আরামদায়ক বাড়ি: ঘর সাজান বুদ্ধি করে

বাড়িতে থাকাকালীন সকলেই চাই একটু আরামদায়ক জায়গা। চাই নিজের ঘরে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার ব্যবস্থা। ঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিতে গুরুত্ব না দিয়ে ঢাকা শহরের অনেকেই যেনতেনভাবে ভবন তৈরি করে, আর এরপর এয়ার কন্ডিশনারের আধিক্য তৈরি করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে।

এতে স্বল্প সময়ের জন্য তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে আসে ঠিকই, কিন্তু সময়ের সাথে বাড়তে থাকে গোটা শহরের তাপমাত্রা। এর সাথে বিশাল অংকের বিদ্যুৎ বিলের বোঝা তো আছেই।  

অন্দরসজ্জা বা ইন্টেরিয়র আজকাল নগরজীবনে বসবাসের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে প্রায় প্রতিটি ঘরেই। তবে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, অন্দরসজ্জার নামে প্রয়োজন বা অপ্রয়োজনে কাঠ বা বোর্ডের আধিক্য দিয়ে ঘর ভরে ফেলেন অনেকে। এতে আসবাবের আধিক্যে দরজা জানালা তো বন্ধ হয়ে যায়ই, সাথে ঘরে তাপ ধারণকারী তলের সংখ্যা বাড়তে থাকে।

অপ্রয়োজনে কখনোই ঘরের দেয়াল কাঠ দিয়ে বা বোর্ড দিয়ে ঢেকে ফেলবেন না। এর মাধ্যমে আপনি ঘরের ভিতরে এবং বাইরে তাপ পরিবহনের স্বাভাবিক হারকে বাধাগ্রস্ত করে ফেলছেন, যা নিঃসন্দেহে ক্ষতিকর। এছাড়াও অন্দরসজ্জায় কিছু জিনিস খেয়াল রাখা উচিৎ।  

তাপ ধরে রাখা নয়

বাংলাদেশের পরিবেশে ঘরের দেয়ালে ফোম, কাঠ ও মেঝেতে কার্পেট ব্যবহার করা উচিৎ নয়। শীতপ্রধান দেশে এগুলো দরকার হয় তাপ ধরে রাখতে। আমাদের পরিবেশে এটি অস্বাস্থ্যকর তাপমাত্রা তৈরি করে। 

ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ব্যবহার

ঘরে যেসকল ইলেকট্রিকাল ডিভাইস ব্যবহার করছেন, তা তাপ উৎপন্ন করে কিনা খেয়াল রাখুন। যদি করে, তাহলে সেগুলোর জন্য বাতাস প্রবাহের ব্যবস্থা রাখুন। অন্দরসজ্জার সময় ফ্রিজ ও ডিপফ্রিজ অনেকে ছোট চেম্বার বার প্রকোষ্ঠে ঢুকিয়ে ফেলেন তিন দিকে বন্ধ করে। এটি ঘরে প্রচণ্ড পরিমাণে তাপ আটকে ফেলে। এছাড়া অন্দরসজ্জায় ছাদে অতিরিক্ত কারুকার্য করে ফ্যানের কার্যকারিতা কমিয়ে ফেলাও ঘরে অযাচিত তাপমাত্রার কারণ।  

ম্যাট্রেসের ফোম

আপনার বসার ঘরের বা লিভিং রুমের সোফার ও শয়নকক্ষের আরামদায়ক বিছানার বা ম্যাট্রেসের ফোম কী পরিমাণ তাপ ধারণ করে সেটিও সতর্কতার সাথে খেয়াল করুন। এমন সোফা বা শয়ন উপকরণ কিনবেন না, যা আপনার আরামদায়ক ঘরকেও তাপমাত্রাজনিত কারণে অস্বস্তিকর করে তুলতে পারে। 

হালকা ইন্টেরিয়র

হালকা কাঠ, বাঁশ বা বেতের আসবাব, মেঝেতে ভারি কার্পেটের বদলে শীতল পাটি, নকশী কাঁথা, প্লাস্টিকের বদলে টবে ছায়াতে বাঁচে এমন গাছ- এধরনের ছোট ছোট পরিবর্তন একদিকে যেমন আপনার ইন্টেরিয়রে নান্দনিকতার ছোঁয়া এনে দেবে, এর পাশাপাশি আপনার ঘরকে করবে ছিমছাম। এধরনের সাজসজ্জার উপকরণ আপনার ঘরের তাপমাত্রা কম রাখতেও বিশেষ ভূমিকা রাখবে। 

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহারের ক্ষেত্রে হোন সচেতন। আপনার স্বস্তির জন্য ২৭-২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা যথেষ্ট। চেষ্টা করুন কোনোভাবেই ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে এসি ব্যবহার না করতে। ঘরের তাপমাত্রা আরামদায়ক পর্যায়ে চলে আসলে এয়ার কন্ডিশনার বন্ধ করে দিন। এতে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের পাশাপাশি পরিবেশের উপরেও চাপ কমবে।

মনে রাখবেন, অন্দরসজ্জার সময় নিজে নিজে এমন পরিকল্পনা করবেন না, যা আপনার বসবাসকেই হুমকির মুখে ফেলবে। নিজের স্বপ্নের বাড়ি আপনার সারাজীবনের শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। পরিকল্পনায় স্মার্ট হলেই শুধুমাত্র দীর্ঘকালীন সময়ের আরামদায়ক বসবাস নিশ্চিত করা সম্ভব।

আরামদায়ক ঘর: তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করুন নির্মাণের সময়েই

চলছে গ্রীষ্মকাল। বাড়তে শুরু করেছে জনবহুল নগরী ঢাকাসহ সারা দেশের তাপমাত্রা। আপাতত সহনশীল পর্যায়ে থাকলেও আর কিছুদিনের মধ্যেই তাপমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে আমাদের আরামদায়ক মাত্রার সীমা। ঘর তৈরি করে ফেললে তো কথা নেই, কিন্তু ভবন নির্মাণের আগেই কীভাবে পরিকল্পনা করতে হবে আরামদায়ক তাপমাত্রায় গ্রীষ্মকালীন ঘর পেতে? 

একটি ভবন নির্মাণের আগেই বসবাসকারী মানুষের জীবন কেমন হবে তা চিন্তা করা উচিৎ। বাংলাদেশের মতো মৌসুমী ও আর্দ্র জলবায়ুর দেশে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি কঠিন, কারণ এখানে তাপমাত্রা আসলে যা থাকে, আর্দ্রতার কারণে তার চেয়ে তিন থেকে চার ডিগ্রি বেশি অনুভূত হয়। তাই তাপমাত্রাজনিত আরাম (Thermal Comfort) নিশ্চিত করতে হয় ভবনের নকশা করার সময়েই। 

ভবনের দিক নির্ধারণ

ভবনের দিক নির্ধারণ হতে পারে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ। বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে বাতাস আসে। পূর্বদিকে সূর্যালোক সংক্রান্ত সমস্যা থাকায় সাধারণত দক্ষিণমুখীভাবে খোলা রাখলে ঘরে বাতাস প্রবেশ করা সহজ হয়।

ভবনের সামনে রাস্তা যেদিকেই থাকুক না কেন, নকশা করার সময় তাই চেষ্টা করা উচিত যেন নিচতলা বাদে প্রতিটি ইউনিট কিছুটা দক্ষিণ দিক পায় ও উত্তর-দক্ষিণ বরাবর যথেষ্ট খোলা (দরজা, জানালা, বারান্দা) থাকে।

সব ইউনিটের চিন্তা

তিন বা চার ইউনিটের ভবনে প্রতিটি ইউনিটকে দক্ষিণ দিক দেওয়া সম্ভবপর হয় না। সেক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ভবন তাপমাত্রা গ্রহণ করে ও রাত্রে ত্যাগ করে ভোর নাগাদ ঠাণ্ডা হয়।

তাই পশ্চিম দিকে তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়। এ দিকটি যথাসম্ভব বন্ধ রাখতে চেষ্টা করা উচিৎ, বাকি তিনদিকে খোলার পরিমাণ বৃদ্ধি করে। যদি দিক নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়, অন্তত বেশি ব্যবহার হবে এমন কক্ষগুলো সঠিক দিকে বসানো উচিৎ।

ক্রস ভেন্টিলেশন

অনেক ক্ষেত্রে নানা কারণে এসবের কোনোটিই সম্ভবপর না হতে পারে। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে দরকারি হচ্ছে ক্রস ভেন্টিলেশন নিশ্চিত করা। প্রতিটি ঘরে দুটি দিক যদি বাইরের সাথে খোলা থাকে, তাহলে প্রতি দেয়ালে একটি করে জানালা দেওয়া উচিৎ। যদি সম্ভবপর না হয়, একই দেয়ালে দুটি জানালা দিয়ে বা জানালার আয়তন বাড়িয়ে ক্রস ভেন্টিলেশন নিশ্চিত করা যায়।

ক্ষেত্রবিশেষে দরজা-জানালা মিলিতভাবেও ক্রস ভেন্টিলেশনের কাজ করতে পারে। কক্ষের ভেতরের বাতাস প্রবাহমান রাখতে পারলে তাপমাত্রা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ফ্যান কোনো নতুন বাতাস তৈরি করে না। শুধুমাত্র ঘরের বাতাস প্রবাহমান রাখে। তাই দরজা-জানালা খোলা রেখে ফ্যান চালালে সেটি অধিক কার্যকর হয়।

নিয়ন্ত্রিত আলো প্রবেশ

ঘরে সূর্যের আলো প্রবেশ করলেই ঘর অধিকতর গরম হবে, তা সত্যি নয়। সূর্যালোককে যদি স্তিমিত করে ঘরে প্রবেশ করানো যায়, তাহলে তা যেমন আলোর চাহিদা পূরণ করবে, তেমনি ঘরের তাপমাত্রাও বাড়বে কম। এটি করতে সূর্যালোক ঘরের বেষ্টনির যে তলগুলোতে পড়ছে, সেগুলো ছায়ায় রাখতে পারলে ঘরের তাপমাত্রা অনেক কম থাকবে।

আমরা আজকাল সব বাসাতেই থাই গ্লাসের জানালা ব্যবহার করে থাকি। এটি জানালার আয়তন অর্ধেক করে ফেলে এবং স্থায়ী কাঁচের ব্যবহারের কারণে ঘরে তাপ আটকে থাকে বেশি। আমাদের ঐতিহ্যবাহী পাল্লা ধরনের জানালার ব্যবহার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পালন করতে পারে দুর্দান্ত ভূমিকা।

জলছাদ

ভবনের উপরের দিকের বাসিন্দারা গ্রীষ্মকালে বেশি সমস্যা বোধ করেন। বিশেষ করে একদম উপরের তলায় যারা থাকেন, তাদের জন্য সারাদিন ধরে দেয়ালের পাশাপাশি ছাদও গরম হয়ে যাওয়ায় তাপমাত্রা বেড়ে যায় অনেকগুণ। এক্ষেত্রে শীতলীকরণের বিশেষ ব্যবস্থা করাটা দরকারি।

জলছাদের প্রক্রিয়াটি অনেকদিন ধরেই এদেশে করা হচ্ছে। এর সাথে সাথে ফাঁপা ইট বা হলো ব্রিকের সাহায্যে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। দেয়ালের উপরের দিকে যত খোলা বা ফাঁকা জায়গা তৈরি করা যাবে ঘর থেকে তাপ বিকিরণ তত সহজ হয়। এছাড়া ছাদে যত বেশি এলাকা জুড়ে বাগান করা যাবে, ছাদ তত কম গরম হবে।

খোলামেলা নকশা

অবশ্যই বাক্স আকারে ফ্ল্যাটের ইউনিট নকশা করা উচিৎ নয়। পর্যাপ্ত বারান্দা, ইনডোর আউটডোর কানেকশন সহ জায়গা, সানশেড ও কার্নিশ ব্যবহার করতে হবে- যদি একটি ভবনে বাসিন্দারা এর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান। কংক্রিট ইটের চেয়ে বেশি তাপ ধারণ করে। নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের সময় সেগুলোর হিট ফ্যাক্টর দেখে নেওয়া উচিত।

আর মনে রাখবেন- ডিগ্রিধারী ও যোগ্য স্থপতি ছাড়া আপনার জীবনযাত্রার সাথে বাড়ির সম্পর্কের ব্যাপারে আর কোনো পেশার মানুষই যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন না। তাই নকশার মধ্যে তাপমাত্রাজনিত সকল বিষয় সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পনার স্বার্থে নকশা করান শুধুমাত্র লাইসেন্সধারী স্থপতির সাহায্যে।