কংক্রিট মিশ্রণ: অনুপাত, মশলা ও গ্রেড

আধুনিক নির্মাণ কাজ এবং স্থাপত্য কাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো কংক্রিট। বাড়ির স্ল্যাব, দেয়াল, কলাম, সুউচ্চ দালান-কোঠা এসব ছাড়াও রাস্তাঘাট কিংবা ব্রিজ বানানোর অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ কংক্রিট। লোহার ডিফর্মড বার-এর উপরে ঢালাই করে এর ভারবাহী ক্ষমতা বহুগুণে বাড়ানো যায়।

এছাড়া একে ফর্মার মাধ্যমে ইচ্ছামত আকৃতিতে মোল্ড করে নেওয়া যায়। এসব সুবিধার জন্য পৃথিবীর সর্বাধিক ব্যবহৃত অন্যতম নির্মাণ সামগ্রী হলো কংক্রিট। আসুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে সাইটে কংক্রিট বানাতে হবে এবং ব্যবহার করতে হবে।

কংক্রিট প্রস্তুতি

কংক্রিট কোনো একক উপকরণ নয়। সিমেন্ট, বালু, ইটের খোয়া কিংবা পাথরের টুকরার সাথে উপযুক্ত পরিমাণে পরিষ্কার পানি মিশ্রিত করে তৈরি করা হয় কংক্রিট। এই উপকরণের সাথে আরও কিছু কেমিক্যাল মেশানো হয় অনেক সময় শুকানোর দ্রুততার চাহিদার জন্য।

আবার বিভিন্ন গ্রেডের কনক্রিটের জন্য এদের মিশ্রণের অনুপাতও বিভিন্ন রকম হয়। এই মিশ্রণগুলোর স্যাম্পল বানিয়ে সেটি ল্যাবে ওয়েট টেস্ট করতে হয়, যাতে তা কত ভর নিতে পারে সেটা বোঝা যায়। এরপর উপযুক্ত মিশ্রণ ঠিক করার পরে ল্যাবের উপদেশ অনুসারে মিশ্রণ বানিয়ে সাইটের জন্য কনক্রিট মিশ্রণ প্রস্তুত করা হয়। সাইটে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, লোকবল, সময় ও বাজেটের উপর ভিত্তি করে এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তির দূরদৃষ্টির উপর ভিত্তি করে কেমিক্যাল ব্যবহার করার বিষয়টি স্থির করা হয়।

কংক্রিটের গ্রেড

ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট কিংবা কমার্শিয়াল প্রজেক্টে প্রজেক্টভেদে ভার বহন করার শক্তি একেক রকম লাগে। সেজন্য একেক প্রজেক্টে একেক শক্তির কংক্রিট লাগে। সেই প্রয়োজনের ভিত্তিতেই মিশ্রণ প্রস্তুত করা হয়।

কংক্রিটের শক্তি ও মিশ্রণের উপর ভিত্তি করে কনক্রিটের গ্রেড স্থির করা হয়। স্যাম্পল কংক্রিটের টুকরা ২৮ দিন ধরে কিউর করে শুকানোর পরে সেটি ল্যাবের টেস্টের জন্য উপযুক্ত হয়। সেটি নিয়ে পরীক্ষা করে স্থির করা হয় স্যাম্পলটি কোন গ্রেডের। এই গ্রেড নির্ধারণ করার জন্য প্রচলিত স্ট্যান্ডার্ড আছে বিভিন্ন রকমের। যেমন- ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড, ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড। ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড M দিয়ে প্রকাশ করা হয় যার মানে মিশ্রণ। আর ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ডে C দিয়ে প্রকাশ করা হয়, যা দিয়ে কম্প্রেসিভ স্ট্রেংথ বোঝানো হয়। আসুন ইন্ডিয়ান গ্রেডে বিভিন্ন গ্রেডের কনক্রিট মিশ্রণ এবং এতে সিমেন্ট, বালি ও খোয়ার অনুপাত দেখে নেই।

কংক্রিটের গ্রেডমিশ্রণের অনুপাত (সিমেন্ট : বালি : মশলা)চাপ শক্তি
MPa (N/mm2)psi
কংক্রিটের গ্রেড
M5১ : ৫ : ১০৫ MPa৭২৫ psi
M7.5১ : ৪ : ৮৭.৫ MPa১০৮৭ psi
M10১ : ৩ : ৬১০ MPa১৪৫০ psi
M15১ : ২ : ৪১৫ MPa২১৭৫ psi
M20১ : ১.৫ : ৩২০ MPa২৯০০ psi
কংক্রিটের স্ট্যান্ডার্ড গ্রেড
M25১ : ১ : ২২৫ MPa৩৬২৫ psi
M30নকশাকৃত মিশ্রণ৩০ MPa৪৩৫০ psi
M35নকশাকৃত মিশ্রণ৩৫ MPa৫০৭৫ psi
M40নকশাকৃত মিশ্রণ৪০ MPa৫৮০০ psi
M45নকশাকৃত মিশ্রণ৪৫ MPa৬৫২৫ psi
উচ্চ শক্তির কংক্রিট গ্রেড
M50নকশাকৃত মিশ্রণ৫০ MPa৭২৫০ psi
M55নকশাকৃত মিশ্রণ৫৫ MPa৭৯৭৫ psi
M60নকশাকৃত মিশ্রণ৬০ MPa৮৭০০ psi
M65নকশাকৃত মিশ্রণ৬৫ MPa৯৪২৫ psi
M70নকশাকৃত মিশ্রণ

কোন কাজের জন্য কোন গ্রেড?

কাঠামোগত নকশার প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে কংক্রিটের নির্মাণের গ্রেড নির্বাচন করা হয়। দুটি ধরনের কংক্রিট মিশ্রণ রয়েছে, নমিনাল মিশ্রণ এবং নকশাকৃত বা ডিজাইন মিশ্রণ।

নমিনাল মিশ্রণ কংক্রিট হলো সেই গ্রেডের কংক্রিট, যা সাধারণত ছোট স্কেল নির্মাণ এবং ছোট আবাসিক ভবনের জন্য ব্যবহৃত হয় এবং যেখানে কংক্রিটের খরচ বেশি হয় না। নমিনাল মিশ্রণ সাধারণত কংক্রিট নির্মাণের সময় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন মানের নিয়ন্ত্রণ সমস্যার বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য সুবিধাজনক।

ডিজাইন মিক্স কংক্রিট হলো বিভিন্ন ল্যাব পরীক্ষা থেকে নির্ধারিত উপযুক্ত অনুপাতে মিশ্রিত কংক্রিট। নকশাকৃত মিক্স কংক্রিটের ব্যবহারের জন্য উপাদান নির্বাচন, মিশ্রণ, পরিবহন এবং কংক্রিটের স্থাপনের সময় ভালো মান নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। এই ধরনের কংক্রিটে স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য উপাদানের উপর ভিত্তি করে মিশ্রণের অনুপাত সরবরাহ করা হয় এবং বড় আকারের কংক্রিটের নির্মাণ চালিত হলে সেখানে সরবরাহ করা হয়। বড় কংক্রিট নির্মাণ প্রকল্পগুলো ডিজাইন মিক্স কংক্রিট ব্যবহার করে। যেমন- ব্রিজ, রাস্তাঘাট ইত্যাদি ক্ষেত্রে।

নির্মাণকাজে কংক্রিটের গুরুত্ব অপরিসীম। এর সুষ্ঠু মিশ্রণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায় দৃষ্টিনন্দন, সুস্থিত এবং দীর্ঘস্থায়ী বাসাবাড়ি ও দালানকোঠা নির্মাণ। এজন্য সঠিক নিয়ম কানুন মেনে এবং বিশেষজ্ঞের সরাসরি তত্ত্বাবধানে উপযুক্ত অনুপাতে এর মিশ্রণ সুনিশ্চিত করতে হবে ।

ভবনের ফাউন্ডেশন: বাড়ির নিরাপত্তার প্রথম ধাপ

ফাউন্ডেশন বা ভিত্তিকে বলা যায় ভবনের রক্ষাকর্তা। যেকোনো ভবন শুরু হয় ফাউন্ডেশন তৈরি করার মাধ্যমে। মাটির নিচে দরকারি জায়গা খুঁড়ে ফাউন্ডেশন তৈরি করার দৃশ্য যেকোনো নির্মাণ সাইটে গেলে চোখে পড়বে হরহামেশাই। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের গুরুত্বও অপরিসীম।

ভবনের নিজের, ভবনে বসবাসকারী মানুষ এবং তাদের প্রয়োজনীয় সকল সামগ্রীর ওজন বহন করে ফাউন্ডেশন। এছাড়া প্রাকৃতিক অনেক দুর্যোগ থেকে ভবনের রক্ষাকবচ হিসাবেও কাজ করে এটি। আসুন এক নজরে দেখে নেয়া যাক ফাউন্ডেশনের খুঁটিনাটি।

ফাউন্ডেশন কী?

কোনো প্রকৌশল কাঠামোর যে অংশ মাটির নিচে থাকে তাকে ভিত্তি বা ফাউন্ডেশন বা Sub Structure বলে। ভিত্তি বা ফাউন্ডেশন কাঠামোর সর্বনিম্ন অংশ, যার সাহায্যে কাঠামোর নিজস্ব ওজন এবং অন্যান্য আরোপিত ওজনকে মাটির শক্ত স্তরে স্থানান্তর করা হয়। ভিত্তি মূলত মূল ভবন বা সুপার স্ট্রাকচার (Super Structure) এর বেইজ হিসাবে কাজ করে।

অর্থ্যাৎ কাঠামোর নিজস্ব ওজন এবং এর উপরস্থ অন্যান্য ওজনকে মাটির শক্ত স্তরে স্থানান্তর করার জন্য কাঠামোর যে ভূনিম্মস্থ অংশ কংক্রিট ব্লক, পাইল, গ্রিলেজ ইত্যাদির সমন্বয়ে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়, তাকেই ভিত্তি বা Foundation বলে।

ফুটিং কী?

নিজের বা প্রযুক্ত ওজনের কারণে কাঠামোর বসে যাওয়া (Settlement) প্রতিরোধ করার জন্য কাঠামোর লোডকে মাটির শক্ত স্তরে ব্যাপক এলাকায় ছড়িয়ে দিতে হয়। এজন্য ভিত্তির সবচেয়ে নিচের অংশকে ধাপে ধাপে বড় করে প্রশস্ত করা হয়। এ অংশকেই আসলে ফুটিং বলে। ফুটিং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপাদান দিয়ে তৈরি করা হতে পারে। আগেকার দিনে দোতলা গ্রাম্যবাড়ির ক্ষেত্রে কাঠ (Timber) এর ব্যবহার বহুল প্রচলিত ছিল। তবে অধিক লোড আরোপিত হলে ফুটিংকে বর্তমানে আর.সি.সি. ( R.C.C. ) পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়।

ফাউন্ডেশনের প্রকারভেদ

ভিত্তি (Foundation) প্রধানত দুই প্রকার –

১. গভীর ভিত্তি ( Deep Foundation)

২. অগভীর ভিত্তি (Shallow Foundation)

গভীর ভিত্তি

যখন সুপার স্ট্রাকচারের সবচেয়ে নিচের অংশকে অনেক গভীরে স্থাপন করা হয়, তখন তাকে গভীর ভিত্তি বলে।

ফুটিংয়ের প্রকারভেদ অনুসারে এটি তিন প্রকার-

  • পাইল ফাউন্ডেশন
  • কফার ড্যাম
  • কেইসন বা ওয়েল ফাউন্ডেশন 

অগভীর ভিত্তি

যখন সুপার স্ট্রাকচারের সবচেয়ে নিচের অংশকে মাটির অভ্যন্তরে স্বল্প গভীরতায় স্থাপন করা হয়, তখন তাকে অগভীর ভিত্তি বলে।

 

ফুটিং ব্যবহার সাপেক্ষে এটি চার প্রকার-

  • স্প্রেড ফুটিং (Spread Footing)
  • কম্বাইন্ড ফুটিং (Combined Footing)
  • স্ট্রাপ বা ক্যান্টিলিভার ফুটিং (Strap or Cantilever Footing )
  • ম্যাট বা র‍্যাফট ফুটিং (Mat or Raft Footing)

ফাউন্ডেশনের গুরুত্ব

একটি কাঠামো বা Superstructure এর উপর নানা ধরনের লোড কাজ করে। ফাউন্ডেশনের কাজ এগুলোর মধ্যে ভারসাম্য আনা ও অতিরিক্ত ওজনকে ভূমিতে বড় এলাকার উপর ছড়িয়ে দেওয়া। কাঠামোর উপর নানা ধরনের লোড কাজ করতে পারে। তবে তিন ধরনের লোড অবশ্যই কাজ করবে। 

১. ভবনের নিজের ওজন (Dead Load) 

২. প্রযুক্ত ওজন (Live load) 

৩. বাতাস প্রযুক্ত চাপ (Wind load)

এর বাইরে পরিবেশের অবস্থাভেদে পানি, তুষার, বালি ইত্যাদির ওজন প্রযুক্ত হতে পারে। তবে একটি আলাদা ধরনের চাপ সম্পর্কে ফাউন্ডেশন তৈরির সময় বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। সেটি হচ্ছে ভূমিকম্পের প্রভাব।

এক্ষেত্রে ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবশ্যই ফাউন্ডেশন শক্ত হওয়া অত্যাবশ্যক। সাথে সাথে এটিও মনে রাখতে হবে, ফাউন্ডেশন তৈরি একটি অত্যন্ত হিসেবী কাজ ও বিশেষজ্ঞ ডিজাইনারের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়। তাই ফাউন্ডেশন নির্মাণের সময় যা যা অবশ্যই করতে হবে –

  • জমির সয়েল টেস্ট করিয়ে নিন এবং কী ধরনের ফাউন্ডেশন দরকার হবে সেটি সয়েল টেস্টের নিরিখে সিদ্ধান্ত নিন।
  • নিজে কিংবা মিস্ত্রি বা ঠিকাদারের উপর নির্ভর করে ফাউন্ডেশনের সিদ্ধান্ত নেবেন না। এমনকি সাধারণ আলাপের ভিত্তিতেও এই সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। বিশেষজ্ঞ ও পেশাদার ইঞ্জিনিয়ারের সহায়তা নিন যিনি এ পেশায় সক্রিয়। এ সম্পর্কে দরকারি ড্রয়িং তার কাছ থেকে সংগ্রহ করুন। সে অনুসারে পেশাদার ঠিকাদারের মাধ্যমে প্রকৌশলীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে ফাউন্ডেশন ও ফুটিংয়ের কাজ সম্পন্ন করুন। 
  • ফাউন্ডেশনের সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা নিন। প্রকৌশলীর নির্ধারিত সময় পর পর ভবন ইনস্পেকশন করান, যেন ফাউন্ডেশনের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে। 

আপনার বাড়িটি যদি পুরাতন হয়ে থাকে তাহলে ফেরোস্কেনিং ও কোরকাটিংয়ের মাধ্যমে সহজেই ফাউন্ডেশনের বর্তমান অবস্থা আপনি পরীক্ষা করিয়ে নিতে পারেন। শুরুতে ডিটেইলড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে সমস্যা চিহ্নিত করে নিতে হবে। এজন্য প্রতি বর্গফুটে খরচ হতে পারে ৫ থেকে ১০ টাকার মতো। অর্থাৎ ২,০০০ বর্গফুটের ছয় তলা একটি ভবনের মূল্যায়ন করতে খরচ হবে মাত্র ৬০ হাজার টাকা।

আর নতুন বাড়ির ক্ষেত্রে প্রকৌশলী শুরুতেই আপনাকে ফাউন্ডেশনের স্থায়িত্বকাল (সাধারণত ৬০ থেকে ১০০ বছর) সম্পর্কে ধারণা দেবেনএছাড়া রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পর্কেও অবগত করবেন তিনি। ফাউন্ডেশন যেহেতু ভবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর একটি, তাই এর নির্মাণের ব্যাপারে থাকুন বিশেষভাবে সতর্ক।