জাদুর শহর ঢাকা: বসবাসের বর্তমান অবস্থা

জাদুর শহর ঢাকা। লাল নীল বাতি দেখে আশা মেটানোর শহর ঢাকা। ৪১০ বছরের পুরাতন রাজধানী শহরের আবেদন বাংলাদেশের মানুষের কাছে শুধু রাজধানী বা তিলোত্তমা নগরী হিসেবে নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাণিজ্য, অর্থনীতি আর জীবিকার কেন্দ্রস্থল এই নগরী। এই নগরী কখনো ঘুমায় না।

স্বপ্ন গড়া আর ভাঙার এই কারখানায় যোগ দিতে প্রতিদিন এসে যোগ হচ্ছে নতুন মানুষ। ঢাকায় বসবাসের স্বপ্নে, ঢাকায় এক টুকরো জমির আশা বহু মানুষের। নিজের ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ঢাকায় এক টুকরো ছাদ অনেকের আকাঙ্ক্ষিত বিষয়। যে ঢাকায় বসবাসের জন্য সারা দেশের মানুষের এই আকাঙ্ক্ষা, তার বুকে বসবাসের প্রকৃতি আসলে কেমন?

বসবাসের প্রকৃতি

ঢাকা শহরে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে মাত্র ৪% লোকের নিজের জমি বা বাড়ি রয়েছে ঢাকা শহরের মাঝে। প্রায় দুই কোটি লোকের শহরে সেই সংখ্যাটি মাত্র আট লাখ। বাকি সবাই থাকেন ভাড়া বাসা বা অন্য কোনো আয়োজনে। সাবলেট হিসেবে থাকেন এর একটি বড় অংশ। এছাড়া মেস, হোস্টেল বা বোর্ডিংয়ের পরিমাণও একদম নগণ্য নয়। ভবিষ্যতে এসব বসবাস পদ্ধতির পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদে ভাড়া বা শর্ট টার্ম রেন্টাল পদ্ধতি জনপ্রিয় হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া রেন্ট টু বাই মডেলেও অনেকে আবাসনে যুক্ত হচ্ছেন। 

বসবাস অবকাঠামো

যেকোনো স্থানে বসবাসের জন্য ব্যাক্তিগত ও সামাজিক অবকাঠামোগত দিক থেকে জায়গাটির আবেদন থাকা আবশ্যক। ঢাকা রাজধানী শহর ও বিশাল জনগোষ্ঠির বসবাস এলাকা হিসাবে সামাজিক অবকাঠামোর দিক থেকে দেশের অন্য যেকোনো জায়গা থেকে এগিয়ে। এখানে বাংলাদেশের হিসেবে সর্বোচ্চ মানের সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা রয়েছে।

বিনোদনের শহর হিসাবেও ঢাকা ছাড়িয়ে যাবে যেকোনো বাংলাদেশি শহরকে। রেস্তোরাঁ থেকে সিনেমা হল, পার্ক, উদ্যান থেকে শুরু করে বিনোদন স্পট রয়েছে মানুষের নগরজীবনের অনুসঙ্গ হিসাবে। ধর্মীয় দিক থেকে সকল ধর্মাবলম্বীর জন্যও দরকারি পরিমাণে উপাসনালয় বর্তমান এখানে।

কিন্তু আধুনিক শহর হিসাবে বিশ্বমান থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে ঢাকা। ব্যক্তিগত অবকাঠামোর হিসেবে ঢাকার অবস্থা খুবই শোচনীয়। বর্তমানে ইলেকট্রিসিটি ও পানির ব্যাপারে আগের চেয়ে উন্নতি লাভ করলেও নতুন বাসভবনে গ্যাসের সংযোগ প্রদান বন্ধ রয়েছে। তবে টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবায় ঢাকা বাংলাদেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নগরী, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।


যোগাযোগ ব্যবস্থা

ঢাকা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ- বিষয়টি এভাবে বলাটা আসলে ভুল। ঢাকা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা আসলে দেশের যেকোনো জায়গা থেকে ভালো। প্রান্তিক রাস্তা বাদ দিলে প্রতিটি এলাকা বেশ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা দিয়ে সংযুক্ত।

এছাড়া ঢাকার সাথে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাও অসাধারণ। কিন্তু ঢাকা শহরের যোগাযোগ অবস্থাকে শোচনীয় করে তুলেছে নগরের সক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি মানুষের বাস ও তাদের ব্যক্তিগত যানের উপরে নির্ভরতা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের গবেষণা বলছে, ঢাকা শহরের যানবাহনের গড় গতিবেগ ৭ কিমি/ঘণ্টার চেয়েও কম। এবং এটি আরো কমে আসছে।

রাস্তাঘাটের এই অবস্থার কারণে ঢাকা একটি মৃত নগরী হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থাও ব্যাক্তিমালিকানা নির্ভর হওয়ায় কার্যত কিছু মানুষের স্বেচ্ছাচারিতার মাঝেই বন্দি যোগাযোগ ব্যবস্থা। তবে নতুন আসতে চলা মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হলে এই অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে আশা করা যায়।

মানুষের আয়ের প্রকৃতি

শুরুতেই বলা হয়েছে, ঢাকা আসলে দেশের বাণিজ্য ও অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু। তাই যেকোনো কাজের মূল্যমান ঢাকায় অন্য স্থানের তুলনায় অনেক বেশি। ঢাকায় কৃষিজীবী মানুষের পরিমাণ দেশের অন্য যেকোনো জায়গা থেকে অনেক কম। তবে সবচেয়ে বেশি পেশাগত বৈচিত্র্য দেখা যায় এই নগরেই। একদম নিম্ন আয় থেকে উচ্চ আয়ের সর্বোচ্চ মান পর্যন্ত মানুষ ঢাকাতেই বসবাস করে। আর অর্থনীতি সবচেয়ে সচল বলেই ঢাকায় এসে কাজ করতে মানুষের আগ্রহ বেশি।

ভবিষ্যতের ঢাকা

ঢাকা শহরের এসব সমস্যা নিয়ে আমরা সকলেই কম-বেশি ওয়াকিবহাল। তবে সবাই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই আবাসনে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন। ঢাকাতে মানুষের পরিমাণ যত বাড়বে, অনেক নাগরিক সুবিধার অবনতি চলতেই থাকবে।

বাতাস বা পানির মানের ক্ষেত্রে ঢাকায় নাটকীয় কোনো পদক্ষেপ না নিলে উন্নতি হবার সুযোগ খুব সীমিত। তবে পরিবহন ব্যবস্থা ও জীবনমানের উন্নয়ন ঘটতে পারে নতুন গৃহীত কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে। মাস্টারপ্ল্যান নতুন করে করা হলে ঢাকা থেকে শিল্প কারখানা ও অনেক সেবাকে ঢাকার বাইরের দিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়াই হতে পারে নগর ও নগরের মানুষকে বাচানোর সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ। এক্ষেত্রে এই বিকেন্দ্রীকরণের সময়ে সবচেয়ে ভাল বিনিয়োগ হতে পারে ঢাকার নতুন অঞ্চলের (পূর্বাচল, উত্তরা নতুন ফেজ) জমি বা বাড়িতে বিনিয়োগ করা। যদিও এসব এলাকা এখনই অনেকের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে বা যাচ্ছে।

টঙ্গী বা গাজীপুরের নিকটবর্তী এলাকা, সাভার অঞ্চলীয় অনেক অঞ্চল এবং নারায়ণগঞ্জের দিকেও বিনিয়োগে এখন একটি উপযুক্ত সময়। ঢাকায় হাতিরঝিল প্রজেক্টের সাফল্যের পর জলাধার আইন মেনে জমি ও বাড়ি করাটা এখন সময়ের দাবি। এরকম আরো দুয়েকটি প্রজেক্ট ভবিষ্যতের ঢাকাকে আরেকটু বসবাস উপযোগী করতে রাখতে পারে কার্যকর ভূমিকা।