ঢালাইয়ের পর কিউরিং করার সঠিক উপায়

বাড়িঘর নির্মাণের সময় আমাদের নানান অসুবিধা এবং প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এই সকল বিষয়ে তাই আগে থেকে ধারণা থাকলে স্বপ্নের আবাসস্থল হবে নিরাপদ এবং দীর্ঘস্থায়ী। আমাদের উপমহাদেশে বাড়ির ছাদ ঢালাই করা উৎসবের উপলক্ষ্য হিসেবে পরিগণিত হয়। আর এ বাড়ি ঢালাইয়ের পর যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে কিউরিং।  

কিউরিং কী? 

কংক্রিট স্থাপন ও কম্পেকশন (জমে শক্ত হয়ে যাওয়া) করার পর কিছু দিন অবিরামভাবে কংক্রিটকে আর্দ্র রাখার পদ্ধতিকে কিউরিং বলে। 

কিউরিংয়ের পদ্ধতি

কিউরিংয়ের জন্য নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করা হয়:

১. পানি ছিটিয়ে (Sprinkling of Water)

২. মাটি দ্বারা ঘের তৈরি করে (Ponding)

৩. ছায়াময় করে (Shading)

৪. পৃষ্ঠদেশ আচ্ছাদিত করে (Covering the Surface) 

সময়কাল

কংক্রিটের মান এবং ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে ২৪ ঘণ্টা থেকে শুরু করে ২১-২৮ দিন অবধি কিউরিং করা হয়ে থাকে। সাধারণভাবে কংক্রিট জমাট বেঁধে চূড়ান্ত শক্ত অবস্থায় আসলে অর্থাৎ ৮-১০ ঘণ্টা পর কিউরিং প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়। তবে আবহাওয়া এবং পরিস্থিতি বিবেচনা করে কিউরিংয়ের যথাযথ কার্যকারিতার জন্য কংক্রিট ফিনিশিংয়ের পরপরই কিউরিংয়ের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে।

সেক্ষেত্রে ছাদ বা ফ্লোর ঢালাইয়ের পর প্রখর রোদ বা বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষার জন্য ফিনিশিংয়ের পরপরই প্লাস্টিক কাভার দিয়ে ঢালাই স্থান ঢেকে রাখতে হবে। এ সময় কংক্রিটের উপরিভাগে শতভাগ প্লাস্টিক কভার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্লাস্টিক যেন সরে না যায় এজন্য কাঠের ব্লক অথবা ইটের সাহায্যে আটকে রাখতে হবে। শুষ্ক অবস্থা পর্যবেক্ষণে কভার সরিয়ে পানি স্প্রে করে আবার প্লাস্টিক বিছিয়ে দিতে হবে। 

কিউরিং করার সময়সূচি

কিউরিং করার সময়সূচি বেশ কয়েকটি জিনিসের ওপর নির্ভর করে। এগুলো হলো:

১. মিশ্রণের অনুপাত

২. কংক্রিটের স্ট্রেংথ

৩. কনক্রিটের আকার ও আকৃতি

৪. আবহাওয়া ও পরিবেশ

৫. ভবিষ্যতে ব্যবহারের প্রকৃতি

সাধারণভাবে, আমাদের দেশে কিউরিং করার সময় নিম্নোক্ত হিসাব অনুসরণ করা হয়ে থাকে।

কাজের বিবরণকিউরিং শুরু করার সময়যতদিন কিউরিং করতে হবে
মাস কংক্রিটের কাজে (১:৩:৬)   (ফাউন্ডেশন)২০ ঘণ্টা পর৭ দিন পর্যন্ত
ইটের গাঁথুনির কাজ (সকল)২০ ঘণ্টা পর৭ দিন পর্যন্ত
ড্যাম্পপ্রুফ কোর্স সিমেন্ট কংক্রিট কাজে (১:২:৪)২০ ঘণ্টা পর৭ দিন পর্যন্ত
লিনটেল, সানশেডের কাজে২০ ঘণ্টা পর৭ দিন পর্যন্ত
ছাদ ঢালাইয়ের কাজে২০ ঘণ্টা পর২১ দিন পর্যন্ত
ফ্লোর ঢালাই সিমেন্ট কংক্রিটের কাজে   (১:৩:৬)২০ ঘণ্টা পর৭ দিন পর্যন্ত
১ ইঞ্চি পেটেন্ট স্টোন সিমেন্ট কংক্রিটের (১:২:৪) কাজে১৫ ঘণ্টা পর৭ দিন পর্যন্ত

নির্মাণ কাজের সেন্টারিং বা সাটারিং খোলার সময়সূচি:

কাজের বিবরণসেন্টারিং (সাটারিং) খোলার সময়
কলাম ও বীমের পার্শ্বদিক৩  দিন পর
বীমের তলা২১  দিন পর
ছাদের স্ল্যাবের তলা (১৫‘ স্প্যান পর্যন্ত)১৫  দিন পর
ছাদের স্ল্যাবের তলা  (১৫‘ স্প্যানের  চেয়ে  বড় পর্যন্ত)২১  দিন পর

  মোজাইক এবং জলছাদের মিশ্রণ পদ্ধতির ছক:

কাজের বিবরণমিশ্রণ সামগ্রীমিশ্রণ  অনুপাত
গ্রে-মোজাইক (০.৫ ইঞ্চি পুরু)সিমেন্ট : মার্বেল১ : ১
জলছাদ (৪ ইঞ্চি পুরু) কাজেচুন : সুরকী : খোয়া২ : ২ : ৭

কংক্রিট মিশ্রণ পদ্ধতির ছক (নমুনা)

কাজের বিবরণকাজের বিবরণ        মিশ্রণ  অনুপাত
মাস-কংক্রিট (ফাউন্ডেশনের তলায়)সিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ৩ : ৬)
ড্যাম্প-প্রুফ কোর্স (D.P.C)সিমেন্ট : বালি :খোয়া(১ : ১.৫ : ৩)
বাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোর (কংক্রিট)সিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ৩ : ৬)
১” থেকে ১.৫” পুরু (পেটেন্ট স্টোন)সিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ২ : ৪)
১” পুরু মোজাইক বেস (তলা)সিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ২ : ৪)
আর.সি.সি. (কংক্রিট) [২৬০০ পি.এস.আই]সিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ২ : ৪)
আর.সি.সি. (কংক্রিট) [২৯০০ পি.এস.আই]সিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ১.৫: ৩)
দরজা-জানালা ফ্রেম দেওয়ালে আটকানোর মশলাসিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ২ : ৪)
গ্রীলের ফ্রেম আটকানো মশলাসিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ২ : ৪)
স্যানিটারি পাইপ কংক্রিটসিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ৩ : ৬)
ড্রেন-পিটের কংক্রিট বেস (তলা)সিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ৩ : ৬)
সেপটিক ট্যাংকের কংক্রিটসিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ২ : ৪)
সেপটিক ট্যাংকের ছাদসিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ২ : ৪)

(তথ্যসূত্র: বাড়ি নির্মাণ গাইড, লেখক: পুরকৌশলী মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী) 

সাধারণভাবে ছাদ বা ফ্লোর কিউরিং এর ক্ষেত্রে ঢালাইয়ের ১০ ঘণ্টা পর পুরো কাস্টিং এরিয়াতে বাঁধ দিয়ে পানি ধরে কিউরিং করা হয়ে থাকে। কলাম এবং বীমের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকরী কিউরিং পেতে ফর্ম ওয়ার্ক বা সাটার ধরে রাখতে হবে। কলামের ক্ষেত্রে সাটারিং উঠিয়ে ফেলার পরেও ভেজা চট দিয়ে জড়িয়ে রাখলে ভালো ফল পাওয়া যায়। কাঠের সাটারিং ব্যবহারের পূর্বে তা পানি দিয়ে ভিজিয়ে নেয়া উচিৎ। খেয়াল রাখতে হবে প্রতিটি ঢালাইয়ের স্থান নিয়মিত পর্যবেক্ষণে দিনে ৫ থেকে ৭ বার কিউরিং করতে হবে।  

নিয়মমাফিক কিউরিং না করা হলে ঢালাইয়ের গুণগত মান কমে আসে, ফলে সম্পূর্ণ কাঠামো দুর্বল হয়ে যায়। এছাড়া ক্ষয় আর আর্দ্রতাজনিত কারণে ক্ষতির সম্ভাবনা বহুগুণে বেড়ে যায়। তাই মনে রাখতে হবে, ভালো মানের কংক্রিট পেতে ঢালাইয়ের পর কিউরিং যথাযথ হওয়া অত্যাবশ্যকীয়। 

বাড়ি বানাচ্ছেন? জেনে নিন ঢালাইয়ের খুঁটিনাটি!

“যেকোনো ভবন তৈরির সবচেয়ে কঠিন অংশ কী?” 

আমাদের উপমহাদেশে এই প্রশ্নের উত্তরগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে সবার উপরে থাকবে ছাদ ঢালাইয়ের ব্যাপারটি। যখন থেকেই পাকা বাড়ি বা বহুতল বাড়ি তৈরির চর্চা শুরু হয়েছে, তখন থেকেই এ ব্যাপারে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। অনেক আগে বাঁশ দিয়ে ঠেস দিয়ে ছাদ ঢালাইয়ের দৃশ্য ছিল এদেশে নির্মাণের সমার্থক। কিন্তু এখন সময় বদলে গিয়েছে। জেনে রাখা ভালো, ছাদ ঢালাইয়ের ব্যাপারটি খুবই টেকনিক্যাল এবং এর প্রতিটি ব্যাপারে নির্মাতার নজর হতে হবে সূক্ষ্ম।  

কী কী বিষয় খেয়াল রাখা উচিত ছাদ ঢালাইয়ের সময়?

  • ছাদ বা ফ্লোরের শাটারিং কোনোভাবেই ধাপে ধাপে করা যাবে না। একটি ফ্লোর বা ছাদ ঢালাই করার সময় পুরো ছাদের শাটারিং একবারে করা অত্যাবশ্যক। এর সাথে সম্পূর্ণ ফর্মা সমতল হয়েছে কিনা তা-ও একবারেই যাচাই করে নিতে হবে। 
  • ছাদ ও বীম ঢালাইয়ের কাজও করতে হবে একসাথেই। যদিও ছাদের লোড বীমের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়, তবুও তৈরির ক্ষেত্রে এদের একসাথে তৈরি করা অত্যাবশ্যক। ছাদ ৪ থেকে ৮ ইঞ্চি পুরু হতে পারে।

  • সাধারণত ২১ দিন পর ফর্মা খোলা হয়। তবে ঢালাইয়ের একদিন পরই ছাদের উপরিভাগে পানি ধরে রেখে কিউরিং করতে হবে।
  • ঢালাইয়ের জন্য যে কাঠের কাজ করা হয়, তাকে বলা হয় সেন্টারিং। এর জন্য যে তক্তা বা প্লেট ব্যবহার করা হয়, তাতে ছিদ্র থাকা চলবে না এবং তক্তার উপরে কোনো তৈলাক্ত পদার্থ (যেমন- ডিজেল বা গ্রিজ) লাগানো থাকলে তা সুন্দর হয়। তবে বর্তমানে পাতলা পলিথিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এসব প্রক্রিয়া মেনে চললে সর্বনিম্ন সময়ে শাটার খোলা সম্ভব।
  • মর্টার মেশাতে যদি মেশিন ব্যবহার করা হয়, তাহলে খেয়াল রাখতে হবে দুটি ব্যাপারে-
    ১. কমপক্ষে ২ মিনিট ধরে মেশাতে হবে।
    ২. মেশানোর সময় সম্পূর্ণ পানির সাথে মিক্সচার গুলে যাওয়া যাবে না।
  • হাতে মিক্সচার তৈরি না করাই উচিত। এতে করে গুণগত মানের ধারাবাহিকতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। মানসম্পন্ন কংক্রিট অনেকদিন স্থায়ী ছাদ তৈরিতে খুবই দরকারি।
  • ছাদ ঢালাইয়ের সময় সেটিং শুরু হবার আগেই প্রক্রিয়া শেষ করা উচিত। আধা ঘণ্টা থেকে ১ ঘণ্টা সময় নেওয়াটা ভালো মানের পরিচায়ক। দেরি হয়ে গেলে ঢালাই আবার নতুন করে তৈরি করা উচিত। অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করলে তা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
  • পিলারের শাটার তৈরির পরে তার মধ্যে ঢালাই ঢালার নিয়ম হচ্ছে, ঢালাই ১.৫ মিটারের বেশি উপর থেকে না ঢালা। এতে মিক্সচারের উপাদান আলাদা হয়ে যাবার ঝুঁকি থাকে।
  • ঢালাই করার পর যাচাই করে দেখতে হবে ঢালাই যেন নিরেট হয় ও তাতে কোনো ফাঁকফোকর না থাকে। এক্ষেত্রে নিডল ভাইব্রেটর বা লোহার রড দিয়ে ঠাসাই করা উচিত।

ছাদ ঢালাই করার নিয়ম

উপাদান – সিমেন্ট, বালি এবং নুড়ি/খোয়া।

উপাদানের অনুপাত – সিমেন্টঃ বালিঃ খোয়া – ১ঃ২ঃ৪।

এই মিশ্রণ প্রতি ৫০ কেজির সিমেন্টের বস্তার ক্ষেত্রে মেনে চলতে হবে এবং পানির পরিমাণ হবে সর্বোচ্চ ২৫ লিটার।

২ মিনিট ধরে এই মিশ্রণ মেশিনে প্রস্তুত করতে হবে। যদি হাতে তৈরি করতে হয় তাহলে পাকা মেঝেতে সিমেন্ট-বালুর মিশ্রণ তৈরি করে দক্ষ হাতে মর্টার তৈরি করতে হবে। ১ ফুট পরপর মোটা বাঁশ দিয়ে ঢেকে দিতে হবে বা ধাতব ফ্রেম ব্যবহার করতে হবে, যাতে ছাদ ও বীমের ফর্মা যথেষ্ট মজবুত হয়। আগের বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করে সেন্টারিং, শাটারিং, ঢালাই, জমাট বাঁধা ও কিউরিং ইত্যাদি ধাপ মেনে ঢালাই সম্পন্ন করতে হবে।

মেঝে ঢালাই করার নিয়ম

মেঝে ঢালাই দেবার নিয়ম অনেকটা ছাদ ঢালাইয়ের মতোই। তবে মেঝে ঢালাই তুলনামূলক সহজ, কারণ, এটি ভেঙে গিয়ে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার আশঙ্কা তুলনামূলক কম। তবে এখানেও মান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সবক্ষেত্রেই। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত যা করতে হবে তা হলো-

  • মেঝে ভিটে বালি দিয়ে ভরাট করতে হবে।
  • ভালোভাবে মুগুর দিয়ে দুরমুজ করে সমান করে নিতে হবে।
  • পানি ঢালতে হবে।
  • ঢালাইয়ের আগে ইট বিছাতে হবে।
  • ঢালাইয়ের পুরুত্ব হতে হবে তিন ইঞ্চি।

ঢালাইয়ের উপর নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব দুইই নির্ভরশীল। তাই ঢালাইয়ের আগে নকশা সম্পর্কে নিশ্চিত হোন। অভিজ্ঞ মিস্ত্রির সাহায্য তো প্রয়োজন হবেই, তবে পুরো প্রক্রিয়াতে মিস্ত্রির উপর নির্ভর না করে অবশ্যই দক্ষ প্রকৌশলীর সাহায্য নেওয়া উচিৎ।

কারণ, শুধু অভিজ্ঞতা থেকে আধুনিক পদ্ধতিতে নির্মাণকাজ পরিচালনা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ অসম্ভব। এজন্যই ঢালাইয়ের খুঁটিনাটি সম্পর্কে নিজে সম্যক ধারণা রাখুন ও পেশাদার নির্মাণ নিশ্চিতকরণে হয়ে উঠুন সতর্ক।