বাড়ি নির্মাণে সম্ভাব্য আইনি বাধাবিপত্তি

আর কিছুদিন পরই অবসরে যাবেন আলতাফ সাহেব। কয়েক বছর আগে একটি জায়গা কিনেছেন ঢাকাতে। অবসরের সময় একটি বড় পরিমাণ অর্থ পেলেই নিজের মতো করে একটি বাড়ি তৈরি করতে চান। কিন্তু বাড়ি তৈরির আইনি ঝামেলার কথা ভেবে তিনি সবসময়ই কিছুটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন।

ঢাকা শহরে একটি জরিপ চালালে এরকম গল্প শোনা যাবে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই। ঢাকা শহরে জমি বা নির্মাণের খরচটা একটু বেশির দিকে হলেও সাধারণ মানুষ ভবন নির্মাণে আগ্রহ হারায় মূলত পদে পদে আইনি জটিলতার কথা চিন্তা করেই।

ভবন নির্মাণের কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ রয়েছে। প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য নির্দিষ্ট কিছু আইন রয়েছে। এগুলোকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। 

১। জমি সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া

২। নির্মাণ সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া

দুটি ভাগের বিভিন্ন পদক্ষেপ এখানে ধাপে ধাপে পর্যালোচনা করে আমরা একটি তালিকা তৈরি করতে পারি। চলুন সেটি দেখে নিই।

জমি সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া

জমি কেনা ভবন নির্মাণের প্রথম পদক্ষেপ। আইনি প্রক্রিয়ার কথা বিবেচনা করলে এটি আসলে সবচেয়ে বেশি সমস্যাপূর্ণ ধাপ। জমি ও জমির মালিকানা সংক্রান্ত ব্যাপারে আইনি ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকতে হলে আপনাকে জমি কেনার আগে থেকেই সতর্ক হতে হবে। জমি কেনার চেকলিস্টটি মূলত এরকম:

জমির তথ্য সংগ্রহ

জমি কেনার আগে জমি যে এলাকায় অবস্থিত সেখানে নিজে চলে যান কিংবা লোক পাঠান কিছু তথ্য সংগ্রহের জন্য। এটিকে আপনি যাচাই বা সার্ভে ধরে নিতে পারেন। এই ধাপে আপনাকে যা যা জানতে হবে তা হলো:

১. জমির জন্য সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভা/ইউনিয়ন পরিষদের প্রদত্ত প্লট নম্বর।

২. মালিকের নাম (বর্তমান এবং পূর্ব)

৩. মালিকানার স্থায়িত্ব (সম্ভব হলে আগের মালিকের নাম, মালিকানা পরিবর্তনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং এবং সময়কাল)

৪. ঠিকানা (সকল রোড নম্বর এবং ডাক নম্বরসহ)

এরপর আপনাকে যেতে হবে সিটি কর্পোরেশনে বা পৌরসভায়। এখানে সংরক্ষিত ডেটাবেজে থাকা তথ্যের সাথে মিলিয়ে তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিন।

দলিল নিরীক্ষণ

খোঁজ নেবার পরে আপনার দরকার হবে কাগজে-কলমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। জমির ক্ষেত্রে আইনি কাগজ হচ্ছে জমির দলিল। কেনার আগে বর্তমান দলিল সত্য ও প্রযোজ্য (Valid) কিনা তা যাচাই করে নিতে হবে। 

এই ধাপে যা যা করতে হবে-

১. বিক্রেতার কাছে দলিল দাবি করুন ও ফটোকপি সংগ্রহ করুন।

২. এই কপি ও খতিয়ান নাম্বারসহ চলে যান সাবরেজিস্ট্রি অফিসে। সেখানে নির্ধারিত ফি’র বিনিময়ে মূল দলিলের একটি কপি সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে। সেটি হয়ে গেলে আপনার ফটোকপির সাথে সেটি মিলিয়ে নিন। 

৩. জমি যদি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয়, সেক্ষেত্রে দলিলের মতো একটি বণ্টননামাও থাকে। সেটিও বৈধ কিনা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে জেনে নিন। 

৪. জমির দলিল থাকা সত্ত্বেও জমি বন্ধক বা ইজারা থাকতে পারে। জমি বন্ধক বা ইজারা থাকলে তা বিক্রয় করা যায় না। সেটি আছে কিনা জানার জন্য সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে জমির দায়মুক্তির তথ্য পাওয়া যায়। এটি ১০ বছরের জন্য যাচাই করা যায়। 

৫. খতিয়ান ও পোর্চা মিলিয়ে নিন। এই তথ্যগুলি থাকে সরকারি তহসিল অফিসে। খতিয়ান ও পোর্চা অনেক সময় রেকর্ড আপডেট করলে ভুল থাকে। সেটির ব্যাখ্যাও থাকতে হবে।

জমি কেনা

এবার আপনার জমিটি নিজের করে নেওয়ার পালা। এখানে আপনাকে যা যা করতে হবে তা হচ্ছে:

১. নতুন দলিল তৈরি করুন। সেখানে মালিকানা পরিবর্তনের জন্য সকল শর্ত এবং অর্থনৈতিক লেনদেনের ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে শর্তাদি লিখুন। একজন ভূমি আইনে দক্ষ আইনজীবীর সহায়তা নিন।

২. নিজের নামে রেজিস্ট্রি করতে হবে আপনার জমি। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে প্রদত্ত নির্দেশনা অনুসরণ করে জমির দামের বিপরীতে নির্ধারিত রেজিস্ট্রি ফি পরিশোধ করে জমির রেজিস্ট্রেশন করুন।

৩. মিউটেশনের মাধ্যমে নতুন দলিলের প্রযোজ্যতা ও পুরাতন দলিল বাতিলের বিষয়টি নথিভুক্ত করান। খতিয়ান ও পোর্চা রেকর্ডেও মালিক হিসাবে যে আপনার নাম এসেছে সেটিও আবেদন করে নিশ্চিত করুন। মিউটেশনের জন্য নামজারি জমাভাগ প্রস্তাবপত্র, ডুপ্লিকেট কার্বন রশিদ এবং মিউটেশন খতিয়ান সংগ্রহ করে নিন আপনার কাজ শেষ হলে। 

নির্মাণ সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া

জমির পরে শুরু হবে ভবন নির্মাণ প্রক্রিয়া। এখানে মোট তিনটি ধাপে আপনাকে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। মনে রাখবেন, নির্মাণে আইনি প্রক্রিয়া না মানা হলে আপনার ভবন বা তার নিয়ম বহির্ভূত অংশ যেকোনো সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভেঙে দিতে পারেন অথবা ভবনের অনুমোদন বাতিল করতে পারেন। এখানে যেসকল ধাপে নিয়ম মানতে হবে তা হচ্ছে:

ভবনের নকশা

আপনার জমি যদি সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন হয়, তাহলে নকশা করার জন্য অবশ্যই আপনাকে লাইসেন্সধারী স্থপতির সাহায্য নিতে হবে। নকশায় স্থপতির স্বাক্ষর না থাকলে ভবনের নকশা পাশ হবে না। বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউট পূর্ণ সদস্য ও অ্যাসোসিয়েট সদস্য হিসেবে আর্কিটেক্টদের অনুমোদন দিয়ে থাকে। আপনার ভবনের স্কয়ার ফিট অনুসারে সেই নকশায় স্বাক্ষর করার অধিকার রাখেন এরকম কাউকে দিয়ে নকশা করাতে হবে।

এর সাথে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে কমপক্ষে ব্যাচেলর ডিগ্রিধারী সিভিল ইঞ্জিনিয়ার স্ট্রাকচারাল ও প্লাম্বিং নকশা প্রণয়ণ করবেন। নকশায় নকশাকারী স্থপতির এবং স্ট্রাকচার ডিজাইনে কাজ করা প্রকৌশলীর স্বাক্ষর থাকতে হবে এবং পরবর্তীতে ভবন নকশা সংক্রান্ত সকল ব্যাপারে তারা দায়বদ্ধ থাকবেন।

ভবনের অনুমোদন

নকশা যদি ইমারত নির্মাণ বিধিমালা এবং বাংলাদেশ গেজেটের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়, তাহলেই আপনি ভবন তুলতে পারবেন। এই ভবনের আইনানুগ ব্যাপারগুলি যাচাই করে রাজউক বা সংশ্লিষ্ট পৌরসভা। এই অনুমোদনের জন্য আপনি নিজেও আবেদন করতে পারেন অথবা আপনার হয়ে আপনার জন্য নকশা প্রণয়নকারী স্থপতি বা স্থাপত্য ফার্মের মাধ্যমেও আবেদন করাতে পারেন। নিজে আবেদন করলে সংশ্লিষ্ট সংস্থায় অনুমোদনের জন্য কী কী ড্রয়িং দরকার হবে সেটি আগে থেকেই জেনে নিন। যেমন- রাজউকে অনুমোদনের আবেদন করতে নিম্নলিখিত উপকরণ দরকার হয়:

  • দলিল
  • অবিকল কার্বন রশিদ (DCR)
  • ভূমি ভাড়া রশিদ
  • পরিব্যক্তি (মিউটেশন)
  • খসড়া প্রকাশনা ফরম (ড্রাফট পাবলিকেশন ফরম)
  • পরিকল্পনার ৭ কপি (৬ তলা পর্যন্ত ভবনের জন্য)
  • যদি ভবনটি ৬ তলার বেশি হয়, একটি কাঠামোগত নকশার প্রয়োজন হয় এবং ২ নং প্রশ্নের উত্তরের বর্ণিত ৯টি প্রতিষ্ঠান থেকে ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়।

ভবন নির্মাণ

ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে আইনি জটিলতা নেই। তবে কয়েকটি জিনিস মেনে চলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

১. অনুমোদিত নকশায় নিজের ইচ্ছামতো পরিবর্তন করবেন না। FAR (Floor Area Ratio) এবং MGC মেনে ভবনের নকশায় অনুমোদন নেয়া হয়। তাই কোনো পরিবর্তন থাকলে স্থপতিকে জানান। তিনি নিয়মের ভেতরে থেকে যদি পরিবর্তন সম্ভব হয় সেটা করে দিতে পারবেন। অতিরিক্ত বারান্দা বা জমি ও সেটব্যাকের মধ্যে ভবনের অংশ প্রবেশ করালে সেটা অবৈধ বলে পরিগণিত হবে এবং ভবনের ওই অংশ ভেঙে দিতে কর্তৃপক্ষ দায়বদ্ধ।

২. ইমারত নির্মাণের সময় শ্রমিক নিরাপত্তা আইন মেনে চলুন। শ্রমিকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে আইনি জটিলতায় ফেলতে পারে যেকোনো ছোট বা বড় দুর্ঘটনা।

৩. রাজউকের নকশা পাসের সময় অতিরিক্ত নয়টি ছাড়পত্র দরকার হয়। এর মধ্যে পরিবেশ ও নিরাপত্তা বিষয়ক কিছু বিষয় ও থাকে। নির্মাণের সময় পরিবেশ বিধিমালা মেনে চলুন। 

আপনার সাইটে তৈরি হওয়া ধুলা ও বর্জ্য যেন আশেপাশের পরিবেশে মারাত্মক ক্ষতি করে না ফেলে সে ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে আপনাকেই।

অনেক ধাপ মেনে চলতে হলেও ভবন নির্মাণে প্রতিটি পদক্ষেপেই আপনাকে আসলে সচেতন হতেই হবে। আপনার জ্ঞান, সচেতনতা ও স্মার্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাই আপনাকে সকল আইনি জটিলতা থেকে রক্ষা করবে।

বাড়ির নকশা অনুমোদনের পূর্বশর্তসমূহ

প্রতিটি মানুষের স্বপ্ন থাকে তার জীবনের কষ্টার্জিত সকল সঞ্চয় দিয়ে তার কল্পলোকের বাড়িটি নির্মাণ করা। আর এ বাড়ি নির্মাণের প্রথম এবং অন্যতম প্রধান ধাপ হলো নকশা অনুমোদন। ঢাকায় এই অনুমোদন প্রদানের কাজটি করে থাকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। অনুমোদনের জন্য নির্ধারিত পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার কারণে অনেককেই পোহাতে হয় নানাবিধ ঝক্কি-ঝামেলা।

প্লটের প্রকারভেদ

প্রথমেই ধারণা নেয়া  প্রয়োজন প্লটের প্রকারভেদ সম্পর্কে। রাজউকে সাধারণত তিন ধরনের প্লটের শ্রেণীবিভাগ করা হয়-

  • রাজউকের প্লটঃ এক্ষেত্রে রাজউকের এস্টেট শাখা থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে।
  • রাজউক অনুমোদিত আবাসিক প্রকল্পের প্লটঃ এক্ষেত্রে নগর পরিকল্পনা শাখার প্রত্যয়নপত্র নিতে হবে।
  • ব্যক্তিমালিকানাধীন প্লটঃ এক্ষেত্রে রাজউকের নগর পরিকল্পনা বিভাগ থেকে ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র নিতে হবে। রাজউক এলাকাভিত্তিক ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র প্রদান করে। সেই ছাড়পত্র নিয়ে নির্মাণ অনুমোদনের জন্য নকশা রাজউকের ‘ইমারত নির্মাণ কমিটি’-তে দাখিল করতে হয়।

 

নকশা অনুমোদন

ইতোমধ্যে নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী  শ ম রেজাউল করিমের প্রশংসনীয় ডিজিটাল উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে । এক্ষেত্রে অনলাইনে আবেদনের মাধ্যমে ৭-৫৩ দিনের মধ্যে সেবা প্রদানের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। 

এবারে জেনে নেয়া যাক রাজউক থেকে নকশা অনুমোদনের পূর্বশর্তসমূহ- 

  •  প্রথমেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে আপনার জমির দাগ ও মৌজা নম্বর সঠিকভাবে যাচাইয়ের পর এটি ড্যাপ (ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান) এর কোন শ্রেণিভুক্ত তা দেখে নিতে হবে। আপনার নির্ধারিত জমিটি আবাসিক শ্রেণিভুক্ত হলেই কেবল সেক্ষেত্রে আবাসিক বাড়ি নির্মাণের অনুমোদন পাওয়া যাবে। 
  • জমি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরেই যা করতে হবে তা হল ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র সংগ্রহ। এজন্য রাজউকের নির্ধারিত ফর্মে আবেদন করতে হবে।
  • ব্যক্তি মালিকানাধীন বাড়ির নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রাদি হল – জমি রেজিস্ট্রেশনের ফটোকপি, খাজনা, জমা, খারিজ, সিএস (CS), আরএস (RS), মৌজা, থানা নাম, অঙ্গীকার নামা, নির্ধারিত আবেদনপত্রে আবেদন, আবেদনপত্র অনুসারে কাগজপত্র ও দলিলাদি এবং ব্যাংকে নির্ধারিত ফি প্রদান।
  • প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানাধীন নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রাদি হলো- প্রাতিষ্ঠানিক নকশা অনুমোদনের জন্য বরাদ্দপত্র, কিস্তি পরিশোধের রিসিট, ভূমি জরিপের নকশা, লিজ দলিল, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি (তৃতীয় ব্যক্তিকে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে), ছাড়পত্রের আবেদনপত্র এবং তদানুসারে কাগজপত্র ও দলিলাদি।
  • নকশা প্রণয়নে উভয় ধরনের মালিকানার ক্ষেত্রে জমি সংলগ্ন রাস্তার ক্ষেত্রে ‘ঢাকা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮’ অনুযায়ী ফার (FAR) প্রযোজ্য হবে।
  • জমি ব্যবহারের ছাড়পত্রের সাথে রাজউকের নির্ধারিত ফি প্রদানসহ জমির কাগজপত্র এবং সাইটপ্ল্যানের প্রিন্টকপি জমা দিতে হবে।
  • আবেদনের পর রাজউকের জরিপ কর্মকর্তাদের দ্বারা জমি পরিদর্শন শেষে, রিপোর্ট পজিটিভ হলে, খুব দ্রুত জমি ব্যবহারের ছাড়পত্র পাওয়া যাবে।
  • জমি ব্যবহারের ছাড়পত্র পাওয়ার পরবর্তী পদক্ষেপ হল মাটি পরীক্ষা বা সয়েল টেস্ট। এই পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে পরের ধাপগুলোতে অগ্রসর হতে হবে।
  • এরপর সুদক্ষ স্থপতি এবং প্রকৌশলী কর্তৃক প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ধরনের নকশা (প্ল্যান, লে আউট, স্ট্রাকচারাল লে আউট, প্লাম্বিং ইত্যাদি) প্রস্তুত করাতে হবে। নকশা অনুমোদনের জন্য প্রয়োজনীয় নকশা ও দলিলাদির মধ্যে যা যা থাকবে-
  • ৮ প্রস্থ নকশাসহ আবেদন ছক সম্পূর্ণরূপে পূরণ ও স্বাক্ষর
  • নকশা-প্রণেতা কারিগরি ব্যক্তির পেশাজীবী সংগঠনের সদস্য নম্বরসহ স্বাক্ষর
  • বৈধ মালিকানার হালনাগাদ সকল দলিলের সত্যায়িত অনুলিপি প্রদান
  • A4 সাইজের কাগজে FAR-এর হিসাব 
  • গভীর ভিত্তি, পাইলিং এবং বেজমেন্ট নির্মাণের ক্ষেত্রে নির্ধারিত ছকে (ইন্ডেমনিটি বন্ড ফর্ম ৩০১) এবং প্রযোজ্য হলে ক্ষতিপূরণ মুচলেকা প্রদান
  • A0-A4 সাইজে মেট্রিক ম্যাপে নকশা প্রণয়ন এবং দাখিলকরণ 
  • নকশাতে অবশ্যই আবেদনকারী (মালিক/ আম মোক্তারের) নাম, ঠিকানা ও স্বাক্ষর থাকা জরুরি
  • ছাদের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং পানির লে-আউট প্রদর্শনপূর্বক ছাদের নকশা প্রদান
  • প্রবেশ, নির্গমন এবং ড্রাইভওয়ে প্রদর্শনপূর্বক ড্রাইভিং প্ল্যান
  • লম্বালম্বি ও আড়াআড়ি দুটি সেকশন এবং সকল দিকের উন্নতি ড্রয়িং (এলিভেশন)
  • প্লটের সীমানারেখা হতে প্রযোজ্য ন্যূনতম সেটব্যাক
  • প্রযোজ্য ক্ষেত্রে রাস্তার জন্য জমি হস্তান্তরের অঙ্গীকারনামা
  • বাসযোগ্য রুম, রান্নাঘর ও গোসলখানা বা টয়লেটের ন্যূনতম ক্ষেত্রফল ও প্রস্থ
  • প্রস্তুতকৃত সকল নকশা চূড়ান্তভাবে অনুমোদনের জন্য পুনরায় রাজউকের নির্ধারিত ফর্ম পূরণ পূর্বক নির্ধারিত ফি প্রদান করতে হবে।
  • পরিশেষে রাজউকের দায়িত্ত্বরত প্রকৌশলীবৃন্দ জমাকৃত নকশা যাচাই করে সন্তুষ্ট হলে আপনার চাহিদা মোতাবেক অনুমোদন প্রদান করবেন।

সম্পন্ন হয়ে গেলো আপনার বাড়িটির জন্য জমি ও নকশার অনুমোদন গ্রহণ প্রক্রিয়া। এবার নির্বিঘ্নে কাজে নামতে পারেন সুদক্ষ কারিগরি ব্যাক্তিদের সহায়তায় আপনার স্বপ্নের বাড়িটিকে বাস্তবরূপ দিতে।

নিজেই নিজের বাড়ি: তৈরি হোক পছন্দমতো

দৃশ্যপট ১

আজমল সাহেব একজন চিকিৎসক। সারাজীবন সরকারি হাসপাতালে সেবাদানের পর যখন অবসরে যান, পেনশন হিসেবে টাকাগুলোকে এক করে ঢাকার বুকে কিনে ফেলেন ৫ কাঠার এক টুকরো জমি। অনেকদিনের ইচ্ছে, নিজের জন্য নিজের মতো করে তৈরি করবেন একটি বাড়ি। বিকেল বেলা এক চিলতে রোদে ভরে থাকবে সে বাড়ির ছোট বারান্দা।

কিন্তু আশেপাশের মানুষের সাথে কথা বলতে গিয়ে নির্মাণ কাজ নিয়ে বেশ ভয় পেয়ে যান তিনি। ভবনের নকশা, একাধিক অনুমোদন, নির্মাণ সামগ্রীর বাজার সম্পর্কে সচেতন ধারণা রাখা থেকে হাজারটা চিন্তা এসে ভর করে নির্মাণ নিয়ে ভাবতে গেলেই। জমির ভবিষ্যৎ আর বাড়ির স্বপ্নের মাঝে বিশাল এক অনিশ্চয়তায় ভোগেন আজমল সাহেব।


দৃশ্যপট ২

প্রান্তিক ঢাকায় এক টুকরো জমি নিয়ে অনেকদিন ধরেই প্রায় একই ধরনের সমস্যায় ভুগছেন রফিকুল হক। আশেপাশের সবাই তৃতীয় পক্ষের সাহায্যে বাড়ি তুলে কয়েকটি ফ্ল্যাট নিয়ে বসবাস করছেন। কিন্তু রফিকুল হকের জন্য এই এক টুকরো জমি তার সারা জীবনের সঞ্চয়ের ফসল। এখানে বাণিজ্যিক চিন্তাধারায় ভবন তৈরি হলে সেটি যে তার ইচ্ছা বা পছন্দকে পরিপূর্ণ করবে না, সে ব্যাপারে তিনি প্রায় নিশ্চিত। তিনি নিজের চাহিদামতো ভবন চান নিজের জমিতে। নকশার আলোচনার অংশ হতে চান। নিশ্চিত করতে চান নিজের ও নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুযোগ সুবিধা। 

নিজের টাকায় এক টুকরো নিষ্কণ্টক জমি আর তার উপর নিজের মনমতো আরামদায়ক বাসস্থান- এ যেন এই দেশের প্রায় সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন। এই স্বপ্নের জ্বালানী যোগান দিতে সারা জীবন কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন এ দেশের অনেক অনেক মানুষ।

নিজের জমি থাকা সত্ত্বেও আজমল আর রফিক সাহেবের মতো নানারকম অনিশ্চয়তার দোলাচলে সেই জমিতে বাড়ির স্বপ্ন অধরা থেকে যাচ্ছে। কেউ কেউ তৃতীয় পক্ষের শরণাপন্ন হয়ে নিজের জমিতে বাড়ি পাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু তাতে থাকছে না নিজের চিন্তা ও চাওয়া-পাওয়ার স্বাতন্ত্র্যের ছাপ। নিজের জমিতে নিজেই বাড়ি করার ব্যাপারে অনেকেই দ্বিধায় ভোগেন কিছু নির্দিষ্ট কারণে। আধুনিক সময়ের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী নির্মাণ ও স্থাপত্য মানের বিবেচনায় এখনো নিজের বাড়ি নিজে তৈরি করাই কিন্তু সবচেয়ে প্রচলিত ও লাভজনক প্রক্রিয়া। নির্মাণের নানা ধাপে এর সুফল পেতে পারেন একজন জমির মালিক।

১. নকশা

জমির উপরে বাড়ির নকশার জন্য একজন প্রশিক্ষিত স্থপতির দারস্থ হওয়াটা খুবই দরকারি। অনেকে মনে করেন, স্থপতির শরণাপন্ন হওয়া মানেই নির্মাণে শুধুমাত্র অলংকরণ যোগ করা ও অতিরিক্ত খরচ। অথচ একটি বাড়িতে বসবাসরত মানুষের জীবনযাপনের মান থেকে শুরু করে পর্যাপ্ত জায়গা, আলো-বাতাসের পর্যাপ্ততা এবং জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারেন শুধুমাত্র একজন স্থপতি। এর জন্য আপনাকে খরচ করতে হবে আপনার পূর্ণাঙ্গ নির্মাণ বাজেটের মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ অর্থ।

কোনোরকম তৃতীয় পক্ষের সহায়তা ছাড়াই আপনি পেশাদার স্থপতির সাহায্য নিতে পারেন খুবই সহজে। আপনি নিজে যদি আপনার বাড়ির নির্মাণে নিযুক্ত স্থপতির সাথে কথা বলেন এবং তাকে আপনার নিজের বাড়ির খুঁটিনাটি চাহিদা সম্পর্কে জ্ঞাত করেন, তাহলে তিনি প্রতিটি সূক্ষ বিষয় নকশায় প্রতিফলিত করতে চেষ্টা করবেন এবং নির্মাণ শুরু হবার অনেক আগেই আপনি পাবেন বাড়ির প্রতিটি বিষয় নিয়ে তার কাছ থেকে সবকিছু জেনে নেবার স্বাধীনতা।

পেশাদার স্থপতি সরকারের সব নিয়মনীতি সম্পর্কে সচেতন এবং নকশা করা বাড়ির ডিজাইন সংরক্ষণের নিশ্চয়তাও তিনি প্রদান করবেন। এছাড়া সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের কাছে স্ট্রাকচার ও প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধা (বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির লাইনের নকশা) সম্পর্কেও আপনি জ্ঞাত থাকতে পারবেন, যা পরবর্তীতে আপনার বাড়িকে করে তুলবে পূর্ণাঙ্গভাবে আপনার নিজের।

২. অনুমোদন

রাজউকে বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নকশা অনুমোদন সহজ করতে সরকার ডিজিটাল পদ্ধতিতে আবেদন ও নকশা অনুমোদনের ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করেছে। খুব দ্রুতই সকল অনুমোদন নেবার প্রক্রিয়া হবে অনিয়ম ও ঝামেলামুক্ত। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে স্থপতির কাছ থেকে প্রাপ্ত নকশা অনুমোদনের জন্য পাঠানো যাবে এবং মোবাইল ফোনে পাবেন নিয়মিত আপডেট। নিজের বাড়ি নিজে করার ক্ষেত্রে অনুমোদন কখনোই কোনো বাধা নয় যদি আপনি সরকারি নিয়মনীতি মেনে বাড়ি তৈরি করেন। 

৩. নির্মাণ সামগ্রী, খরচ সময়

বাড়ির নির্মাণ সামগ্রীর দাম ওঠা-নামা করে প্রায় প্রতিবছরই। একারণে বাড়ি নির্মাণে ব্যয়ের পরিমাণও নির্দিষ্ট রাখা খুবই কঠিন হয়ে যায়। দক্ষ ঠিকাদার নির্বাচন করা এক্ষেত্রে একজন বাড়ির মালিকের জন্য হতে পারে সর্বোত্তম সমাধান। নিজে নির্মাণ কাজ পরিচালনার সাথে যুক্ত থাকলে এ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা থাকে এবং ব্যয়, সময় ও সামগ্রীর মানের ব্যাপারে একজন জমির মালিক নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারেন।

এছাড়া নির্মাণের সময় সম্পর্কে ধারণা একদম পরিষ্কার থাকায় বাজেট ম্যানেজমেন্টও তুলনামূলক সহজ ও সাশ্রয়ী হয়। তৃতীয় পক্ষ অনেক ক্ষেত্রেই এই ধরনের সমস্যা মোকাবেলায় দিনের পর দিন নির্মাণ কাজ বন্ধ করে রাখেন। এতে নির্মাণ সামগ্রীর যেমন অপচয় হয় তেমনি ভবনের মান ক্ষতিগ্রস্থ হয় বিভিন্নভাবে।

৪. স্বকীয়তা

প্রতিটি মানুষ যখন জমি ক্রয় করেন, নিজের মনে নিজের বাসার একটি ছবি থাকে। বাড়ি বা বাসা মানে শুধু এক টুকরো মাথা গোঁজার ঠাঁই নয়। নিজের বাসা বা বাড়ি মানে একটি পরিবারের এক চিলতে স্বপ্নও। হয়তো আপনি আপনার রান্নাঘরটি চান একটু বড়, হয়তো আপনার চাই প্রতিটি ঘরের সাথে লাগোয়া এক টুকরো বারান্দা অথবা আপনি চান আপনার পরিবারের সব সদস্যই যেন নিজের পছন্দমতো একটি ঘর বরাদ্দ যেন পায় বাড়িতে।

এসব চাহিদা মানুষের মানবিক বোধ থেকে তৈরি এবং প্রতিটি মানুষের জন্য আলাদা, প্রতিটি পরিবারের জন্য আলাদা। যদি সর্বসাধারণের মাঝে বিক্রয়ের জন্য বাড়ির নকশা করা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই এই স্বকীয় চিন্তাধারা চলে যেতে পারে আড়ালে। আপনার বাড়ি হয়ে যেতে পারে আর দশটি বাড়ির মতোই ইট-কাঠের বাক্স। তাই ব্যবসায়িক চিন্তাধারার বাইরে থেকে বাড়ি তৈরি করতে চাই নিজের শক্ত উপস্থিতি। শুধুমাত্র নিজের বাড়ি নিজে তৈরি করতে সাহস করলেই এই স্বকীয় চিন্তাধারা বেঁচে থাকতে পারে প্রতিটি বাড়ির নির্মাণ প্রক্রিয়ায়।

৫. অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

২০২০ সালে এসে রিয়েল এস্টেট বা আবাসন হয়ে উঠেছে সর্বোচ্চ মানের অর্থনৈতিক বিনিয়োগের ক্ষেত্র। ব্যাংকের লভ্যাংশের চেয়ে অনেক দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে জমির দাম, ফ্ল্যাটের দাম। নিজের জমিতে নিজের বিনিয়োগ এই লাভের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে প্রচুর পরিমাণে। বলা বাহুল্য, তৃতীয় পক্ষের নির্মাণ কাজে সংশ্লিষ্টতার কারণে এসব ক্ষেত্রে জমির মালিকের জন্য লভ্যাংশ যোগ হচ্ছে না তেমন কিছুই। নিজের বাড়ি নিজে তৈরি করা তাই অনেক দিক থেকে ঝামেলার মনে হলেও মান নিয়ন্ত্রণ ও গুণগত দিক ঠিক রাখতে পারলে ভবিষ্যতের জন্য এটি হতে পারে একটি দুর্দান্ত বিনিয়োগ।

. ভবিষ্যতের পথে

ঢাকা শহরে এক টুকরো জমি বা একটি বাড়ি শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, সামাজিকভাবেও একটি দূরদর্শী বিনিয়োগ। নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা, তাদের সামাজিক বিবর্তন বা নাগরিক সুযোগ-সুবিধা একটি কমার্শিয়াল চিন্তাধারার বাড়িতে বাধাগ্রস্থ হবে, এটি খুবই স্বাভাবিক। এ সম্পর্কে তাই চাই মানবিক চিন্তাধারা, পারিবারিক বন্ধনকে ভবনের নকশায় স্থান দেওয়া।

বাড়ির সাথে আত্মিক বন্ধন তৈরিও তাই ভবিষ্যতের পথে একটি পরিবারকে এগিয়ে দিতে পারে অনেকদূর। নিজের বাড়ি নিজে তৈরি করার মাধ্যমে একটি পরিবার একসাথে থাকার ও একভাবে সামনে এগিয়ে যাবার যে প্লাটফর্ম তৈরি হয়, তা শর্তসাপেক্ষে কয়েকটি ফ্ল্যাটের বিনিময়ে তৈরি করে দেওয়া বাড়িতে পাওয়া কি আদৌ সম্ভব?

এসব কারণেই নিজের বাড়ি নিজে তৈরি করতে আগ্রহী হতে সেরা সময়টা আসলে এখনই। তবে এজন্য চাই প্রশিক্ষিত স্থপতি ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, যারা আপনার চাহিদা বুঝবেন ও কমার্শিয়াল ধ্যান-ধারণার বাইরে এসে আপনাকে সাহায্য করবেন। আর চাই নিষ্ঠাবান ঠিকাদার। আর এসবের জন্য প্রয়োজন একটি বিশ্বমানের কনসাল্টেশন সার্ভিসও।

এই কয়টি জিনিস নিশ্চিত করতে পারলেই আপনার স্বপ্নের বাড়ি ইট-কাঠের খাঁচা ভেঙে হয়ে উঠবে চিরায়ত সেই বাসস্থান, যার মায়ায় যুগের পর যুগ আপনার মন পড়ে থাকবে এই ভৌগোলিক পরিসীমাতে। তখন বাড়ি শুধু একটি স্থাপনা নয়, হবে আপনার আবেগ, অনুভূতি আর পরিবারের সুখ-দুঃখের সূতিকাগার।