ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিট হলো একপ্রকার তন্তুময় কংক্রিট, যা প্রস্তুত করা হয় সিমেন্ট, কংক্রিট আর বিশেষ প্রকার তন্তুর সংমিশ্রণে। এই তন্তুর উপস্থিতির কারণে ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিট গাঠনিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং টেকসই হয়। সাধারণ কংক্রিটের মিশ্রণে তন্তু ব্যবহারের কারণ মূলত এটিই- অবকাঠামোকে আরো মজবুত ও টেকসই করা।
অবশ্য, কেবল অবকাঠামো মজবুত এবং টেকসই করে বললে কম বলা হবে। ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিটের রয়েছে বহুবিধ গুণাগুণ। একনজরে দেখে নেয়া যাক কংক্রিটের মিশ্রণে ফাইবার যোগ করার সুবিধাগুলো-
- এটি ব্যবহারে অবকাঠামোতে কংক্রিট শুকিয়ে যাবার পর সম্ভাব্য সর্বনিম্ন ফাটল সৃষ্টি হয়।
- শিল্পকারখানার অবকাঠামো নির্মাণে, যেখানে অধিক পুরু এবং মজবুত অবকাঠামোর প্রয়োজন হয়, ম্যাক্রো-সিন্থেটিক ফাইবার নামক একপ্রকার ফাইবার ব্যবহার করা হয় যা আকারে সাধারণ ফাইবারের চেয়ে কিছুটা বড় এবং কংক্রিটের স্থায়িত্ব দীর্ঘ করে।
- কংক্রিটে ফাইবার যুক্ত করলে এর বস্তুগত সংহতি বা সংযুক্তি বৃদ্ধি পায়, ফলে আঘাত সহনশীলতা বাড়ে। প্রতিকূল পরিবেশে এটি অপরিবর্তনীয় থাকতে সক্ষম।
- ফাইবার কংক্রিটের স্থিতিস্থাপক ক্লান্তি (Elastic Fatigue) বৃদ্ধি করে, ফলে বারংবার আঘাতেও সহজে ভেঙে পড়ে না।

ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিটের অন্তত অর্ধশতাধিক ধরন আছে। প্রয়োজনভেদে কংক্রিটের মিশ্রণে বিভিন্ন প্রকার ফাইবার মেশানো হয়। ধাতব থেকে শুরু করে পশুর লোম পর্যন্ত সবকিছু থাকে এই মিশ্রণের তালিকায়। একটি থেকে আরেকটির মূল পার্থক্যগুলো নির্ভর করে ফাইবারের দৈর্ঘ্য, ব্যাস, শতকরা পরিমাণ, সিমেন্ট-পানির অনুপাত ইত্যাদির উপর।
চলুন জেনে নেয়া যাক সর্বাধিক প্রচলিত কিছু ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিটের রকমফের।
১. স্টিল ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিট
এটি মূলত কংক্রিটের মাঝে ধাতব তন্তুর মিশ্রণ। নির্দিষ্ট পরিমাণ কংক্রিটের সাথে সুনির্দিষ্ট অনুপাতে ধাতব তন্তু যোগ করলে এর গুণগত পরিবর্তন আসে। তখন এটি ফাটল-রোধী হয়, স্থিতিস্থাপক ক্লান্তি (Elastic Fatigue) ও স্থায়িত্ব বাড়ায়। মাইনিং, প্রিকাস্ট অবকাঠামো, টানেল নির্মাণ, ব্রিজ, ফ্লাইওভার নির্মাণের মতো দীর্ঘস্থায়ী কাঠামোতে এই কংক্রিট ব্যবহার করা হয়। বাজারে কয়েক প্রকার স্টিল ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিট পাওয়া যায়- কোল্ড-ড্রন ওয়্যার, কাট শিট, মেল্ট এক্সট্রাক্টেড, মিল কাট ইত্যাদি।
২. পলিপ্রোপাইলিন ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিট
এই কংক্রিটের আরেক নাম পলিপ্রোপেন বা সংক্ষেপে পিপি-ও বলা হয়। এটি একপ্রকার সিন্থেটিক ফাইবার যা প্রোপাইলিং থেকে প্রস্তুত করা হয়। এটি মূলত কংক্রিটের অবকাঠামোর প্লাস্টিক সংকোচন রোধে ব্যবহার করা হয়। পাঠকের সুবিধার্থে উল্লেখ করা যেতে পারে, সদ্য ব্যবহার করা কংক্রিট শুকাতে থাকলে তা থেকে পানি বাষ্পীভূত হতে থাকে এবং এর আকার কিছুটা সংকুচিত হয়ে আসে, যাকে বলা হয় প্লাস্টিক সংকোচন। এছাড়াও এই তন্তু ব্যবহারে কংক্রিটের ভেদনযোগ্যতা হ্রাস পায়, ফলে দেয়াল বা পিপির তৈরি যেকোনো কাঠামো থেকে পানি চুইয়ে পড়ে না।

পলিপ্রোপাইলিন আংশিক স্বচ্ছ স্ফটিকাকার এবং অ-পোলার। এর গুণগত মান অনেকটাই পলিইথিলিনের মতো, তবে এটি পলিইথিলিনের চেয়ে অধিক শক্ত এবং তাপ সহনশীল। এর কেমিক্যাল রেজিস্ট্যান্সও অন্যান্য কংক্রিটের তুলনায় বেশি।
৩. গ্লাস ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিট
নাম থেকেই অনুধাবন করা সম্ভব যে এটি কাচের তন্তুর মিশ্রণে প্রস্তুত করা হয়। পলিমার কিংবা কার্বন ফাইবারের সাথে এর খানিকটা সাদৃশ্যও রয়েছে। অবশ্য কার্বন ফাইবারের মতো এতটা শক্তিশালী নয় এই কংক্রিট। কিন্তু এটি তুলনামূলকভাবে সস্তা এবং মিশ্রণে ব্যবহার করলে কম ভঙ্গুর কংক্রিট প্রস্তুত করে। এর আরেকটি গুণ হচ্ছে- এটি ওজনে বেশ হালকা হয় বাকিগুলোর তুলনায়। এর ঘনত্বও অন্যগুলোর তুলনায় বেশি, তাপ নিরোধক হিসেবে এর সুনাম আছে। অনেকে গ্লাস রিইনফোর্সড ফাইবার কংক্রিটকে ‘ফাইবারগ্লাস’-ও বলে থাকেন।
৪. পলিস্টার ফাইবার
যেকোনো ধরনের প্রিকাস্ট অবকাঠামো, ফুটপাথ, ওয়ারহাউজ কিংবা শিল্পকারখানায় পলিস্টার ফাইবার ব্যবহার করা হয়। মাইক্রো এবং ম্যাক্রো- দুই ধরনের পলিস্টার ফাইবার ব্যবহার করা হয়ে থাকে এই কংক্রিট মিশ্রণে। এটি অবকাঠামোর প্লাস্টিক সংকোচন রোধ করে, দীর্ঘস্থায়িত্ব নিশ্চিত করে, কাঠামোগত সক্ষমতা বাড়ায়।
৫. কার্বন ফাইবার
নানাপ্রকার ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিটগুলোর মাঝে কার্বন ফাইবারই হলো সবচেয়ে মজবুত। ৫-১০ মাইক্রোমিটার ব্যাসের তন্তুগুলো মূলত কার্বন দিয়েই তৈরি। অধিক কেমিক্যাল রেজিস্ট্যান্স, কম ওজন, অত্যন্ত কম থার্মাল এক্সপানসন (তাপে প্রসারণ), উচ্চ তাপ সহনশীলতা, অধিক কঠোরতা- এগুলো কার্বন ফাইবারের মূল বৈশিষ্ট্য। এর ব্যবহারবিধি মূলতা উচ্চ তাপ সহনশীলতা কেন্দ্র করেই। গ্রাফাইটের মিশ্রণে তৈরি এই কংক্রিট সাধারণ শিল্প কারখানায় বা যেখানে অধিক তাপ সহনশীল কোনো অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজন, সেখানে ব্যবহার করা হয়। অবশ্য কিছু কার্বন ফাইবার আবার ভঙ্গুর হয়।

৬. ম্যাক্রো সিনথেটিক ফাইবার
ম্যাক্রো সিনথেটিক ফাইবার মূলত পলিমারের তৈরি। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে স্টিল ফাইবারকে প্রতিস্থাপন করতেই এর প্রচলন। এর সর্বাধিক ব্যবহার উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন স্ল্যাব তৈরিতে। কেননা ম্যাক্রো সিনথেটিক ফাইবারের মূল বৈশিষ্ট্যই হলো অধিক চাপ সহনশীলতা।
৭. ন্যাচারাল ফাইবার
প্রাকৃতিক ফাইবার মূলত সরাসরি প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত। পশুর চামড়া, শাকসবজি, খনিজ উৎস আর রূপান্তরযোগ্য অ-বুননকৃত ফ্যাব্রিক্স, যেমন- কাপড়, উল বা কাগজ, ইত্যাদি এই ফাইবারের উৎস। এ ধরনের ফাইবার ব্যবহারের কারণ মূলত দুটি। একটি হলো এর সহজলভ্যতা, যে কারণে এটি তুলনামূলকভাবে সস্তা। অন্যটি হলো ভঙ্গুরতা রোধ করা। অন্য যেকোনো ফাইবারের তুলনায় ন্যাচারাল ফাইবারের কংক্রিট কম ভঙ্গুর।
ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিটের নানা গুণাগুণ মাথায় রাখলে বাড়ি নির্মাণের সময় নেয়া যাবে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত।