালভানাইজড (Galvanised) লোহার পাইপ

বাসাবাড়িতে ফিটিং, পয়োঃনিষ্কাশন কিংবা পানি সরবরাহের জন্য পেটা লোহার পাইপের তুলনায় গ্যালভানাইজড লোহার পাইপ অধিক জনপ্রিয় ছিল একসময়। এই পাইপে জিংকের আস্তরণ থাকায় এতে মরিচা ধরে না সহজে, সময়ের সাথে উজ্জ্বলতাও কমে যায় না।

তবে এই পাইপের সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই যেন বেশি। প্রথমত, এর স্থায়িত্ব কম, ২০-২৫ বছর সাধারণত। সীসার গ্যালভানাইজেশন হলে সেই পাইপের পানিতে সীসার বিষাক্ততা ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। কোনো কারণে জিংকের আস্তরণ চলে গেলে সহজেই মরিচা পড়ে। ভীষণ ভারি হওয়ায় নির্মাণকাজে এর ব্যবহারও কষ্টসাধ্য। আবার জিংকের সাথে পানিতে উপস্থিত খনিজ পদার্থের বিক্রিয়ায় ক্রমে গাদ জমা হয় পাইপের ভেতর, এবং একসময় তা সম্পূর্ণ পাইপও বন্ধ করে দিতে পারে।

পিভিসি (Polyvinyle Chloride) পাইপ

পিভিসি পাইপ এখনকার সময়ে প্লাম্বিংয়ের জন্য সর্বাধিক জনপ্রিয় নামগুলোর একটি। বাসাবাড়ির পানি সরবরাহ কিংবা ফিটিংয়ে সমানভাবে ব্যবহৃত হয় এই পাইপ। তুলনামূলক স্বল্পমূল্যের পিভিসি পাইপ চাপ সহনশীল, মরচে পড়ে না, তাই ক্ষয়ে যায় না। ওজনে কম এবং সহজে কাটা যায় বলে ব্যবহারও সহজ।

পিভিসির বড় শত্রু হলো তাপ। অধিক তাপে পিভিসি পাইপের আকার বিকৃতি ঘটতে পারে, এমনকি ফেটেও যায়। আবার আকারে বৈচিত্র্য না থাকায় জটিল নির্মাণকাজে এই পাইপ ব্যবহার করলে বারবার কাটা এবং জোড়া দেয়ার প্রয়োজন পড়ে।

সিপিভিসি (Chlorinated PVC) পাইপ

পিভিসি পাইপের সাথে পার্থক্য এর নাম থেকে অনুমান করা যায়। পিভিসি পাইপের সাথেই ক্লোরিন মিশ্রিত করে তৈরি করা হয় সিপিভিসি। কারণটাও অনুমেয়। অতিরিক্তি এই ক্লোরিন সিপিভিসি পাইপকে তাপ সহনশীল করে তোলে।

সিপিভিসি পাইপ প্রায় ২০০º সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপ সহনশীল, দামে কম, ক্ষয়কারী পদার্থ পরিবহনে সক্ষম, দীর্ঘস্থায়ী এবং চাপ সহনশীল। ঝামেলা বলতে ভঙ্গুরতা। ক্লোরাইড থাকায় এই পাইপ দীর্ঘক্ষণ সূর্যালোকে থাকলে ফেটে যেতে পারে। তাই এই পাইপ সাধারণত গৃহাভ্যন্তরে ব্যবহারের জন্য কাজে লাগান হয়।

ক্রস লিংক পলিইথিলিন (Cross Linked Polyethelyne) বা পেক্স পাইপ

পেক্স পাইপের বিশেষত্ব হলো এটি নমনীয় এবং বাঁকানো যায়। পিভিসির মতো এটিও একটি প্লাস্টিক পাইপ। তাছাড়া এই পাইপ কাটা এবং জোড়া লাগানো অত্যন্ত সহজ। রাবারের বার্ব ব্যবহার করে কিংবা অল্প আঁচে এক মুখ প্রসারিত করে দুটি পাইপকে সংযুক্ত করা যায়। নমনীয়তার পাশাপাশি তাপ সহনশীলতা এবং টেকসই হওয়াও পেক্স পাইপের গুণ। তবে ঝামেলা হলো এতে পানি দূষণের সম্ভাবনা থাকে। কিছু পেক্স পাইপে পানি সরবরাহ করলে তাতে গন্ধ হয়ে যায়।

সবচেয়ে জনপ্রিয় এই পাইপগুলো ছাড়াও আরো অনেক প্রকার প্লাম্বিং পাইপ রয়েছে। সেগুলো সম্পর্কেও সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক।

স্টেইনলেস স্টিল পাইপ

এগুলো দামে অধিক, মানেও উন্নত। অত্যধিক চাপ ও তাপ সহনশীল, ক্ষয়রোধী। তবে ক্ষয়কারক তরল পরিবহনযোগ্য নয়। দীর্ঘস্থায়ী এসব পাইপ কঠিন ও নমনীয় উভয় প্রকারের পাওয়া যায়।

পলিবিউটিলিন (Polybutylyne) পাইপ

এ পাইপগুলোকে একসময় পেটা লোহার পাইপের বিকল্প ভাবা হতো। পিভিসির মতো একপ্রকার প্লাস্টিকের পাইপ। পলিবিউটিলিন পাইপের বাজারে নতুন দিনের সূচনা করেছিল গত শতকের ‘৮০র দশকে। তবে ধীরে ধীরে এর ব্যবহার কমে আসে সংযুক্তির সমস্যার কারণে। দামে কম এই পাইপের সমস্যা একটাই, সংযোজন স্থানে সহজে লিক হয়, ফেটে যায়।

এবিএস পাইপ

অল্প দামে অধিক কর্মসম্পাদনের জন্য এবিএস পাইপ উপযোগী। এ পাইপ ক্ষয়কারী রাসায়নিক সহনশীল এবং মোটামুটি মাত্রায় তাপ সহনীয়। এবিএস পাইপ সাধারণ ড্রেনেজ ব্যবস্থায়, ছোট খাল বা নালায় ব্যবহার করা হয়।

ব্রাস (Brass) বা পিতলের পাইপ

পিতলের পাইপ যেকোনো দিক বিবেচনায় অন্য অনেক পাইপের তুলনায় অত্যন্ত কর্ম-উপযোগী। কারণ এ পাইপের চাপ ও তাপ সহনক্ষমতা বেশি, ক্ষয়রোধী, মরচে ধরে না, এবং দীর্ঘদিন টেকে। কিন্তু বড় পরিসরের কাজে এই পাইপ সাধারণত ব্যবহার হয় না বললেই চলে। কারণ এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কিচেন সিংকে, পানির কলে বা বিভিন্ন সৌন্দর্যবর্ধক অভ্যন্তরীণ কাজে পিতলের পাইপ ব্যবহার করা হয়।

হাই ডেনসিটি পলিইথিলিন (High-Density Polyethylene) বা এইচডিপিই পাইপ

এইচডিপিই পাইপগুলো বাজারে পিভিসি শ্রেণীর পাইপের মধ্যে সবচেয়ে ভালো মানের। এ পাইপগুলো অনেক বেশি চাপ সহনশীল। যেকোনো ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী এগুলো ৯০° কোণ পর্যন্ত বাঁকানো যায়। ৫০ বছর অনায়াসেই টিকে যেতে পারে এগুলো, যদি না চরম পরিস্থিতির শিকার হয়। দাম সহনশীল হওয়ায় এ পাইপের ব্যবহারও জনপ্রিয়, বিশেষ করে শিল্প-কারখানার পানি সরবরাহে।

কীভাবে মার্বেলের দাগ দূর করবেন?

আদিকাল থেকেই গৃহনির্মাণে মার্বেল ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গৃহসজ্জায় চাকচিক্য, নান্দনিকতা, সর্বোপরি মসৃণ এক অনুভূতি দেয় মার্বেলের মেঝে, দেয়াল কিংবা অন্যান্য ব্যবহার। অবশ্য সৌন্দর্যের সাথে মার্বেল নিয়ে আসে বাড়তি দায়িত্বও। নিয়মিত যত্ন না নিলে মার্বেলের গায়ে তৈরি হয় অনেকরকম দাগ, যেগুলো মার্বেলের সৌন্দর্যকে নষ্ট করে।

কিন্তু নিয়ম করে পরিচর্যার পরও যদি দাগ পড়েই যায়, তাহলে কী করা যায়? ভাবনার কারণ নেই। কীরকম দাগ তার ওপর নির্ভর করে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে মার্বেলের দাগও দূর করা যায়। কীভাবে দাগ দূর করবেন, সেটি জানবার আগে চলুন দেখে আসি মার্বেলে কত রকমের দাগ হতে পারে।

মার্বেলে যত দাগ

তেলের দাগ – রান্নার তেল থেকে শুরু করে লোশন, দুধ, মাখন, প্রসাধনী তেল, গ্রিজ ইত্যাদি থেকে মার্বেলে তেল চিটচিটে ধূসর হলুদাভ দাগ হতে পারে।

জৈবিক কারণ – কফির কাপ, কাচের বাসনকোসন, বালতি, মগ ইত্যাদির কারণে এই দাগ হতে পারে যা ধূসর বা কালচে হয়।

পানির দাগ – নিয়মিত পানি পড়লে বা পানি জমে থাকলে, দ্রুত না মুছে ফেললে এই দাগ ধীরে ধীরে তৈরি হয়।

চিটি পড়া – এ ধরনের দাগ সবচেয়ে বেশি হয় গোসলখানায়, বিশেষ করে যে অংশে মার্বেল পুরো ভিজে না গেলেও পানির ফোঁটা পড়ে তার উপর।

মরচে পড়া দাগ – লোহা ও ইস্পাতের সামগ্রী থেকে মার্বেলে এই দাগ পড়ে।

এগুলো সবচেয়ে পরিচিত সমস্যা। তবে এগুলো ছাড়াও ঘর্ষণের দাগ, কালির দাগ, চা-কফির দাগ, রঙের দাগ ইত্যাদি উপায়ে মার্বেলে দাগ পড়তে পারে।

দাগ ওঠানোর উপায়

মার্বেল থেকে কঠিন কঠিন দাগ ওঠানোর জন্য পোল্টিস (Poultice) নামক একপ্রকার রাসায়নিক ব্যবহার করা সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং সর্বাধিক প্রচলিত পদ্ধতি। পোল্টিস বাজারেই কিনতে পাওয়া যায়। এটি নানা প্রকার রাসায়নিক ও পরিষ্কারক দ্রব্যের সংমিশ্রণে তৈরি। কেওলিন ক্লে (Kaolin Clay- একপ্রকার কাদামাটি), ফুলার্স আর্থ (Fuller’s Earth – অ্যালুমিনিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম সিলিকেট সমৃদ্ধ একপ্রকার কাদামাটি), ট্যাল্ক, বেকিং সোডা, চকের গুঁড়া ইত্যাদি মিশ্রিত করে চাইলে বাসাতেই প্রস্তুত করা যাবে এই ক্লিনার।

তেল চিটচিটে দাগ

তেলজাতীয় দ্রব্য সাধারণত মার্বেলের ক্ষুদ্র ছিদ্রগুলোতে প্রবেশ করে স্থায়ী কালচে দাগ তৈরি করে। এ দাগ দূর করার একটাই উপায়- ছিদ্রগুলোতে অবস্থান নেয়া এই তেল অপসারণ, যা সাধারণ ধোয়া-মোছায় সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রথম পদ্ধতি হলো অ্যামোনিয়া বা অ্যাসিটোন মিশ্রিত তরল ক্লিনার দিয়ে দাগ ওঠানোর চেষ্টা করা। এ পদ্ধতি কাজ না করলে পোল্টিস দিয়ে ভালো করে ঘসে ২৪ ঘণ্টা পর গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। প্রয়োজনে দ্বিতীয় দিনের মতো পোল্টিস দিয়ে ২৪ ঘণ্টা অতিবাহিত করতে হবে।

জৈবিক দাগ

চা, কফি, লেবুর রস ইত্যাদির জৈবিক দাগ তোলা বেশ সহজ। ১২% হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের সাথে কয়েক ফোঁটা অ্যামোনিয়ার মিশ্রণে তৈরি লিকুইড ক্লিনার দিয়ে এ দাগ সহজেই তোলা যাবে। তবে কালো রঙের মার্বেল পাথরের ক্ষেত্রে এই মিশ্রণ ব্যবহারে কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কেননা অধিক সময় এর ব্যবহারে কালো রঙের মার্বেলের রঙ পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে।

গোসলখানায় পানির দাগ

গোসলখানার দেয়ালে প্রতিনিয়ত পানির ছিটা কিংবা সাবান/ডিটারজেন্ট মিশ্রিত পানির ছিটা পড়ে, তাতে দীর্ঘস্থায়ী দাগ তৈরি হয়। তবে এই দাগ দূর করাও বেশ সহজ। একটি মাঝারি আকারের বালতিতে (৬-৮ লিটার পানি) আধা কাপ অ্যামোনিয়া মিশিয়ে দেয়ালে ভালোভাবে ঘষলেই এ দাগ উঠে যাবে। একদিনে না উঠলে ২/৩ দিন পরিচ্ছন্নতা অভিযান অব্যহত রাখতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, অধিক অ্যামোনিয়া মানেই অধিক পরিষ্কার নয়। বরং অতিরিক্ত অ্যামোনিয়া ব্যবহার করলে দেয়ালের মার্বেলের রঙ ঝলসে যেতে পারে।

মরচে পড়ার দাগ

ধাতব বস্তু থেকে মরচে পড়ার যে দাগ তৈরি হয় মার্বেলে, তা তুলতে গিয়ে অনেকে মার্বেলের বিস্তর ক্ষতিসাধন করে থাকেন তীক্ষ্ম বা ধারালো কোনো ধাতব বস্তু দিয়ে ঘষে। যদিও মরচে পড়া দাগ দূর করা দুরূহ ব্যাপার, তবে ধাতব বস্তুর ঘর্ষণ একেবারেই করা যাবে না।

প্রথমত, মোলায়েম ব্রাশ দিয়ে ভালো করে দাগ পড়া অংশগুলো ঘষতে হবে যেন মরচের অতিরিক্ত আবরণই কেবল উঠে যায়, নতুন কোনো দাগ সৃষ্টি না হয়। এরপর পোল্টিস প্রয়োগ করে ঘষতে হবে। টানা কয়েকদিন পোল্টিস প্রয়োগ করলেই কেবল মার্বেলের সূক্ষ্ম ছিদ্রের ভেতর প্রবেশ করা মরচে বের করে আনা সম্ভব হবে। এতেও না হলে জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়ার প্রয়োজন হতে পারে, যা পেশাদার কাউকে দিয়ে করানো উত্তম।

কালির দাগ

যেসব কালির দাগ পানিতে ধুয়ে দিলে যায় না, সেগুলোর জন্য পোল্টিসই যথেষ্ট। তবে অত্যধিক পরিমাণে কালি পড়লে কিংবা আঠালো এবং স্থায়ী কোনো কালচে দাগ তুলবার জন্য বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত অধিক শক্তিশালী লিকুইড ক্লিনার প্রয়োজন। তবে এই লিকুইড ক্লিনার নিজে ব্যবহার না করে পেশাদার কাউকে দিয়ে করানোই যুক্তিযুক্ত। কারণ সঠিক পদ্ধতিতে প্রয়োগ করতে না পারলে এতে দু’রকম ঝামেলা হতে পারে– মার্বেলের চাকচিক্য নষ্ট হয়ে যাওয়া, এবং হাতে চুলকানির সৃষ্টি হওয়া।

ধোঁয়া কিংবা আগুনে পোড়া দাগ

দীর্ঘক্ষণ ধোঁয়ায় থাকলে কিংবা আগুনের সংস্পর্শে মার্বেলে গভীর কালো দাগ হতে পারে যা ওঠানোর জন্য বেশ কসরত করতে হবে। পোল্টিসের প্রলেপ দিয়ে ২৪ ঘণ্টা পর ভালো করে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে এবং সেটি শুকিয়ে এই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করতে হবে। এভাবে কয়েকবার করার পর মার্বেল প্রাথমিক রূপে ফিরে আসতে পারে।

ওয়াটার সাপ্লাই সিস্টেমে ব্যবহৃত পাইপের রকমফের: কোনটি কেন ব্যবহৃত হয়, সুবিধা-অসুবিধা

ওয়াটার সাপ্লাই সিস্টেম বা পানি সরবরাহ ব্যবস্থা যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি। পানি সরবরাহের পাইপ যদি টেকসই ও চাপ সহনক্ষম না হয়, তাহলে পুরো নির্মাণকাজই নস্যাৎ হতে পারে। পাইপ ফেটে চুইয়ে পানি পড়া ঘরের দেয়ালের রঙ নষ্ট করা থেকে শুরু করে পলেস্তারা খসানো, শেওলা জমানো, এমনকি দেয়াল-ছাদের গাঁথুনি পর্যন্ত দুর্বল করে দিতে পারে। তাই বাসাবাড়ি, অফিস ও শিল্পকারখানা- যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণে পাইপ নিয়ে যথেষ্ট মাথা ঘামাতে হবে।

অবকাঠামো নির্মাণে পানি সরবরাহের পাইপের রয়েছে রকমফের। সবকাজে সবরকম পাইপ মানানসই না। পানি সরবরাহের জন্য সবচেয়ে মানানসই পাইপগুলো কোনটি কী কাজে ব্যবহৃত হয় সেই ব্যাপারে জানা যাক চলুন।

কাস্ট আয়রন (Cast Iron) বা ঢালাই লোহার পাইপ

পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় সর্বাধিক ব্যবহৃত পাইপের নাম কাস্ট আয়রন পাইপ বা ঢালাই লোহার পাইপ। এই পাইপ এর ক্ষয়রোধী ক্ষমতা, দীর্ঘস্থায়িত্ব আর অন্যান্য পাইপের তুলনায় সাশ্রয়ী হবার জন্য এখনও সবচেয়ে জনপ্রিয়।

ঢালাই লোহার পাইপ ৫ সেন্টিমিটার থেকে শুরু করে ১২০ সেন্টিমিটার বা তারও বেশি ব্যাসের হতে পারে, লম্বায় ১২ ফুট থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত। বিশেষ কোনো দুর্যোগের সম্মুখীন না হলে ঢালাই লোহার পাইপ ১০০ বছর বা তারও বেশি টিকে থাকতে পারে। ব্যবহারবিধি অনুযায়ী এই পাইপের ঘনত্বও ভিন্ন হয়।

ঢালাই লোহার পাইপের আরেকটি বড় সুবিধা হলো সহজ সংযুক্তি। এই পাইপ একটির সাথে আরেকটি সহজে সংযুক্ত করে বা প্রয়োজন অনুযায়ী আকৃতিতে কেটে নেয়া যায়।

এটি ব্যবহারের প্রধান অসুবিধা হলো মরিচা পড়া। স্যাঁতস্যাঁতে স্থানে এই পাইপের উপর সহজেই মরিচা ধরে, শৈবাল জমে এবং পাইপ ক্ষয় হতে শুরু করে।

গ্যালভানাইজড আয়রন পাইপ (Galvanised Iron Pipe)

গ্যালভানাইজড আয়রন পাইপকে সংক্ষেপে জিআই পাইপ বলা হয়। এটি সাধারণ স্টিল বা ইস্পাতের পাতের উপর গ্যালভানাইজ করে তৈরি করা হয়। সহজ ভাষায় বললে, ইস্পাতের পাইপ তৈরি করে তা জিংকের মিশ্রণে ডোবানো হয় নতুন আস্তরণের জন্য। এ প্রক্রিয়াকে গ্যালভানাইজিং বলে। জিআই পাইপ বৃহৎ পরিসরের কোনো কাজে ব্যবহৃত হয় না। সাধারণত ১২ মিলিমিটারের সরু পাইপ থেকে শুরু করে ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত ব্যাসের জিআই পাইপ তৈরি করা হয়। লম্বায় এসব পাইপ ২০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে।

জিআই পাইপও তুলনামূলকভাবে স্বল্পমূল্যের। বাসা-বাড়িতে পানি, গ্যাস, বিদ্যুতের লাইনের জন্য এই পাইপ ব্যবহার করা হয়। ব্যাস কম হওয়ায় এটি সহজেই দেয়ালের ভেতর দিয়ে স্থাপন করা যায়। এছাড়াও এটি পাতলা এবং সহজে কাটা ও জোড়া দেয়া যায়।

জিআই পাইপ ব্যবহারের অসুবিধা হলো এর স্থায়িত্ব। এটি ১০ বছরের বেশি স্থায়ী হয় না। আবার পানি কিছুটা অম্লীয় বা ক্ষারীয় হলে এই পাইপ ক্ষয় হতে শুরু করে।

রট আয়রন (Wrought Iron) বা পেটা লোহার পাইপ

জিআই পাইপের সাথে রট আয়রন বা পেটা লোহার পাইপের একমাত্র পার্থক্য হলো এতে গ্যালভানাইজিং করা হয় না, পেটা লোহার পাত ওয়েল্ডিং (ঝালাই) করে এই পাইপ তৈরি করা হয়।

পেটা লোহার ব্যবহারবিধিও অনেকটা জিআই পাইপের মতো- পানি, গ্যাস, ইত্যাদি পরিবহনে ব্যবহার করা হয় এটি। তবে পার্থক্য এর প্রয়োজনীয়তায় এবং ব্যবহারবিধির বৈচিত্র্যে।

পেটা লোহার পাইপ জিআই পাইপের তুলনায় হালকা, সহজে কাটা যায়, জোড়া লাগানো যায় এবং যেকোনো আকৃতিতে বাঁকিয়ে ব্যবহার করা যায়। ১২ মিলিমিটার থেকে ১৫ সেন্টিমিটার ব্যাসের পেটা লোহার পাইপ মূলত যেসব কাজে পাইপ অধিক পরিমাণ কাটা বা জোড়া লাগানোর প্রয়োজন হয়, সেসব কাজে ব্যবহার করা হয়। এই পাইপ জোড়া লাগানোর তিনটি উপায় আছে- সকেট সংযোজন (Socket joint), ফ্ল্যাংড সংযোজন (Flanged joint) এবং ওয়েল্ডেড সংযোজন (Welded joint)।

স্টিল (Steel) বা ইস্পাতের পাইপ

জিআই পাইপ আর পেটা লোহার পাইপের সাথে স্টিলের পাইপের পার্থক্য হলো ব্যবহারবিধিতে। এই পাইপ সাধারণত অ

ধিক চাপে পানি, গ্যাস বা যেকোনো তরল সরবরাহের জন্য সংক্ষিপ্ত পরিসরের লাইনে ব্যবহার করা হয়। স্টিলের শিট ব্যবহার করে তৈরি করা এ পাইপেও জিআই পাইপের মতো জিংক সল্যুশন ব্যবহার করে অতিরিক্ত একটি আবরণ বা গ্যালভানাইজিং ব্যবহার করা হয়। স্টিলের পাইপ আকারে ছোট, পাতলা এবং অত্যন্ত মসৃণ। এসিড বা ক্ষারের সংস্পর্শে না এলে এ পাইপ সহজেই ২০-২৫ বছর টিকে যায়, মরিচাও পড়ে না।

কপারের পাইপ (Copper)

লোহা ও ইস্পাতের তুলনায় কপার বা তামা বেশ দামী। তাই কপারের পাইপ সাধারণত সীমিত পরিসরে বিশেষ বিশেষ কাজে ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে যখন পানি সরবরাহের অংশের সাথে শ্রী-বৃদ্ধির ব্যাপার যুক্ত থাকে, তখন এই পাইপ ব্যবহার করা হয়।

কপারে মরিচা ধরে না, তাই এর পাইপ দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়। গরম পানি পরিবহনে এই পাইপ সবচেয়ে বেশি উপযোগী। অত্যধিক তাপেও কপারের পাইপের কোনো ক্ষতি হয় না। তবে অসুবিধা ঘটে চাপে। নরম ধাতু হওয়ায় অধিক চাপে এই পাইপ ক্ষয় হয়ে যেতে পারে বা ভেঙে যেতে পারে।

প্লাস্টিকের পাইপ (Plastic pipe)

প্লাস্টিকের পাইপ সাধারণ রাবার বা পিভিসি (পলিভিনাইল ক্লোরাইড) দিয়ে তৈরি। পিভিসি পাইপ আজকাল বাসা-বাড়িতে পানি সরবরাহের জন্য ব্যাপক জনপ্রিয়। কেননা, এই পাইপ চাপ সহনীয়, ক্ষয়রোধী, মরিচা ধরার কোনো সম্ভাবনাই নেই, সহজে শেওলাও জমে না। এতে পানি, গ্যাস ছাড়াও অম্ল বা ক্ষার পরিবহন করলেও ক্ষয় হয় না।

প্লাস্টিকের পাইপও সহজেই কাটা যায়, আর যেকোনো মাপ অনুযায়ী জোড়া লাগানো যায়। ইউনিয়ন বা রিভেট ব্যবহার করে এই পাইপ জোড়া দেয়া হয়। প্লাস্টিকের পাইপের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো তাপ অসহনশীলতা। অধিক তাপে এই পাইপ অকার্যকর হয়ে পড়ে, ফেটে যাবার সম্ভাবনা থাকে।

এসব পাইপ ছাড়াও অধিক পরিমাণ পানি সরবরাহের জন্য, বিশেষ করে শিল্প কারখানায় অ্যাসবেস্টসের পাইপ (Asbestos Pipe), কংক্রিট পাইপ (Concrete Pipe) ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। অবশ্য পয়ঃনিষ্কাশনেই এ পাইপগুলো অধিক ব্যবহারোপযোগী।

কংক্রিট ফিনিশিংয়ের রকমফের

প্রাচীনকালে বসতবাড়িসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হতো মাটি, চুন, সুড়কি, পাথর ও অন্যান্য উপাদান দিয়ে। ইতিহাসবিদদের বক্তব্য অনুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে রোমানরা প্রথম অবকাঠামো নির্মাণে বিভিন্ন বস্তুর মিশ্রণে একধরনের মিশ্রণ ব্যবহার শুরু করে। বালু, চুন, সুড়কির সাথে পরিমাণমতো পানি দিয়ে তৈরি এই মিশ্রণ কংক্রিট হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অবকাঠামো নির্মাণে। আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যেই রোমানদের মাঝে কংক্রিট অবকাঠামো নির্মাণের প্রধান উপাদান হিসেবে প্রচলিত হয় এবং কালের পরিক্রমায় কংক্রিটের মিশ্রণে চুনকে প্রতিস্থাপন করে সিমেন্ট।

কংক্রিটের ব্যবহার যেমন সহজ, তেমনই নিরাপদ ও বহুমাত্রিক। অবকাঠামোতে যেকোনো প্রকার ডিজাইন প্রয়োগেই কংক্রিট ব্যবহার করা যায়। কংক্রিটের ফিনিশিংয়ের রকমভেদের উপর অনেকাংশেই নির্ভর করে সৃজনশীল নির্মাণশৈলির নান্দনিকতা।

. ট্রোয়েল ফিনিশ

রাজমিস্ত্রী একপ্রকার হাতলযুক্ত মসৃণ স্টিলের গঠন নিয়ে কংক্রিটের ঢালাইয়ের উপর বারবার নাড়াচাড়া করে যাচ্ছেন- এই দৃশ্য আমাদের সকলের নিকটই সুপরিচিত। এরূপ ফিনিশিংকেই মূলত ট্রোয়েল ফিনিশিং বলা হয়। এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বহুল প্রচলিত ফিনিশিং। মূলত কংক্রিটের ঢালাইয়ের কাজ হয়ে গেলে পৃষ্ঠতল মসৃণ ও সমতল করে দেয়াই ট্রোয়েল ফিনিশ। রাজমিস্ত্রীদের হাতে সচরাচর দেখা ম্যানুয়াল ট্রোয়েলের পাশাপাশি আজকাল যান্ত্রিক ট্রোয়েলের ব্যবহারও বেড়েছে।

২. ব্রুম ফিনিশ

এ ধরনের কংক্রিট ফিনিশে কংক্রিটের পৃষ্ঠতল মসৃণ রাখা হয় না। অবশ্য অনেকে একে ট্রোয়েলড-ব্রুমও বলে থাকে এজন্য যে ট্রোয়েল দিয়ে প্রথমে কংক্রিট মসৃণ করে সমতল করার পরই এর উপর ব্রুম বা ঝাঁটা দিয়ে টেনে টেনে একে অমসৃণ করা হয়। ব্রুম ফিনিশিংয়ে সময়ের ব্যাপারে বিশেষ সাবাধান হতে হয়। ট্রোয়েলের কাজ শেষ হবার সাথে সাথেই ব্রুমের কাজ শুরু করে দিতে হয়, অন্যথায় সিমেন্ট শুকিয়ে গেলে তা করা সম্ভব হয় না। এ ধরনের ফিনিশিং প্রধানত পৃষ্ঠতল যেন পিচ্ছিল না হয়ে যায় সে উদ্দেশ্যে করা হয়।

. স্ট্যাম্পড ফিনিশ

নাম থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া সম্ভব, কেননা স্ট্যাম্পড কংক্রিট ফিনিশিংয়ে আক্ষরিক অর্থেই কংক্রিটের উপর স্ট্যাম্পিং করা হয়। কংক্রিটের ঢালাই যথাযথভাবে ট্রোয়েল দিয়ে মসৃণ করার পর কংক্রিট নরম থাকতেই তার উপর কোনো নমুনা বস্তু দিয়ে চেপে সেটির আকৃতি ফুটিয়ে তোলার নাম স্ট্যাম্পড ফিনিশ। এটি মূলত সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্দেশ্যেই করা হয়ে থাকে। স্ট্যাম্পড করার পর কংক্রিটের মেঝে দেখতে পাথর, স্লেট, ইট কিংবা যথাযথ উপায়ে করতে পারলে কাঠের মতোও হয়। বাসাবাড়িতে সাইডওয়াক কিংবা রাস্তায় ফুটপাতে, গাড়ির গ্যারেজে এ ধরনের ফিনিশিং দেয়া হয়।

. সল্ট ফিনিশ

সদ্য ঢালাই করা কংক্রিটের উপর এবড়োথেবড়ো ক্রিস্টাল আকৃতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথড়ের টুকরো ফেলে তা রোলার দিয়ে চেপে মসৃণ করে দেয়ার প্রক্রিয়াকে সল্ট ফিনিশিং বলে। কংক্রিট শক্ত হবার পর মেঝেটি ভালো করে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললেই সল্ট ফিনিশিংয়ের সৌন্দর্য বোঝা যায়। অবশ্য সৌন্দর্য এখানে গৌন ব্যাপার। মুখ্য হলো মেঝে পিচ্ছিলরোধী করা। সাধারণ সুইমিংপুলে এ ধরনের ফিনিশিং ব্যবহার করা হয় যার উপর সহজে শ্যাওলা পড়ে না কিংবা পিচ্ছিল হয়ে যায় না।

৫. এক্সপোজড এগ্রিগেট ফিনিশ

এটাও বহুল প্রচলিত পদ্ধতি। মূলত ট্রোয়েলড ফিনিশের উপর অতিরিক্ত একস্তরের কংক্রিট বা সিমেন্ট যোগ করাই এক্সপোজড এগ্রিগেট ফিনিশ। প্রথমে ট্রোয়েল দিয়ে কংক্রিটের ঢালাই মসৃণ করা হয়। এরপর তা থেকে কয়েক মিলিমিটারের মতো চিকন একটি আবরণ পাওয়ার ফ্ল্যাটার বা ডায়মন্ড পলিশার দিয়ে উঠিয়ে নেয়া হয়। এই আবরণ উঠিয়ে নিলে ভেতরের কংক্রিটের পৃষ্ঠতল আরো মসৃণ হয়। এরপর তার উপর সিমেন্টের মিশ্রণের একটি অতিরিক্ত লেয়ার যোগ করা হয় যা একে অত্যন্ত মসৃণ এবং তকতকে করে তোলে।

. সোয়ার্ল ফিনিশ

কংক্রিটের ফিনিশের নানা রকমভেদের মাঝে এটি সবচেয়ে সৃজনশীলগুলোর একটি। প্রথম কংক্রিটের আবরণ সমতল করার পর তার উপর জ্যামিতিক মাপ ঠিক রেখে অভিন্ন পরিমাণ এবং আকার বজায় রেখে কংক্রিট মিশিয়ে দেয়া হয়। ফলে মেঝের উপর নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে কংক্রিটের বৃত্তাকার গঠন তৈরি হয় যা মেঝের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। একইসাথে হাঁটাচলার জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক হয়, কেননা এতে পিছলে পড়ার সম্ভাবনা থাকে না বললেই চলে।

অবশ্য এটি ঘরের বাইরের মেঝেতেই সাধারণত ব্যবহার করা হয়। যেসব স্থানে অধিক হাঁটাচলা হয় এবং মানুষের পায়ের ঘর্ষণে মেঝে খুব দ্রুতই ক্ষয় হয়ে কিছুটা পিচ্ছিল হয়ে যায়, সেসব স্থানে এই প্রক্রিয়ায় কংক্রিটের ফিনিশিং দেয়া হয়। সোয়ার্ল ফিনিশিংয়ের ব্যবহার খুব একটা দেখা যায় না, কারণ এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা বেশ কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়বহুল।

. পলিশড ফিনিশ

পলিশড ফিনিশ মূলত এরূপ যে মেঝে টাইলসের মতো মসৃণ ও আরামদায়ক হবে এবং তা এতটাই চকচকে হবে যে তাতে বিভিন্ন বস্তুর প্রতিফলন দেখা যাবে। সাধারণ বড় হলঘরে, প্রদর্শনীর মেঝেতে এ ধরনের ফিনিশ ব্যবহার করা হয়। পলিশড ফিনিশ যান্ত্রিকভাবেই করা হয়।

. কালারড ফিনিশ

কালারড বা রঙিন ফিনিশ মূলত মেঝেকে রঙিন করার জন্যই করা হয়। মেঝেকে রঙিন করতে দুটি উপায় ব্যবহার করে থাকেন রাজমিস্ত্রীরা। পিগমেন্ট বা একপ্রকার বিশেষ রঞ্জক পদার্থ প্রথমেই কংক্রিটের সাথে মিশিয়ে নেয়া হয় এবং তা ফিনিশিং করলে রঙ ফুটে ওঠে। অথবা কংক্রিট ফিনিশিং সম্পন্ন করে তা শুকিয়ে যাবার পূর্বেই তার উপর পছন্দমতো রঙের স্ট্রেইন প্রয়োগ করা হয়। উল্লেখকৃত কংক্রিট ফিনিশিংগুলো হলো সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ও ব্যবহৃত কংক্রিটের ফিনিশিং। এগুলো ছাড়াও ডাইড, মার্বেলড, ফ্ল্যাশড, মাইক্রো টপিং, স্যান্ড ব্লাস্টারসহ নানা প্রকারের কংক্রিট ফিনিশিং রয়েছে।

প্লাস্টার ফিনিশিং-এর প্রকারভেদ

প্লাস্টার (পলেস্তারা) ফিনিশিং কী? সহজ ভাষায়- দেয়াল নির্মাণের পর তার মসৃণ বহিরাবরণ করার নামই প্লাস্টার ফিনিশিং। অবশ্য প্লাস্টার ফিনিশিং সর্বদাই মসৃণ হবে- এমন ভাবলে ভুল করবেন। দেয়ালের সুরক্ষা আর স্থায়িত্বের পাশাপাশি প্লাস্টার ফিনিশিংয়ের আরেকটি অন্যতম লক্ষ্য দেয়ালকে নান্দনিক করে তোলা। আর নান্দনিকতার স্বার্থে প্লাস্টার সবসময় মসৃণ না-ও হতে পারে।

চলুন জেনে নেয়া যাক এমনই কিছু প্লাস্টার ফিনিশিংয়ের কথা, যার নান্দনিক দর্শন ছাড়িয়ে যায় ব্যবহারিক গুণকেও।

পিবল ড্যাশ প্লাস্টার ফিনিশ (Peeble Dash Plaster Finish)

নামের মতো প্লাস্টার ফিনিশের এ ধরনটি তৈরির প্রক্রিয়াও বেশ মজার। সদ্য বসানো মসৃণ করা সিমেন্ট/কংক্রিটের ঢালাইয়ের উপর ছোট ছোট নুড়ি পাথরের টুকরো কিংবা অন্যান্য পাথরের টুকরো পরিমাণ মতো ফেলে পিবল ড্যাশ প্লাস্টার ফিনিশ প্রস্তুত করা হয়। প্রাথমিক সিমেন্টের ঢালাই অন্তত ১ মিলিমিটার পুরু হতে হবে, অন্যথায় পাথরের গুঁড়ো তাতে স্থায়ী হবে না। প্রস্তুতি থেকেই অনুধাবনযোগ্য যে এই ফিনিশিং মসৃণ নয়, বরং রুক্ষ হয়। সাধারণ বাড়ির সীমানা দেয়ালের বহিরাবরণে এই ফিনিশিং দেয়া হয়, যা একইসাথে সৌন্দর্যবর্ধন করে এবং দেয়ালকে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘর্ষণ থেকে রক্ষা করে।

স্ক্র্যাপড প্লাস্টার ফিনিশ (Scrapped Plaster Finish)

প্লাস্টার ফিনিশিংয়ের এই ধরনের জন্য অন্তত ৬ মিলিমিটার থেকে শুরু করে ১২ মিলিমিটার পর্যন্ত পুরুত্বের কংক্রিট/সিমেন্টের ঢালাই প্রয়োজন। প্রক্রিয়াটি কিছুটা সময়সাপেক্ষ। প্রথমে সিমেন্টের ঢালাই যথাযথভাবে মসৃণ করে কয়েক ঘন্টা শুকাতে হবে। ঢালাই মোটামুটি শক্ত হয়ে এলে তার বহিরাবরণ ধারালো লোহার যন্ত্র বা অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করে চেঁছে তুলে ফেলা হয়। এ কারণেই একে বলা হয় স্ক্র্যাপড প্লাস্টার (ছাঁটা প্লাস্টার)। এটি সৌন্দর্যবর্ধনে তেমন উপযোগী না হলেও দেয়াল বা মেঝেকে পিচ্ছিলরোধী করতে যথেষ্ট উপযোগী। অবশ্য স্ক্র্যাপ করবার উপকরণভেদে এই প্লাস্টার দেখতে একেকরকম হয়।

স্টাকো প্লাস্টার ফিনিশ (Stucco Plaster Finish)

স্টাকো প্লাস্টার ফিনিশ ঘরের বহির্ভাগ কিংবা অভ্যন্তর, উভয় ক্ষেত্রেই মানানসই। এটি মূলত তিন স্তরের প্লাস্টার, যে কারণে বেশ পুরু হয়ে থাকে, প্রায় ২৫ মিলিমিটার পর্যন্ত। প্রথম আবরণকে বলা হয় স্ক্র্যাচ কোট (Scratch Coat), দ্বিতীয়টিকে ফাইনার কোট (Finer Coat), এবং সবার শেষে ফিনিশিং কোট (Finishing Coat) বা হোয়াইট কোট (White Coat)। এটি সম্পূর্ণ মসৃণ না হলেও এবড়োথেবড়োও নয় বটে।

স্মুদ কোট ফিনিশ (Smooth Coat Finish)

প্লাস্টার ফিনিশিংয়ের মাঝে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হলো স্মুদ কোট ফিনিশ। এটি দেয়ালের মসৃণ, সমতল ফিনিশ যা ১ ভাগ বালু আর ৩ ভাগ সিমেন্টের মিশ্রণ দিয়ে সমতল করে দেয়ালে বসানো হয়।

স্যান্ড ফিনিশ প্লাস্টার (Sand Finish Plaster)

এটাও প্লাস্টার করার একটি জনপ্রিয় এবং বহুল ব্যবহৃত প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় দেয়ালে দুবার প্লাস্টার করা হয়। প্রথমবার ১২ মিলিমিটার পুরু অমসৃণ প্রাথমিক প্লাস্টার করা হয় যাতে সিমেন্ট-বালুর অনুপাত থাকে ১:৪। প্রথম আবরণ সপ্তাহখানেক শুকানোর পর শুরু হয় দ্বিতীয় আবরণের কাজ। এই আবরণের জন্য সমান অনুপাতে বালু ও সিমেন্টের মিশ্রণ তৈরি করা হয় এবং অমসৃণ প্রাথমিক প্লাস্টারের উপর ৬ মিলিমিটার পুরু প্লাস্টার দিয়ে তা মসৃণ করা হয়।

টেক্সচারড প্লাস্টার ফিনিশ (Textured Plaster Finish)

বালু, সিমেন্ট, চুন আর পানির পর্যাপ্ত মিশ্রণে প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন প্রকার তন্তু ও রঞ্জক মিশ্রিত করে টেক্সচারড প্লাস্টার ফিনিশ তৈরি করা হয়। এটি মূলত স্টাকো প্লাস্টারিংয়েরই একটি প্রকারভেদ। ভিন্নতা কেবল এতটুকু যে এটি স্টাকোর তুলনায় অধিক মসৃণ, কেননা, এতে বারংবার প্লাস্টার করা হয় কম পুরু আবরণের। এছাড়াও এটি কিছুটা রঙিনও হয় যা দেয়ালকে দেখতে আকর্ষণীয় করে।

এক্সপোজড এগ্রিগেট প্লাস্টার ফিনিশ (Exposed Aggregate Plaster Finish)

এটি মূলত পিবল ড্যাশ ফিনিশিংয়ের একটি প্রকারভেদ, তবে এটি অধিকতর মসৃণ এবং নান্দনিক। এর প্রক্রিয়ায় অনেকটা একইরকম। এটি ১:১ সিমেন্ট ও সাদা পাথরের কুচির আবরণ। প্রাথমিকভাবে মসৃণ করে ঢালাই বা প্লাস্টার করা কংক্রিটের আবরণ (অন্তত ২০ মিলিমিটার পুরু) নরম থাকতে থাকতে এর উপর সিমেন্ট আর পাথর কুচির দ্বিতীয় আবরণ স্থাপন করা হয় এবং মোটামুটি মসৃণ করা হয়। ফলে পাথরের কুচি দৃশ্যমান থাকে, প্লাস্টারটি দেখতে অমসৃণ, কিন্তু সুন্দর হয়।

স্প্যাটার ড্যাশ ফিনিশ (Spatter Dash Finish)

একভাগ বালু আর একভাগ সিমেন্টের মিশ্রণের উপর তিনভাগ পাথরের মিশ্রণ দিয়ে স্প্যাটার ড্যাশ ফিনিশ প্রস্তুত করা হয়। প্রথমে বালু আর সিমেন্টের মিশ্রণ দেয়ালে ৩-১২ মিলিমিটার (প্রয়োজনমতো আরো বেশি হতে পারে) পর্যন্ত পুরু করে একটি আবরণ দেয়া হয়। এই আবরণের উপর পাথরের মিশ্রণ সর্বত্র সমান অনুপাতে দিয়ে কর্ণিক (Trowel) ব্যবহার করে মোটামুটি সমতল করা হয়। মূলত বহিরাবরণের পাথরগুলোর একাংশ বাইরে বেরিয়ে থাকে, সেগুলোকে সমতল করতে পারলেই দারুণ একটি স্প্যাটার ড্যাশ ফিনিশ হয়ে যায়। এই ফিনিশ পানিরোধক, টেকসই এবং সহজে ফাটে না।

আরো কয়েক প্রকার প্লাস্টার

উপরোক্ত প্লাস্টার ফিনিশগুলো সবচেয়ে প্রচলিত ও সহজলভ্য। এসবের বাইরেও ভবনের নকশা ও প্রয়োজনভেদে আরো কিছু প্লাস্টার ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যেমন– অ্যাকাউস্টিক (Acoustic) প্লাস্টারে জিপসামের মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়। প্লাস্টার হয়ে গেলে একে মৌচাকের মতো দেখতে দেখায়; অ্যাসবেস্টস (Asbestos) মার্বেল প্লাস্টারে সিমেন্টের মিশ্রণের সাথে অ্যাসবেস্টস আর পাথরের গুঁড়া মেশানো হয় যা বেশ দর্শনীয়। সাধারণ কর্পোরেট অফিসে এরকম প্লাস্টার ফিনিশ ব্যবহার করা হয়; এক্সরে কক্ষের তেজস্ক্রিয়তা যেন বাইরে ছড়াতে না পারে সেজন্য সেখানে বেরিয়াম (Barium) যুক্ত সিমেন্টের মিশ্রণ ব্যবহার করে বেরিয়াম প্লাস্টার ফিনিশ করা হয়; গ্রানাইট আর বালুর মিশ্রণে গ্রানাইট-সিলিকন (Granite-Silicon) প্লাস্টার সাধারণ অফিস কক্ষে দেখা যায়। এটি দেখতে সুন্দর এবং ফাটলরোধী।

নির্মাণকাজে ব্যবহৃত পাথরের প্রকারভেদ

নির্মাণকাজে পাথরের ব্যবহার কতকাল আগে শুরু হয়েছে তা বলা মুশকিল। কেননা, পশু শিকার করতে পাথরের হাতিয়ার বানানো মানুষেরা যখন বসতবাড়ি নির্মাণ শিখলো, তা পাথর দিয়েই নির্মাণ করতো, এটি অনুমেয়। ধরে নেয়া যায়, নির্মাণকাজের সবচেয়ে আদিম উপাদান পাথর। দৃঢ়তা ও স্থায়িত্বের জন্য পাথর নির্মাণকাজে বহুল প্রচলিত। বিশেষ করে ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণ, ছাদ ঢালাই, হাইওয়ে কিংবা ব্রিজের ভায়াডাক্ট তৈরিতে পাথরের বিকল্প নেই। কেননা, এসব স্থাপনা দীর্ঘ সময়ের জন্যই নির্মাণ করা হয়। তবে স্থায়িত্ব ছাড়াও পাথরের ব্যবহার সৌন্দর্যের সাথেও সম্পৃক্ত। দেয়াল বা মেঝের নান্দনিকতা বৃদ্ধিতেও ব্যবহার করা হয় নানা রকমের পাথর।

চলুন, দেখে নেয়া যাক নির্মাণকাজে ব্যবহৃত সবচেয়ে জনপ্রিয় কিছু পাথর ও সেসবের ব্যবহারবিধি।

ব্যাসল্ট (Basalt)

নির্মাণকাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পাথরগুলোর একটি ব্যাসল্ট। এটি একপ্রকার আগ্নেয় শিলা যা ভূগর্ভস্থ উত্তপ্ত গলিত পাথর চাপে জমে কঠিন পাথরে পরিণত হয়। এরূপ প্রক্রিয়ার কারণে এর গঠন অত্যন্ত ঘন ও মজবুত, এবং নির্মাণকাজে এর ব্যবহার স্থাপনাকে দৃঢ়তা দেয়। সাধারণ রাজমিস্ত্রীর কাজ থেকে শুরু করে ব্রিজের পিলার নির্মাণ, নদীতে বাঁধ নির্মাণ, কিংবা বৃহৎ স্থাপনায় ব্যাসল্টের কংক্রিটের মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়।

ব্যাসল্ট সাধারণত ধূসর এবং কালো বর্ণের হয়। এটি অত্যন্ত দৃঢ় হওয়ায় ইচ্ছেমতো আকৃতি প্রদান করা কঠিন। এর দৃঢ়তা ২০০-৩০০ মেগাপ্যাসকেল (Megapascal) প্রেসার ইউনিট বা এমপিএ। আর্দ্রতা ও প্রতিকূল পরিবেশে ব্যাসল্টের সহনশীলতা বেশ ভালো।

গ্রানাইট (Granite)

বড় নির্মাণকাজে, যেমন- ব্রিজের পিলার, বাঁধরক্ষা দেয়াল থেকে শুরু করে বাসাবাড়ির দেয়ালে আর্দ্রতারোধী আস্তরণ, রেললাইনের স্লিপার, ছাদের বহিরাবরণ ইত্যাদি নির্মাণে গ্রানাইট ব্যবহার করা হয়। এটি ব্যাসল্টের তুলনায় কিছুটা কম হলেও বেশ দৃঢ় এবং টেকসই একটি পাথর। এর ঘনত্ব অনেক বেশি হওয়ায় এর ভেতরে দীর্ঘদিনেও পানি প্রবেশ করতে পারে না।

গ্রানাইটের দৃঢ়তা ২৫০ মেগাপ্যাসকেল। হালকা ধূসর থেকে কিছুটা গোলাপী রঙেরও হয়ে থাকে গ্রানাইট। এর শোষণক্ষমতা অত্যন্ত কম হওয়ায় যেসব স্থানে অধিক আর্দ্রতা থাকে সেখানে এটি ব্যবহার করা হয়, যেমন- রেস্টুরেন্টের খাবার টেবিলের ওপর কিংবা পিলারের আবরণ হিসেবে।

স্যান্ডস্টোন (Sandstone)

ভাবছেন স্যান্ড বা বালুর আবার পাথর হয় কী করে? স্যান্ডস্টোন আসলেই বালুর পাথর, তবে এর গঠন প্রক্রিয়া দীর্ঘ। অন্যান্য পাথরের ক্ষয় হয়ে যাওয়া ধূলিকণা আর স্ফটিক বিভিন্ন প্রাকৃতিক খনিজের সাথে মিশ্রিত হয়ে সময়ের আবর্তে জমাট বেঁধে শক্ত পাথরের রূপ নিলে তাকে আমরা স্যান্ডস্টোন বলি।

স্যান্ডস্টোন মূলত নির্মাণকাজে সাজসজ্জায় ব্যবহৃত হয়। লাল, সাদা, হলুদ, ধূসর, কালচে, পীত বর্ণসহ স্যান্ডস্টোন এর বৈচিত্র্যময় রঙের জন্য দেয়াল, সিঁড়ি বা অন্যান্য নির্মাণে সৌখিন উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অবশ্য বড় বড় নির্মাণকাজেও প্রয়োজনভেদে এই পাথরের ব্যবহার হয়ে থাকে।

চুনাপাথর (Limestone)

চুনাপাথর সকল প্রকার নির্মাণকাজে ব্যবহারের উপযোগী নয়। এর ঘনত্ব সাধারণত কম হয়, ফাটল থাকে এবং কাদামাটিতে তৈরি হওয়ায় নমনীয় ও ভঙ্গুর হয়। অবশ্য ফাটলহীন, ঘন ও মজবুত চুনাপাথর ঘরের মেঝে, ছাদ কিংবা ফুটপাতের আবরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর একটি অসুবিধা হলো- শিল্পকারখানার দূষিত বাতাসে এবং সমুদ্র তীরবর্তী লবণাক্ত বাতাসে এর ক্ষয় হয়।

মার্বেলপাথর (Marbel)

মাত্র ৭০-৭৫ এমপিএ চাপ সহনশক্তির মার্বেলপাথরের ব্যবহার অনুমিতভাবেই নির্মাণকাজে অবকাঠামো তৈরিতে ব্যবহৃত হয় না। এটি মূলত নির্মাণশৈলির নান্দনিকতার অংশ। এর সবচেয়ে বড় গুণ হলো একে চমৎকারভাবে পালিশ (Polish) করে ইচ্ছেমতো আকার দেয়া যায় এবং আরামদায়ক, চকচকে ও মসৃণ করা যায়।

মার্বেলপাথর টাইলস নামেই সর্বাধিক পরিচিত। বাসাবাড়ির মেঝে, রান্নাঘর আর গোসলখানায় মার্বেলপাথরের ব্যবহার এখন অবশ্যম্ভাবী। দেয়াল কিংবা পিলারের সৌন্দর্য বাড়াতে মার্বেলের ব্যবহারের বিকল্প নেই। মার্বেলের ওপর নানারকম ডিজাইন করিয়ে কিংবা নাম লিখিয়েও এটি ব্যবহার করা হচ্ছে নির্মাণকাজে।

স্লেট (Slate)

স্লেট হলো পাললিক শিলাজাত একপ্রকার রূপান্তরিত শিলা যা ভূগর্ভের উচ্চচাপে গঠিত হয়। গঠন ঘন হওয়ায় এই পাথর সমান্তরালে কাটা যায় এবং পালিশ করে মসৃণ করে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যায়। অত্যধিক ভার বহনে অক্ষম হওয়ায় ভবন বা বড় কোনো অবকাঠামো নির্মাণে স্লেট ব্যবহার করা হয় না। সাধারণত বাড়ির ছাদের ক্ষয়রোধী আস্তরণ, স্ল্যাব, ফুটপাতের কার্পেটিং, মেঝেতে স্লেট ব্যবহার করা হয়।

কোয়ার্টজাইট (Quartzite)

কোয়ার্টজাইটের দৃঢ়তা ৫০-২০০ এমপিএ। এতে বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান থাকায় সাধারণ নির্মাণকাজে এর ব্যবহার কম। তবে অধিক মজবুত কোয়ার্টজাইট বিল্ডিং ব্লক, স্ল্যাব, কার্পেটিং, কিংবা কখনো কখনো কংক্রিটের মিশ্রণেও ব্যবহৃত হয়।

কোয়ার্টজাইটের সবচেয়ে উপযোগী ব্যবহার হলো রেলওয়ে ব্যালাস্ট (রেললাইনে বিছিয়ে রাখা পাথর) হিসেবে। তাছাড়া শিল্পজাত সিলিকা বালু প্রস্তুত করার অন্যতম প্রধান উপাদান হলো কোয়ার্টজাইট। মেঝেতে টাইলস হিসেবে, দেয়ালে বা সিঁড়িতে কোয়ার্টজাইটের মসৃণ আকৃতি ব্যবহার করা হয়। হলুদ, ধূসর, সাদাসহ নানা রঙের কারণে ইন্টেরিয়র ডিজাইনে কোয়ার্টজাইটের ব্যবহার জনপ্রিয়। কোয়ার্টজাইটের আরেকটি বড় গুণ হলো- এতে সহজে দাগ পড়ে না, আঁচড় লাগে না, চিটচিটে হয় না। তাই কিচেন কাউন্টারটপ (রান্নাঘরে যে পৃষ্ঠের ওপর খাদ্যদ্রব্য কাটা হয় বা রান্নার উপকরণ প্রস্তুত করা হয়) তৈরিতে কোয়ার্টজাইট একটি আদর্শ উপাদান।

ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিট: জেনে নিন একনজরে

ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিট হলো একপ্রকার তন্তুময় কংক্রিট, যা প্রস্তুত করা হয় সিমেন্ট, কংক্রিট আর বিশেষ প্রকার তন্তুর সংমিশ্রণে। এই তন্তুর উপস্থিতির কারণে ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিট গাঠনিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং টেকসই হয়। সাধারণ কংক্রিটের মিশ্রণে তন্তু ব্যবহারের কারণ মূলত এটিই- অবকাঠামোকে আরো মজবুত ও টেকসই করা।

অবশ্য, কেবল অবকাঠামো মজবুত এবং টেকসই করে বললে কম বলা হবে। ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিটের রয়েছে বহুবিধ গুণাগুণ। একনজরে দেখে নেয়া যাক কংক্রিটের মিশ্রণে ফাইবার যোগ করার সুবিধাগুলো-

  • এটি ব্যবহারে অবকাঠামোতে কংক্রিট শুকিয়ে যাবার পর সম্ভাব্য সর্বনিম্ন ফাটল সৃষ্টি হয়।
  • শিল্পকারখানার অবকাঠামো নির্মাণে, যেখানে অধিক পুরু এবং মজবুত অবকাঠামোর প্রয়োজন হয়, ম্যাক্রো-সিন্থেটিক ফাইবার নামক একপ্রকার ফাইবার ব্যবহার করা হয় যা আকারে সাধারণ ফাইবারের চেয়ে কিছুটা বড় এবং কংক্রিটের স্থায়িত্ব দীর্ঘ করে।
  • কংক্রিটে ফাইবার যুক্ত করলে এর বস্তুগত সংহতি বা সংযুক্তি বৃদ্ধি পায়, ফলে আঘাত সহনশীলতা বাড়ে। প্রতিকূল পরিবেশে এটি অপরিবর্তনীয় থাকতে সক্ষম।
  • ফাইবার কংক্রিটের স্থিতিস্থাপক ক্লান্তি (Elastic Fatigue) বৃদ্ধি করে, ফলে বারংবার আঘাতেও সহজে ভেঙে পড়ে না।
Image Courtesy: Bianca Paola Maffezzoli/Wikimedia Commons

ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিটের অন্তত অর্ধশতাধিক ধরন আছে। প্রয়োজনভেদে কংক্রিটের মিশ্রণে বিভিন্ন প্রকার ফাইবার মেশানো হয়। ধাতব থেকে শুরু করে পশুর লোম পর্যন্ত সবকিছু থাকে এই মিশ্রণের তালিকায়। একটি থেকে আরেকটির মূল পার্থক্যগুলো নির্ভর করে ফাইবারের দৈর্ঘ্য, ব্যাস, শতকরা পরিমাণ, সিমেন্ট-পানির অনুপাত ইত্যাদির উপর।

চলুন জেনে নেয়া যাক সর্বাধিক প্রচলিত কিছু ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিটের রকমফের।

১. স্টিল ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিট

এটি মূলত কংক্রিটের মাঝে ধাতব তন্তুর মিশ্রণ। নির্দিষ্ট পরিমাণ কংক্রিটের সাথে সুনির্দিষ্ট অনুপাতে ধাতব তন্তু যোগ করলে এর গুণগত পরিবর্তন আসে। তখন এটি ফাটল-রোধী হয়, স্থিতিস্থাপক ক্লান্তি (Elastic Fatigue) ও স্থায়িত্ব বাড়ায়। মাইনিং, প্রিকাস্ট অবকাঠামো, টানেল নির্মাণ, ব্রিজ, ফ্লাইওভার নির্মাণের মতো দীর্ঘস্থায়ী কাঠামোতে এই কংক্রিট ব্যবহার করা হয়। বাজারে কয়েক প্রকার স্টিল ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিট পাওয়া যায়- কোল্ড-ড্রন ওয়্যার, কাট শিট, মেল্ট এক্সট্রাক্টেড, মিল কাট ইত্যাদি।

২. পলিপ্রোপাইলিন ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিট

এই কংক্রিটের আরেক নাম পলিপ্রোপেন বা সংক্ষেপে পিপি-ও বলা হয়। এটি একপ্রকার সিন্থেটিক ফাইবার যা প্রোপাইলিং থেকে প্রস্তুত করা হয়। এটি মূলত কংক্রিটের অবকাঠামোর প্লাস্টিক সংকোচন রোধে ব্যবহার করা হয়। পাঠকের সুবিধার্থে উল্লেখ করা যেতে পারে, সদ্য ব্যবহার করা কংক্রিট শুকাতে থাকলে তা থেকে পানি বাষ্পীভূত হতে থাকে এবং এর আকার কিছুটা সংকুচিত হয়ে আসে, যাকে বলা হয় প্লাস্টিক সংকোচন। এছাড়াও এই তন্তু ব্যবহারে কংক্রিটের ভেদনযোগ্যতা হ্রাস পায়, ফলে দেয়াল বা পিপির তৈরি যেকোনো কাঠামো থেকে পানি চুইয়ে পড়ে না।

পলিপ্রোপাইলিন আংশিক স্বচ্ছ স্ফটিকাকার এবং অ-পোলার। এর গুণগত মান অনেকটাই পলিইথিলিনের মতো, তবে এটি পলিইথিলিনের চেয়ে অধিক শক্ত এবং তাপ সহনশীল। এর কেমিক্যাল রেজিস্ট্যান্সও অন্যান্য কংক্রিটের তুলনায় বেশি।

৩. গ্লাস ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিট

নাম থেকেই অনুধাবন করা সম্ভব যে এটি কাচের তন্তুর মিশ্রণে প্রস্তুত করা হয়। পলিমার কিংবা কার্বন ফাইবারের সাথে এর খানিকটা সাদৃশ্যও রয়েছে। অবশ্য কার্বন ফাইবারের মতো এতটা শক্তিশালী নয় এই কংক্রিট। কিন্তু এটি তুলনামূলকভাবে সস্তা এবং মিশ্রণে ব্যবহার করলে কম ভঙ্গুর কংক্রিট প্রস্তুত করে। এর আরেকটি গুণ হচ্ছে- এটি ওজনে বেশ হালকা হয় বাকিগুলোর তুলনায়। এর ঘনত্বও অন্যগুলোর তুলনায় বেশি, তাপ নিরোধক হিসেবে এর সুনাম আছে। অনেকে গ্লাস রিইনফোর্সড ফাইবার কংক্রিটকে ‘ফাইবারগ্লাস’-ও বলে থাকেন।

. পলিস্টার ফাইবার

যেকোনো ধরনের প্রিকাস্ট অবকাঠামো, ফুটপাথ, ওয়ারহাউজ কিংবা শিল্পকারখানায় পলিস্টার ফাইবার ব্যবহার করা হয়। মাইক্রো এবং ম্যাক্রো- দুই ধরনের পলিস্টার ফাইবার ব্যবহার করা হয়ে থাকে এই কংক্রিট মিশ্রণে। এটি অবকাঠামোর প্লাস্টিক সংকোচন রোধ করে, দীর্ঘস্থায়িত্ব নিশ্চিত করে, কাঠামোগত সক্ষমতা বাড়ায়।

৫. কার্বন ফাইবার

নানাপ্রকার ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিটগুলোর মাঝে কার্বন ফাইবারই হলো সবচেয়ে মজবুত। ৫-১০ মাইক্রোমিটার ব্যাসের তন্তুগুলো মূলত কার্বন দিয়েই তৈরি। অধিক কেমিক্যাল রেজিস্ট্যান্স, কম ওজন, অত্যন্ত কম থার্মাল এক্সপানসন (তাপে প্রসারণ), উচ্চ তাপ সহনশীলতা, অধিক কঠোরতা- এগুলো কার্বন ফাইবারের মূল বৈশিষ্ট্য। এর ব্যবহারবিধি মূলতা উচ্চ তাপ সহনশীলতা কেন্দ্র করেই। গ্রাফাইটের মিশ্রণে তৈরি এই কংক্রিট সাধারণ শিল্প কারখানায় বা যেখানে অধিক তাপ সহনশীল কোনো অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজন, সেখানে ব্যবহার করা হয়। অবশ্য কিছু কার্বন ফাইবার আবার ভঙ্গুর হয়।

৬. ম্যাক্রো সিনথেটিক ফাইবার

ম্যাক্রো সিনথেটিক ফাইবার মূলত পলিমারের তৈরি। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে স্টিল ফাইবারকে প্রতিস্থাপন করতেই এর প্রচলন। এর সর্বাধিক ব্যবহার উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন স্ল্যাব তৈরিতে। কেননা ম্যাক্রো সিনথেটিক ফাইবারের মূল বৈশিষ্ট্যই হলো অধিক চাপ সহনশীলতা।

৭. ন্যাচারাল ফাইবার

প্রাকৃতিক ফাইবার মূলত সরাসরি প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত। পশুর চামড়া, শাকসবজি, খনিজ উৎস আর রূপান্তরযোগ্য অ-বুননকৃত ফ্যাব্রিক্স, যেমন- কাপড়, উল বা কাগজ, ইত্যাদি এই ফাইবারের উৎস। এ ধরনের ফাইবার ব্যবহারের কারণ মূলত দুটি। একটি হলো এর সহজলভ্যতা, যে কারণে এটি তুলনামূলকভাবে সস্তা। অন্যটি হলো ভঙ্গুরতা রোধ করা। অন্য যেকোনো ফাইবারের তুলনায় ন্যাচারাল ফাইবারের কংক্রিট কম ভঙ্গুর।

ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিটের নানা গুণাগুণ মাথায় রাখলে বাড়ি নির্মাণের সময় নেয়া যাবে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত।

বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করবেন যেভাবে

পৃথিবীর কোন প্রাকৃতিক সম্পদ সবচেয়ে বেশি দূষিত? কিংবা কোন প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার সবচেয়ে বেশি? অথবা অন্য একটি প্রশ্ন, কোন প্রাকৃতিক সম্পদের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি? অধিকাংশ মানুষই উত্তর জেনে চমকে উঠতে পারে। কেননা সবগুলোর উত্তর একই- পানি।

পানির অপচয়ের কোনো নির্দিষ্ট তথ্য উপাত্ত নেই। গবেষণা বলছে প্রতিবার টয়লেটের ফ্লাশেই খরচ হয় প্রায় ৪ লিটার পানি! অথচ সুপেয় পানির পরিমাণ কমছে প্রতিদিনই। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় উঠে এসেছে এক ভয়াবহ তথ্য- ২০২৫ সালের মাঝেই পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ পাবে না ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানি। পানি দূষণের হারও ততদিনে প্রায় দ্বিগুণ হবে। বর্তমানে বিশ্বে বছরে প্রায় ৩৪ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করে পানিবাহিত রোগ থেকে। বলা বাহুল্য, সুপেয় পানির সংকট প্রকট হলে এই সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে।

বিশুদ্ধ পানি সংক্রান্ত এতসব জটিলতার সমাধান হিসেবে বিজ্ঞানীরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন বৃষ্টির পানির কথা। বৃষ্টির পানি সংগ্রহের প্রক্রিয়াকে ‘রেইনওয়াটার হারভেস্টিং’ বলা হয়। সাধারণ ছাদে জমা হওয়া বৃষ্টির পানি দূষণমুক্তভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবহারের পুরো প্রক্রিয়াই হলো রেইনওয়াটার হারভেস্টিং।

সুবিধাসমূহ

প্রকৃতির দান বিশুদ্ধ ও সকল প্রকার খরচমুক্ত বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের রয়েছে বহুবিধ সুবিধা। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো- সঠিক প্রক্রিয়ায় এই পানি সংরক্ষণ করা গেলে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটিই সবচেয়ে নিরাপদ। তাছাড়া, সংরক্ষিত বৃষ্টির পানি বাগানের জন্য বা বাড়ির উঠানে লাগানো গাছের চারার জন্য অধিক উপকারী। কারণ ভূগর্ভস্থ পানিতে অনেকসময় ক্লোরাইডের উপস্থিতি পাওয়া যায় যা বৃষ্টির পানিতে থাকে না বললেই চলে। অন্যদিকে, প্রাকৃতিক উৎস থেকে পানি সংরক্ষণ করার ফলে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনে যান্ত্রিক শক্তি ব্যয় হয় না। এতে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়। সব মিলিয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের সুবিধা বহুবিধ। এছাড়াও টয়লেটের ফ্লাশ, গাড়ি ধোয়া, সুইমিং পুলের পানি, ইত্যাদি অদরকারি কিংবা কম দরকারি কাজে বৃষ্টির পানি ব্যবহার ভূগর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমায়, অপচয় রোধ করে।

প্রক্রিয়া

রেইনওয়াটার হারভেস্টিং অত্যন্ত সহজলভ্য এবং সুলভ একটি প্রযুক্তি। আধুনিককালে প্রযুক্তির উন্নয়নে পানির গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ আরো সহজ এবং নির্ভরযোগ্য হয়েছে। এককালীন খরচের মাধ্যমে একটি রেইনওয়াটার হারভেস্টিং প্ল্যান্ট নিজ বাসায় তৈরি করে নিতে পারলে বছরের পর বছর এর সুফল ভোগ করা সম্ভব।

রেইন ব্যারেল

বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের আদিমতম এবং সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি ‘রেইন ব্যারেল’। মূলত এ প্রক্রিয়ায় কোনোরূপ জটিলতা নেই; নামের মতো এখানে কেবল প্রয়োজন একটি ব্যারেল বা পিপা। ছাদ থেকে পানি নামার নালার নীচে একে স্থাপন করলেই হচ্ছে। এক্ষেত্রে একটি বড় সুবিধা হলো এর জন্য অতিরিক্ত জায়গা, খরচ বা দক্ষতা কোনোটিরই প্রয়োজন নেই। কেবল বাজার থেকে একটি ব্যারেল কিনে আনলেই কাজ শেষ। কিন্তু সমস্যা হলো এর সক্ষমতা অত্যন্ত কম, মাত্র ২০০-২৫০ লিটার। অধিক বৃষ্টির সময় পানি উপচে পড়ে সংরক্ষণের সুযোগও অপচয় হয়।

ড্রাই সিস্টেম

এটি মূলত রেইন ব্যারেলেরই বৃহত্তর সংস্করণ। এই পদ্ধতিতে ছাদ থেকে পাইপ এনে একটি বড় আকৃতির ব্যারেলের সাথে সংযুক্ত করা হয়। বৃষ্টি শেষে পানি পাইপের নীচে থাকায় পাইপটি দ্রুত শুকিয়ে যায়; তাই একে বলা হয় ড্রাই সিস্টেম। এটি সহজে ব্যবহারযোগ্য এবং অধিক পানি সংরক্ষণের সুবিধা দিলেও ঠিক বাড়ির পাশেই ট্যাংক স্থাপন করাটা খুব বেশি আকর্ষণীয় নয়।

ওয়েট সিস্টেম

ড্রাই সিস্টেমের তুলনায় এ প্রক্রিয়াটি অধিক সুবিধাজনক কেননা এখানে সংরক্ষণ ট্যাংকটি বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে রাখারও সুযোগ রয়েছে। অসুবিধা কেবল একটিই- খরচ। এ প্রক্রিয়ায় মূলত ছাদের বা অন্য কোনো প্ল্যান্টের উপর পতিত বৃষ্টির পানি পাইপের মাধ্যমে মাটির নীচে দিয়ে স্থাপন করা পাইপে দূরবর্তী ট্যাংকে পৌঁছানো হয়। ফলে বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলেও পাইপের মাঝে সবসময় কিছু পানি রয়ে যায়।

যেভাবে করতে হবে

বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য নিম্নলিখিত কাজগুলো ধাপে ধাপে করতে হবে।

  • ওয়াটার-হারভেস্টিং শুরু হয় বাড়ির ছাদ থেকে। তাই বাড়ির ছাদ পরিষ্কার রাখাই প্রথম কাজ।
  • পানি প্রবাহের পাইপ বা নালার মুখে অবশ্যই ছাঁকনি বা অনুরূপ কোনো সুরক্ষা সরঞ্জাম লাগাতে হবে যেন ঝড়ের সময় উড়ে আসা বড় কোনো আবর্জনা নালায় প্রবেশ করতে না পারে।
  • অতিরিক্ত ব্যবস্থা হিসেবে পানি প্রবাহের নালার মুখে ছাঁকনির পাশাপাশি নালায় একটি ফিল্টারও স্থাপন করা যেতে পারে।
  • মশা-মাছি আর অন্যান্য কীটপতঙ্গ দূরে রাখতে ট্যাংক স্ক্রিন বা অন্য কোনো প্রাসঙ্গিক ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • ট্যাংকের ওভারফ্লো পাইপ (যে পাইপ দিয়ে ট্যাংক পানিতে ভরে গেলে পানি উপচে পড়ে) এর মুখেও লাগাতে হবে কীটপতঙ্গনাশক ছাঁকনি বা অনুরূপ কিছু।
  • পানি বিতরণের জন্য ট্যাংকের সাথে সংযুক্ত করতে হবে একটি পাম্প।

ওয়াটার লেভেল মনিটরিং নামক একপ্রকার মিটার পাওয়া যায় যা ট্যাংকে উপস্থিত পানির পরিমাণ বলে দিতে পারে। এরকম মিটার তারবিহীন কিংবা তারসহ, উভয়ই বাজারে বিদ্যমান।

মোদ্দাকথা এই যে, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ অত্যন্ত সহজ এবং সুলভ একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া স্থাপনে যেমন অধিক খরচ নেই, তেমনি এর রক্ষণাবেক্ষণেও বিশেষ কোনো মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। তাছাড়া ভূগর্ভস্থ পানি অপচয় রোধের ব্যাপার তো রয়েছেই। তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে হলেও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণকে প্রাধান্য দিতে হবে, প্রতিটি উন্মুক্ত বাড়ির ছাদেই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।

যেভাবে স্থাপত্যে মিশে গেল গ্লাস

আধুনিককালের অবকাঠামো নির্মাণশৈলীর অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে থাই গ্লাস বা আর্কিটেকচারাল গ্লাস। বসত-বাড়ি থেকে শুরু করে অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল কিংবা শিল্প-কারখানা— সর্বত্রই এই গ্লাস ব্যবহারের ছড়াছড়ি। সৌন্দর্যের দিকটা তো রয়েছেই, আছে আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নেবার ব্যাপারও। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে নতুন যেসব বাড়িঘর বা অফিস ভবন গড়ে উঠেছে, সেসবের কোনোটিই গ্লাসের ব্যবহার ব্যতিরেকে নয়। শহরের ধুলো-ময়লা আর অত্যধিক শব্দদূষণ থেকে বাঁচিয়ে রাখে থাই গ্লাস। পাশাপাশি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভবন নির্মাণে গ্লাসের বিকল্প নেই। গ্লাস বা কাঁচ হলো এমন একটি বস্তু যা আবিষ্কারের পর থেকে অদ্যাবধি খুব বেশি পরিবর্তন ছাড়াই নিত্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যদিও গ্লাস আবিষ্কারের সঠিক ইতিহাস জানা দুষ্কর, তবে গ্লাসের ইতিহাস খুঁজতে গেলে খ্রিস্টের জন্মেরও ৭০০০ বছর পূর্বে, নিওলিথিক যুগে, এর হদিস পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের দিকে মিশরীয়দের মাঝে গ্লাসের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। অবশ্য বসতবাড়ি নির্মাণে গ্লাসের নান্দনিকতার ছোঁয়া এসেছে এর ঢের পরে।

আর্কিটেকচারাল গ্লাসের সবচেয়ে পুরাতন রূপটি হলো কাস্ট গ্লাস। পাটা লোহার মতো এই পাটা গ্লাস রেনেসাঁপূর্ব ইংল্যান্ডে ব্যবহার করা হতো। মধ্যযুগে ক্রাউন গ্লাসের আবির্ভাব এর ব্যবহার আরো বাড়িয়ে দেয়। ক্রাউন গ্লাস মূলত বিলাসবহুল জাহাজের অঙ্গসজ্জায় ব্যবহার করা হলেও দ্রুতই এটি ধনাঢ্যদের বাড়ির জানালায় স্থান করে নেয়। সিলিন্ডার গ্লাস, ড্রন শিট, কাস্ট প্লেট গ্লাস- সবই একে একে অবকাঠামো নির্মাণের সাথে নিজেদের সম্পর্ক তৈরি করতে থাকে। প্রাথমিকভাবে এসব গ্লাস মূলত গবেষণাগার, প্রাসাদ আর ধনী ব্যক্তিদের বাড়িঘরে শোভা পেত।

এরপর রোলড প্লেট গ্লাস নামে আরেক প্রকার অমসৃণ গ্লাসের উদ্ভব হয় যা মূলত বড় আকারের জানালায় ব্যবহার করা হতো। প্রিজম গ্লাসের আগমন গ্লাসের ব্যবহারে বিলাসিতার মাত্রা আরেকটু চড়িয়ে দিলেও গ্লাস ব্লকের আগমন তা মধ্যবিত্তের নাগালের মাঝে নিয়ে আসে।

এরপর ১৭ শতকে ইউরোপে লেড গ্লাস উৎপাদনের প্রযুক্তি তৈরি হলে স্থাপত্যের সাথে গ্লাসের সম্পর্ক অটুট হয়ে যায়। শুরুর দিকে যদিও কৃষি ও গবেষণার জন্য গ্রিন হাউজ এবং কনজারভেটরি নির্মাণে গ্লাস ব্যবহৃত হতো। ১৮ শতকেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাড়িঘরের জানালায় গ্লাসের ব্যবহার শুরু হয় এর সৌন্দর্যের জন্য। শুরুতে যদিও একে বিলাসিতা মনে করা হতো, শিল্পবিপ্লবের সাথে সাথে দ্রুতই ধারণা বদলে যেতে থাকে এবং বড় এক্সিবিশন হল, টাউন হলের পাশাপাশি রেলওয়ে স্টেশন আর সরকারি দালানকোঠায়ও গ্লাস উঁকি দিতে শুরু করে। দ্রুতই গ্লাসের দরজা-জানালাকে আরও টেকসই করতে স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম ও অন্যান্য ধাতব বস্তুর ফ্রেমিংয়ে আবদ্ধ করা শুরু হয়।

অবশ্য অবকাঠামো নির্মাণে গ্লাসের ব্যবহারে বিপ্লব ঘটায় কিছু যুগান্তকারী ভবনের নির্মাণ। ১৮৫১ সালে স্থপতি জোসেফ প্যাক্সটন লন্ডনে ক্রিস্টাল প্যালেস নির্মাণ করে স্থাপত্যশিল্পে গ্লাস ব্যবহারের ধারণা চিরতরে বদলে দেন। তিনি সেসময় প্রচলিত অস্বচ্ছ লেড গ্লাসের পরিবর্তে স্বচ্ছ এবং ঝকঝকে (গ্লেজি) গ্লাস দিয়ে চোখ ধাঁধানো এক দালান নির্মাণ করেন। তার এই ভবন নির্মাণই আর্কিটেকচারাল গ্লাসের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। যদিও তিনি এরূপ গ্লাস সৌন্দর্য নয় বরং ইন্টেরিয়রে সূর্যালোক ব্যবহার করে বিদ্যুৎ খরচ কমানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছিলেন। তথাপি নির্মাণ পরবর্তী সময়ে ক্রিস্টাল প্যালেস সার্বজনীন প্রশংসা পায় এর সৌন্দর্যের জন্য।

ক্রিস্টাল প্যালেসের হাত ধরে স্বচ্ছ গ্লাসের ব্যবহার শুরু হয়ে গেলেও প্রখর সূর্যালোক কিছুটা ঝামেলারও হয়ে দাঁড়ায়। এর কয়েকবছর পর লিভারপুলে ওরিয়েল চেম্বার নামে একটি ভবন নির্মাণে রঙিন গ্লাসের পরীক্ষা চালান স্থপতি পিটার এলিস। তিনি প্রথমবারের মতো গ্লাস কার্টেইন ওয়ালের ব্যবহার করেন যা ছিল স্থাপত্যে গ্লাস ব্যবহারের আরেকটি যুগান্তকারী অধ্যায়। তার এই পরীক্ষামূলক ব্যবহারের পর থেকেই বাণিজ্যিকভাবে গ্লাস নির্মিত কার্টেইন ওয়ালের ব্যবহার বেড়ে যায়।

এরপর ১৯ শতকের শেষভাগে এবং ২০ শতকের শুরুর সময়ে আমেরিকায় ‘অল-গ্লাস বিল্ডিং’ ব্যাপক প্রচলন হয়। এরূপ ভবনগুলোয় মূলত ভবনের পুরো বহিরাবরণটাই গ্লাস দ্বারা নির্মাণ করা হতো। স্বচ্ছতা আর উজ্জ্বলতাই ছিল তখন মুখ্য। ভবনের বহিরাবরণে ধীরে ধীরে কনক্রিটের জায়গা নিয়ে নিল গ্লাস, এবং সময়ের সাথে ঝকঝকে-চকচকে স্বচ্ছ গ্লাসকে প্রতিস্থাপন করলো অনুজ্জ্বল, মসৃণ ও আধা-স্বচ্ছ গ্লাস।

প্রযুক্তির উন্নয়নে বর্তমানে তৈরি হচ্ছে হাজারো রঙের, ডিজাইনের আর ভিন্ন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় তৈরি গ্লাস। এনিলিড গ্লাস, হিট স্ট্রেংদেন্ড গ্লাস, কেমিক্যালি স্ট্রেংদেন্ড গ্লাস, হিটেবল গ্লাস, ইনসুলেটিং গ্লাস, টাফেন্ড গ্লাস, ইত্যাদি। এমনকি ভূমিকম্পের কম্পন এবং উচ্চমাত্রা কম্পন বিশিষ্ট শব্দতরঙ্গ সহনশীল সাইজমিক গ্লাসও তৈরি হচ্ছে আজকাল।

বর্তমান সময়ে আর্কিটেকচারাল গ্লাস তথা রঙ-বেরঙের থাই গ্লাস ভবন নির্মাণের একটি অপরিহার্য উপাদান। বিশ্বজুড়ে এই গ্লাস শিল্পের বাজার এখন কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের। এই বাজারে ফ্রেঞ্চ বহুজাতিক কোম্পানি সেইন্ট গোবেন সর্বোচ্চ মুনাফা নিয়ে রাজত্ব করছে। এই প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক আয় ৪০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি (২০২০ সালের হিসেব)। এছাড়াও পিপিজি ইন্ডাস্ট্রি, নিপ্পন শিট গ্লাস কোম্পানি, কর্নিং ইন্টারন্যাশনালের মতো বড় বড় বৈশ্বিক গ্লাস রপ্তানিকারক রয়েছে বাজারে।