নির্মাণকাজে ব্যবহৃত পাথরের প্রকারভেদ

নির্মাণকাজে পাথরের ব্যবহার কতকাল আগে শুরু হয়েছে তা বলা মুশকিল। কেননা, পশু শিকার করতে পাথরের হাতিয়ার বানানো মানুষেরা যখন বসতবাড়ি নির্মাণ শিখলো, তা পাথর দিয়েই নির্মাণ করতো, এটি অনুমেয়। ধরে নেয়া যায়, নির্মাণকাজের সবচেয়ে আদিম উপাদান পাথর। দৃঢ়তা ও স্থায়িত্বের জন্য পাথর নির্মাণকাজে বহুল প্রচলিত। বিশেষ করে ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণ, ছাদ ঢালাই, হাইওয়ে কিংবা ব্রিজের ভায়াডাক্ট তৈরিতে পাথরের বিকল্প নেই। কেননা, এসব স্থাপনা দীর্ঘ সময়ের জন্যই নির্মাণ করা হয়। তবে স্থায়িত্ব ছাড়াও পাথরের ব্যবহার সৌন্দর্যের সাথেও সম্পৃক্ত। দেয়াল বা মেঝের নান্দনিকতা বৃদ্ধিতেও ব্যবহার করা হয় নানা রকমের পাথর।

চলুন, দেখে নেয়া যাক নির্মাণকাজে ব্যবহৃত সবচেয়ে জনপ্রিয় কিছু পাথর ও সেসবের ব্যবহারবিধি।

ব্যাসল্ট (Basalt)

নির্মাণকাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পাথরগুলোর একটি ব্যাসল্ট। এটি একপ্রকার আগ্নেয় শিলা যা ভূগর্ভস্থ উত্তপ্ত গলিত পাথর চাপে জমে কঠিন পাথরে পরিণত হয়। এরূপ প্রক্রিয়ার কারণে এর গঠন অত্যন্ত ঘন ও মজবুত, এবং নির্মাণকাজে এর ব্যবহার স্থাপনাকে দৃঢ়তা দেয়। সাধারণ রাজমিস্ত্রীর কাজ থেকে শুরু করে ব্রিজের পিলার নির্মাণ, নদীতে বাঁধ নির্মাণ, কিংবা বৃহৎ স্থাপনায় ব্যাসল্টের কংক্রিটের মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়।

ব্যাসল্ট সাধারণত ধূসর এবং কালো বর্ণের হয়। এটি অত্যন্ত দৃঢ় হওয়ায় ইচ্ছেমতো আকৃতি প্রদান করা কঠিন। এর দৃঢ়তা ২০০-৩০০ মেগাপ্যাসকেল (Megapascal) প্রেসার ইউনিট বা এমপিএ। আর্দ্রতা ও প্রতিকূল পরিবেশে ব্যাসল্টের সহনশীলতা বেশ ভালো।

গ্রানাইট (Granite)

বড় নির্মাণকাজে, যেমন- ব্রিজের পিলার, বাঁধরক্ষা দেয়াল থেকে শুরু করে বাসাবাড়ির দেয়ালে আর্দ্রতারোধী আস্তরণ, রেললাইনের স্লিপার, ছাদের বহিরাবরণ ইত্যাদি নির্মাণে গ্রানাইট ব্যবহার করা হয়। এটি ব্যাসল্টের তুলনায় কিছুটা কম হলেও বেশ দৃঢ় এবং টেকসই একটি পাথর। এর ঘনত্ব অনেক বেশি হওয়ায় এর ভেতরে দীর্ঘদিনেও পানি প্রবেশ করতে পারে না।

গ্রানাইটের দৃঢ়তা ২৫০ মেগাপ্যাসকেল। হালকা ধূসর থেকে কিছুটা গোলাপী রঙেরও হয়ে থাকে গ্রানাইট। এর শোষণক্ষমতা অত্যন্ত কম হওয়ায় যেসব স্থানে অধিক আর্দ্রতা থাকে সেখানে এটি ব্যবহার করা হয়, যেমন- রেস্টুরেন্টের খাবার টেবিলের ওপর কিংবা পিলারের আবরণ হিসেবে।

স্যান্ডস্টোন (Sandstone)

ভাবছেন স্যান্ড বা বালুর আবার পাথর হয় কী করে? স্যান্ডস্টোন আসলেই বালুর পাথর, তবে এর গঠন প্রক্রিয়া দীর্ঘ। অন্যান্য পাথরের ক্ষয় হয়ে যাওয়া ধূলিকণা আর স্ফটিক বিভিন্ন প্রাকৃতিক খনিজের সাথে মিশ্রিত হয়ে সময়ের আবর্তে জমাট বেঁধে শক্ত পাথরের রূপ নিলে তাকে আমরা স্যান্ডস্টোন বলি।

স্যান্ডস্টোন মূলত নির্মাণকাজে সাজসজ্জায় ব্যবহৃত হয়। লাল, সাদা, হলুদ, ধূসর, কালচে, পীত বর্ণসহ স্যান্ডস্টোন এর বৈচিত্র্যময় রঙের জন্য দেয়াল, সিঁড়ি বা অন্যান্য নির্মাণে সৌখিন উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অবশ্য বড় বড় নির্মাণকাজেও প্রয়োজনভেদে এই পাথরের ব্যবহার হয়ে থাকে।

চুনাপাথর (Limestone)

চুনাপাথর সকল প্রকার নির্মাণকাজে ব্যবহারের উপযোগী নয়। এর ঘনত্ব সাধারণত কম হয়, ফাটল থাকে এবং কাদামাটিতে তৈরি হওয়ায় নমনীয় ও ভঙ্গুর হয়। অবশ্য ফাটলহীন, ঘন ও মজবুত চুনাপাথর ঘরের মেঝে, ছাদ কিংবা ফুটপাতের আবরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর একটি অসুবিধা হলো- শিল্পকারখানার দূষিত বাতাসে এবং সমুদ্র তীরবর্তী লবণাক্ত বাতাসে এর ক্ষয় হয়।

মার্বেলপাথর (Marbel)

মাত্র ৭০-৭৫ এমপিএ চাপ সহনশক্তির মার্বেলপাথরের ব্যবহার অনুমিতভাবেই নির্মাণকাজে অবকাঠামো তৈরিতে ব্যবহৃত হয় না। এটি মূলত নির্মাণশৈলির নান্দনিকতার অংশ। এর সবচেয়ে বড় গুণ হলো একে চমৎকারভাবে পালিশ (Polish) করে ইচ্ছেমতো আকার দেয়া যায় এবং আরামদায়ক, চকচকে ও মসৃণ করা যায়।

মার্বেলপাথর টাইলস নামেই সর্বাধিক পরিচিত। বাসাবাড়ির মেঝে, রান্নাঘর আর গোসলখানায় মার্বেলপাথরের ব্যবহার এখন অবশ্যম্ভাবী। দেয়াল কিংবা পিলারের সৌন্দর্য বাড়াতে মার্বেলের ব্যবহারের বিকল্প নেই। মার্বেলের ওপর নানারকম ডিজাইন করিয়ে কিংবা নাম লিখিয়েও এটি ব্যবহার করা হচ্ছে নির্মাণকাজে।

স্লেট (Slate)

স্লেট হলো পাললিক শিলাজাত একপ্রকার রূপান্তরিত শিলা যা ভূগর্ভের উচ্চচাপে গঠিত হয়। গঠন ঘন হওয়ায় এই পাথর সমান্তরালে কাটা যায় এবং পালিশ করে মসৃণ করে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যায়। অত্যধিক ভার বহনে অক্ষম হওয়ায় ভবন বা বড় কোনো অবকাঠামো নির্মাণে স্লেট ব্যবহার করা হয় না। সাধারণত বাড়ির ছাদের ক্ষয়রোধী আস্তরণ, স্ল্যাব, ফুটপাতের কার্পেটিং, মেঝেতে স্লেট ব্যবহার করা হয়।

কোয়ার্টজাইট (Quartzite)

কোয়ার্টজাইটের দৃঢ়তা ৫০-২০০ এমপিএ। এতে বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান থাকায় সাধারণ নির্মাণকাজে এর ব্যবহার কম। তবে অধিক মজবুত কোয়ার্টজাইট বিল্ডিং ব্লক, স্ল্যাব, কার্পেটিং, কিংবা কখনো কখনো কংক্রিটের মিশ্রণেও ব্যবহৃত হয়।

কোয়ার্টজাইটের সবচেয়ে উপযোগী ব্যবহার হলো রেলওয়ে ব্যালাস্ট (রেললাইনে বিছিয়ে রাখা পাথর) হিসেবে। তাছাড়া শিল্পজাত সিলিকা বালু প্রস্তুত করার অন্যতম প্রধান উপাদান হলো কোয়ার্টজাইট। মেঝেতে টাইলস হিসেবে, দেয়ালে বা সিঁড়িতে কোয়ার্টজাইটের মসৃণ আকৃতি ব্যবহার করা হয়। হলুদ, ধূসর, সাদাসহ নানা রঙের কারণে ইন্টেরিয়র ডিজাইনে কোয়ার্টজাইটের ব্যবহার জনপ্রিয়। কোয়ার্টজাইটের আরেকটি বড় গুণ হলো- এতে সহজে দাগ পড়ে না, আঁচড় লাগে না, চিটচিটে হয় না। তাই কিচেন কাউন্টারটপ (রান্নাঘরে যে পৃষ্ঠের ওপর খাদ্যদ্রব্য কাটা হয় বা রান্নার উপকরণ প্রস্তুত করা হয়) তৈরিতে কোয়ার্টজাইট একটি আদর্শ উপাদান।

বাড়ি নির্মাণে ব্লক ব্যবহারের প্রচলন

প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে বাড়িঘর নির্মাণের পদ্ধতিতে এসেছে বিস্তর পরিবর্তন। অন্যান্য যান্ত্রিক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সাথে সাথে চোখে পড়ার মতো একটি পরিবর্তন হলো অবকাঠামো নির্মাণে ক্রমবর্ধমান সিমেন্টের ব্লক ব্যবহার। ইটের পর ইট সাজিয়ে রাজমিস্ত্রির হাতে ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়ানো ভবনগুলোর পাশেই আজকাল দাঁড়াচ্ছে সিমেন্ট ব্লক আর ‘হলো’ (ফাঁপা) ব্লকের তৈরি দালানকোঠা। দেখতেও মন্দ নয় ব্লকের তৈরি কাঠামো, বরং নির্মাণশৈলী ভালো হলে ব্লকের তৈরি বাড়িঘরেই আধুনিকতার ছাপ ফুটে ওঠে বেশি।

ইট নাকি ব্লক- বাড়ি তৈরির সময় তাই দ্বিধান্বিত হয়ে যান অনেকেই। দুটোরই রয়েছে নিজস্ব ধাঁচ, সৌন্দর্য আর সুবিধাদি। উভয়েই মজবুত, বিদ্যুৎ অপরিবাহী, তাপ ও চাপ সহনীয়। বাড়ির নকশা অনুযায়ী যেকোনোটিই বেছে নেয়া যেতে পারে নির্দ্বিধায়। তারপরও, দুটোর ব্যবহারের সুবিধাগুলো জানা থাকলে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে।

সিমেন্ট ব্লক বনাম ইট

সিমেন্ট ব্লক সাধারণত ২০০ X ৪০০ X ২০০ মি.মি. (৭.৮৭ X ১৫.৭৫ X ৭.৮৭ ইঞ্চি) আকারের হয়ে থাকে, যেগুলো ২০০ মি.মি.-এর (৭.৮৭ ইঞ্চি) পুরু দেয়াল নির্মাণে ব্যবহৃত হয়। চিকন দেয়ালের জন্য ব্যবহার করা হয় ১০০ X ৪০০ X ২০০ মি.মি. (৩.৯৪ X ১৫.৭৫ X ৭.৮৭ ইঞ্চি) আকারের ব্লক। ইট সাধারণত ২৩০ X ১১০ X ৭৫ মি.মি. (৯.০৬ X ৪.৩৩ X ২.৯৫ ইঞ্চি) আকারের হয়ে থাকে।

ব্লকের তুলনায় ইটের ওজন কম হওয়ায় কাজ করার ক্ষেত্রে এটি সুবিধাজনক। সলিড (নিরেট) ব্লকগুলো আকারে বড় ও ভারী হলেও ‘হলো’ (ফাঁপা) ব্লকগুলো বেশ হালকা এবং কাজ করার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক। ‘হলো’ ব্লকের আরেকটি সুবিধা হচ্ছে এর ভেতরে ফাঁকা স্থান থাকায় এটি ইট এবং সলিড ব্লক উভয়ের তুলনায় অধিক তাপনিরোধী। চাপ সহনশীলতাও ইটের চেয়ে ব্লকের বেশি।

অন্যদিকে, বর্ষাকালে পানি অধিক পানি শোষণ করায় ইটের দেয়ালে ছত্রাক গজায়, ব্লকের দেয়ালে যা অত সহজে জন্মাতে পারে না। আবার ব্লকের স্থায়িত্বও ইটের চেয়ে কিছু বেশি। নির্মাণকাল বিবেচনায় উভয়েরই নিজস্ব সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে। ব্লকের আকার ইটের তুলনায় বড় হওয়ায় ব্লক দিয়ে দেয়াল নির্মাণ দ্রুত হয়। আবার ব্লকের চেয়ে ইট ছোট ও হালকা হওয়ায় ইট দিয়ে দেয়াল নির্মাণ অপেক্ষাকৃত সহজ।

ইটের কিছু বিশেষ সুবিধা

১. ব্লকের চেয়ে ইটের তাপ শোষণ ক্ষমতা অনেক বেশি। ইটের কাঠামো ও গঠন এমন যে এটি অধিক তাপ ধারণ করতে পারে, বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ‘থারমাল ম্যাস’। দিনভর তাপ ধারণ করলেও রাতের বেলা দ্রুত তাপ ছেড়ে দিতে সক্ষম ইট।

২. ‘হলো’ ব্লকের তুলনায় ইটের স্থায়িত্ব বেশি। ইটের তৈরি বাড়ি দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই হবার কারণেই বাড়ি নির্মাণে এটি এখনও সর্বাধিক জনপ্রিয় উপকরণ।

৩. ইটের একটি মৌলিক গুণ হলো ‘কম্প্রেসন’ বা সংনমন। ইট তৈরিতে এর উপকরণ অর্থাৎ মাটি এতটা কমপ্রেস করা হয় যে ইটের ঘনত্ব সহজেই ব্লকের চেয়ে অনেকগুণ বেশি হয়। ফলে ইটের তৈরি দেয়ালে কোনোরূপ দাহ্য বিস্ফোরণ বা দহনের সম্ভাবনা থাকে না।

৪. রক্ষণাবেক্ষণে ইটের দেয়ালের চেয়ে সুবিধাজনক আর কিছুই নেই। ইটের দেয়ালে নির্মাণ চলাকালে কিছু রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া পরবর্তীতে আর তেমন কোনো যত্নের প্রয়োজন হয় না। যদিও ব্লকের দেয়াল নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ব্লকের কিছু বিশেষ সুবিধা

১. ব্লক দিয়ে বাড়ি নির্মাণের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো খরচ কমে আসা। নির্মাতারা অনুমান করে থাকেন যে ব্লক দিয়ে বাড়ি নির্মাণ ইটের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ কম খরচে হয়ে যায়। প্রায় সাড়ে ৪টি ইটের সমান একটি ব্লক বাংলাদেশে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২৫-৪০ টাকায়। ইটের ব্যবহারে যেখানে অধিক সিমেন্ট, অধিক সময়, এবং ফলস্বরূপ রাজমিস্ত্রির পেছনে অধিক ব্যয় হয়, ব্লকের ব্যবহারে সাশ্রয় হয় সবগুলোই।

২. ব্লকের একটি বড় গুণ হলো এটি পরিবেশবান্ধব। ব্লক তৈরি করা হয় ফ্লাই অ্যাশ থেকে। আর ফ্লাই অ্যাশ হলো তাপোৎপাদী বিক্রিয়ার একটি অবশেষ মাত্র, যা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদিত হয়। এখানে ব্লকের কল্যাণে দ্বিমুখী লাভ পরিবেশের। প্রথমত, ব্লক উৎপাদনে মাটি পোড়াতে হচ্ছে না, ফলে চাষযোগ্য জমি বা পাহাড় খনন করতে হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, ফ্লাই অ্যাশ একটি বায়ু দূষণকারী উপাদান যা ব্লক নির্মাণে ব্যবহৃত হলে পরিবেশ দূষণমুক্ত হয়। এছাড়াও, ফ্লাই অ্যাশের দাম কম হওয়ায় ব্লক নির্মাণে খরচও কম হয়।

৩. ব্লকের মধ্যে সবচেয়ে হালকা হলো ‘অটোক্লেভড এরিয়েটেড কনক্রিট’ ব্লক বা এএসি ব্লক। এই ব্লক দিয়ে দেয়াল নির্মাণ অপেক্ষাকৃত অনেক সহজ বলে এটি নির্মাতাদের পছন্দের উপকরণ হয়ে উঠছে।

৪. বর্তমানে বাড়ি নির্মাণের সময় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় যে বিষয়ে তা হলো বাড়ির ভূমিকম্প সহনশীলতা। নানা কারণে বেড়েছে ভূমিকম্প আর টর্নেডোর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তাই অবকাঠামো নির্মাণের একটি প্রাথমিক প্রয়োজনীয়তা হলো একে ভূমিকম্প সহনীয় করে নির্মাণ করা। আর এখানে বেশ এগিয়েই থাকে ব্লক। যেকোনো প্রকার কম্পন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ইটের চেয়ে ব্লকের কার্যকারিতা অনেকাংশেই বেশি।

৫. শহুরে বাড়িঘর, বিশেষ করে ব্যস্ত সড়কের পাশে কিংবা শিল্প-কারখানাবেষ্টিত অঞ্চলে বাসা বাড়ি নির্মাণে ব্লক হতে পারে দারুণ উপযোগী। একটি ইট এককভাবে অধিক ঘন হলেও ইটের গাঁথুনিতে তুলনামূলকভাবে অধিক সংখ্যক সংযোগস্থল থাকে যা ব্লকের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কম। ফলে ব্লকের তৈরি বাসাবাড়ি ইটের তৈরি বাসাবাড়ির তুলনায় অধিক শব্দনিরোধী। তাই শব্দবহুল এলাকায় বাড়ি নির্মাণে ব্লকই শ্রেয়।

ইট এবং ব্লক, উভয়ের গুণাগুণ এবং বিশেষ সুবিধাদি জানবার পর কোনোটিকেই ব্যবহারের অনুপযোগী বলার সুযোগ নেই। বরং সিদ্ধান্ত নিতে হবে প্রয়োজন এবং পছন্দ অনুযায়ী। কেউ কেউ চান নির্মাণকাজ শেষে আর কিছু নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে। তাদের প্রথম পছন্দ হবে ইট। আবার যারা খরচ বাঁচিয়ে বাড়ি নির্মাণ এবং পরবর্তীতে নিয়মিত এর পরিচর্যা, পরিবর্তন আর পরিবর্ধনের ব্যাপারে আগ্রহী, তাদের জন্য ব্লকই যুতসই।

কংক্রিটের অ্যাগ্রেগেট স্ট্যান্ডার্ড: ভালো অ্যাগ্রেগেটের যা যা গুণাবলি থাকা প্রয়োজন

স্থাপনার জগতে কংক্রিটের অত্যাবশ্যক প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানে না, এমন কাউকে বর্তমানে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। প্রধানত ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হলেও কংক্রিট সুপারস্ট্রাকচার কনস্ট্রাকশনেও কার্যকর। স্ল্যাব এবং সিঁড়ি নির্মাণের সাথে সাথে বিভিন্ন স্থাপনাশিল্পেও কংক্রিটের অনবদ্য ভূমিকা আছে। এত প্রয়োজনীয় এই উপাদান সম্পর্কে ভালো করে জানা তাই বাড়ির কাজে হাত দেওয়ার পূর্বে বেশ দরকারি। এক নজরে তাই দেখে নেয়া যাক ভালো অ্যাগ্রেগেটের কী কী গুণাবলি থাকা দরকার ভালো মানের কংক্রিট পেতে হলে।

সারফেস, টেক্সচার, আকার, গ্রেডেশন, শোষণ ক্ষমতা, বাল্ক ইউনিট ওয়েট, স্পেসিফিক গ্র‍্যাভিটি, ময়েশ্চার কনটেন্ট ইত্যাদি হলো অ্যাগ্রেগেটের বৈশিষ্ট্য। অ্যাগ্রেগেটের কাজ হল ঘর্ষণজনিত প্রতিবন্ধকতা রোধ করা, জমাট বাধা রোধ করা, অ্যালকালি এবং সালফেটের প্রভাব ঠেকানো, সাথে সংকীর্ণভাব মোচন করা। সাধারণ স্থাপনার ক্ষেত্রে অ্যাগ্রেগেট ৬৫-৭৫ ভাগ আয়তনের হয়ে থাকে, বাকিটুকুতে থাকে সিমেন্টের মিশ্রণ, পানি এবং বাতাস। অ্যাগ্রেগেট প্রধান ভূমিকা রাখে মানসম্মত কংক্রিটের ক্ষেত্রে। যত ঘনভাবে Aggregate-এর গঠন নিশ্চিত করা যাবে কংক্রিটের স্থায়িত্ব ততই ভালো হবে। এই কারণে অ্যাগ্রেগেটের গ্রেডেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রেডেশনের ভিত্তিতে অ্যাগ্রেগেট দুই রকমের হয়ে থাকে। 

১। কোর্স অ্যাগ্রেগেট (Coarse Aggregate) 

২। ফাইন অ্যাগ্রেগেট (Fine Aggregate)

কোর্স অ্যাগ্রেগেট

আমরা ফুটপাতে হেঁটে যাওয়ার সময়ে বা ড্রাইভের সময় পায়ের নীচে শক্ত যা অনুভব করি এইটাই কোর্স অ্যাগ্রেগেট। প্রাকৃতিক পাথর ভেঙেই এই অ্যাগ্রেগেট পাওয়া যায়। অ্যাগ্রেগেট কেমন হবে তা নির্ভর করে পাথরের ধরনের উপর। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অ্যাগ্রেগেট মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। এই ধরনের উপাদান স্ল্যাবের এক-তৃতীয়াংশের বেশি হয় না, বা রিইনফোর্সমেন্ট বারের মধ্যকার দূরত্বের এক-পঞ্চমাংশের বেশি হয় না।

বিভিন্নরকম কোর্স অ্যাগ্রেগেট আমরা ব্যবহার করে থাকি। যেমন-

১। পাথর বা গ্র‍্যাভেল

এই ধরনের পাথর একে অপরের সাথে যুক্ত থাকে বা। কংক্রিটের মিশ্রণে এই গ্র‍্যাভেল থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর ইউনিট ওয়েট প্রতি ঘনফুটে ১৪০ থেকে ১৫২ পাউন্ড পর্যন্ত হতে পারে। তবে সাধারণভাবে এই মান ১৪৫ পাউন্ড ধরে নেয়া হয়। এ ধরনের অ্যাগ্রেগেটের সাধারণ আকার গ্র‍্যানিউল থেকে শুরু করে বোল্ডারের মতো বিশাল সাইজেরও হতে পারে।

২। স্যান্ড বা বালি

বালি হল সবচাইতে মসৃণ অ্যাগ্রেগেটের উদাহরণ। বিভিন্ন রকম বালি আছে, শার্প স্যান্ড/বিল্ডার্স স্যান্ড/ক্লিন ড্রাইড স্যান্ড যা কোর্স বা ফাইন বিভিন্ন অ্যাগ্রেগেটের কাজ করে। কোর্স বালি কংক্রিটের মিশ্রণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। 

৩। গ্রানাইট

Crushed stone texured background.

গ্রানাইট এক ধরনের ইগ্নিয়াস পাথরের উদাহরণ। একে বিভিন্ন ডায়ামিটারে চূর্ণ করে অ্যাগ্রেগেট হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

৪। পাথরচূর্ণ বা স্টোন চিপ

Stone. Crushed stone construction materials.

এই পাথরচূর্ণ সবচেয়ে শক্তিশালী অ্যাগ্রেগেট। কংক্রিটের বেস বা ভিত্তি হিসেবে বহুল ব্যবহৃত এই বস্তুর অ্যাগ্রেগেট-সিমেন্টের অনুপাত মেনে না চললেও হয়।

৫৷ রিসাইকেল্ড অ্যাগ্রেগেট

এই ধরনের অ্যাগ্রেগেট পূর্বে নির্মিত কংক্রিট ভেঙে পছন্দানুযায়ী সাইজে বানিয়ে নেওয়া হয়। বেস লেয়ার হিসেবে বেশ জনপ্রিয় এই উপাদান। এর শোষণ ক্ষমতা এবং স্পেসিফিক গ্র‍্যাভিটি অন্যান্য প্রাকৃতিক অ্যাগ্রেগেটের চাইতে বেশি থাকে। 

এছাড়াও ভার্মিকুলাইট, গ্লাস, স্ল্যাগ ইত্যাদি বিভিন্ন নতুন রকমের অ্যাগ্রেগেট নিয়েও কাজ হচ্ছে। 

ফাইন অ্যাগ্রেগেট

ফাইন অ্যাগ্রেগেট হলো বালি বা পাথরচূর্ণ যার ডায়ামিটার ৯.৫৫ মিলিমিটারের চেয়ে কম হয়। এই অ্যাগ্রেগেট ৪.৭৫ মিলিমিটার সীভের মধ্যে সহজেই পার হয়ে যায়। প্রাকৃতিক বালি, সিল্ট, পাথর গুড়ো, কাদা এসবও ফাইন অ্যাগ্রেগেটের শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত। ফাইন অ্যাগ্রেগেটের উদ্দেশ্যই হল কোর্স অ্যাগ্রেগেটের মধ্যে বিদ্যমান শূন্যস্থান পূরণ করে আরো বেশি কার্যকরী করে তোলা।

মজবুত দীর্ঘস্থায়ী ঘরের জন্য কংক্রিট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই অ্যাগ্রেগেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বাছাইতে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। ভালো মানের অ্যাগ্রেগেট ব্যবহার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমেই আপনার স্থাপনার কাজ হতে পারে সফল এবং দীর্ঘমেয়াদী। 

ইটের কাজের নানা উপায়

আমাদের দেশে পাকা দালান বলতে ইটের ব্যবহার সবক্ষেত্রে দেখা যায়। সেই ইটের গাঁথুনিতেও আছে নানা উপায় এবং নিয়ম কানুন।

গাঁথুনিতে ইট সাজানো বা জোড়া দেয়ার কৌশলকে বন্ড বলে। এতে ইটকে এভাবে জোড়া দেওয়া হয় যাতে উপরের বা নিচের দুই স্তরের খাড়া জোড়া একই খাড়া লাইনে না থাকে।

কারিগরি নিয়ম-কানুন না মেনে ইট বা পাথর গাঁথুনি করলে তা দীর্ঘদিন ব্যবহারযোগ্য হয় না। স্থায়িত্ব, সৌন্দর্য, আর্থিক দিক, ভারবহন ক্ষমতাসহ নানাদিক বিবেচনায় দেয়াল গাঁথুনিতে বন্ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ইটের কাজে বন্ডের প্রয়োজনীয়তা  

1. কাঠামো স্থায়ী ও শক্তিশালী করা।

2. ইটের মধ্যকার বন্ধন সুদৃঢ় করা।

3. গাঁথুনিতে উল্লম্ব বা খাড়া জোড়া পরিহার করা।

4. নির্মাণ কাজ দ্রুত করা।

5. দেয়ালের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা।

6. শিয়ার ফোর্স প্রতিরোধ করা।

7. দেয়ালের উপর আসা ভার সমানভাবে ও নিরাপদে বণ্টন করা।

ইটের বন্ডের প্রকারভেদ

গাঁথুনিতে ব্যবহৃত বন্ডকে নানাভাগে ভাগ করা যায়

  1. ইংলিশ বন্ড (English bond)
  1. ফ্লেমিশ বন্ড (Flemish bond)
  1. স্ট্রেচার বন্ড বা রানিং বন্ড (Stretcher bond)
  1. হেডার বন্ড (Header bond)
  1. গার্ডেন ওয়াল বন্ড (Garden wall bond)
  1. রেকিং বন্ড (Raking bond)
  1. ডাচ বন্ড (Dutch bond)

৪. ফেসিং বন্ড (Facing bond)

9. ইংলিশ ক্রস বন্ড (English cross bond)

10. ব্রিক-অন-এজ বন্ড (Brick on edge bond)

প্রচলিত ইটের বন্ড এবং এদের ব্যবহার

আমাদের দেশে প্রচলিত কয়েকটি বন্ডে ইট গাঁথুনি পদ্ধতি এবং এর ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলো নিম্নে দেওয়া হল:

ইংলিশ বন্ড : 

এই প্রকার বন্ডে এক স্তর হেডারের উপর অপর স্তর স্ট্রেচার ইট স্থাপন করা হয় অর্থাৎ এক স্তরে  ইটগুলো লম্বালম্বিভাবে এবং অপর স্তরে ইটগুলো আড়াআড়িভাবে স্থাপন করা হয়। এ বন্ড খুবই শক্তিশালী এবং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। খাড়া জোড়াগুলো যাতে একই উলম্ব রেখায় না পড়ে সেজন্য হেডার স্তরের প্রথম হেডার ইটের পর একটি কুইন ক্লোজার বসাতে হয়।

হাফ ইটের মোটা পুরুত্বের যেকোনো দেয়াল নির্মাণে ইংলিশ বন্ড ব্যবহার করা হয়।

ফ্লেমিশ বন্ড :

এই বন্ডে একই স্তরে একটি ইট লম্বালম্বি ও পরেরটি আড়াআড়ি করে পাশাপাশি স্থাপন করা হয়। ফ্লেমিশ বন্ডে প্রতিটি স্তরে হেডার ইটের কেন্দ্র বরাবর এর উপরের এবং নিচের স্তরের স্ট্রেচার ইটের কেন্দ্র থাকবে। প্রতিটি হেডারের দুই পাশে একটি করে স্ট্রেচার ইট থাকবে। ইংলিশ বন্ড থেকে এটি দেখতে সুন্দর হলেও অধিক সংখ্যক ক্লোজার ব্যবহার করার কারণে এই বন্ড দূর্বল হয়।

দেয়ালের সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং কারুকার্যের ক্ষেত্রে নির্মাতাদের প্রথম পছন্দ নান্দনিক ফ্লেমিশ বন্ড।

স্ট্রেচার বন্ড : 

এই প্রকার বন্ডে প্রতিটি স্তরে দেয়ালের দৈর্ঘ্য বরাবর ইটকে স্ট্রেচার হিসেবে স্থাপন করা হয়। কেবলমাত্র অর্ধ ইট বা ১২.৫ সে.মি পুরুত্বের দেয়ালে নির্মাণে এ বন্ড ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের বন্ডে গাঁথুনিতে যথাযথ বন্ড সৃষ্টি হয় না। অর্ধ ইটের বেশি পুরুত্বের দেয়ালে এ বন্ড ব্যবহার করা যায় না। একে রানিং বন্ডও বলে।

চিমনির দেয়াল, পার্টিশন এবং ডিভিশন ওয়াল নির্মাণের ক্ষেত্রে স্ট্রেচার বন্ড ব্যবহৃত হয়। 

হেডার বন্ড :

এই পদ্ধতিতে প্রতিটি স্তরের প্রতিটি ইটকে হেডার হিসেবে স্থাপন করা হয়। এক ইটের দৈর্ঘ্যের সমান বা ২৫ সে.মি. পুরুত্বের দেয়াল বা বাঁকা দেয়াল নির্মাণের ক্ষেত্রে এই বন্ড বেশি উপযোগী।

বাঁকা দেয়াল এবং ফুটিং নির্মাণের সময় হেডার বন্ড ব্যবহার করা হয়। 

গার্ডেন ওয়াল বন্ড :

গার্ডেন ওয়াল, কম্পাউন্ড ওয়াল ও বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণের জন্য যে বন্ড ব্যবহৃত হয় তাকে গার্ডেন ওয়াল বন্ড বলে। সাধারণত ২৫ সে.মি বা এক ইট পুরু দেয়ালের ক্ষেত্রে এ বন্ড ব্যবহার করা হয়। ইংলিশ বা ফ্লেমিশ উভয় বন্ডে এ দেয়াল গাঁথা যায়।

সীমানার দেয়াল, বাগানের দেয়াল এই ধরনের হালকা নির্মাণে গার্ডেন ওয়াল বন্ড ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

বাড়ি নির্মাণে ইট বহুল প্রচলিত একটি উপাদান। সেক্ষেত্রে বাড়ির স্থায়িত্ব এবং নির্মাণ প্রক্রিয়ায় বন্ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। নিজের কষ্টের অর্থ পরিশ্রম ব্যয়ে গড়ে তোলা বাড়িটি বাসযোগ্য এবং স্থায়ী হওয়া জরুরি। সবকিছুর সাথে ইটের দালানে বন্ডের বিষয়টিও লক্ষ্য রেখে বানালে নির্মাণ হবে সমৃদ্ধ এবং স্থায়ী।

ইট-মসলার ভালো গাঁথুনি কীভাবে নিশ্চিত করবেন?

বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সহজলভ্য উপকরণ হলো ইট। ইটের মডিউলার প্রকৃতির কারণে এটি অনেক স্থপতি আর প্রকৌশলীর কাছেই প্রিয়। তাই যুগ যুগ ধরে ইট ও মশলার মেলবন্ধনে গড়ে উঠছে আমাদের স্বপ্নের বাড়িগুলো।

বাড়ির কাজে হাত দেওয়ার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো ইট ও মশলা ঠিক পরিমাণে থাকার বিষয়টি। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের ভাষায় যাকে বলে ব্রিকওয়ার্ক। আজকে এই ব্রিকওয়ার্ক নিয়ে সংক্ষেপে কিছু কথা বলা যাক।

প্রকারভেদ

আমাদের দেশে ব্রিক ওয়ার্ক দুই রকমের হয়ে থাকে।

 ১. অর্ডিনারি ব্রিক ওয়ার্ক   

 ২. পয়েন্টিং ব্রিক ওয়ার্ক

অর্ডিনারি ব্রিক ওয়ার্ক 

আমাদের দেশে সাধারণত এই ব্রিকওয়ার্কই বহুলভাবে প্রচলিত। ইট দিয়ে গাঁথুনি নির্মাণের পর সেই পৃষ্ঠ বা সারফেসকে এদেশের মৌসুমী ঝড় বা বিরূপ আবহাওয়া থেকে রক্ষা করতে প্লাস্টার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এই প্লাস্টার সৌন্দর্য বর্ধনেও কাজে দেয় বেশ চমৎকারভাবেই।     

পয়েন্টিং ব্রিক ওয়ার্ক

এই ব্রিকওয়ার্কে জয়েন্টের উপর প্লাস্টার দেওয়া হয় না। গাঁথুনি পরবর্তী জয়েন্টগুলোকে পয়েন্টিং করে দেওয়া হয়, যা সাধারণত ১০ ইঞ্চির হয়। এক্ষেত্রে মর্টার বা মশলা খুব হালকা লেয়ারে শক্তভাবে থাকে এবং বাইরে মসৃণ সারফেসের রূপ দেওয়া হয়ে থাকে।

নিয়মাবলী

ইটের গাঁথুনির কাজ শুরু করার আগে কিছু প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন, যা গাঁথুনিকে মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী করতে সাহায্য করে।  চলুন এখন জেনে নেওয়া যাক গাঁথুনির কাজ শুরু হওয়ার আগে আমাদের যা যা করতে হবে।

ব্রিকওয়ার্কের ব্রিক বা ইটকে অবশ্যই ভালো মানের হতে হবে। অর্থাৎ শক্ত, মজবুত আর সেইসাথে সুষমভাবে পোড়ানো, সঠিক আকার-আকৃতি এবং রং বিশিষ্ট ইট ব্যবহার করতে হবে। ইটকে প্রথমেই ভালোভাবে ভিজিয়ে রাখতে হবে। ইটের কাজ শুরু হওয়ার একদিন আগে পানি থেকে ইটকে তুলে ফেলতে হবে। এই কাজটি করা হয় যাতে শুষ্ক ইট সিমেন্ট মসলার পানি শোষণ না করতে পারে। কেননা পানি শোষণ করা হলে সিমেন্টের হাইড্রেশন বন্ধ হয়ে যায় যার ফলাফল দূর্বল গাঁথুনি। 

এছাড়াও ইটের মাঝে বেশি পানি থাকায় সিমেন্ট মশলা নরম হয়ে জয়েন্ট থেকে ইটের গা বেয়ে পড়ে যেতে পারে। মসলার পুরুত্ব কম হলে এর ফলে গাঁথুনিও দূর্বল হবে, গাঁথুনি ভার্টিক্যালি শল আউটের সম্ভাবনা বেশি থাকবে। এমনকি এই অবস্থায় মিস্ত্রিও কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করবে কেননা এতে হাতের ক্ষয় হওয়ার ঝুঁকি বেশিই থাকে।    

ইট ভিজানোর পর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বালি চালা এবং ভেজানো। যদিও আর্থিক ও সময়ের ব্যাপার বিবেচনায় এই কাজ এদেশে কম করা হয়, কিন্তু কাজের মান ভালো চাইলে বালিকেও ইটের মতো ভিজিয়ে রাখার পর চেলেও নিতে হবে। এরপর আসবে চিপিং। ব্রিকওয়ার্ক শুরু করার আগে সকল ধরনের সারফেস ভালোভাবে চিপিং করা খুবই জরুরি। চিপিং এর পর ফ্লোরকে ভালোভাবে পানি দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে পরিষ্কার করার পরেই গাঁথুনির কাজে হাত দেওয়া যাবে। ইট বিছানোর আগে ফ্রগ মার্ক যাতে উপরে থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এক দিনে গাঁথুনি ১.৫ মিটারের বেশি হওয়া উচিত না। তবে ভবিষ্যতে দেয়াল বাড়ানোর পরিকল্পনা থাকলে দেয়াল টুথিং করে কাজ বন্ধ রাখা যেতে পারে।   

এবার আসা যাক মশলার ব্যাপারটিতে। পানি দেওয়ার আগে ড্রাই সিমেন্ট এবং বালির ভালোভাবে মিক্সিং করাটা ভীষণ জরুরি। মনে রাখতে হবে ভালো মিশ্রণেই ভালো গাঁথুনি নিশ্চিত হবে। সাধারণত ৫ ইঞ্চি গাঁথুনিতে ১:৪ অথবা ১:৫ এবং ১০” গাঁথুনিতে ১:৬ অথবা ১:৫ মশলা প্রস্তুত করতে হয়। মশলা নরম থাকা অবস্থায় ১২ মিলিমিটার গভীরে রেকিং করা হয়, এতে প্লাস্টারিং বা পয়েন্টিং এ সুবিধা হয়। যদি দেয়াল দুই বা ততোধিক ইটের পুরু হয়,  তবে মশলা প্রত্যেক কোর্সে বেডিং এবং ফ্লাশিং ছাড়াও গ্রাউটিং করতে হবে।

গাঁথুনির কাজ শেষ হলে চুন মশলার ক্ষেত্রে দুই-তিন সপ্তাহ এবং সিমেন্ট মশলার ক্ষেত্রে এক-দুই সপ্তাহ কিউরিং করা লাগবে। 

সতর্কতা 

গাঁথুনির কাজে যেসব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে:

১. সম্পূর্ণ বেডে ভালো করে মশলা বিছিয়ে ধীরে ধীরে চাপ দিয়ে ইট বসাতে হবে যাতে ভালো করে মশলার সাথে ইট লেগে যায়।

২. ইটের গাঁথুনির কাজে ইংলিশ বন্ড ব্যবহার করা ভালো। 

৩. ইটের গাঁথুনির পর প্লাস্টারিং এর কাজ কমপক্ষে ৪ সপ্তাহ পর শুরু করা উচিৎ।

৪. প্রথমে দেয়ালের দুই প্রান্তের ইট বসানোর পর সুতা ধরে মাঝের দেয়ালের ইট বসাতে হবে। সুতা টেনে অ্যালাইনমেন্ট ঠিক রাখা হয়, যাতে সব সমান থাকে।  

লোড বহনকারী সাপোর্ট হিসেবে কাজ করা ছাড়াও গাঁথুনির কারণে বড় জায়গার লোড ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়। সেই সাথে আগুন বা আবহাওয়ার সরাসরি প্রভাব থেকেও ইন্টেরিয়রকে অনেক ক্ষেত্রে রক্ষা করে। সঠিকভাবে গাঁথুনি সম্পন্ন হওয়া ইটের দেয়াল তাপ এবং শব্দ প্রতিরোধ করার পাশাপাশি ব্যক্তিগত গোপনীয়তাও রক্ষা করে৷ কাজেই গাঁথুনি ভালো হওয়া খুবই জরুরি৷ এজন্য উপযুক্ত গাঁথুনি নিশ্চিতকরণে উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে ভবিষ্যতে বাড়ির কাজে হাত দেওয়া সকলকেই।          

কংক্রিট মিক্সার: কেন ব্যবহার করবেন?

নির্মাণ কাজের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো কংক্রিট। কংক্রিট হলো সিমেন্টের সাথে অন্যান্য উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত একটি জটিল সংমিশ্রণ। এক্ষেত্রে পানির সাথে অন্যান্য উপাদানের সঠিক মিশ্রণের উপর নির্ভর করে কংক্রিটের গুণগত মান। তাই সঠিক উপায়ে কংক্রিট মিক্সিং ভালো কংক্রিট পাওয়ার পূর্বশর্ত।

কংক্রিট মিক্সিংয়ের কাজটি প্রথাগতভাবে মেশিন ছাড়াই করা হতো, যাতে প্রয়োজন প্রচুর সময় এবং সুনিপুণ দক্ষতা। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে এই কষ্টসাধ্য কাজটিকে সহজ করার জন্য এসেছে কংক্রিট মিক্সার। কংক্রিট মিক্সার হলো সেই মেশিন যেখানে সিমেন্ট, পানি ও অন্যান্য উপাদান একসাথে নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশ্রিত করা হয় এবং মিশ্রণের ঘনত্ব ঠিক রেখে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঢালা হয়।

এমনকি সাইটের নির্দিষ্ট জায়গায় কংক্রিট ছিটানোর ক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিক মিক্সারও বর্তমানে পাওয়া যায়। প্রয়োজনীয়তা অনুসারে বিভিন্ন সাইজের এবং প্রকারের মিক্সার বিদ্যমান। ছোট এবং মাঝারি কাজের ক্ষেত্রে সাধারণত বহনযোগ্য মিক্সার এবং বড় কাজের ক্ষেত্রে সাধারণত সাইটে মিক্সিংয়ের প্ল্যান্ট তৈরি করে নেওয়া হয়।

কংক্রিট মিক্সারের প্রকারভেদ

আমাদের দেশে ব্যবহৃত মিক্সার মেশিন সাধারণত দুই প্রকার-

১. অবিরাম মিক্সার (Continuous Mixer)

২. সবিরাম মিক্সার (Batch Mixer)

 অবিরাম মিক্সার

সাধারণত ব্রিজ, টানেল এবং বড় প্রজেক্টগুলোতে অবিরাম মিক্সার ব্যবহৃত হয়। নাম থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, এই ধরনের মিক্সার অবিরাম কাজ করে যায় এবং সাইটে বিরামহীনভাবে কংক্রিট উৎপাদন করতে থাকে। এটাতে অনবরত কাঁচামাল সরবরাহের প্রয়োজন হয়। এ মেশিনে মোট তিনটি অংশ থাকে- কাঁচামাল সরবরাহের জন্য গ্রহণ করার অংশ, মিক্সিংয়ের অংশ এবং উৎপাদিত কংক্রিট বের করে দেওয়ার অংশ। তবে এক্ষেত্রে কংক্রিটে বাতাসের পরিমাণ নির্ণয় সহজ হয় না বিধায়, তদারকির প্রয়োজন হয়।

সবিরাম মিক্সার

ব্যাচ মিক্সারের ক্ষেত্রে সাধারণত প্রতি ব্যাচ হিসাবে কংক্রিট মিক্স উৎপাদিত হয়। এ মেশিনে ঘূর্ণায়মান ব্লেডের সমন্বয়ে গঠিত ড্রামে বা প্যানে কংক্রিট মিশ্রণের কাজ করা হয়। ঘূর্ণনের গতি, ড্রামের বাঁকানোর পরিমাণ এবং ব্লেডের আবর্তন কোণ এই ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণযোগ্য।

সাধারণত ছোট এবং মাঝারি ধরনের কনস্ট্রাকশন সাইটের জন্য এই ধরনের মিক্সার ব্যবহার উপযোগী।

ব্যাচ মিক্সার আবার দুই ধরনের হয়। ড্রাম (Drum Mixer) এবং প্যান মিক্সার (Pan Mixer)।

ড্রাম মিক্সার

ড্রাম মিক্সারে কোণাকৃতি ড্রাম থাকে যাতে এক সেট বা একাধিক সেট ব্লেড সংযুক্ত থাকে, যেগুলো মিশ্রণ প্রস্তুত করা, তৈরি করা এবং উৎপাদিত কংক্রিট বের করে দেওয়ার কাজ করে থাকে। ড্রাম মিক্সার আবার তিন প্রকারের হয়ে থাকে।

১. টিল্টিং ড্রাম মিক্সার (Tilting Drum Mixer)

২. নন-টিল্টিং ড্রাম মিক্সার (Non-Tilting Drum Mixer)

৩. রিভার্সিং ড্রাম মিক্সার (Reversing Drum Mixer)

নন-টিল্টিং ড্রামের ক্ষেত্রে ড্রামটি তার অনুভূমিক অক্ষের চারদিকে ঘুরতে থাকে। এক্ষেত্রে দুটি ভিন্ন পথে কাঁচামাল দেওয়া ও বের করা হয়। রিভার্সিং ড্রাম নন-টিল্টিংয়ের মতোই, তবে এক্ষেত্রে কাঁচামাল দেওয়া ও বের করার জন্য একই পথ ব্যবহৃত হয়। টিল্টিং ড্রাম মিক্সারে মেশিনটি একটি নির্দিষ্ট কোণ বরাবর উপরে নিচে কাত হতে পারে।

প্যান মিক্সার

প্যান মিক্সারের ক্ষেত্রে ড্রামের পরিবর্তে সিলিন্ডার আকৃতির প্যান ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে প্যানটি নির্দিষ্ট জায়গায় অপরিবর্তিত থাকে এবং উলম্ব অক্ষ বরাবর ব্লেডটি ঘুরতে থাকে।

মিক্সার মেশিনের ব্যবহার

ব্যাচ মিক্সার

  • হাতে মিশ্রণের চেয়ে অনেকগুণ সময়সাশ্রয়ী এবং কম কষ্টসাধ্য।
  • মিশ্রণের গুণগত মান হাতে মিশ্রণের চেয়ে বেশ ভালো।
  • সুষম মিশ্রণের কারণে এক্ষেত্রে কংক্রিট বেশ শক্তিশালী হয়।
  • এটি তৈরি সময়সাশ্রয়ী হওয়ার কারণে ঢালাইয়ে বেশি সময় পাওয়া যায়।
  • বিভিন্ন অনুপাতের মিশ্রণ তৈরি করা সম্ভব।

অবিরাম মিক্সার

  • যেখানে কম স্লাম্পের কংক্রিট প্রয়োজন, যেমন- রাস্তার পেভমেন্ট, সেখানে সাধারণত এটি ব্যবহৃত হয়।
  • নির্মাণকাজের ক্ষেত্রে বেশ সময়সাশ্রয়ী, তবে কংক্রিট আনলোডিংয়ের প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ।

বর্তমানে বাংলাদেশে নির্মাণকাজের সিংহভাগ ক্ষেত্রেই মেশিন মিক্সড কংক্রিট ব্যবহার করা হয়। সেক্ষেত্রে যা বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন তা হলো:

  • মিক্সার মেশিনের কাছে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, মালামাল প্রস্তুত রাখতে হবে।
  • মিক্সার মেশিনের কাছে এক ড্রাম পানি রাখতে হবে।
  • এগ্রিগেটে ময়লা থাকলে তা অবশ্যই পরিষ্কার রাখতে হবে।
  • সিমেন্টের সাথে অনুপাত ঠিক রেখে এগ্রিগেট পরিমাপের যন্ত্র প্রস্তুত রাখতে হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশে বীম-কলাম নির্মাণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে রেডিমিক্স কংক্রিটের ব্যবহার হলেও স্থানভেদে রেডিমিক্স কংক্রিট অপ্রতুল হওয়ায়, সাইটে কংক্রিট মিশ্রণই এখনও ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। আর এক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে মিক্সিং মেশিনের ব্যবহার। মিক্সিং মেশিনের বদৌলতে প্রথাগত উপায়ে কংক্রিট মিশ্রণের কাজ প্রতিস্থাপিত হয়ে দ্রুততম সময়ে নিখুঁত কংক্রিট উৎপাদিত হয়, ফলে এই পদ্ধতিতে সময় ও কষ্ট লাঘব হওয়ার মাধ্যমে নির্মাণকাজে এসেছে নতুন মাত্রা।

ক্লে-ব্রিক ও গ্রিন কনস্ট্রাকশনের আদ্যোপান্ত

মানুষ সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে মাটি ব্যবহার করে বাসা তৈরি করে থাকে। সভ্যতার ক্রমোন্নতির সাথে সাথে এবং মানুষের বাসা বাড়ি নির্মাণের সুবিধার জন্য মাটিকে রূপান্তর করে সেটাকে ব্যবহারযোগ্য করার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে সবচেয়ে সহজে ব্যবহারযোগ্য উপকরণের সন্ধান পায় তারা। সেটা হলো ইট, যা আজকে নির্মাণের পরিভাষায় ক্লে-ব্রিক নামে সর্বাধিক পরিচিত।

ইটের মড্যুলারিটি, ব্যবহারের সুবিধা, কম খরচ, টেকসই ধরন এবং আকৃতি সব কিছু মিলিয়ে একে করে তুলেছে সর্বাধিক পরিচিত এবং ব্যবহৃত নির্মাণ সামগ্রী। টেকসই হবার প্রসঙ্গ যখন উঠল, তখন প্রথমে যে কথাটা মাথায় আসে তা হলো, গ্রিন বিল্ডিং। গ্রিন বিল্ডিং কী কী গুণাগুণের জন্য গ্রিন হয় তা আমরা কমবেশি সবাই জানি। আমরা আজকে গ্রিন বিল্ডিং বানানোর একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট- গ্রিন কনস্ট্রাকশন নিয়েও আলোচনা করব।

ক্লে-ব্রিক কী? 

ক্লে-ব্রিক হলো একপ্রকারের ইট, যা মাটি কেটে কম্প্রেস করে সেটাকে ছাঁচে রেখে উপযুক্ত আকৃতি প্রদান করে তৈরি করা হয়। এটা মানুষের তৈরি করা অন্যতম প্রাচীন নির্মাণসামগ্রী। নির্মাণ ও ব্যবহারের সহজতা, সহজলভ্যতা, টেকসই প্রকৃতি, আবহাওয়া ও দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা ইত্যাদি গুণাগুণের জন্য এটি সর্বাধিক প্রচলিত ও পরিচিত একটি নির্মাণ সামগ্রী। দালানের ভেতরে-বাইরে থেকে শুরু করে এমনকি রাস্তার পেভিং ম্যাটেরিয়ালেও ক্লে-ব্রিক ব্যবহার করা হয়। এর ম্যাটেরিয়াল হিসেবে ব্যবহারের বহুমাত্রিকতা একে আলাদা একটা পরিচিতি দিয়েছে।  

কীভাবে তৈরি হয়?

 ক্লে ব্রিক খুব সহজেই মাটি ও পানি মিশিয়ে তৈরি করা হয়। এরপরে মিশ্রণটিকে পছন্দসই মাপের ছাঁচে ঢেলে সেটাকে শক্ত করে আকৃতি প্রদান করতে হয়। এই মাটি যাতে আগাছা বা কংকরমুক্ত হয় সেদিকে খুব সচেতনভাবে খেয়াল রাখতে হবে। নাহলে এই ইটের অর্গানিক কম্পোনেন্ট বাসা-বাড়ির ক্ষতি করবে। এই মিশ্রণ তৈরির জন্য যে পানি ব্যবহার করা হয়, সেটাও বিশুদ্ধ ও পরিষ্কার পানি হতে হবে। সাধারণত মিহি দানার টপসয়েল ব্যবহার করা হয় এক্ষেত্রে। একে ছাঁচে ঢেলে আকৃতি প্রদান করে এরপরে সেটাকে সাধারণভাবে রোদে শুকাতে হয়। আজকাল ইন্ডাস্ট্রিতে রোদে শুকানো হয় না, আগে চুল্লিতে উত্তপ্ত করে সেটাকে শুকিয়ে এর পরে সেটা রোদে রাখা হয়। চুল্লীতে দেওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে অতি দ্রুত পোড়ানো না হয়। সেক্ষেত্রে যেই সমস্যাটা হয় তা হলো, দ্রুত সংকোচন ঘটে। ফলে তা ফেটে যেতে পারে। এই জন্য কারখানায় চুল্লী পরিমিত তাপমাত্রায় রাখতে হবে।

 

 ক্লে-ব্রিকের সুবিধা 

  – সাশ্রয়ী 

 – সহজে উৎপাদনযোগ্য

 – দীর্ঘস্থায়ী

 – নির্মাণের জন্য সুবিধাজনক ব্যবহার

 – মডুলার নির্মাণ সামগ্রী, তাই অধিকাংশ স্ট্রাকচারের নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা যায়

 – বিভিন্ন আকৃতিতে তৈরি করা যায়

 – বিভিন্ন ক্ষেত্রে, যেমন- দালানের অভ্যন্তরের দেয়াল, বাইরের দেয়াল, পেভমেন্ট, জলাশয়ের ঘাট ইত্যাদি নানাবিধ কাজে ব্যবহৃত হয়। 

অসুবিধা

 – জলীয়বাষ্প বাতাস থেকে শোষন করে নেয় ফলে সময়ের সাথে সাথে দুর্বল হয়ে যায়

 – ভঙ্গুর

 – মাটি ও পানির সাথে অর্গানিক উপকরণ জমে স্ট্রাকচার দুর্বল করে দিতে পারে

 – সঠিক ব্যবহার না জানলে ভুল প্রয়োগবিধির জন্য ক্ষতি হতে পারে দালানের

 এবার আসুন আমরা গ্রিন কনস্ট্রাকশন সম্পর্কে জেনে নিই।

 

গ্রিন কনস্ট্রাকশন কী?

 একটি দালানের জীবদ্দশার সম্পূর্ণ সময়কাল ধরে রিসোর্স এফিসিয়েন্ট, এনার্জি এফিসিয়েন্ট এবং পরিবেশ-বান্ধব কিনা তার ভিত্তিতে দালানটিকে গ্রিন বিল্ডিং হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। প্ল্যানিং পর্যায় থেকে শুরু করে নির্মাণ, অপারেশন, মেইন্টেনেন্স এবং সবশেষে ডেমোলিশন পর্যন্ত যদি একটি দালান রিসোর্স এফিসিয়েন্ট, পরিবেশ বান্ধব এবং টেকসই হয় তাহলেই তাকে আমরা গ্রিন বিল্ডিং বলে আখ্যায়িত করে থাকি। এই জন্য নির্মাণ পর্যায়ে যাতে একেবারেই কম কার্বন নিঃসরণ হয় এবং সর্বনিম্ন ওয়েস্ট ম্যাটেরিয়াল বের হয় সেজন্য গ্রিন কনস্ট্রাকশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

 এর জন্য প্রয়োজন-

 – স্মার্ট, আধুনিক টেকনোলজির ব্যবহার, যাতে সময় ও লোকবলে সাশ্রয় হয়

 – গ্রিন তথা পরিবেশ বান্ধব নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা

 – কনস্ট্রাকশন সিস্টেমকে প্ল্যানিং এর আওতায় আনা

 – অপ্রয়োজনীয় কোন ভাংচুর না করা যাতে ম্যাটেরিয়াল পুনরায় ব্যবহার করা সম্ভব হয়

 – যথাসম্ভব ম্যাটেরিয়াল পুনরায় ব্যবহার করা

 – পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ কনস্ট্রাকশন পিরিয়ডে অপচয় না করা

 – দালানের ভেতর পর্যাপ্ত আলো বাতাস সুনিশ্চিত করা যাতে করে এনার্জি সাশ্রয় হয়

 – কনস্ট্রাকশন ওয়েস্ট যথাযথভাবে ডিসপোজ করা

 – কনস্ট্রাকশন শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা

 – কনস্ট্রাকশন সাইটের আশেপাশের লোকালয়ে মানুষের যাতে সমস্যা না হয় সেটির প্রতি যত্নশীল হওয়া 

 – নন-টক্সিক, নন-ভোলাটাইল অর্গানিক ও লোকাল ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা

 – ইন্টারন্যাশনাল কোড, LEED-এর নিয়মকানুন মেনে সঠিকভাবে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা উপযুক্ত এক্সপার্টের সহায়তায়

 – বিল্ডিং যাতে সহজে মেইন্টেনেন্স এর যোগ্য হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা

 – দালানের নির্মাণ যাতে এনার্জি এফিসিয়েন্ট হয় সেজন্য সোলার প্যানেল, ফ্লো কন্ট্রোলিং ট্যাপ ইত্যাদি আধুনিক উপকরণ ব্যবহার করা

গ্রিন বিল্ডিং টেকনোলজি ও কনস্ট্রাকশন পদ্ধতি কেবল পরিবেশবান্ধব নয়, দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক এবং বিশ্বের বিভিন্ন নির্মাণ সংস্থা এটি গ্রহণ করছে। এটি আধুনিক উন্নয়নের একটি প্রধান উদাহরণ যা ভবিষ্যতের প্রজন্মের প্রয়োজনের সাথে আপস না করে বর্তমানের চাহিদা পূরণ করে। সেইসাথে এই পদ্ধতি বিপুল পরিমাণ শক্তি সঞ্চয় করতে সহায়তা করে, যা পরে অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে, ফলে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহারকে হ্রাস করতে সহায়তা করে। গ্রিন বিল্ডিং টেকনোলজি উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য আশীর্বাদ হিসাবে প্রমাণিত হবে, কারণ এটি শক্তি খরচ সীমাবদ্ধ করতে এবং টেকসই উন্নয়নের প্রচারে সহায়তা করে।

কংক্রিট মিশ্রণ: অনুপাত, মশলা ও গ্রেড

আধুনিক নির্মাণ কাজ এবং স্থাপত্য কাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো কংক্রিট। বাড়ির স্ল্যাব, দেয়াল, কলাম, সুউচ্চ দালান-কোঠা এসব ছাড়াও রাস্তাঘাট কিংবা ব্রিজ বানানোর অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ কংক্রিট। লোহার ডিফর্মড বার-এর উপরে ঢালাই করে এর ভারবাহী ক্ষমতা বহুগুণে বাড়ানো যায়।

এছাড়া একে ফর্মার মাধ্যমে ইচ্ছামত আকৃতিতে মোল্ড করে নেওয়া যায়। এসব সুবিধার জন্য পৃথিবীর সর্বাধিক ব্যবহৃত অন্যতম নির্মাণ সামগ্রী হলো কংক্রিট। আসুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে সাইটে কংক্রিট বানাতে হবে এবং ব্যবহার করতে হবে।

কংক্রিট প্রস্তুতি

কংক্রিট কোনো একক উপকরণ নয়। সিমেন্ট, বালু, ইটের খোয়া কিংবা পাথরের টুকরার সাথে উপযুক্ত পরিমাণে পরিষ্কার পানি মিশ্রিত করে তৈরি করা হয় কংক্রিট। এই উপকরণের সাথে আরও কিছু কেমিক্যাল মেশানো হয় অনেক সময় শুকানোর দ্রুততার চাহিদার জন্য।

আবার বিভিন্ন গ্রেডের কনক্রিটের জন্য এদের মিশ্রণের অনুপাতও বিভিন্ন রকম হয়। এই মিশ্রণগুলোর স্যাম্পল বানিয়ে সেটি ল্যাবে ওয়েট টেস্ট করতে হয়, যাতে তা কত ভর নিতে পারে সেটা বোঝা যায়। এরপর উপযুক্ত মিশ্রণ ঠিক করার পরে ল্যাবের উপদেশ অনুসারে মিশ্রণ বানিয়ে সাইটের জন্য কনক্রিট মিশ্রণ প্রস্তুত করা হয়। সাইটে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, লোকবল, সময় ও বাজেটের উপর ভিত্তি করে এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তির দূরদৃষ্টির উপর ভিত্তি করে কেমিক্যাল ব্যবহার করার বিষয়টি স্থির করা হয়।

কংক্রিটের গ্রেড

ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট কিংবা কমার্শিয়াল প্রজেক্টে প্রজেক্টভেদে ভার বহন করার শক্তি একেক রকম লাগে। সেজন্য একেক প্রজেক্টে একেক শক্তির কংক্রিট লাগে। সেই প্রয়োজনের ভিত্তিতেই মিশ্রণ প্রস্তুত করা হয়।

কংক্রিটের শক্তি ও মিশ্রণের উপর ভিত্তি করে কনক্রিটের গ্রেড স্থির করা হয়। স্যাম্পল কংক্রিটের টুকরা ২৮ দিন ধরে কিউর করে শুকানোর পরে সেটি ল্যাবের টেস্টের জন্য উপযুক্ত হয়। সেটি নিয়ে পরীক্ষা করে স্থির করা হয় স্যাম্পলটি কোন গ্রেডের। এই গ্রেড নির্ধারণ করার জন্য প্রচলিত স্ট্যান্ডার্ড আছে বিভিন্ন রকমের। যেমন- ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড, ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড। ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড M দিয়ে প্রকাশ করা হয় যার মানে মিশ্রণ। আর ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ডে C দিয়ে প্রকাশ করা হয়, যা দিয়ে কম্প্রেসিভ স্ট্রেংথ বোঝানো হয়। আসুন ইন্ডিয়ান গ্রেডে বিভিন্ন গ্রেডের কনক্রিট মিশ্রণ এবং এতে সিমেন্ট, বালি ও খোয়ার অনুপাত দেখে নেই।

কংক্রিটের গ্রেডমিশ্রণের অনুপাত (সিমেন্ট : বালি : মশলা)চাপ শক্তি
MPa (N/mm2)psi
কংক্রিটের গ্রেড
M5১ : ৫ : ১০৫ MPa৭২৫ psi
M7.5১ : ৪ : ৮৭.৫ MPa১০৮৭ psi
M10১ : ৩ : ৬১০ MPa১৪৫০ psi
M15১ : ২ : ৪১৫ MPa২১৭৫ psi
M20১ : ১.৫ : ৩২০ MPa২৯০০ psi
কংক্রিটের স্ট্যান্ডার্ড গ্রেড
M25১ : ১ : ২২৫ MPa৩৬২৫ psi
M30নকশাকৃত মিশ্রণ৩০ MPa৪৩৫০ psi
M35নকশাকৃত মিশ্রণ৩৫ MPa৫০৭৫ psi
M40নকশাকৃত মিশ্রণ৪০ MPa৫৮০০ psi
M45নকশাকৃত মিশ্রণ৪৫ MPa৬৫২৫ psi
উচ্চ শক্তির কংক্রিট গ্রেড
M50নকশাকৃত মিশ্রণ৫০ MPa৭২৫০ psi
M55নকশাকৃত মিশ্রণ৫৫ MPa৭৯৭৫ psi
M60নকশাকৃত মিশ্রণ৬০ MPa৮৭০০ psi
M65নকশাকৃত মিশ্রণ৬৫ MPa৯৪২৫ psi
M70নকশাকৃত মিশ্রণ

কোন কাজের জন্য কোন গ্রেড?

কাঠামোগত নকশার প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে কংক্রিটের নির্মাণের গ্রেড নির্বাচন করা হয়। দুটি ধরনের কংক্রিট মিশ্রণ রয়েছে, নমিনাল মিশ্রণ এবং নকশাকৃত বা ডিজাইন মিশ্রণ।

নমিনাল মিশ্রণ কংক্রিট হলো সেই গ্রেডের কংক্রিট, যা সাধারণত ছোট স্কেল নির্মাণ এবং ছোট আবাসিক ভবনের জন্য ব্যবহৃত হয় এবং যেখানে কংক্রিটের খরচ বেশি হয় না। নমিনাল মিশ্রণ সাধারণত কংক্রিট নির্মাণের সময় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন মানের নিয়ন্ত্রণ সমস্যার বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য সুবিধাজনক।

ডিজাইন মিক্স কংক্রিট হলো বিভিন্ন ল্যাব পরীক্ষা থেকে নির্ধারিত উপযুক্ত অনুপাতে মিশ্রিত কংক্রিট। নকশাকৃত মিক্স কংক্রিটের ব্যবহারের জন্য উপাদান নির্বাচন, মিশ্রণ, পরিবহন এবং কংক্রিটের স্থাপনের সময় ভালো মান নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। এই ধরনের কংক্রিটে স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য উপাদানের উপর ভিত্তি করে মিশ্রণের অনুপাত সরবরাহ করা হয় এবং বড় আকারের কংক্রিটের নির্মাণ চালিত হলে সেখানে সরবরাহ করা হয়। বড় কংক্রিট নির্মাণ প্রকল্পগুলো ডিজাইন মিক্স কংক্রিট ব্যবহার করে। যেমন- ব্রিজ, রাস্তাঘাট ইত্যাদি ক্ষেত্রে।

নির্মাণকাজে কংক্রিটের গুরুত্ব অপরিসীম। এর সুষ্ঠু মিশ্রণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায় দৃষ্টিনন্দন, সুস্থিত এবং দীর্ঘস্থায়ী বাসাবাড়ি ও দালানকোঠা নির্মাণ। এজন্য সঠিক নিয়ম কানুন মেনে এবং বিশেষজ্ঞের সরাসরি তত্ত্বাবধানে উপযুক্ত অনুপাতে এর মিশ্রণ সুনিশ্চিত করতে হবে ।

ভালো ইট, বালু চেনার উপায়

আমাদের দেশে নির্মাণ কাজ ইট আর বালু ছাড়া চিন্তাই করা যায় না। আপনার ইমারত তৈরিতে এগুলোকে অত্যাবশ্যকীয় ও মৌলিক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তাই গুণাগুণ সম্পন্ন উপাদান ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরী। আবার শুধু গুণাগুণ সম্পন্ন উপাদান ব্যবহার করলেই হবে না, এর ব্যবহারবিধিও জানাটা জরুরী। বাড়ির মালিক হিসেবে আপনার প্রকৌশলগত জ্ঞান না থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সামান্য সচেতন হলে আপনি নিজেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এই লক্ষ্যেই বাড়ি নির্মাণের কাজে ইট ও বালুর গুণাগুণ ও ব্যবহারবিধি উপস্থাপন করা হল।

ইট

বহু প্রাচীনকাল থেকেই নির্মাণ কাজে ইট ব্যবহার হয়ে আসছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মধ্যপ্রাচ্যে আগুনে পোড়া ইট তৈরি করা হয়েছিল। মাটিকে একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় কাঁচামালে রূপান্তর করে কাঁচা ইট তৈরি করা হয়। এই কাঁচা ইট তৈরিতে আয়তঘনক আকারের ছাঁচ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কাঁচা ইট রোদে শুকিয়ে আগুনে পোড়ানো হয় যা ঠাণ্ডা এবং আর্দ্র আবহাওয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে ও বেশ মজবুত প্রকৃতির হয়ে থাকে।  এছাড়া ইট পাথরের মত দীর্ঘস্থায়ী এবং মজবুত না হলেও এটি সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী হওয়ায় নির্মাণকাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

 

আধুনিককালে নির্মাণকাজে বিভিন্ন ধরণের ইট ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন: প্রথম শ্রেণীর ইট, পিকেট ইত্যাদি। এছাড়াও সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরণের ইট ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু ইমারত নির্মাণে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয় প্রথম শ্রেণীর ইট। যে কোন গাঁথুনির কাজে ব্যবহার করা হয় প্রথম শ্রেণীর ইট বিধায় এর গুণগতমানের উপর অনেকাংশে নির্ভর করে ইমারত কাঠামোর গুণগতমান।

১। ইট যেখানে তৈরি করা হয়, সে স্থানকে বলা হয় ইটের ভাটা। আমরা বাড়ি নির্মাণের জন্যে যে ইটগুলো ব্যবহার করব, সেগুলো কোন ইট ভাটায় তৈরি হয়েছে সেটা সম্পর্কেও ধারণা রাখতে হবে। কারণ, ইটের গুণাগুণ নির্দিষ্ট হয় এই ইট ভাটা থেকেই। যেমন:

ক) যে মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে ইট তৈরির কাজে, তা কোন রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে তৈরি। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইটের মাটির প্রধান রাসায়নিক উপাদানসমূহ হচ্ছে : সিলিকা, অ্যালুমিনা, লৌহ অক্সাইড, ম্যাগনেশিয়া, চুন ও ক্ষার। যদি এসব উপাদানের তারতম্য হয়, তবে তা ইটের গুণাগুণও ক্ষতিগ্রস্ত করে। লৌহকণা, পাথরকণা, দ্রবণীয় লবণ ও চুনাপাথর মিশ্রিত মাটি দিয়ে ভালো ইট তৈরি সম্ভব হয় না। তাই ইট কেনার আগে এলাকাভিত্তিক ইট ভাটার ধারণা নিতে হবে এটি জানার জন্য যে, কোন জায়গায় কাঁচামাল হিসেবে ভালো মাটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ভালো ইট কেনার পরও অনেক সময় লোনার সমস্যার কারণে ইমারতের স্থায়িত্ব কমে যায়।

খ) পোড়ানোর প্রক্রিয়াও গুরুত্বপূর্ণ। খুব বেশি পোড়ানো ইট যেমন ভালো না, তেমনি আধা পোড়ানো ইট দিয়েও নির্মাণকাজ ভালো হয় না। তাই সরাসরি ইটের ভাটা থেকে ইট কেনা উচিৎ। এতে ভালো ইট কেনা যায়

২। আপনি যেখান থেকেই ইট কিনেন না কেন, প্রত্যেকটি ইটের উপরে একটি ফ্রগ মার্ক থাকবে। প্রথমত, এটি কোন কোম্পানির তা এই ফ্রগ মার্ক থেকে জানা যায়। এছাড়া গাঁথুনির সময়ে এটি পার্শ্বীয় শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।

৩। প্রত্যেকটি প্রথম শ্রেণীর ইট অবশ্যই একই মাপ একই রঙ এর হতে হবে। বাংলাদেশে একটি প্রথম শ্রেণীর ইটের আকার ৯-১/২”X৪-১/২”X২-৩/৪” (২৪০ মিঃমিঃX ১১৫ মিঃমিঃX৭০ মিঃমিঃ)। এছাড়া ইটের গায়ে কোন ধরণের ফাটল বা বায়ুর বুদবুদের চিহ্ন থাকা যাবে না

good&bad brick

৪। খুব সহজে কিছু পরীক্ষা দ্বারা ইটের গুণাগুণ চিহ্নিত করা যায়। যেমন:

ক) দুইটি ইট দ্বারা ইংরেজি অক্ষর “T” এর মত তৈরী করে যদি ৪ ফুট উঁচু স্থান হতে শক্ত ও সমতল ভূমিতে ছেড়ে দেয়ার পর উপরের ইটটি যদি ভেঙ্গে যায়, তাহলে বুঝতে হবে ইট ভালো নয়। খেয়াল রাখতে হবে পরীক্ষাটি করার সময় ইট দু’টো এমনভাবে সংস্থাপন করতে হবে যেন উভয় ইটের ফ্রগ মার্ক সামনে থেকে দৃশ্যমান হয়।

brick test

খ) ধাতব পদার্থের আঘাত যেমন শোনায়, একটি ইটকে অন্য ইট দিয়ে আঘাত করলে যদি তেমন আওয়াজ হয়, তাহলে বুঝতে হবে ইটের মান ভালো।

গ) একটি ইটের গায়ে যদি পেরেক বা আঙুল দ্বারা দাগ দেয়া যায়, তাহলে বুঝতে হবে ইটের গুণগত মান খারাপ। যদি কোনো প্রকার দাগ না বসে, তাহলে বুঝতে হবে সেটি ভালো ইট।

৫। সাইটেই একটি ইটকে ভেঙ্গে পরীক্ষা করা যেতে পারে। যদি গঠনরীতি সরূপ হয় অর্থাৎ পোড়ানো সর্বত্র সমান এবং যতটা সম্ভব কম ও সমানভাবে ফাঁকা থাকে, তবে তাকে ভালো ইট বলা যাবে।

৬। একটি ভালো ইটের ওজন ৬ পাউন্ড বা ২.৭২ কেজি।

৭। উন্নত মানের ইট পানিতে ডোবালে সর্বোচ্চ ১৫% এর বেশি পানি শোষণ করতে পারে না। তাই সাইটে ইট পানিতে চুবিয়ে রেখে ওজন পরীক্ষা করে ভালো ইট সনাক্ত করা যেতে পারে।

৮। ব্যবহারবিধি:

ক) গাঁথুনির আগে ইট ভেজাতে হবে। ইটের পানি শোষণ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় না ভেজালে মশলার পানি শোষণ করে ফেলবে যা গাঁথুনির স্থায়িত্ব কমিয়ে দিবে।

খ) যে স্থানে গাঁথুনি করা হবে, সে স্থান অবশ্যই পরিষ্কার ও চিপিং করে নিতে হবে।

গ) গাঁথুনির লে আউট ও উলম্ব লাইন ঠিক আছে কিনা বারবার দেখে নিতে হবে।

ঘ) গাঁথুনির মাঝে ভালোভাবে মশলা ঢুকেছে কিনা দেখতে হবে। একটি ইটের উপর আরেকটি ইটের সংযোগস্থল যেন ১০ মিঃমিঃ এর বেশি না হয়।

ঙ) যেদিন গাঁথুনি করা হচ্ছে সেদিনের তারিখ স্থাপনার দেয়ালের গায়ে লিখে দিলে ভালো। কারণ ৭ কিউরিং করার সময় সহজে বোঝা যায় কতদিন পানি দেওয়া হয়েছে।

Brick placement

বালি

নির্মাণ কাজের জন্যে বলতে গেলে বালি ছাড়া কোন কাজ করাই সম্ভব নয়। ঢালাই, ইটের গাঁথুনি, প্লাস্টার ইত্যাদি কাজে বহুলভাবে এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটি মূলত সিলিকা থেকে পাওয়া যায়। সাধারণত সমুদ্র বা নদীর উপকূলে, সমুদ্রের তলায়, নদীয় তলায় বালি পাওয়া যায়। এই বালিকে আমরা তিনভাগে ভাগ করতে পারি। এগুলো হচ্ছে: পিট বালি, নদীর বালি, সমুদ্রের বালি। পিট বালি সাধারণত ভরাট করার কাজে ব্যবহৃত হয়। সমুদ্রের বালিতে ক্ষতিকর লবণ থাকায় ব্যবহারের অযোগ্য। তাই নির্মাণকাজে মূলত নদীর বালি ব্যবহার করা উচি। এখানে আমরা প্লাস্টার বা গাঁথুনির জন্য ব্যবহৃত চিকন বালি নিয়ে আলোচনা করব।

 

১। নির্মাণ কাজে বালি ব্যবহার করার আগে কোন প্রকার ময়লা, কাদামাটি যেন না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। নির্মাণ কাজের পূর্বে বালি ভালভাবে ধুয়ে নিতে হবে যেন বালির সাথে সংযুক্ত কাদা, ময়লা, আগাছা, ডালপালা, নুড়ি বের হয়ে যায়।

Net

২। খুব সহজে কিছু ক্ষেত্রে পরীক্ষা দ্বারা ইটের গুণাগুণ চিহ্নিত করা যেতে পারে। যেমন:

ক) এক হাতের তালুতে বালি নিয়ে অন্য হাত দিয়ে ঘষলে যদি হাতের তালুতে ময়লা লেগে যায়, তবে বুঝতে হবে বালি ভালো নয়।

খ) সামান্য বালি মুখে নিয়ে লবণাক্ততা পরীক্ষা করা যেতে পারে।

৩। একটি কাচের গ্লাসে ১/৪ ভাগ বালি দ্বারা এবং ৩/৪ ভাগ পানি দ্বারা পূর্ণ করে ঝাঁকানোর পর স্থির করলে যদি বালির স্তর একেবারে নিচে থাকে, তবে বুঝতে হবে বালি ভালোরঙহীন হলেও ভালো বালি বলে চিহ্নিত হবে।

bottle sand

৪। ৩% কস্টিক সোডা সল্যুশনের সাথে অল্প কিছু বালি যোগ করে একটি বোতলে কিছুক্ষণ ঝাঁকিয়ে ২৪ ঘন্টা ঐ অবস্থায় রেখে দিতে হবে। যদি বোতলে রক্ষিত দ্রব্যের রং পরিবর্তন হয়ে বাদামী হয়, তবে বুঝতে হবে বালিতে রাসায়নিক পদার্থ বিদ্যমান।

৫। আমরা সাইটে বালি ট্রাকে করে নিয়ে আসি। অনেক সময় অল্প শিক্ষিত মানুষ এই বালি গ্রহণ করে থাকে। সেই ব্যক্তিকে বোঝাতে হবে যে এক ট্রাক শুকনো বালির চেয়ে এক ট্রাক ভেজা বালির ওজন অনেক বেশি। তাই রাতের বেলা বালি সাইটে আসলে অবশ্যই তা শুকনো/ভেজা তা দেখে নিতে হবে। কারণ সম্পূর্ণ শুকনো বালিতে পানি মেশালে বালির আয়তন বৃদ্ধি পায়। এই বৃদ্ধির ফলে আমরা পরিমাণে কম বালি পাব।

৬। সাইটে পানি দিয়ে পরিশোধনের পর আগে শুকাতে হবে। ভিজা বালি নির্মাণ কাজে ব্যবহার করলে তা স্থায়িত্ব কমিয়ে দেয়।

৭। ল্যাবরেটরিতে বালির দানার গ্রেডিং নিরূপণ করা হয়। এই পরীক্ষার ফলাফলকে Fineness Modulus (FM) দ্বারা প্রকাশ করা হয়। নির্মাণ কাজের জন্য উপযুক্ত চিকন বালির এফ এম ১.২ থেকে ১.৫ হতে হবে।

 

ইট নিয়ে প্রয়োজনীয় কথা

বাড়ি তৈরির অন্যতম প্রধান উপাদান হলো ইট। বাজারের অন্য সব পণ্যের মত ইটেরও ভালো-মন্দ আছে। যে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আপনার জমিতে বাড়ি নির্মাণ করছে, তারা ভালো নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করছে কি না, তা তদারক করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে কোন নির্মাণ সামগ্রী ভালো তা জানতে আপনি বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে পারেন। সে সুযোগ না থাকলে আপনার জন্য আমাদের কিছু পরামর্শ রইল। এসব পরামর্শ প্রকৌশলী, নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ও নির্মাণ সামগ্রীর উৎপাদকদের কাছ থেকে জানা গেছে।

 ইটঃ

ইট হচ্ছে ইমারত তৈরির একটি আবশ্যকীয় ও মৌলিক উপাদান বিশেষ। মাটিকে আয়তঘনক আকারের ছাঁচে ঢেলে ভিজিয়ে কাঁচা ইট তৈরি হয়, তারপর এক রোদে শুকানো হয়। কাঁচা ইটকে আগুনে পোড়ালে পাকা ইট তৈরি হয়। বহু প্রাচীনকাল থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রোদে শুকানো বা আগুনে পোড়ানো ইট ব্যবহার হয়ে আসছে। যদিও ইট পাথরের মত দীর্ঘস্থায়ী এবং মজবুত নয়; তারপরও সহজলভ্যতা, অল্প খরচ এবং স্বল্প ওজনের জন্য এর জনপ্রিয়তা এবং ব্যবহার সর্বাধিক। ইট বানানোর সময় কিছু ইট বেশি পুড়ে যায় ও কেকের মত ফুলে উঠে এক ফোপা শক্ত কালচে খয়েরী আঁকা-বাঁকা আকৃতির ইঁট তৈরি করে, যাকে বলে ঝামা বা ঝামা ইট। ঝামা শক্ত ও এবড়ো থেবড়ো বলে ঘষামাজার কাজে ব্যবহৃত হয়।

ভালো ইট চেনার উপায় ঃ

1) একটি ইট নিয়ে তার গায়ে নখের আঁচড় কাটার চেষ্টা করলে তাতে আঁচড় পড়বে না। যদি আঁচড় পরে তাহলে বুঝতে হবে ইটটি ভালো না।

2) একটি ইটকে অন্য একটি ইট দিয়ে আঘাত করলে যদি ধাতব শব্দ উৎপন্ন হয়, তাহলে বুঝতে হবে ইটটি ভালো।

3) দুইটি ইটকে টি (T) এর মত করে ধরে ২ মিটার উঁচু থেকে ফেলে দিলে যদি ভেঙ্গে যায়, তাহলে ইটটি ভালো না আর যদি ভেঙ্গে না যায়, তাহলে ইটটি ভালো।

4) একটি পাত্রে যদি ইটকে ভিজানো হয় এবং তা বুদবুদ সহকারে বেশ পরিমাণ পানি শোষণ করে নেয় এবং পানি ঘোলাটে হয়, তবে এটি ভালো ইট নয়।

5) একটি ইটকে ভেঙ্গে টুকরা করা হলে যদি টুকরা গুলোর রঙ দেখতে একই রকম হয়, তবে এটি ভালো ইট।

6) ইটের ধার ও কোণ গুলো সূক্ষ হলে বুঝতে হবে এটি ভালো ইট।

7) ইটের পৃষ্ঠ মসৃণ ও সমতল হলে এটি ভালো ইট।

8) ইটের মাপ আদর্শ থাকবে, যেমনঃ (৯.৫” x ৪.৫” x ২.৭৫”)

9) ইটের ওজন ৩.৫ কেজির বেশী হবে না।

ইটের বিবরণ ঃ

আমাদের দেশে সাধারণত ৯.৫” x ৪.৫” x ২.৭৫” সাইজের ইট, যা মিলি মিটারে ( 238 x 114 x 70 ) বাংলা ইট ব্যবহার হয়ে থাকে, এই মান PWD এর সিডিউল অনুযায়ী। মসলা সহ ১০” x ৫” x ৩” ( 250 x 125 x 76 )

ইটের প্রকার ঃ

বাজারে এখন দুই ধরণের ইট ভাটায় তৈরি ইট পাওয়া যায়। একটা হলো সনাতনী ইট ভাটায় পোড়ানো ইট। অন্যটি অটো-ব্রিকফিল্ডে উৎপাদিত ইট। আপনি যে ইটই কেনেন না কেন  শক্ত, দৃঢ় ও সম্পূর্ণভাবে পোড়া ইট কিনতে হবে। ভালো ইট এক মিটার উচ্চতা থেকে নিচে ফেলা হলেও সাধারণত ভাঙে না। সমতল ও ফাটল মুক্ত ইট কমপক্ষে এক দিন পানিতে ভিজিয়ে রেখে তারপর ব্যবহার করতে হবে।

ইট পাঁচ প্রকার। যথা ঃ

১। ১ম শ্রেনীর ইট।

২। ২য় শ্রেনীর ইট।

৩। ৩য় শ্রেনীর ইট।

৪। ঝামা ইট।

৫। পিকেট ইট।

ইটের কাজের পরিমাণ বাহির করার একক পদ্ধতিঃ

প্রতি ১০০ sft জায়গায় ইটের ৫” গাঁথুনিতে ইট লাগে = ৫০০ টি।

প্রতি ১০০ sft ইটের ১০” গাঁথুনিতে ইট লাগে = ১১৫০ টি।

প্রতি ১০০ sft জায়গাতে হেরিং বোন বন্ড করতে ইট লাগে = ৫০০ টি।

প্রতি ১০০ sft জায়গাতে সোলিং করতে ইট লাগে = ৩০০ টি।