বাচ্চাদের ঘর কেমন করে সাজাবেন?

অন্দরের সাজসজ্জা নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। প্রতিনিয়ত আসছে আসবাবপত্রের নতুন আঙ্গিক, ওয়াল-পেইন্টিংয়ের নতুন ট্রেন্ড, কিংবা জানালার নতুন ডিজাইন। সবকিছুর সম্যক ধারণা নিয়ে ঘরের ভেতরটা রুচিমাফিক সাজানো চ্যালেঞ্জিং তো বটেই। তবে এই চ্যালেঞ্জের কেন্দ্রে থাকে শিশুদের ঘর সাজানো।

না, পুরো বাড়ির সজ্জা যেমন-তেমনও যদি হয়, শিশুর ঘরখানির সজ্জা ঠিকঠাক থাকা চাই-ই চাই! সর্বোপরি, একটি রুচিশীল, সৌখিন বাড়ি নির্মাণের মূল্য উদ্দেশ্যই তো শিশুর বেড়ে ওঠায় সাহায্য করা, তাকে মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে গড়ে তোলা। তাই আপনার শিশুর ঘরের ডিজাইন নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণ পড়াশোনা করুন, শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হয় এমন ডিজাইন সম্পর্কে জানুন।

Nursery, Crib, Chair, Bedroom, Room, Home, Child, Baby

আধুনিক ট্রেন্ড, ডাক্তারদের পরামর্শ আর নিত্যনতুন গবেষণার কল্যাণে শিশুর ঘরসজ্জা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা আমরা নিজেরাই করে নিতে পারি, এজন্য প্রয়োজন পড়বে না কোনো বিশেষজ্ঞের। এরকম কিছু প্রাথমিক ধারণা সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক চলুন।

সবধরনের জটিলতা পরিহার করুন

শিশুর ঘর সাজাতে গেলে ভাবতে হবে শিশুর মতো করে। কোনোকিছু খুব বেশি জটিল করা যাবে না। যাবতীয় আসবাবপত্র, বিছানা কিংবা শিশুর খেলার জায়গা, সবকিছুই সহজ ও সাবলীল হবে। শিশুর ঘর আপনার শোবার ঘরের মতো একেবারে পাই টু পাই সাজানো-গোছানো হবার প্রয়োজন নেই। বরং শিশুদের সুবিধানুযায়ী সবকিছু এমনভাবেই সাজাতে হবে যেন তারা প্রয়োজনের সময় সবকিছু হাতের কাছে পায়।

Children, Room Newborn, The Cradle, For Baby, Furniture

গ্রাফিক্সের ব্যবহার কিংবা রঙতুলি

শিশুমনের সৃজনশীলতা বৃদ্ধিতে তার ঘরটি রঙিন করার বিকল্প নেই। ঘরের দেয়ালগুলো নীল, আসমানি, সবুজ, গোলাপি, বেগুনির মতো রঙে রাঙিয়ে ফেলুন। কোনোটিই যেন খুব মৃদু বা খুব উজ্জ্বল না হয়।

তবে দেয়ালে রঙ করার চেয়েও অধিকতর ভালো বিকল্প হচ্ছে গ্রাফিক্সের ব্যবহার, অর্থাৎ সুন্দর ও রুচিসম্পন্ন ছবি। এটি করা যেতে পারে নানাভাবে; ওয়ালপেপার সবচেয়ে সহজ বিকল্প। চমৎকার সব ছবি সংবলিত ডেকালও (Decal – দেয়ালে লাগানোর জন্য একধরনের প্লাস্টিক, কাপড় বা পেপারের তৈরি শিট) শিশুর ঘরের সৌন্দর্য বাড়ায়। তবে সবচেয়ে ভালো হয় যদি দেয়ালে রঙতুলিতে ছবি আঁকিয়ে নেয়া যায়। সেসব ছবিতে তারকাময় আকাশ, প্রাকৃতিক দৃশ্য, কিংবা খেলাধুলায় মত্ত মুক্ত শিশুদের ছবি স্থান পেতে পারে।

Free Empty Bedroom Set Stock Photo

শিক্ষণীয় উপকরণ

শিশুর ঘরের ডিজাইনে বিভিন্ন শিক্ষণীয় উপকরণ যুক্ত করার ট্রেন্ড বহু পুরনো। শুরু করা যেতে পারে ঘরের দেয়াল থেকেই। ঘরের সবগুলো দেয়ালেই ছবি বা গ্রাফিক্সের ব্যবহার না করে একটি দেয়ালে করা যেতে পারে রঙিন এবং সহজ করে আঁকা বিশ্ব মানচিত্র। মানচিত্রের ডেকালও লাগানো যেতে পারে।

প্রথমে এমন মানচিত্র লাগাতে হবে যাতে কেবল দেশগুলোর নাম থাকবে। এরপর শিশুর বয়সের সাথে সাথে মানচিত্রের জটিলতা বাড়ানো যেতে পারে। মানচিত্রের পাশাপাশি ঘরের সিলিং থেকে বিভিন্ন সৌন্দর্যবর্ধক উপকরণ ঝোলানোর সাথে তাতে রাখুন সৌরজগতের একটি মডেল। এতে শৈশব থেকেই তারা সৌরজগৎ সম্পর্কে জানার জন্য আগ্রহী হবে, মোটের উপর বিজ্ঞান বিষয়ক কৌতূহল তৈরি হবে।

প্রচুর স্টোরেজের প্রয়োজন হবে

শিশুর ঘর মানেই একটি যত্রতত্র খেলনা ও অন্যান্য সামগ্রী পড়ে থাকা অগোছালো ঘরের ছবি। এই অগোছালো ঘরকে গুছিয়ে নিতে লেগে যাবে বেশ খানিকটা সময়। একে পুনরায় পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে শিশুদের কিন্তু মোটেও বেশি সময় লাগে না। তাই বার বার এই ঘর গোছানোর ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে শিশুদের ঘরে বহু সংখ্যক স্টোরেজের ব্যবস্থা করুন।

শিশুর বিছানা থেকে শুরু করে টেবিল এবং দেয়ালে লাগোয়া যেকোনো আসবাবপত্রেই স্টোরেজ থাকা আবশ্যক। ব্যবহার করুন সুন্দর এবং রঙিন সব ঝুড়ি বা বাক্স, অস্থায়ী কেবিনেটের। শিশুর বেশি ব্যবহৃত বস্তুগুলো বার বার গোছানো থেকে মুক্তি মিলবে এসব স্টোরেজের কল্যাণে।

রাগ (Rug) বা কার্পেটের ব্যবহার

শিশুর ঘরের দেয়াল রাঙানোর আরেকটি দীর্ঘস্থায়ী বিকল্প হলো রাগ বা একপ্রকার কার্পেটের ব্যবহার। এগুলো কিছুদিন পর পর দেয়াল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ধুয়েও ফেলা যাবে। এছাড়া, শিশুর বিছানার চারধারে কিছুটা অংশ জুড়ে মোটা ও মোলায়েম কার্পেট ব্যবহার করা ভালো। এতে শিশু বিছানা থেকে পড়ে গেলে ব্যথা পাবে না। অবশ্য তিন বছরের ছোট শিশুর বিছানা একেবারে নিচু রাখাই বাঞ্ছনীয়, ১-২ ফুটের মতো হবে যার উচ্চতা।

Children'S For Girls, Children'S Interior, Children

কাজের আর খেলার স্থান

শিশুর বয়স পাঁচ বছর বা তার অধিক হলেই তার ঘরের বিভিন্ন আসবাবপত্রের অবস্থানগত সাজসজ্জা পরিবর্তন করে ফেলুন। মূলত খেলার স্থান প্রাধান্য দেয়া ঘরকে এবার খেলার আর কাজের জন্য দুটি আলাদা জোনে ভাগ করে ফেলুন। কাজ অর্থাৎ পড়ার জন্য রিডিং স্পেস বেশ মনোযোগ দিয়ে সাজাতে হবে যেন শিশু ছোটকাল থেকেই লেখাপড়া আর অন্যান্য কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করতে শেখে।

Children Girls, The Little Girl'S Room, Interior

থিমভিত্তিক সাজসজ্জা

শিশুর শোবার ঘরের ইন্টেরিয়র ডিজাইন নিয়ে নানা রকম ভাবনার সাথে থিমভিত্তিক ডিজাইনের ভাবনাও রাখতে পারেন তালিকায়। যেকোনো কিছুকে থিম হিসেবে নিয়ে তাকে কেন্দ্র করেই সাজাতে হবে পুরো ঘর- এটাই থিমভিত্তিক অন্দরসজ্জার মূলকথা। আপনার থিম যদি হয় মহাকাশ, তাহলে শিশুর দেয়ালে চাঁদ-তারা-গ্রহ-নক্ষত্রের রঙিন ছবি, সিলিং থেকে ঝুলতে থাকা সৌরজগতের মডেল থাকতে পারে; আসবাবপত্রগুলোও আকাশের রঙে রাঙানো চাই। এমনকি, শিশুর বিছানার চাদর বা কম্বলও হতে পারে মহাকাশের বিভিন্ন কনস্টেলেশনের ডিজাইনে।

প্রকৃতি, পশুপাখি, ফুল, ফল, শৈশব, পড়ালেখা- অনেককিছুই হতে পারে শিশুর ঘরের ডিজাইনের থিম। তবে মাথায় রাখা জরুরি, থিমভিত্তিক ডিজাইন দীর্ঘদিনের জন্য নয়। প্রতিবছর না হলেও দেড় বা দু’বছরে একবার পরিবর্তন করা চাই থিম। নয়তো শিশুর মানসিক বিকাশ একমুখী কিংবা ব্যহত হতে পারে।

Free Brown Wooden Baby Crib Near White Wooden Framed Glass Window Stock Photo

কার্টুন

শিশুর ঘরের দেয়ালে কার্টুন আঁকা বেশ জনপ্রিয় একটি থিম। অবশ্য একটু বুদ্ধি করে এই সাধারণ ব্যাপারকে অসাধারণ করে তুলতে পারেন। টম অ্যান্ড জেরি বা মিকি মাউসের কার্টুন থাকুক, তার সাথে জুড়ে দিন বিখ্যাত নানা ব্যক্তির কার্টুনও। বিখ্যাত মনিষীদের ছবি না দিয়ে কার্টুন করার উপকারিতা হলো এতে করে ছবিটির সাথে শিশুটি মিশে যেতে পারে, তার সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি হয়।

Free Close-up Photo of Pink and Red Fairy Graphic Textile Stock Photo

কাস্টমাইজ করার ব্যবস্থাও রাখুন

ঘর সাজাতে গিয়ে অধিকাংশ মানুষই যে ভুলটা করে তা হলো সাজসজ্জায় কোনোরূপ পরিবর্তন আনার সুযোগ না রাখা। অর্থাৎ ঘরের সমস্ত স্পেস কাজে লাগিয়ে ফেলা। এক্ষেত্রে ডিজাইন সেরে ফেলার পর উদ্ভুত সমস্যা ঠিক করতে ভীষণ কসরত করতে হয়, বেড়ে যায় ব্যয়ও। আবার আপনার করা ডিজাইনে আপনার শিশুটি মানিয়ে না-ও উঠতে পারে, কিংবা কোনো কারণে খেলাধুলা করতে গিয়ে ব্যথা পাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এক্ষেত্রে গৃহসজ্জা পরিবর্তন করার সুযোগ রাখা চাই। অবশ্যই ঘরে শূন্যস্থান রাখুন, এবং সাজসজ্জাও এমনভাবে করুন যেন যেকোনো প্রয়োজনে আসবাবপত্র বা অন্যান্য উপকরণ এদিক-সেদিক করে নেয়া যায়।

বাবা-মায়েদের জীবনের সবচেয়ে বড় লক্ষ্যই থাকে আদরের সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলা, তার জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যতের রাস্তা তৈরি করে দেয়া। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের ভিত্তি রচনা করতে হয় নাড়ি ছেড়া ধনের শৈশব থেকেই; নানা উপায়ে, নানা পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে। শিশুর জন্য ঠিক তার মানসিকতার সাথে মানানসই ঘর সাজানোও এর মাঝে একটি। তাই যত্নবান হোন আপনার সন্তানের ঘর সাজানোর দিকে, গড়ে তুলুন তার মাঝে ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকা সৃজনশীল সত্তাকে।