আদিকাল থেকে বর্তমান: বসতবাড়ির বিবর্তনের ইতিহাস

মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা হলো বাসস্থান। বাসস্থান মানুষকে বিরুদ্ধ শক্তি থেকে দেয় সুরক্ষা, বন্যপ্রাণীর আক্রমণ থেকে দেয় নিরাপত্তা, দেয় দিনের শেষে স্বস্তিতে ঘুমানোর জায়গা। কালের বিবর্তনে মানুষের কারিগরী দক্ষতা বেড়েছে, বেড়েছে নতুন নতুন প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও তা প্রয়োগ করার দক্ষতা। মানুষ নিজের আরাম-আয়েশের সাথে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে, নিত্য-নতুনভাবে বানিয়েছে তার বাসস্থান, যা কালের পরিক্রমায় তার স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে গেছে। আসুন দেখে নেওয়া যাক, কীভাবে কালের বিবর্তনে মানুষের বাসস্থান আদিমকাল থেকে আজকের আধুনিক রূপ পেয়েছে।

প্রস্তরযুগ

যখন মানুষ বাসা বানাতে পারত না, তারা প্রকৃতি থেকে নিজের সব চাহিদা পূরণ করত। মানুষ গাছের ছায়াতে ছোট ছোট দলভুক্ত হয়ে থাকত। ঝড়, বৃষ্টি, প্রখর রোদ থেকে বাঁচতে গাছের শীতল ছায়া তাদের দিত খুব সীমিত পরিসরের সুরক্ষা।

তারা একসময় হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ থেকে বাঁচতে গাছের উপরে আশ্রয় নেয়। যেসব স্থানে ঘন বন পাওয়া যেত না, সেসব স্থানের পাহাড়ে বা আশেপাশের গুহাতে মানুষ থাকার চেষ্টা করত। গুহা মানুষকে আবহাওয়া থেকে রক্ষা করত আরো ভালোভাবে। আগুন আবিষ্কারের পরে বন্যপ্রাণী থেকে সুরক্ষা আরো সুনিশ্চিত হলো। প্রত্নতাত্ত্বিকরা পাথরের তৈরি বাসন এবং অস্ত্র আবিষ্কার করে কার্বন ডেটিং-এর মাধ্যমে এত সব তথ্য পেয়েছেন।

তখনও মানুষ খাদ্য সংগ্রহ ও সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াত। নিজের ঘর তৈরি করতে পারত না।

মধ্য-নব্যপ্রস্তরযুগ

এসময়ে মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে থাকার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারে এবং আগুন ও চাকার আবিষ্কারের সাথে সাথে নিত্যনতুন যন্ত্রের সাহায্যে ছোট ছোট ঘর গড়ে তুলে একটি ছোট জায়গার বন সাফ করে। এসময়ে মানুষ কিছু লম্বা, সরু রকমের গাছ, যেমন- খেজুর বা সুপারি এসব গাছের মাথা বাঁকিয়ে একসাথে করে বেঁধে এর উপর ঝোপ-ঝাড় দিয়ে মানুষ তৈরি করে প্রথম বাসা।

এরকম দলভুক্ত বাসাগুলোতে বাসকারী সদস্যরা তাদের সুরক্ষার জন্য বাসার চারিদিকে বেড়া দিত। এর মধ্যে গবাদি পশু আর তারা নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারত। কিছু কিছু স্থানে বড় গাছ পাওয়া না গেলে মাটি, পাথর কিংবা শিকারকৃত পশুর হাড় দিয়ে বাসা বানাতো।

সভ্যতার উত্থান

সমাজ ব্যবস্থার অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ প্রকৃতির উপর নিজের আধিপত্য স্থাপন করতে শুরু করে। বিভিন্ন বড় বড় নদ-নদীর অববাহিকায় মানুষ গড়ে তোলে বড় বড় সভ্যতা। নীলনদের অববাহিকায় প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা, টাইবার নদীর পাশে রোমান সভ্যতা, তাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর অববাহিকায় সুমেরীয় বা আক্কাডিয়ান সভ্যতা, আমাজন বেসিনের অববাহিকায় ইনকা সভ্যতা কিংবা মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা সভ্যতার বিস্তার এই কথাটার ইঙ্গিত দেয়।

এসব অববাহিকা থেকে পাওয়া মাটি দিয়ে বানানো ইট হয়ে উঠে ঘর বানানোর প্রধান উপকরণ। বড় বড় স্থাপনা বানাতে পাথরের ব্যবহারও লক্ষ্যণীয়। পোড়ামাটি বা পোড়া ইটের বাসার সাথে অঞ্চল ভেদে ছাদে নলখাগড়া, তালপাতা, প্যাপিরাস পাতা কিংবা কাঠের ব্যবহার হতো। সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে এদের ব্যবহার ও তৈরিতে এসেছে নতুনত্ব।

মধ্যযুগ

মধ্যযুগে ইউরোপে ধর্মপ্রচার, নতুন দেশ আবিষ্কারের জন্য মানুষ নৌপথে বিভিন্ন স্থানে যেতে শুরু করে। মানুষের মধ্যে শ্রেণিবিভেদ আরো প্রকট হয়ে উঠে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং কৃষক শ্রেণির ঘর তৈরির পদ্ধতিতে আসে ভিন্নতা, মূলত অর্থনৈতিক কারণে।

শিল্প বিপ্লবের আগপর্যন্ত হাতে বানানো হতো গৃহ নির্মাণ সামগ্রী, যা শুধু ধনীরাই কিনে ব্যবহার করতে পারত। এজন্য কাঠ, খড় কিংবা পাটখড়ির ব্যবহার শুরু হয় বাড়ি তৈরিতে। বহিশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে বড় বড় দুর্গ বানানো হতো পাথর, চুন, কাদামাটি, খড় এবং কাঠ দিয়ে। পরবর্তীতে লোহার ব্যবহার শুরু হয় অল্প পরিসরে।

শিল্পযুগ

শিল্পযুগের শুরুতে কলকারখানার কার্যক্রম ও বিভিন্ন যন্ত্রের আবিষ্কার মানুষের সভ্যতার অগ্রগতির চাকাকে করে তোলে বেগবান। কম সময়ে দ্রুততার সাথে নিখুঁতভাবে নির্মাণসামগ্রী বানানো শুরু হয়।

লোহা ও কলে পোড়ানো ইটের ব্যবহার মানুষের গৃহের স্থাপত্যকলার আমূল পরিবর্তন আনতে শুরু করে। মানুষের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য এনে দেয় শিল্প বিপ্লব। রেল ও সড়ক যোগাযোগের উন্নতি হওয়ায় মানুষের কাছে দ্রুততার সাথে পণ্য পৌঁছানো সম্ভবপর হয়ে উঠে।

বর্তমান যুগ

শিল্প, বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমাগত উন্নতির সাথে সাথে মানুষ সহজে গৃহনির্মাণ সামগ্রী তৈরির জন্য গবেষণা শুরু করে। কংক্রিট হলো এর ফসল। আরসিসি স্ট্রাকচারে কনক্রিট ও লোহার মেলবন্ধনের ফলে মানুষ আজ বানাতে পারছে আকাশচুম্বী অট্টালিকা, বড় বড় ব্রিজ।

ইটের ব্যবহার হয়েছে আরো বহু বিস্তৃত। কাঁচ দিয়ে হচ্ছে জানালা, যা বড় বড় দালানকে দিচ্ছে নান্দনিক ও আকর্ষণীয় রূপ। মানুষ নিজের স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বসতি গড়ার স্বপ্ন দেখছে আজ চাঁদে কিংবা মঙ্গলে। আজকে মানুষের বাসার কোনো স্বপ্নই অলীক নয়। যা ভাবতে পারা যায়, তার প্রায় সবটাই বাস্তবে করা সম্ভবপর এখন।

এভাবেই কালের বিবর্তনে মানুষ নিজের বাসাকে আজকের স্বপ্নাতীত, কল্পনাতীত স্থানে চিন্তা করতে পেরেছে। এর পুরোটাই সম্ভব হয়েছে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং মানুষের স্বপ্ন দেখার সাহসের জন্য।

আপনার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে, একটি সুন্দর বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য স্থপতি এবং প্রকৌশলীরা কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। এভাবেই নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাসা বানানোর সাথে সাথে বিবর্তিত হচ্ছে মানুষের বাসস্থানের চাহিদা ও পূরণ হচ্ছে সভ্যতার আধুনিকতম সব স্বপ্ন।