বাড়ির কাঠামো নিয়ে যা না জানলেই নয়

নিজের বাড়ি করার অনুপ্রেরণা নিয়ে প্রতিদিন নিরন্তর কাজ করে চলে পেশা-বয়স নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু প্রাথমিক জ্ঞানের অভাবে সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে স্বপ্নের বাড়ি করতে গিয়ে হোঁচট খান অনেকেই। বহুতল ইটের দালানই হোক বা পাকা মেঝের টিনশেড হোক, কিংবা ভবিষ্যতের কথা ভেবে ফাউন্ডেশন দিয়ে রাখা একটি ছোট বাড়িই হোক, কাঠামো সবসময়ই সেই বাড়ির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাড়ির ব্যবহার আর স্থায়িত্বের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হলো এর কাঠামো।

বাড়ির কাজে হাত দেওয়ার আগে তাই কাঠামো নিয়ে কিছু প্রাথমিক জ্ঞান সবারই থাকা প্রয়োজন। এতে যেমন বাড়ি নির্মাণে গুণগত মান বজায় রাখার ব্যাপারে সুবিধা হয়, সেই সাথে ভবিষ্যতে বাড়ির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝক্কি-ঝামেলাও কম পোহাতে হয়।  

কাঠামোর প্রকারভেদ 

একটি বাড়ির নির্মাণকালীন কাজগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।

১. স্ট্রাকচারাল (ফাউন্ডেশন, ফ্রেম, রুফ)

২. ফাংশনাল (জানালা/দরজা, প্লাম্বিং, ইলেকট্রিক্যাল, HVAC)

৩. ফিনিশিং (সাইডিং, ড্রাইওয়াল/পেইন্ট, ইন্টেরিয়র ফিনিশ কার্পেন্ট্রি, ফ্লোর ফিনিশিং)

এগুলোর ভিতর স্ট্রাকচার এবং ফাংশনের দরজা-জানালা বাড়ির কাঠামোগত অংশ। একটি বাড়ি নির্মাণের আগে তাই এসব ব্যপারে ন্যূনতম প্রাথমিক ধারণা থাকা প্রয়োজন।

স্ট্রাকচার 

যেকোনো বাড়ির স্ট্রাকচার বা মূল কাঠামোকে মোটা দাগে তিনটি ভাগে ভাগ করে ফেলা যায়। এগুলো হলো- ফাউন্ডেশন, ফ্রেম আর রুফ।

ফাউন্ডেশন

যেকোনো বাসা-বাড়ির ভিত্তিই হলো মাটির নিচ থেকে নির্মাণ করা ফাউন্ডেশন। ভবনের অবস্থানের উপর ফাউন্ডেশনের প্রকৃতি নির্ভর করে। বাড়ি যদি এমন জায়গায় নির্মাণ করা হয়, যেখানের মাটি নরম তাহলে নির্মাণের সময় অনেক গভীরে খনন করে কংক্রিট স্ল্যাব ঢেলে ব্লক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বেজমেন্ট বানানো হয়। 

ফ্রেম

ফাউন্ডেশনের পর আসুন জেনে নেওয়া যাক ফ্রেম বিষয়ে। ফ্রেমিং করতে স্থানভেদে বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন দেশে কাঠ বা স্টিলের ফ্রেমিং জনপ্রিয় হলেও আমাদের দেশে এখনও ফ্রেমিং বলতে কলাম-বীম আর ইটের দেয়ালকেই বোঝায়। ভালো বাসস্থানের জন্য ফ্রেমিং গুরুত্বপূর্ণ। এই ফ্রেমিংয়ের মাঝেই ইনস্যুলেশন, ইলেক্ট্রিক্যাল ওয়্যারিং, প্লাম্বিংয়ের অবস্থান। আবার এই ফ্রেমিংয়েই পোকামাকড় বা ছত্রাক (মোল্ড) ঠাঁই করে নেয়।  

রুফিং

ফ্রেমিংয়ের পর আসে রুফ বা ছাদ, বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে প্রতিটি ফ্লোর স্ল্যাব বা মেঝেও বটে। ছাদের প্রধান কাজই হলো রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে বাঁচানো। ছাদ ঢালাই দেওয়া তাই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ নির্মাণের সময়ে। মাঝেমধ্যে ছাদে লিক সৃষ্টি হলে মেরামতের মাধ্যমেই তা ঠিক করে ফেলা যায়।   

ফাংশন

প্রতিদিন বাসায় বসবাস করতে আমাদের যে সুবিধাগুলো ব্যবহার করা হয়, সেগুলোই ফাংশনাল এলিমেন্ট। এই ব্যাপারগুলো এত স্বাভাবিক এবং বহুল পরিচিত যে আপাতদৃষ্টিতে এগুলো নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করা হয় না।  

দরজা-জানালা

ফাংশনাল ব্যপারগুলোর ভেতরে কেবলমাত্র দরজা-জানালাই সরাসরি বাড়ির কাঠামোর সাথে সম্পর্কিত। ভারবাহী দেয়ালে জানালা দেয়ার ক্ষেত্রে এর লোড ট্রান্সফার সম্পর্কে খেয়াল না রাখলে দেয়াল দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। বড় বড় জানালা আছে এমন বাড়িঘর আমাদের সবারই কম-বেশি পছন্দ। আলো বাতাসের চলাচলের জন্য জানালা খুবই প্রয়োজনীয়। ফ্রেমের মাঝে জানালা নির্মাণ করা হয়, তাতে ট্রিম থাকে বিভিন্নরকম যা নান্দনিক চাহিদাও মেটায়, আবার বৃষ্টি থেকেও রক্ষা করে।

জানালার ক্ষেত্রে যা লক্ষ্য রাখতে হবে তা হলো জানালার ফ্রেম বসানোর সময় কোনোরকম লিক যাতে না থাকে। লিক থাকলেই বৃষ্টির পানি ঘরে প্রবেশ করবে যা দেয়াল স্যাঁতস্যাঁতে করে ফেলে আর ফ্রেমের পচনে ভূমিকা রাখে। দরজার ক্ষেত্রেও নষ্ট হওয়ার কালপ্রিট সেই বৃষ্টির পানি। এছাড়া কাঠের দরজায় পোকামাকড় সংক্রমণের ব্যাপার তো আছেই।  

বাড়ি নির্মাণের আগে বাড়ির কাঠামোগত উপাদানগুলো নিয়ে পর্যাপ্ত ধারণা না থাকলে একদিকে যেমন বাড়ির দৃঢ়তা ঝুঁকির মুখে পড়ে, তেমনি সাইটে কাজ করা ইঞ্জিনিয়ার বা মিস্ত্রীদের সাথে যোগাযোগ অনেকাংশেই বাধাগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে, অল্প একটু সাধারণ জ্ঞানই কিন্তু পারে আমাদের স্বপ্নের বাড়িকে আরও স্বস্তিময় করে তুলতে। 

স্বপ্নের বাড়ি নির্মাণ: ডার্ট ব্যালান্স কীভাবে করে?

নিজের জায়গায় নিজের বাড়ি করার স্বপ্ন মানুষের পরম আরাধ্য। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করে বাড়ি বানানোর জন্য কিছু অত্যাবশ্যকীয় কাজ আমাদের করতে হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো আর্থওয়ার্ক কিংবা জমির মাটির ব্যবস্থাপনা। জমি তৈরি করা যেকোনো নির্মাণকাজের প্রথম ধাপ।

জমির প্রকৃতি, মাটির প্রকরণ, মাটিতে পানির উপস্থিতির পরিমাণ, বালু, কাদা ইত্যাদির অনুপাত সঠিকভাবে পরিমাপ করে এরপরে জমি সঠিকভাবে পরিচর্যা করে তবেই তা বাড়ি তৈরির জন্য প্রস্তুত হয়। আর বাড়ি তৈরির জন্য জমিতে নির্ধারিত কর্মপরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়নকে আর্থওয়ার্ক বলে। আর্থওয়ার্ক একটা স্থিতিশীল, দীর্ঘস্থায়ী বাড়ি নির্মাণের জন্য অত্যন্ত আবশ্যক বিষয়।

ডার্ট ব্যালান্স কী?

সাধারণত এক জায়গার মাটি কেটে পার্শ্ববর্তী জায়গার মাটির উপর ফেলে সে জায়গার মাটি উঁচু করা হয়- এই প্রক্রিয়াটিকেই ডার্ট ব্যালান্স বলে। পরিবহন ও আনুষঙ্গিক খরচ কমানোর জন্য এবং প্রয়োজনমাফিক জমির বিভিন্ন স্থানের উচ্চতা কম বেশি করার জন্য জমি থেকেই এক জায়গার মাটি সরিয়ে আরেক জায়গায় দেওয়া হয় এর জন্য।

সাধারণত কাট এবং ফিল পদ্ধতিতে ডার্ট ব্যালান্স করা হয়। ল্যান্ডস্কেপিং-এর অংশ হিসেবে কিংবা মাটি ভরাট করে গ্রাউন্ড ফ্লোর উন্নীত করতে ডার্ট ব্যালান্স করতে হয়।

মাটির বিভিন্ন স্তরের প্রকৃতি এবং অঞ্চলভেদে, একেক জায়গায় একেকভাবে ডার্ট ব্যালান্স করতে হয় নকশাকৃত বাড়ির প্রয়োজনমাফিক। সাধারণত রাস্তার লেভেল থেকে উঁচুতে বাড়ি বানাতে হয়। এজন্য সাইটে মাটি ফেলে এরপরে এতে সঠিক গ্রাউন্ডওয়ার্ক করে সাইটের স্থান বিশেষ উঁচু করতে হয়। তাই সাইটের মধ্যে যে স্থান নিচু করা উচিত, সেখান থেকে মাটি নিলে বাইরে থেকে মাটি আনার খরচ ও পরিশ্রম দুইটাই কমে যায়, জমির টপ সয়েল সুরক্ষিত হয়।

ডার্ট ব্যালান্স কীভাবে করতে হয়?

কাটা ঢালগুলোর খুব কমই ২:১ অনুপাতে (অনুভূমিক থেকে উল্লম্ব মাত্রাগুলো) তৈরি হয়। রোডওয়ে বা রেলের কাটা অংশগুলো পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর তুলনায় উচ্চতায় কম হয়। অপারেশনাল দৃষ্টিকোণ থেকে রাস্তার কাটা অংশগুলোর সাথে সম্পর্কিত অনন্য পরিবেশগত প্রভাব রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বায়ু দূষণকারী উপাদানগুলো, কাটা অংশ দ্বারা নির্মিত ‘উপত্যকাগুলোতে’ অবস্থান করতে পারে।

বিপরীতভাবে, শব্দদূষণকারী উপকরণগুলো কাটা বিভাগগুলো দ্বারা হ্রাস করা সম্ভব হয় যেহেতু নিচু রোডওয়ের নকশা দ্বারা শব্দের সঞ্চালনের লাইনের কার্যকর বাধা তৈরি করা সম্ভব হয়। ভরাট সেকশনগুলো কোনো রোডওয়ে বা ট্র্যাকবডের উঁচু সেকশান হিসাবে তৈরি করা হয়।

ভরাট সেকশানের পরিবেশগত প্রভাবগুলো সাধারণত বায়ু দূষণ রোধের ক্ষেত্রে অনুকূল, তবে শব্দ সঞ্চালনের ক্ষেত্রে, আশেপাশের বাসিন্দাদের এক্সপোজার সাধারণত বৃদ্ধি পায়, কারণ শব্দ জ্যামিতিতে শব্দ প্রাচীর এবং অন্যান্য ধরনের শব্দ পথের বাধা কম কার্যকর হয়।

আর্থ রিটেইনিং স্ট্রাকচার কী?

রিটেইনিং কাঠামো মাটি এবং/অথবা শিলা ধরে রাখতে প্রস্তুত করা হয়। এগুলো সাধারণত গ্রেডে পরিবর্তনগুলো সামঞ্জস্য করতে, ঢাল আটকে রাখতে কিংবা ঢালের মাটি যাতে খননকৃত গর্তে না আসে সেজন্য ব্যবহৃত হয়। একটি বিস্তৃত অর্থে, আর্থ রিটেইনিং কাঠামোগুলো তাদের ফেসিং অনুসারে শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে, যেমন: এটি যদি ৭০ ডিগ্রির চেয়ে বেশি হয় তবে এগুলো সাধারণত প্রাচীর ধরে রাখার বৈশিষ্ট্যযুক্ত।

সাধারণত, জমি খনন করে পাশের মাটি যাতে খননকৃত গর্তে না পড়ে সেজন্য দেওয়া হয়। বিভিন্ন কাজের উপযোগিতার উপর ভিত্তি করে, বিভিন্ন রকমের আর্থ রিটেইনিং স্ট্রাকচার তৈরি ও ব্যবহার করা হয়, যেমন- অভিকর্ষজ, শীটপাইল, ক্যান্টিলিভার ইত্যাদি। আসুন জেনে নেই কোনটির উপযোগিতা কী।

গ্র্যাভিটি রিটেইনিং ওয়াল

– গ্র্যাভিটি রিটেইনিং ওয়াল কেবলমাত্র পার্শ্বীয় পৃথিবীর চাপ প্রতিরোধ করার জন্য তার নিজের ওজনের উপর নির্ভর করে।

– সাধারণত, এই প্রকারের প্রাচীরটি বিশাল কারণ এটি মাটির চাপকে লড়াই করার জন্য উল্লেখযোগ্য মাধ্যাকর্ষণ বোঝা প্রয়োজন।

– এই ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ প্রাচীর কাঠামোটি নকশাকৃত করার সময় স্লাইডিং, ওভারট্রিং এবং ভারবহন বাহিনী বিবেচনা করা হবে।

– এটি বিভিন্ন উপকরণ যেমন কংক্রিট, পাথর এবং রাজমিস্ত্রি ইউনিট থেকে তৈরি করা যেতে পারে।

– এটি ৩ মিটার পর্যন্ত উচ্চতার জন্য অর্থনৈতিক।

পাইলকৃত রিটেইনিং ওয়াল

– একে অপরের সাথে সংলগ্ন করে কাঠ কিংবা কংক্রিটের পাইলগুলো চালনা করে পাইল ধরে রাখার প্রাচীরটি নির্মিত হয়।

– পাইলকে এমন গভীরতায় বাধ্য করা হয় যা শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে যথেষ্ট যা প্রাচীরের উপরে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করে।

– এটি অস্থায়ী এবং স্থায়ী উভয় কাজে নিযুক্ত করা হয়।

– পাইলড দেয়ালগুলো উচ্চ শক্তিকে ধরে রাখার উপাদান সরবরাহ করে যা পার্শ্ববর্তী কাঠামো বা বৈশিষ্ট্যগুলোতে প্রায় কোনও ঝামেলা ছাড়াই বৃহত খনন গভীরতায় পার্শ্বীয় চাপ ধরে রাখতে সক্ষম।

– স্টিল শীট ব্যবহার করে একটি ঢাল বা খনন করে প্রয়োজনীয় গভীরতা পর্যন্ত তৈরি করা হয় তবে এটি খুব বেশি চাপ সহ্য করতে পারে না।

– শীটের পাইলটি ৬ মিটার উচ্চতা অবধি প্রাচীরটি ধরে রাখে

– সাধারণত শহরে এই রকমের স্ট্রাকচার বেশি ব্যবহৃত হয় যদি ফাউন্ডেশন গভীর হয়।

এছাড়াও আরো কিছু পদ্ধতি আছে যেগুলো বড় বড় সিভিল কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আর্থওয়ার্ক যেকোন স্ট্রাকচারের স্থায়িত্ব ও মজবুত করে রাখার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত এক্সপার্টের পরামর্শ নিয়ে আমাদের আর্থওয়ার্কের প্রয়োজনীয় কাজ করতে হবে। সঠিক নিয়মমাফিক আর্থওয়ার্ক সবার জীবনের নিরাপত্তা দান করে আর আমাদেরকে আমাদের এক টুকরো জমিতে উপহার দেয় স্বপ্নের নীড়।

স্বপ্নের বাড়ি নির্মাণ: পাইলিং এর ইতিবৃত্ত

ভবন নির্মাণ করতে গেলে প্রারম্ভিক পর্যায়ে সবচেয়ে বড় কাজগুলোর একটি হচ্ছে পাইলিং। বহুতল ভবনের নিশ্চিত নিরাপত্তা এবং কাঠামোগত স্থিতির জন্য পাইলিং একটি অত্যাবশ্যকীয় পদক্ষেপ। কিন্তু কোথায় পাইলিং প্রয়োজন হবে, কতটুকু পাইলিং করতে হবে অথবা পাইলিং করার ক্ষেত্রে খরচের হিসেবটাই বা কীভাবে হবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে হবে নির্মাণ কাজে হাত দেবার আগেই।

পাইলিং কী?

পাইলিং মূলত ভবন বা স্থাপনার জন্য এক ধরনের ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি, যা মাটিতে দণ্ডায়মান স্থাপনার ভর একটি স্ট্রাকচারাল পদ্ধতি থেকে মাটির নিচে স্থানান্তর করে ও স্থাপনাকে দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে রাখে।

ভবনের ভার বহন ক্ষমতার উপরে নির্ভর করে কোনো ভবনে পাইলিং করার প্রয়োজন আছে কিনা। এছাড়া বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে তলার সংখ্যাও এক্ষেত্রে একটি নিয়ামক। অনেক সময় একে মাটির গভীরে প্রবেশ করা কলামের সাথেও তুলনা করা হয়ে থাকে।

কেন করা হয় পাইলিং?

যেকোনো স্থাপনাকে সুদৃঢ় করাই মূলত পাইলিং-এর কাজ। এছাড়া এর কাজগুলো হলো মূলত-

১. ভবনের ভার বহন করা।

২. ভবনের চাপে বা অবস্থানের কারণে যেন মাটি সরে না যায় বা ক্ষয়ে না যায় তা নিশ্চিত করা।

৩. ভবনের দ্বারা তৈরি হওয়া ঘূর্ণন মোমেন্ট বা তীর্যক বলকে প্রতিরোধ করা।

৪. অনেক ক্ষেত্রে জমিতে বালি দিয়ে জমি ভরাট করা হয়। পাইলিং এই বালি-মাটির ভারবহন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

৫. ভবনের ভারকে নরম বা সংকোচনশীল পদার্থের মধ্যে দিয়ে মাটির শক্ত স্তরে পৌঁছে দেওয়া।

কী কী ধরনের পাইলিং হয়?

  • কাস্ট ইন সিটু (CAST IN-SITU) পাইল

বাংলাদেশে প্রচলিত পাইলিং পদ্ধতির মধ্যে কাস্ট-ইন-সিটু পাইল সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়এটি মূলত সিলিন্ডার আকৃতির হয়ে থাকে, যার ব্যাস ১৮ ইঞ্চি থেকে ৩০ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারেবিশেষ প্রয়োজনে এটি আরো বাড়ানো যায়। আর দৈর্ঘ্য নির্ভর করে মাটির স্তরের উপর, যা সয়েল টেস্ট রিপোর্টে পাওয়া যায়।

  • স্যান্ড (SAND) পাইল

স্যান্ড পাইলের ধারণাটি অপেক্ষাকৃত নতুন। সাধারণত কম তলা বিশিষ্ট স্থাপনা, যেখানে মাটির ভারবহন ক্ষমতা কম, সেখানে স্যান্ড পাইল করে সেটি বৃদ্ধি করা যায় এবং এধরনের ক্ষেত্রে এটি খুবই কার্যকরতবে বেশি তলাবিশিষ্ট ভবনের ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করা সম্ভবপর নয়।

  • প্রি-কাস্ট (PRE-CAST) পাইল

প্রি-কাস্ট পাইলের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ পাইল আগে কাস্টিং বা ঢালাই করে নেয়া হয় সুবিধামতো স্থানে (অবশ্যই মাটির অভ্যন্তরে নয়)তারপর এটি আধুনিক মেশিনের সাহায্যে বা হাতুড়ি পেটা করে জমির ভুমিতে যথাস্থানে প্রবেশ করানো হয়।

  • শোর (SHORE) পাইল

যে সমস্ত স্থাপনায় বেসমেন্ট থাকে, কিংবা অন্য কোনো কারণে মাটি কাটতে হয়, সেখানে পাশের মাটি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেখানে শোর পাইল করা হয়। এটি করা হয় মূলত, মাটির পার্শ্বচাপ প্রতিরোধ করার জন্য। এর সাথে শিয়ার ওয়ালের তুলনা করা যায়। এটা প্রিকাস্ট বা কাস্ট ইন সিটু বা টিম্বার পাইল হতে পারে।

  • টিম্বার (TIMBER) পাইল

টিম্বার পাইল হলো গাছকে (সাধারণত শাল গাছের কাণ্ড) পাইল হিসেবে ব্যবহার করা। এটি ব্যবহার করা হয় কম তলা বিশিষ্ট ভবনে।

পাইলিং-এর হিসেব

পাইলিং-এর ক্ষেত্রে রড, রিইনফোর্স করা কনক্রিট এবং বোরিং এই তিনটি জিনিসের হিসেব করা হয়। একটি সাধারণ পাইলিং (যা কাস্ট ইন সিটু ধরনের) এর হিসাব নিম্নরূপ:

কাস্ট ইন সিটু পাইলের হিসেব (1:1.5:3)

  • পাইলটির ব্যাস 18″
  • গভীরতা 60′-0″
  • পাইলটিতে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত মোট 8টি 16mm ব্যাসের রড ব্যবহার করা হয়েছে
  • কাট অফ লেভেল আরো 2′-0″ ধরা আছে
  • 10mm রড দিয়ে স্পাইরালের কাজ করা আছে

প্রথম L/4 এবং শেষ L/4 এ স্পাইরালের স্পেসিং 4″C/C, বাকিটা 6″C/C ধরতে হবে। কভারিং আদর্শ পরিমাণ ধরে নিতে হবে।

Estimate for 18″Dia Boring = 1×62′-0″ = 62.00 Rft.

Estimate for RCC (1:1.5:3) = 1x{(πx1′-6″x1′-6″)/4}x62′-0″ = 109.56 Cft.

Estimate for Reinforcement:

For 16mm Dia Main Rod. = 8×62′-0″ = 496.00 Rft.

= 238.57 Kg. Lap = 8×2′-0″ = 16.00 Rft. = 7.69 Kg. For 10mm Dia Spiral

= Nπ{(D+d)+8d}

= 152π{(1′-0″+0.032)+(8×0.032)}

= 152π(1.032+0.256) = 615.04 Rft.

= 115.01 Kg. Lap

= 15×1′-0″

= 15.00 Rft = 2.80 Kg.

Total Rod = 364.00 Kg. = 3.64 qntl.

মনে রাখবেন, প্রত্যেক ভবনের পাইলিং-এর হিসেব একইরকম হবে না। তবে এই ধাপ ও ফর্মুলাতে বসিয়েই হিসেব করা হয়। এভাবে হিসেব করে আপনি পাইলিং-এর আগেই আপনার ভবনের পাইলিং-এর জন্য দরকারি রড, সিমেন্ট, বোরিং-এর হিসেব বের করতে পারেন। এরপর বর্তমান বাজার মূল্যের সাথে মিলিয়ে নিলেই পেয়ে যাবেন আপনার ভবনের পাইলিং-এর খরচের হিসাবটি।

ভবনের ফাউন্ডেশন: বাড়ির নিরাপত্তার প্রথম ধাপ

ফাউন্ডেশন বা ভিত্তিকে বলা যায় ভবনের রক্ষাকর্তা। যেকোনো ভবন শুরু হয় ফাউন্ডেশন তৈরি করার মাধ্যমে। মাটির নিচে দরকারি জায়গা খুঁড়ে ফাউন্ডেশন তৈরি করার দৃশ্য যেকোনো নির্মাণ সাইটে গেলে চোখে পড়বে হরহামেশাই। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের গুরুত্বও অপরিসীম।

ভবনের নিজের, ভবনে বসবাসকারী মানুষ এবং তাদের প্রয়োজনীয় সকল সামগ্রীর ওজন বহন করে ফাউন্ডেশন। এছাড়া প্রাকৃতিক অনেক দুর্যোগ থেকে ভবনের রক্ষাকবচ হিসাবেও কাজ করে এটি। আসুন এক নজরে দেখে নেয়া যাক ফাউন্ডেশনের খুঁটিনাটি।

ফাউন্ডেশন কী?

কোনো প্রকৌশল কাঠামোর যে অংশ মাটির নিচে থাকে তাকে ভিত্তি বা ফাউন্ডেশন বা Sub Structure বলে। ভিত্তি বা ফাউন্ডেশন কাঠামোর সর্বনিম্ন অংশ, যার সাহায্যে কাঠামোর নিজস্ব ওজন এবং অন্যান্য আরোপিত ওজনকে মাটির শক্ত স্তরে স্থানান্তর করা হয়। ভিত্তি মূলত মূল ভবন বা সুপার স্ট্রাকচার (Super Structure) এর বেইজ হিসাবে কাজ করে।

অর্থ্যাৎ কাঠামোর নিজস্ব ওজন এবং এর উপরস্থ অন্যান্য ওজনকে মাটির শক্ত স্তরে স্থানান্তর করার জন্য কাঠামোর যে ভূনিম্মস্থ অংশ কংক্রিট ব্লক, পাইল, গ্রিলেজ ইত্যাদির সমন্বয়ে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়, তাকেই ভিত্তি বা Foundation বলে।

ফুটিং কী?

নিজের বা প্রযুক্ত ওজনের কারণে কাঠামোর বসে যাওয়া (Settlement) প্রতিরোধ করার জন্য কাঠামোর লোডকে মাটির শক্ত স্তরে ব্যাপক এলাকায় ছড়িয়ে দিতে হয়। এজন্য ভিত্তির সবচেয়ে নিচের অংশকে ধাপে ধাপে বড় করে প্রশস্ত করা হয়। এ অংশকেই আসলে ফুটিং বলে। ফুটিং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপাদান দিয়ে তৈরি করা হতে পারে। আগেকার দিনে দোতলা গ্রাম্যবাড়ির ক্ষেত্রে কাঠ (Timber) এর ব্যবহার বহুল প্রচলিত ছিল। তবে অধিক লোড আরোপিত হলে ফুটিংকে বর্তমানে আর.সি.সি. ( R.C.C. ) পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়।

ফাউন্ডেশনের প্রকারভেদ

ভিত্তি (Foundation) প্রধানত দুই প্রকার –

১. গভীর ভিত্তি ( Deep Foundation)

২. অগভীর ভিত্তি (Shallow Foundation)

গভীর ভিত্তি

যখন সুপার স্ট্রাকচারের সবচেয়ে নিচের অংশকে অনেক গভীরে স্থাপন করা হয়, তখন তাকে গভীর ভিত্তি বলে।

ফুটিংয়ের প্রকারভেদ অনুসারে এটি তিন প্রকার-

  • পাইল ফাউন্ডেশন
  • কফার ড্যাম
  • কেইসন বা ওয়েল ফাউন্ডেশন 

অগভীর ভিত্তি

যখন সুপার স্ট্রাকচারের সবচেয়ে নিচের অংশকে মাটির অভ্যন্তরে স্বল্প গভীরতায় স্থাপন করা হয়, তখন তাকে অগভীর ভিত্তি বলে।

 

ফুটিং ব্যবহার সাপেক্ষে এটি চার প্রকার-

  • স্প্রেড ফুটিং (Spread Footing)
  • কম্বাইন্ড ফুটিং (Combined Footing)
  • স্ট্রাপ বা ক্যান্টিলিভার ফুটিং (Strap or Cantilever Footing )
  • ম্যাট বা র‍্যাফট ফুটিং (Mat or Raft Footing)

ফাউন্ডেশনের গুরুত্ব

একটি কাঠামো বা Superstructure এর উপর নানা ধরনের লোড কাজ করে। ফাউন্ডেশনের কাজ এগুলোর মধ্যে ভারসাম্য আনা ও অতিরিক্ত ওজনকে ভূমিতে বড় এলাকার উপর ছড়িয়ে দেওয়া। কাঠামোর উপর নানা ধরনের লোড কাজ করতে পারে। তবে তিন ধরনের লোড অবশ্যই কাজ করবে। 

১. ভবনের নিজের ওজন (Dead Load) 

২. প্রযুক্ত ওজন (Live load) 

৩. বাতাস প্রযুক্ত চাপ (Wind load)

এর বাইরে পরিবেশের অবস্থাভেদে পানি, তুষার, বালি ইত্যাদির ওজন প্রযুক্ত হতে পারে। তবে একটি আলাদা ধরনের চাপ সম্পর্কে ফাউন্ডেশন তৈরির সময় বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। সেটি হচ্ছে ভূমিকম্পের প্রভাব।

এক্ষেত্রে ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবশ্যই ফাউন্ডেশন শক্ত হওয়া অত্যাবশ্যক। সাথে সাথে এটিও মনে রাখতে হবে, ফাউন্ডেশন তৈরি একটি অত্যন্ত হিসেবী কাজ ও বিশেষজ্ঞ ডিজাইনারের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়। তাই ফাউন্ডেশন নির্মাণের সময় যা যা অবশ্যই করতে হবে –

  • জমির সয়েল টেস্ট করিয়ে নিন এবং কী ধরনের ফাউন্ডেশন দরকার হবে সেটি সয়েল টেস্টের নিরিখে সিদ্ধান্ত নিন।
  • নিজে কিংবা মিস্ত্রি বা ঠিকাদারের উপর নির্ভর করে ফাউন্ডেশনের সিদ্ধান্ত নেবেন না। এমনকি সাধারণ আলাপের ভিত্তিতেও এই সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। বিশেষজ্ঞ ও পেশাদার ইঞ্জিনিয়ারের সহায়তা নিন যিনি এ পেশায় সক্রিয়। এ সম্পর্কে দরকারি ড্রয়িং তার কাছ থেকে সংগ্রহ করুন। সে অনুসারে পেশাদার ঠিকাদারের মাধ্যমে প্রকৌশলীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে ফাউন্ডেশন ও ফুটিংয়ের কাজ সম্পন্ন করুন। 
  • ফাউন্ডেশনের সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা নিন। প্রকৌশলীর নির্ধারিত সময় পর পর ভবন ইনস্পেকশন করান, যেন ফাউন্ডেশনের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে। 

আপনার বাড়িটি যদি পুরাতন হয়ে থাকে তাহলে ফেরোস্কেনিং ও কোরকাটিংয়ের মাধ্যমে সহজেই ফাউন্ডেশনের বর্তমান অবস্থা আপনি পরীক্ষা করিয়ে নিতে পারেন। শুরুতে ডিটেইলড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে সমস্যা চিহ্নিত করে নিতে হবে। এজন্য প্রতি বর্গফুটে খরচ হতে পারে ৫ থেকে ১০ টাকার মতো। অর্থাৎ ২,০০০ বর্গফুটের ছয় তলা একটি ভবনের মূল্যায়ন করতে খরচ হবে মাত্র ৬০ হাজার টাকা।

আর নতুন বাড়ির ক্ষেত্রে প্রকৌশলী শুরুতেই আপনাকে ফাউন্ডেশনের স্থায়িত্বকাল (সাধারণত ৬০ থেকে ১০০ বছর) সম্পর্কে ধারণা দেবেনএছাড়া রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পর্কেও অবগত করবেন তিনি। ফাউন্ডেশন যেহেতু ভবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর একটি, তাই এর নির্মাণের ব্যাপারে থাকুন বিশেষভাবে সতর্ক।