আমাদের দেশে প্রতি বছর কী পরিমাণ নতুন ভবন তৈরি হয় এ নিয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা পাওয়া খুবই কঠিন। তবে দেশের ক্রম উন্নয়নশীল অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে নির্মাণ শিল্প কলেবরে বড় হচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই। সাথে যোগ হচ্ছে নতুন মানুষ। বাড়ছে নির্মাণ শ্রমিকের সংখ্যা।
নির্মাণকাজ সারা বিশ্বে প্রতিদিন আধুনিকায়নের মধ্যে দিয়ে গেলেও আমাদের দেশে এটি এখনো অনেকাংশেই শ্রমিক নির্ভর। সস্তা শ্রম এবং বিভিন্ন দক্ষতার লোক নিয়োগের সুযোগ থাকায় মেশিনের চেয়ে নির্মাণশ্রমিকের উপরে এই নির্ভরতা নিকট ভবিষ্যতে কমে যাবার সম্ভাবনাও খুবই কম।
কিন্তু বাংলাদেশে নির্মাণশ্রমিকদের জীবন সহজ নয়। নানা সমস্যায় নির্মাণ শিল্প এবং এর কারিগরেরা জর্জরিত। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো নিয়ে আলাপ করা হলো সংক্ষেপে।
কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা
নির্মাণশিল্প অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি শিল্প। এখানে প্রতিদিনই কাজ করতে হয় অসম্পূর্ণ ভবন ও ঝুঁকিপূর্ণ মেশিনারির মধ্যে। অথচ বাংলাদেশে নির্মাণ শ্রমিকদের নিরাপত্তার যে গাইডলাইন রয়েছে তা মানা হয় না প্রায়ই। শ্রমিকদের জন্য বেশিরভাগ সাইটেই দেখা যায় না কোনো ধরনের নিরাপত্তা পোশাক, হেলমেট এবং গামবুট।
এর বাইরে ইট তোলা, রড বহন করা সহ বিভিন্ন ভারী উপকরণ ব্যবহারেও রয়েছে নিরাপত্তার ঘাটতি। সেইসাথে অনেক সাইটেই সেফটি নেটও ব্যবহার করা হয় না। যেটার কারণে পড়ে গিয়েও অনেক দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থেকে যায়।
অর্থনৈতিক অবস্থান
বাংলাদেশে শ্রমিক নিয়োগে এখনো কোনো লিখিত বিধিমালা নেই। এই কারণে কোনো নির্ধারিত বেতন তালিকা এবং কোনো ধরনের সর্বনিম্ন গ্রহণযোগ্য বেতনের নিয়মকানুন এখানে ভয়াবহভাবে অনুপস্থিত। এছাড়া সরাসরি কোনো ইউনিয়নের অধীনে না থাকায় স্বাভাবিক সুযোগ সুবিধাও তাদের নাগালের অনেক বাইরে।
ঢাকায় দক্ষ নির্মাণ শ্রমিকদের বেতন হিসাবে দিনে ৫০০ টাকা এবং তুলনামূলক অদক্ষ শ্রমিকদের ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা বেতন দেয়া হয়। এই বেতন অনেক সময় দিনের পর দিন বাকি থাকে। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করলেও কোনো ধরনের জীবনবীমা বা ওয়ার্ক ইনস্যুরেন্সেরও ব্যবস্থা নেই।
আবাসন
ঢাকায় বেশিরভাগ নির্মাণ সাইটের শ্রমিকেরা নির্মাণ সাইটেই বসবাস করেন। স্বল্প বেতনে আবাসনের সুযোগ ঢাকায় না থাকাই মূলত এই কাজে তাদের বাধ্য করে। ফাউন্ডেশনের সময় তারা থাকেন সেই খুঁড়তে থাকা মাটিতেই। ভবনের ফ্লোর ঢালাই হয়ে গেলে তারা ভবনে শিফট করেন। এসব ভবনে নিরাপদ বৈদ্যুতিক লাইন থেকে শুরু করে, পানি এবং পয়ঃনিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থাই থাকে না। এসব কারণে তারা প্রায় মানবেতর জীবনযাপন করেন।
আর এই জীবন কখনোই শেষ হয় না, কারণ একটি ভবন শেষ করতে গড়ে আড়াই বছর সময় লাগে এবং তারপর তারা তাদের পরবর্তী কাজের জায়গায় চলে যান। নির্ধারিত বেতন, বীমা ও কোনো ধরনের নিরাপত্তা ছাড়া এভাবে বছরের পর বছর বসবাস তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে প্রচণ্ড খারাপ প্রভাব রেখে যায়।
দক্ষতা ও শিক্ষা
আবাসন সমস্যা ও অর্থনৈতিক কারণে অনেক নির্মাণশ্রমিকই বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে পারেন না। তাই প্রজন্মান্তরে একই পেশাতেই রয়ে যায়ে পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু এই একই কারণে নতুন নির্মাণ কৌশল বা মেশিন পরিচালনার নতুন কোনো জ্ঞান যোগ হয় খুবই ধীরে।
নির্মাণশিল্পে সামনের দিনগুলোতে আমাদের মেশিন ও বিদেশী কন্ট্রাকটরদের সাথে কাজ করার সম্ভাবনা থাকায় এই শিল্পের শ্রমিকরা কাজ হারাতে পারেন বা পড়তে পারেন দীর্ঘ প্রক্রিয়ায়, যা তাদের অত্যন্ত নিম্ন সুযোগ সুবিধার পেশাটিকে ফেলতে পারে আরো বড় হুমকির মুখে।
এসব মাথায় রেখেই, নির্মাণ শ্রমিকদের আবাসন, অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা ও দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে ভবন মালিক, স্থপতি, ইঞ্জিনিয়ার এবং কন্ট্রাকটরসহ সকলকেই। কারণ শ্রমিকের হাতেই ভবন তার স্বপ্ন, নকশা, অংক আর অর্থনৈতিক ধাপগুলো পার হয়ে বাস্তবে চেহারা পায়। তাদের দক্ষতা, মনোযোগ এবং সুন্দর ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা হতে পারে আমাদের সকল নির্মাণের পেছনের সবচেয়ে বড় শক্তি!