কাঠের মেঝে যুগ যুগ ধরে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
Continue readingনির্মাণশিল্পে কোভিড-১৯ এর প্রভাব এবং এর ভবিষ্যৎ
নভেল করোনা ভাইরাসের শেষ কোথায় এ সম্পর্কে কারও জানা নেই। এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে থমকে গেছে আমাদের জীবন ও জীবিকা। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোনো কিছুই এর ছোবল থেকে রেহাই পায়নি। বিশ্বব্যাপী মার্চ মাসের শুরু থেকে চলছে লকডাউন। ঘরবন্দী থাকার দিন সেই যে শুরু হলো, তার শেষ এখনো হয়নি কোনো কোনো ক্ষেত্রে। অফিস, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, বাজারসদাই সবকিছুই চলে আসছে চার দেয়ালে বন্দী থেকে।
কিন্তু কিছু কাজ রয়েছে যা কখনোই চার দেয়ালের ভেতরে থেকে করা সম্ভব নয়, আবার এই মহামারিতে করাও ঝুঁকিপূর্ণ। এক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলেও আমাদেরকে তা বন্ধ রাখতে হয়েছে। তেমন একটি হলো নির্মাণশিল্প। করোনার প্রাদুর্ভাবে সাপ্লাই চেইন থেকে শুরু করে কাঁচামাল সরবরাহ বন্ধ, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি সবকিছু মিলিয়ে এই শিল্প এক বিশাল হুমকির মুখে এসে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের সিমেন্টশিল্প, স্টিলশিল্পসহ নির্মাণ সংশ্লিষ্ট সকল শিল্প একযোগে এই সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং স্থানীয় সকল ছোট প্রজেক্টের সাথে সাথে আন্তর্জাতিক অনুদান সম্বলিত সকল কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পদ্মা সেতু, রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট, কর্ণফুলি টানেল, ঢাকা মেট্রোরেলসহ প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের নির্মাণ কাজ, দেশি-বিদেশি শ্রমিকের সক্রিয়তা, কাঁচামালের স্বাভাবিক সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় নির্মাণ কাজে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
এই অবস্থায় কর্তৃপক্ষ কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাজ সমাপ্তির সময় ২০২২ সাল পর্যন্ত বর্ধনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং করোনা প্রভাবমুক্ত দেশ থেকে শ্রমিক, প্রকৌশলীসহ লোকবল আমদানির কথা পর্যন্ত আমলে নেয়। কিন্তু করোনার প্রভাবমুক্ত কোনো দেশ থেকে জনশক্তি পাওয়া সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে উৎপাদন তথা নির্মাণকাজ বহুদিন বন্ধ থাকার কারণে কাঁচামাল নষ্ট, মেয়াদ উত্তীর্ণসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি সহজেই অনুমেয়। ইতোমধ্যে নির্মাণশিল্পের সাথে জড়িত নিম্ন আয়ের মানুষ, যেমন- টেকনিশিয়ান, দিনমজুরেরা কাজ হারিয়ে বেকারত্বের শিকার। ব্যাংকগুলো থেকে লোন নেয়ার পরেও কাজে লাগাতে পারছে না মালিক সম্প্রদায়। অর্থাৎ ব্যক্তিপর্যায় থেকে শুরু করে দেশের বৃহত্তর অর্থনীতি সবকিছু নিয়েই শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
যেকোনো নির্মাণকাজের সময়সীমাকে চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম ভাগে পরিকল্পনা, নকশা অনুমোদন, সরকারি-বেসরকারি অনুদান নিশ্চিতকরণ হয়ে থাকে। দ্বিতীয় ভাগে চলে সাপ্লাই চেইনের কাজ এবং মালামাল মজুতকরণ। নির্মাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে থাকে তৃতীয় এবং চতুর্থ ভাগে। আর সেই নির্মাণ কাজ শুরুর প্রাক্কালেই শুরু হয় আমাদের লকডাউন।
নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় একদিকে যেমন মালামালের ক্ষতি হয় অন্যদিকে প্রায় ৩৫ লাখ নির্মাণ শ্রমিক এবং তাদের পরিবার অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন বলে জানান গবেষকরা। এক্ষেত্রে মালিক সম্প্রদায়সহ সংশ্লিষ্ট সকলের সুচিন্তিত পদক্ষেপ এ যাবৎকালীন হয়ে যাওয়া ক্ষতির কিছুটা হলেও লাঘব করা সম্ভব হবে।
১. যথাসম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনে পর্যায়ক্রমে শ্রমিকদের নির্মাণকাজে নিয়োগ দেওয়া যাতে পরবর্তীতে আর রোগ সংক্রমণের জন্য কাজ বন্ধ না হয়। কারণ, সরকার ইতোমধ্যে কিছু কিছু কাজ চালু করার অনুমোদন দিয়েছে।
২. সাইটে মালামাল মজুত থেকে শুরু করে কাজ শেষ পর্যন্ত একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা এবং প্রয়োজনে প্রোজেক্ট ম্যানেজার নিয়োগ।
৩. পররবর্তীতে নির্মাণকাজে প্রিফ্যাব্রিক্যাটেড উপকরণের ব্যবহার বাড়ানো এবং আগে থেকে মজুদ না করে সাইটেই অল্প সময়ে বানানো সম্ভব এরকম বিকল্প উপকরণের উপর নির্ভরশীলতা বাড়ানো। যেমন- কংক্রিট ব্লক অথবা নষ্ট হয়ে যাওয়া ইটের ব্লককে সুড়কি বানিয়ে ফেলা।
৪. এক গবেষণায় দেখা যায় প্রায় ৩০,০০০ আবাসন প্রকল্পের কাজসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নির্মাণকর্ম এর মধ্যে হস্তান্তরের কথা থাকলেও করোনার কারণে তা সম্ভবপর হয়নি। এগুলো শেষ করার পূর্বে আর কোনো নতুন প্রকল্প গ্রহণ না করে এগুলো সম্পূর্ণ করার দিকে মনোনিবেশ করা শ্রেয়।
৫. ইতোমধ্যে ঠিকাদার ও কাঁচামাল ব্যবসায়ীরা যে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন তার জন্য প্রয়োজনে আলাদা ফান্ড গঠন করা যেতে পারে সরকারি অনুদানে, কারণ, সরবরাহ সচল না থাকলে এই প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের কোনো সুযোগ নেই।
৬. পুনরায় পদ্মা ব্রিজের কাজ শুরু হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ সাইটেই ৪০০০ জন শ্রমিকের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করে, যার কারণে শ্রমিকদের অন্য এলাকায় চলাচল বন্ধ হয়। এ যাবৎ এই প্রকল্প থেকে কোনো প্রকার সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়নি। এভাবে প্রতিটি সাইটে প্রোজেক্টের স্কেল অনুযায়ী শ্রমিকদের আবাসনের ক্ষণস্থায়ী ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্মাণ কাজকে কিছুটা হলেও সচল করা যেতে পারে।
কোভিড-১৯ এর কারণে সমগ্র বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার যে প্রভাব আমাদের দেশের উপর পড়েছে তা মোকাবেলা করার জন্য সরকারের সাথে সাথে বেসরকারি খাতগুলোকেও তৎপর হতে হবে। বিগত মাসগুলোর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ মাথায় রেখে ভবিষ্যতে সুচিন্তিত উপায়ে অগ্রসর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।