যেভাবে স্থাপত্যে মিশে গেল গ্লাস

আধুনিককালের অবকাঠামো নির্মাণশৈলীর অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে থাই গ্লাস বা আর্কিটেকচারাল গ্লাস। বসত-বাড়ি থেকে শুরু করে অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল কিংবা শিল্প-কারখানা— সর্বত্রই এই গ্লাস ব্যবহারের ছড়াছড়ি। সৌন্দর্যের দিকটা তো রয়েছেই, আছে আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নেবার ব্যাপারও। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে নতুন যেসব বাড়িঘর বা অফিস ভবন গড়ে উঠেছে, সেসবের কোনোটিই গ্লাসের ব্যবহার ব্যতিরেকে নয়। শহরের ধুলো-ময়লা আর অত্যধিক শব্দদূষণ থেকে বাঁচিয়ে রাখে থাই গ্লাস। পাশাপাশি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভবন নির্মাণে গ্লাসের বিকল্প নেই। গ্লাস বা কাঁচ হলো এমন একটি বস্তু যা আবিষ্কারের পর থেকে অদ্যাবধি খুব বেশি পরিবর্তন ছাড়াই নিত্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যদিও গ্লাস আবিষ্কারের সঠিক ইতিহাস জানা দুষ্কর, তবে গ্লাসের ইতিহাস খুঁজতে গেলে খ্রিস্টের জন্মেরও ৭০০০ বছর পূর্বে, নিওলিথিক যুগে, এর হদিস পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের দিকে মিশরীয়দের মাঝে গ্লাসের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। অবশ্য বসতবাড়ি নির্মাণে গ্লাসের নান্দনিকতার ছোঁয়া এসেছে এর ঢের পরে।

আর্কিটেকচারাল গ্লাসের সবচেয়ে পুরাতন রূপটি হলো কাস্ট গ্লাস। পাটা লোহার মতো এই পাটা গ্লাস রেনেসাঁপূর্ব ইংল্যান্ডে ব্যবহার করা হতো। মধ্যযুগে ক্রাউন গ্লাসের আবির্ভাব এর ব্যবহার আরো বাড়িয়ে দেয়। ক্রাউন গ্লাস মূলত বিলাসবহুল জাহাজের অঙ্গসজ্জায় ব্যবহার করা হলেও দ্রুতই এটি ধনাঢ্যদের বাড়ির জানালায় স্থান করে নেয়। সিলিন্ডার গ্লাস, ড্রন শিট, কাস্ট প্লেট গ্লাস- সবই একে একে অবকাঠামো নির্মাণের সাথে নিজেদের সম্পর্ক তৈরি করতে থাকে। প্রাথমিকভাবে এসব গ্লাস মূলত গবেষণাগার, প্রাসাদ আর ধনী ব্যক্তিদের বাড়িঘরে শোভা পেত।

এরপর রোলড প্লেট গ্লাস নামে আরেক প্রকার অমসৃণ গ্লাসের উদ্ভব হয় যা মূলত বড় আকারের জানালায় ব্যবহার করা হতো। প্রিজম গ্লাসের আগমন গ্লাসের ব্যবহারে বিলাসিতার মাত্রা আরেকটু চড়িয়ে দিলেও গ্লাস ব্লকের আগমন তা মধ্যবিত্তের নাগালের মাঝে নিয়ে আসে।

এরপর ১৭ শতকে ইউরোপে লেড গ্লাস উৎপাদনের প্রযুক্তি তৈরি হলে স্থাপত্যের সাথে গ্লাসের সম্পর্ক অটুট হয়ে যায়। শুরুর দিকে যদিও কৃষি ও গবেষণার জন্য গ্রিন হাউজ এবং কনজারভেটরি নির্মাণে গ্লাস ব্যবহৃত হতো। ১৮ শতকেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাড়িঘরের জানালায় গ্লাসের ব্যবহার শুরু হয় এর সৌন্দর্যের জন্য। শুরুতে যদিও একে বিলাসিতা মনে করা হতো, শিল্পবিপ্লবের সাথে সাথে দ্রুতই ধারণা বদলে যেতে থাকে এবং বড় এক্সিবিশন হল, টাউন হলের পাশাপাশি রেলওয়ে স্টেশন আর সরকারি দালানকোঠায়ও গ্লাস উঁকি দিতে শুরু করে। দ্রুতই গ্লাসের দরজা-জানালাকে আরও টেকসই করতে স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম ও অন্যান্য ধাতব বস্তুর ফ্রেমিংয়ে আবদ্ধ করা শুরু হয়।

অবশ্য অবকাঠামো নির্মাণে গ্লাসের ব্যবহারে বিপ্লব ঘটায় কিছু যুগান্তকারী ভবনের নির্মাণ। ১৮৫১ সালে স্থপতি জোসেফ প্যাক্সটন লন্ডনে ক্রিস্টাল প্যালেস নির্মাণ করে স্থাপত্যশিল্পে গ্লাস ব্যবহারের ধারণা চিরতরে বদলে দেন। তিনি সেসময় প্রচলিত অস্বচ্ছ লেড গ্লাসের পরিবর্তে স্বচ্ছ এবং ঝকঝকে (গ্লেজি) গ্লাস দিয়ে চোখ ধাঁধানো এক দালান নির্মাণ করেন। তার এই ভবন নির্মাণই আর্কিটেকচারাল গ্লাসের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। যদিও তিনি এরূপ গ্লাস সৌন্দর্য নয় বরং ইন্টেরিয়রে সূর্যালোক ব্যবহার করে বিদ্যুৎ খরচ কমানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছিলেন। তথাপি নির্মাণ পরবর্তী সময়ে ক্রিস্টাল প্যালেস সার্বজনীন প্রশংসা পায় এর সৌন্দর্যের জন্য।

ক্রিস্টাল প্যালেসের হাত ধরে স্বচ্ছ গ্লাসের ব্যবহার শুরু হয়ে গেলেও প্রখর সূর্যালোক কিছুটা ঝামেলারও হয়ে দাঁড়ায়। এর কয়েকবছর পর লিভারপুলে ওরিয়েল চেম্বার নামে একটি ভবন নির্মাণে রঙিন গ্লাসের পরীক্ষা চালান স্থপতি পিটার এলিস। তিনি প্রথমবারের মতো গ্লাস কার্টেইন ওয়ালের ব্যবহার করেন যা ছিল স্থাপত্যে গ্লাস ব্যবহারের আরেকটি যুগান্তকারী অধ্যায়। তার এই পরীক্ষামূলক ব্যবহারের পর থেকেই বাণিজ্যিকভাবে গ্লাস নির্মিত কার্টেইন ওয়ালের ব্যবহার বেড়ে যায়।

এরপর ১৯ শতকের শেষভাগে এবং ২০ শতকের শুরুর সময়ে আমেরিকায় ‘অল-গ্লাস বিল্ডিং’ ব্যাপক প্রচলন হয়। এরূপ ভবনগুলোয় মূলত ভবনের পুরো বহিরাবরণটাই গ্লাস দ্বারা নির্মাণ করা হতো। স্বচ্ছতা আর উজ্জ্বলতাই ছিল তখন মুখ্য। ভবনের বহিরাবরণে ধীরে ধীরে কনক্রিটের জায়গা নিয়ে নিল গ্লাস, এবং সময়ের সাথে ঝকঝকে-চকচকে স্বচ্ছ গ্লাসকে প্রতিস্থাপন করলো অনুজ্জ্বল, মসৃণ ও আধা-স্বচ্ছ গ্লাস।

প্রযুক্তির উন্নয়নে বর্তমানে তৈরি হচ্ছে হাজারো রঙের, ডিজাইনের আর ভিন্ন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় তৈরি গ্লাস। এনিলিড গ্লাস, হিট স্ট্রেংদেন্ড গ্লাস, কেমিক্যালি স্ট্রেংদেন্ড গ্লাস, হিটেবল গ্লাস, ইনসুলেটিং গ্লাস, টাফেন্ড গ্লাস, ইত্যাদি। এমনকি ভূমিকম্পের কম্পন এবং উচ্চমাত্রা কম্পন বিশিষ্ট শব্দতরঙ্গ সহনশীল সাইজমিক গ্লাসও তৈরি হচ্ছে আজকাল।

বর্তমান সময়ে আর্কিটেকচারাল গ্লাস তথা রঙ-বেরঙের থাই গ্লাস ভবন নির্মাণের একটি অপরিহার্য উপাদান। বিশ্বজুড়ে এই গ্লাস শিল্পের বাজার এখন কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের। এই বাজারে ফ্রেঞ্চ বহুজাতিক কোম্পানি সেইন্ট গোবেন সর্বোচ্চ মুনাফা নিয়ে রাজত্ব করছে। এই প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক আয় ৪০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি (২০২০ সালের হিসেব)। এছাড়াও পিপিজি ইন্ডাস্ট্রি, নিপ্পন শিট গ্লাস কোম্পানি, কর্নিং ইন্টারন্যাশনালের মতো বড় বড় বৈশ্বিক গ্লাস রপ্তানিকারক রয়েছে বাজারে।

নির্মাণের নান্দনিকতায় কাচের ব্যবহার: সুবিধা ও অসুবিধা

গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের গল্প। ইউরোপ জুড়ে শুরু হয়েছে শিল্প বিপ্লব। সকল শিল্পে আসছে নতুন ফর্মুলা। একই ফর্মুলাতে দ্রুত গতিতে যেকোনো কাজ সেরে ফেলার নেশায় বিভোর সারা বিশ্ব। প্রযুক্তির আশীর্বাদে তখন প্রতিটি ক্ষেত্রেই চলছে বদলের গান। 

নির্মাণ শিল্পে এই ফর্মুলাকে বাস্তবায়ন করতে একের পর এক যোগ হতে শুরু করল নতুন উপকরণ। প্রথমে শুরু হল রি-ইনফোর্সড কংক্রিটের ব্যবহার যেটি তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। তারপর সামনে এলো ধাতুর ব্যবহার। সেটি একসময় রূপ নিল সংকর ধাতু স্টিলের জয়জয়কারে। আর স্টিলের হাত ধরে নির্মাণে নতুন করে ফিরে এল কাচ। স্টিলের কাঠামো ও কংক্রিটের মেঝের তৈরি ভবন দ্রুত মুড়ে দিতে কাচ হয়ে উঠল কমার্শিয়াল ভবনের পরিচায়ক। এই ঘরানার নির্মাণ এত দ্রুত ও এত সহজ যে, এখনও চলছে এর জয়জয়কার। 

কাচ একটি শিল্পজাত পণ্য। প্রকৃতিতে সরাসরি কাচ পাওয়া যায় না। তবে অনেক আগে থেকেই বালি গলিয়ে কাচ তৈরি শুরু হয়েছিল। একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বালি গলালে সরাসরি কাচ তৈরি করা যায়। তবে সময় যত গড়িয়েছে এই শিল্পকে সহজতর করেছে বিজ্ঞান। রোমান প্রক্রিয়া থেকে কাচ তৈরি সহজতর করতে ইসলামি কাচশিল্পীদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। 

বর্তমানে কাচ তৈরি করা হয় সিলিকা বা কাচবালির সাথে সোডা, ডলোমাইট, চুনাপাথর, ফেলস্ফার, সোডিয়াম নাইট্রেট ও কয়লার পাউডার মিশিয়ে। বাংলাদেশের বাজারে সাধারণত দুই ধরনের কাচ দেখা যায়। সাধারণ কাচ ও ক্রিস্টাল গ্লাস। সাধারণ গ্লাস কাটলে সবুজাভ রং দেখা যায়। ক্রিস্টাল গ্লাস সেই তুলনায় একদমই পরিষ্কার। গ্লাস উৎপাদনের সময় এর পুরুত্ব (Thickness) নির্ধারণ করা হয়। সাধারণত ৩ থেকে ১২ মিলিমিটার পুরুত্বের কাচ খোলা বাজারে দেখা যায়। ৫ ও ১০ মিলিমিটার কাচ ভবনের ভেতরে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। ভবনের বাইরে ২০ মিলিমিটার পর্যন্ত পুরুত্বের গ্লাস প্যানেল ব্যবহার করা হয়। 

Urban Scene Skyline Morning View Metropolis Concept

ভবনে কাচের ব্যবহার জনপ্রিয় হবার অন্যতম প্রধান কারণ এর স্বচ্ছতা। ভবনের ভেতরে ধুলা প্রবেশ বন্ধ করে একই সাথে আলোর প্রবেশ নিশ্চিত করতে প্রথমে জানালায় কাচ ব্যবহার শুরু হয়। কাচের জানালাতে খরচও কমে যায় শিল্পপণ্য হিসাবে কাচ সহজলভ্য হওয়াতেই। কাচের সহজলভ্যতা ও তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যই কাচকে এতটা জনপ্রিয় করেছে। এই সূলভ মূল্যের কারণেই কাচের জানালা ভবনের বাইরের অংশের মূল উপাদান হয়ে ওঠার শুরু। 

ইট বা কংক্রিটের নির্মাণ একইসাথে যেমন একের বেশি উপাদান দাবি করে তেমনি এর পেছনে বিনিয়োগ করতে হয় প্রচুর সময়, অর্থ ও শ্রম। এছাড়া নির্মাণ শেষ হলে উপরে দিতে হয় ফিনিশিং ম্যাটেরিয়াল, যেমন- টাইলস বা মোজাইক। কাচ ব্যবহার এই তুলনায় রীতিমত ঝামেলামুক্ত। শুধুমাত্র স্থাপন ও পরিষ্কার করলেই নির্মাণ শেষ করে ফেলা সম্ভব বলে ব্যবসায়িক ভবনের ক্ষেত্রে এটি বেশি জনপ্রিয়। 

তবে কাচের ব্যবহারকে তুমুল জনপ্রিয় করেছে মূলত দুটি ঘটনা।

১. কাঠামো নির্মাণ শিল্পে ধাতুর জয়যাত্রা 

২. শিল্প বিপ্লবের পর নতুন নান্দনিকতার বিকাশ

প্রথমে বিশুদ্ধ ধাতু ও পরে সংকর অর্থাৎ স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের নির্মাণে বড় জায়গা করে নেওয়াতে তাদের সাথে মানানসই নির্মাণ উপকরণের চাহিদা বাড়ে। প্রথমে কংক্রিট ও ইট দিয়ে চেষ্টা করা হলেও কম ভর, নির্মাণের সহজ প্রক্রিয়া এবং বদলে ফেলার সুবিধার কথা বিবেচনায় রেখেই কাচ হয়ে ওঠে ভবনের এক্সটেরিয়রের জন্য সবচেয়ে উপযোগী উপাদান। 

বর্তমানে প্যানেল আকারে আলাদা কাচ নির্মাণের জন্যই তৈরি করা হয় এবং এগুলো জুড়ে দিয়ে তৈরি হয় বিশ্বের প্রায় ৮০% বাণিজ্যিক ভবন। এছাড়া অন্দরসজ্জাতেও বিশেষ করে অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সজ্জায় কাচ হয়ে উঠেছে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

আলোর সহজাত প্রবেশ যেমন কাচের আশীর্বাদ, তেমনি এক্ষেত্রে অভিশাপ হলো বাতাসের প্রবাহ রোধ। কাচ দিয়ে তৈরি ভবনের বহির্ভাগ সাধারণত নড়াচড়া করানো যায় না। তাই সরাসরি বাতাস এতে প্রবেশ করতে পারে না। আর সূর্যরশ্মি যে তরঙ্গদৈর্ঘ্য নিয়ে প্রতিসরিত হয়ে কাচের ভেতর প্রবেশ করে ভেতরে ঢুকে সেটি অনেক বেড়ে যায়। ফলে ভেতর থেকে খুব বেশি তাপ বাইরে আসতে পারে না। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় গ্রিনহাউজ প্রক্রিয়া। 

এই সমস্যার সমাধান করতে ভবনে প্রচুর পরিমাণে যান্ত্রিক তাপনিয়ন্ত্রক যন্ত্র বা এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহার করতে হয়। যেটি বাইরের বাতাসকে ঠাণ্ডা করে ভেতরে প্রেরণের পাশাপাশি ভেতরের গরম বাতাসকে সরাসরি বাইরে বের করে দেয়। এর ফলে ভবন ভেতরে ঠাণ্ডা হলেও বাইরে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। 

কাচের আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে এর প্রতিফলন। আলো এবং তাপ প্রতিসরণের পাশাপাশি প্রতিফলিতও হয় কাচে। ফলে সূর্যরশ্মির তাপ ভবনের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া কাচের আলোকচ্ছটা বা গ্লেয়ারেও (Glare) অনেক ক্ষেত্রে আশেপাশের মানুষের বেশ সমস্যা হতে পারে। আলোর প্রতিসরণ কমাতে অনেক ক্ষেত্রে টিন্টেড আউট বা অস্বচ্ছ বা আধা-স্বচ্ছ কাচ ব্যবহার করা হয়। এতে ভেতরের তাপমাত্রা কমলেও প্রতিফলনের হার বাড়ে। এই ধরনের কাচগুলো সাধারণত নীল বা সবুজ হয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভবনের চেহারাতেও বেশ খারাপ প্রভাব ফেলে এরকম অতিগ্রাসী রং। 

তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করে রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি। কাচ সুলভ ও সাশ্রয়ী হলেও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ দাবি করে। বাংলাদেশে সূর্যের কৌণিক অবস্থান, বৃষ্টির আধিক্য, ঢাকা শহরের বাতাসে বিদ্যমান সাধারণের চেয়ে বেশি ধুলোবালি এবং বহুতল ভবনের রক্ষণাবেক্ষণে প্রযুক্তির অভাব বাংলাদেশে ভবনে ব্যবহৃত কাচের সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয় খুব দ্রুত। ৫-১০ বছরের মধ্যেই কাচের রং নষ্ট হওয়া এবং ফাটলের অভিযোগও শোনা যায় বেশ। তবে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে মনোযোগী হলে এ সমস্যা কাটানো সম্ভব।

ভবনের ভেতরে বর্তমানে ফুল হাইট কাচের পার্টিশনের ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এছাড়া অ্যালুমিনিয়াম প্যানেল দিয়ে স্লাইডিং দরজা ব্যবহার হচ্ছে বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে। এগুলো দামে সাশ্রয়ী ও সহজ ব্যবহার্য হলেও ঘরের বাতাস প্রবাহ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বেশ চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। তবুও পরিবর্তনের সুবিধা এবং নিয়ন্ত্রণের সারল্য একে ইন্টেরিয়র শিল্পে একই অবস্থানে রাখবে অনেকদিন। 

ভবনের বাইরের ও ভেতরের পরিবেশের কথা বিবেচনা করলে কাচ দীর্ঘ সময়ের জন্য খুব উপকারী উপাদান নয়। কিন্তু নির্মাণ নান্দনিকতা, খরচের সাশ্রয় ও একই রকম স্বচ্ছ উপকরণ হিসেবে বিকল্প না থাকায় কাচের ব্যবহার অব্যাহত থাকবে আরও অনেকদিন। নির্মাণে কাচের ব্যবহারে তাই হতে হবে হিসেবি, হতে হবে পরিবেশ সচেতন এবং রক্ষণাবেক্ষণে মনোযোগী। 

কাচের সাথে সোলার প্যানেল যুক্ত করে দেয়া কিংবা অপারেবল ডিজাইনের মতো কৌশল ব্যবহার করে কাচের প্রভাবকে যেমন পরিবেশবান্ধব করা যায়, তেমনি ভবনের সৌন্দর্যকে বাড়ানো যায় বহুগুণে। এছাড়া রক্ষণাবেক্ষণে মনোযোগী হলে ভবনের চেহারার পাশাপাশি দীর্ঘস্থায়ী হয় ব্যবহার উপযোগিতাও। তাই উপকরণ হিসেবে কাচের কিছু সমস্যা থাকলেও প্রশিক্ষিত স্থপতির চিন্তাশীল নকশা, দক্ষ প্রকৌশলীর নির্মাণ এবং নির্মাতার সদিচ্ছা কাচকে করে তুলতে পারে ভবনের জন্য আশীর্বাদ। 

বাড়ি নির্মাণ: দরজা-জানালায় বিশেষ পরিকল্পনা

নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর এই দেশের বাড়িগুলোতে জানালা একটি অপরিহার্য উপাদান। উচ্চ আর্দ্রতা আর তাপের কারণে বাতাসের প্রবাহের মাধ্যমে তাপ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা সেই আদিকাল থেকেই হয়ে আসছে। এক সময়ে আমাদের বাড়িগুলোর ঐতিহ্য ছিল কাঠের খড়খড়ি দেয়া ভারী পাল্লার দরজা আর জানালা, যাতে পাল্লা আটকে দিলেও খড়খড়ির বদৌলতে ঘরের ভেতর বায়ুপ্রবাহ থাকত নিরবচ্ছিন্ন।

বাড়ির প্রতিটি ঘরে প্রাকৃতিক আলো-বাতাস নিশ্চিত করতে জানালা যেমন আবশ্যক, তেমনি নিরাপত্তার অনুষঙ্গ হিসেবে জানালার সাথে চলে আসবে গ্রিলের নাম। চলুন জেনে নেয়া যাক বাড়ির দরজা, জানালা আর গ্রিল নির্বাচনের সময় যা যা মাথায় রাখা উচিৎ। 

গ্রিলের ব্যবহার  

বিদেশের অনুকরণে আজকাল পাল্লা দেয়া কাঠের জানালার স্থান দখল করে নিয়েছে থাই গ্লাস। এটি একদিকে যেমন এদেশের জলবায়ুর ধরনের পরিপন্থী, তেমনি বাড়ির সৌন্দর্যেও এটি যেন ঠিক সেই আগের আভিজাত্য বজায় রাখতে হচ্ছে ব্যর্থ। তারপরও খরচ এবং প্রাপ্তির হিসেবে ক্রেতাদের ঝুঁকতে হচ্ছে থাই গ্লাসের দিকেই।

সেই ব্রিটিশ আমল থেকে স্থাপত্যের সাথে বনেদিয়ানার আভিজাত্য প্রকাশেই শুরু হয় গ্রিলের ব্যবহার। বাড়ির ছাদের রেলিং, ভেন্টিলেটর, সিঁড়ির সাথে বেয়ে ওঠা রেলিংয়ে প্রচলন ছিল ফুলেল নকশার লোহার গ্রিলের ব্যবহারের। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আজও আবাসিক, অনাবাসিক প্রতিটি ভবন নির্মাণেই জানালা, বারান্দা এবং সিঁড়ির রেলিং, কলাপসিবল গেইট ও মেইন গেইটে এমন গ্রিলের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। 

প্রকারভেদ

বাংলাদেশে বর্তমানে গ্রাম এবং শহরে সর্বত্রই বাড়ি নির্মাণে বিভিন্ন ধরনের গ্রিল ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে স্কয়ার বার, ফ্ল্যাট বার, চ্যানেল বার ইত্যাদি জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে। গত দশকে রেলিং এবং প্রবেশ দরজার ক্ষেত্রে এম এস-এর তৈরি নকশাদার গ্রিলের ব্যাপক ব্যবহার দেখা গেলেও বর্তমান সময়ে এর জায়গা দখল করছে এস এস-এর তৈরি সিম্পল স্কোয়ার বার, থাই গ্রিল এবং প্লেইন শিট। সাধারণত চার সুতার স্কয়ার বার আর দেড় সুতার পাতি দিয়ে গ্রিল প্রস্তুত করা হয়। আর বাজারদর নির্ণয়ের ক্ষেত্র হয় সাধারণত ভর হিসেবে কেজিতে হিসাব বা দৈর্ঘ্যে ফুটের পরিপ্রেক্ষিতে। কেজি হিসেবে ধরে প্রতিটি গ্রিলের দাম আলাদাভাবে পড়বে কেজি-প্রতি ৮০-৮৫ টাকা। আর ক্ষেত্রফল হিসেবে বর্গফুট-প্রতি দাম পড়বে ১৫০-১৫৫ টাকা। 

দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্ব এবং বাসায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য নান্দনিক ডিজাইনের পাশাপাশি, সঠিক গুণগত মান দেখে গ্রিল নির্বাচন করা প্রয়োজন। আপনার কল্পলোকের বাড়ি নির্মাণে উৎকৃষ্ট গ্রিল নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো লক্ষ্য করা প্রয়োজন, তা হলো- 

১। এর উপাদানের গুণগত মান ঠিক আছে কিনা এবং সোজা আছে কিনা দেখে নেয়া 

২। মসৃণতা এবং নিখুঁত ফিনিশিং

দরজার চৌকাঠ বা ফ্রেমিং নির্মাণ

বাড়ি নির্মাণের আরেকটি অপরিহার্য কাজ হলো, দরজার জন্য নিখাদ ফ্রেমিং বাছাই। বাংলাদেশে এখনও দরজা ও ফ্রেম তৈরিতে কাঠের বহুল প্রচলন দেখা যায়। ফ্রেম বানানোর ক্ষেত্রে সঠিক কাঠ বাছাই করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

সাধারণত যেসব কাঠের বহুল ব্যবহার দেখা যায় সেগুলোর মধ্যে মেহগনি, বার্মা টিক, চিটাগং শিলকড়ই, টিক চাম্বুল, চিটাগং টিক এবং লোহা কাঠের ব্যবহার অন্যতম। ফ্রেমিং এর জন্য সাধারণত দুই ধরনের পুরুত্বের কাঠ ব্যবহার করা হয়। এক ধরনের হচ্ছে ২.২৫” x ১১.৭৫” যা ১০” দেয়ালের ক্ষেত্রে, এবং অন্যটি হচ্ছে ২.২৫” x ৫.৭৫” যা ৫” ইটের দেয়ালের জন্য নির্ধারিত। এছাড়াও নিরাপত্তা ও কাঠের আবহাওয়াগত পরিবর্তনের কারণে স্টিলের দরজার ব্যবহারও পরিলক্ষিত হয়।  

কোথায় পাবেন

ঢাকার ভিতর পাইকারি দরে দরজা প্রাপ্তির স্থানগুলো হলো কুতুবখালি, নয়াবাজার, পান্থপথ, বাড্ডা, রোকেয়া সরণী ও কুড়িল বিশ্বরোড। এখানে চৌকাঠ বা ফ্রেমের দাম পড়বে ২,০০০-৪,০০০ টাকা। পাইকারি বাজার ছাড়াও বিভিন্ন স্বনামধন্য কোম্পানি দরজা প্রস্তুত ও বাজারজাত করে থাকে। এই ধরনের জায়গায় দরজার ফ্রেমের দাম আকার, উপাদান এবং ডিজাইনের প্রকারভেদে ৩,০০০ থেকে ১২,০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।

স্টিল বা কাঠের দরজার পানিতে নষ্ট হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। এই কারণে বাথরুমে সাধারণত প্লাস্টিকের দরজা এবং ফ্রেমিং ব্যবহার করা হয়। বংশাল এবং পান্থপথে পাল্লাসহ এধরনের দরজার দাম পড়ে সাধারণত ২,৫০০-৪,০০০ টাকা।

আমাদের কল্পনায় থাকা স্বপ্নের বাড়িকে বাস্তব রূপ দেয়ার সময় আমাদের সামনে আসে নানা সিদ্ধান্ত নেয়ার জায়গা, আসে হরেক রকম প্রশ্নও। স্বপ্নের বাড়ি নির্মাণের সময় এর কাঠামো, সৌন্দর্য ইত্যাদির দিকে আমাদের থাকে সূক্ষ্ম দৃষ্টি। ইট, বালি, সিমেন্ট, কংক্রিটের মাঝে আমরা সঠিক গ্রিল এবং দরজার ফ্রেম নির্বাচনকে প্রায়ই গুরুত্বহীন করে দেখি। কিন্তু বাড়ির সার্বিক নিরাপত্তা এবং সর্বাঙ্গিক নান্দনিকতা নিশ্চিত করার জন্য দরজা, জানালার ফ্রেম ও গ্রিলের মতো বিষয়গুলোর দিকে গুরুত্ব দেয়া উচিৎ সমানভাবেই।

নির্মাণ কাজে দরজা জানালা কেমন হবে

নির্মাণ কাজে দরজা জানালা কেমন হবে সেটা বোঝার জন্য আমাদের বিভিন্ন রুমের দরজা  ও জানালার মাপ ভালো করে জানতে হবে। নিচে মাপ দেওয়া হলোঃ

দরজা দেওয়ার মাপঃ

জানালা দেওয়ার মাপ ঃ

এছাড়াও আলো-বাতাসের প্রতুলতার দিক বিবেচনা পূর্বক ও সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য জানালার মাপ এবং আসা-যাওয়ার কথা বিবেচনা করে দরজার মাপ পরিবর্তিত হতে পারে।