বাড়ি তৈরির পথে আইনি কাজ

বাংলাদেশে ভূমি নির্মাণ ও বাড়ি করার ধাপে ধাপে প্রতারণা এবং ঠকে যাওয়ার গল্প এত বেশি সাধারণ যে, সাধারণ মানুষ পুরো প্রক্রিয়াটিকে অনেক ক্ষেত্রে শুধু ঝামেলারই মনে করেন না, রীতিমতো ভয় পান। অবশ্যই বাড়ি নির্মাণের সাথে ভূমিক্রয়, রেজিস্ট্রেশন, সরঞ্জামাদি ক্রয়-বিক্রয় এবং শ্রমনির্ভর নির্মাণকাজের মতো নানা ধাপ রয়েছে বলে এ ব্যাপারে অনেকগুলো আইন মেনে চলার ব্যাপার থাকে এবং প্রক্রিয়াটি সহজ নয়। কিন্তু জানা থাকলে ও সচেতন থাকলে সকল ঝামেলাই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। 

আসুন দেখে নিই বাড়ি নির্মাণের বিভিন্ন ধাপে আইনি ঝামেলা এড়িয়ে চলতে আপনাকে কী কী করতে হবে।

তথ্য সংগ্রহ

জমি কেনার আগেই জমি ও তার ইতিহাস সম্পর্কে সকল তথ্য জেনে নিন। প্লট নম্বর, বর্তমান মালিকের নাম, ঠিকানা, খতিয়ান নম্বর এই বিষয়গুলি অবশ্যই জেনে নিন। বর্তমানে সিটি কর্পোরেশনের জমির ডেটাবেজ রয়েছে। পৌরসভা পর্যায়েও ডেটাবেজ তৈরির কাজ চলছে। তাই এই তথ্যগুলো জানতে পারলে জমি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনা পাওয়াটা অনেক সহজ হয়।

যিনি প্রপার্টি কিনতে চাচ্ছেন, তার উচিত প্রপার্টির আগের সব ইতিহাস তথ্য খুঁজে বের করা। যদি আপনার এলাকায় ডেটাবেজ তৈরির কাজ না হয়ে থাকে তাহলে এ ব্যাপারে আগের মালিক ও এলাকার লোকজন আপনাকে সহায়তা করতে পারেন।

দলিলের প্রযোজ্যতা যাচাই

দলিল হচ্ছে যেকোন সম্পত্তির মালিকানার একমাত্র স্বীকৃত নথি। তাই প্রতিটি ব্যাপারেই দলিল হতে হবে আসল, ত্রুটিমুক্ত এবং নির্ভরযোগ্য। এই নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করা যাবে সাবরেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে। সাবরেজিস্ট্রি অফিসে প্রত্যেকটি রেজিস্টার্ড দলিলের অধীনে আসল দলিলের রেজিস্ট্রি সম্পর্কে সকল তথ্য থাকে। সাবরেজিস্ট্রারকে সরকারের নির্ধারিত ফি দিয়ে সহজেই মূল দলিলের একটা কপি বের করা যায়। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তির ক্ষেত্রে বৈধ বণ্টননামা রয়েছে কিনা সেটাও জেনে নেওয়া যাবে।

এছাড়া এই সম্পদের গত দশ বছরের সকল তথ্য অনুসন্ধান করা যায় সাবরেজিস্ট্রারের মাধ্যমে। জমির মালিকানা যদি বদল বা বন্ধকে রাখা হয়ে থাকে কখনো, সেই তথ্যও পাওয়া যাবে এভাবে। যাচাই করে নিন কেনার আগে যে আপনার জমি দায়মুক্ত কিনা। 

খতিয়ান ও পোর্চা মিলিয়ে নেয়া

এলাকার সরকারি তফসিল অফিসে কোন জমির খতিয়ান বা পোর্চা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া থাকে। খতিয়ান বা পোর্চার সকল তথ্যই তফসিল অফিস থেকে জানা যাবে, জমির মালিকের নামের সাথে জমির বাকি তথ্যের মিল আছে কিনা সেটাও যাচাই বাছাই করে রাখতে হবে। কোন তথ্যে ভুল থাকলে সেটারও একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা সেখানে উল্লেখ থাকবে। তাই ক্রস রেফারেন্সিং এর জন্য দলিলের বিপক্ষে খতিয়ান ও পোর্চার নাম্বারও মিলিয়ে নিন।

মিউটেশান

অনেকক্ষেত্রে জমির দলিল পুরাতন হলে জমিতে বর্তমান বিক্রেতার নাম থাকে না। কিন্তু জমি কারো কাছ থেকে কিনতে হবে অবশ্যই জমির মালিকের নাম মিউটেশান করে আপডেট করে নেয়াটা অত্যন্ত দরকারি। মিউটেশানের জন্য তিনটি দলিল থাকতে হয়-

১. নামজারি জমাভাগ প্রস্তাবপত্র

২. ডুপ্লিকেট কার্বন রশিদ

৩. মিউটেশান খতিয়ান

খাসজমি এবং ইজারা

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনেক ক্ষেত্রে জমি নিজের বিভিন্ন কাজে ইজারা দিয়ে থাকেন। আইন অনুসারে সরকার দেশের সব জমির মালিক এবং এই কারণেই জমির খাজনা সরকারকে দিতে হয়। কিন্তু নির্ধারিত কাজের জন্য সরকার কোন জমি ইজারা দিয়ে থাকলে তা আইনত কেনাবেচা করা যায় না। তবে আবাসিক কারনে ইজারা দেয়া হলে তার জন্য আলাদা বিধান রয়েছে।

বাংলাদেশের অনেক আবাসিক প্রপার্টিই সরকারের কাছ থেকে ইজারা নেওয়া। সরকার সাধারণত সিডিআর কিংবা রাজউক ইত্যাদি সরকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে অনেক প্রপার্টি ইজারা দিয়ে থাকে। তাই ওসব প্রপার্টির উপর কোন কাজ করতে গেলে এইসব সংস্থার অনুমতি নিতে হয়, আপনি যে প্রপার্টি কিনতে চাচ্ছেন সেটা সরকারি ইজারায় আছে কিনা সেটা নিজে গিয়ে অনুসন্ধান করে আসতে হবে।

খাজনা পরিশোধ

জমি কেনার আগের বছর পর্যন্ত জমির খাজনা পরিশোধ আছে কিনা সেটা অবশ্যই দেখে নেয়া উচিত। নইলে পরবর্তীতে জমিতে বকেয়া খাজনা খরিদ্দারকেই শোধ করতে হবে। দিতে হতে পারে জরিমানাও। এছাড়া আগের মালিকের দীর্ঘদিনের খাজনা বাকি থাকা সাপেক্ষে হতে পারে সরকারি মামলাও। তাই খাজনা পরিশোধের রশিদসহই জমি ক্রয় করা উচিত।

ইমারত নির্মাণে আইন

জমি কেনার পরে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা না মেনে ভবন করলে সেটা সরকার যেকোন সময় ভেঙ্গে দিতে পারেন। তাই আপনাকে যা যা করতে হবে তা নিয়ে আলাপ করা হলো।

অবশ্যই একজন লাইসেন্সধারী স্থপতিকে দিয়ে ভবনের নকশা করাতে হবে যেন ইমারত নির্মাণ বিধিমালার FAR, MGC এর পাশাপাশি সকল আগুন, ভূমিকম্প এবং সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান মেনেই নকশাটি করা হয়। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে FAR বা MGC সম্পর্কে কিছু ধারণা থাকলেও এবং ইট কাঠের দাম বলতে পারলেও একজন নন-লাইসেন্সড মানুষ ডিজাইন বা নকশা করার যে প্রাথমিক জ্ঞান তাও রাখেন না। সুতরাং এই চর্চা শুধু বিপদই ডেকে আনবে।

পৌরসভা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়মের কড়াকড়ি কম হলেও এখানেও একইভাবে একটি বিধি বিধানের বই রয়েছে। এখানেও পেশাদারের সাহায্য নিয়েই ডিজাইন করানো উচিৎ। কারণ, স্থান পরিবর্তন হলেও নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইনে ছাড় দেয়া উচিৎ নয়।

ভবন নির্মাণের সময় শ্রম অধিকার আইন অনুসারে শ্রমিকদের নিরাপত্তা, অনুমোদিত মজুরি এবং জীবনমান সম্পর্কে সচেতন হোন। কোন দুর্ঘটনায় আইন অমান্য হলে সেটাও হতে পারে ঝামেলার কারণ।

নকশা রাজউক বা সিটি কর্পোরেশান থেকে পাশ করানোর পর সেই নকশায় বড় পরিবর্তন আনা (যেমন- ফ্লোরের আয়তন বাড়ানো বা ফাঁকা জায়গা কমিয়ে দেয়া) আইনত দণ্ডনীয়। এ অবস্থায় যেকোন ইন্সপেক্টর এসে প্রমাণ সাপেক্ষে ভবন বা তার অংশবিশেষ ভেঙে দিতে পারেন। তাই এই চর্চাও পরিহার করতে হবে। এ জন্য অনুমোদিত ড্রয়িং অনুসারেই ভবন তুলুন এবং নকশা সংরক্ষণ করুন।

আইন মেনে প্রতিটি ধাপে ভবন তৈরি করলে আপনি ভবন সংক্রান্ত কাজে আইনি ঝামেলায় পড়বেন না। ব্যাপারটি সময়সাপেক্ষ হলেও আপনি ভবনে বসবাস করবেন আরো বেশি সময় ধরে। সেই দীর্ঘ সময়ে নিজের এবং নিজের পরবর্তী প্রজন্মের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে পারে আপনার সচেতনতাই।

ভূমিক্ষয় কেন হয়? জানুন রোধের উপায়

আমাদের বাসার জন্য জমি ঠিকমতো তৈরি করে এরপরেই আমরা বাড়ি নির্মাণ শুরু করি। কিন্তু প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে টপসয়েল এবং মাটির ক্ষয় হয়। যা আমাদের স্থাপনাকে করে তোলে দুর্বল এবং আমাদের জীবন হয়ে উঠে বিপদসঙ্কুল। এজন্য আমাদের বাসাবাড়ির আশেপাশের জমি ক্ষয় রোধ করা খুবই জরুরি।

জমির ক্ষয় রোধ করতে না পারলে ফাউন্ডেশন দুর্বল হয়ে যায় এবং ক্ষেত্রবিশেষে দেয়ালও ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে ভেঙে পড়তে পারে। তাই নিরাপদ আবাসস্থানের জন্য আমাদেরকে অবশ্যই জমির ক্ষয় রোধ করতে হবে। আসুন আমরা জেনে নিই জমি কী কী কারণে ক্ষয় হয়, কী কী ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে আর কী কী উপায়ে আমরা ভূমিক্ষয় রোধ করতে পারি।

ভূমিক্ষয় কেন হয়?

সাধারণত বাড়ি নির্মাণের আগে জমির উপযুক্ত পরিচর্যা করে নিয়ে এর পরে নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। প্রাকৃতিক কারণেই মূলত জমির ক্ষয় হয়। যেসব এলাকায় বৃষ্টির প্রবণতা বেশি, সেসব এলাকায় জমিতে ভূমিক্ষয়ও বেশি, যদি সঠিক ট্রিটমেন্ট না করা হয়। বৃষ্টির ফোঁটা ক্রমাগত পড়ায় টপসয়েলের উপাদান হাল্কা হয়ে পানির স্রোতে ভেসে যায়। ফলে ভূমিক্ষয় দেখা যায়।

এছাড়া বাতাসের প্রভাবে মাটির উপরের স্তর হাওয়ায় ভেসে সরে যায়। এতে করে মাটির আদি আকৃতি নষ্ট হয় এবং ভূমিক্ষয় হয়। ক্রমাগতভাবে পানি মাটিতে পড়লেও ভূমিতে আস্তে আস্তে ক্ষতি হতে থাকে। উপরের স্তরের মাটি সরে যেতে থাকে। এই সরে যাওয়ার ফলে মাটির গঠনগত প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়ে ভূমিক্ষয় হয়।

নদীভাঙন ভূমিক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। সাধারণত নদীর গতিপথ পরিবর্তনের সাথে সাথে নদীর পাড়ের ক্ষয় হয়, পাড় ভাঙে। এর সাথে সাথে পাড়ে অবস্থিত মাটি নদীগর্ভে ক্ষয় হয়ে বিলীন হয়ে যায়। এছাড়াও টেকসই পদ্ধতিতে জমির ব্যবহার না করা, আগুন ইত্যাদি বহুবিধ কারণেও ভূমির টপসয়েল ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং ভূমিক্ষয় হয়।

কী কী হয় ভূমিক্ষয়ে

টপসয়েল হ্রাস

এটি মাটি ক্ষয়ের বৃহত্তম প্রভাব। কারণ টপসয়েল উর্বর, যদি এটি সরিয়ে ফেলা হয়, এটি উদ্ভিদের ক্ষতি করে বা জমির কার্যকারিতায় ক্ষতির কারণ হতে পারে। এতে করে জমির ল্যান্ডস্কেপিং করা দুরূহ হয়ে যায়।

মাটির সংক্ষেপণ

টপসয়েলের নিচে মাটি সংক্রমিত এবং শক্ত হয়ে যায়, এটি পানির গভীরতর স্তরগুলোতে অনুপ্রবেশের ক্ষমতা হ্রাস করে, যা আরও মারাত্মক ক্ষয়ের ঝুঁকি বাড়ায়।

জৈব এবং উর্বর পদার্থ হ্রাস

জৈব পদার্থের সাথে ভারী টপসয়েল অপসারণের ফলে জমির নতুন উদ্ভিদ বা ফসলের নতুন করে জন্মানোর ক্ষমতা হ্রাস পাবে। যখন নতুন ফসল বা উদ্ভিদগুলো এলাকায় সফলভাবে স্থাপন করা যায় না, এটি জৈব পুষ্টির হ্রাস স্তরের চক্রকে স্থায়ী করে।

দুর্বল নিষ্কাশন

কখনো কখনো বালির সাথে অত্যধিক সংকোচন কার্যকর আলাদা ভূমির ক্রাস্ট তৈরি করে একটি কার্যকর ভূত্বক তৈরি করতে পারে, যেটি গভীর স্তরে পানি প্রবেশ করতে আরও কঠিন করে তোলে।

কিছু উপায়ে, ঘন কাদাযুক্ত মাটির কারণে এটি ক্ষয়কে সহায়তা করতে পারে, তবে এটি যদি বৃষ্টির পানি বা বন্যার ফলে বৃহত্তর স্তরের পানিবায়ু স্থায়ী হয়, তবে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে ভূপৃষ্ঠের পানির উপর। ফলে পানি জমে থেকে যায়।

উদ্ভিদের পুনরুৎপাদন সংক্রান্ত সমস্যা

যখন একটি সক্রিয় ফসলি জমিতে মাটি ক্ষয় হয়, বিশেষত বাতাস হালকা মাটির বৈশিষ্ট্য, যেমন- নতুন বীজ এবং চারাগুলো কবর দেওয়া বা ধ্বংস করা হয়। এটি ভবিষ্যতের ফসল উৎপাদনকে প্রভাবিত করে।

মাটির অম্লতার মাত্রা

যখন মাটির কাঠামো ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যায় এবং জৈব পদার্থের পরিমাণ হ্রাস পায়, তখন মাটির অম্লতা বৃদ্ধির উচ্চতর সম্ভাবনা থাকে, যা উদ্ভিদ এবং ফসলের বৃদ্ধির ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করবে।

দীর্ঘমেয়াদী ক্ষয়

দুর্ভাগ্যক্রমে, যদি কোনো অঞ্চল ক্ষয়প্রবণ হয় বা এর ক্ষয়ের ইতিহাস থাকে তবে ভবিষ্যতে একে সংরক্ষণ করা আরও শক্ত হয়ে যায়। এমন প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে এই অঞ্চলের মাটির কাঠামো এবং জৈব পদার্থকে হ্রাস করেছে, যার অর্থ এটি দীর্ঘকালীন মেয়াদে পুনরুদ্ধার করা আরও কঠিন হবে।

পানি দূষণ

মাটি থেকে ক্ষয়ের একটি বড় সমস্যা, যেটি বিশেষত কৃষি প্রক্রিয়াগুলোর জন্য ব্যবহৃত হয়, সেটি হলো সার বা কীটনাশক ব্যবহারের মতো পলল এবং দূষণের বেশি সম্ভাবনা রয়েছে। এটি মাছ এবং পানির গুণমানের উপর উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করতে পারে।

কীভাবে রোধ করা যায়?

গাটার এবং ডাউনস্প্রাউট

বৃষ্টি পড়ার সময় আপনার ছাদের কার্নিশে জমা বৃষ্টির পানি যেদিকে প্রবাহিত করা দরকার সেদিকে এমনভাবে গাটার ও ডাউনস্প্রাউটগুলো সেট করতে হবে যাতে তারা বেলে বা কমপ্যাক্ট মাটিতে নির্মিত বাড়িগুলোর জন্য ঘর থেকে কমপক্ষে ১০ ফুট দূরে প্রসারিত মাটিতে পানি ফেলে দেয়। নর্দমাগুলো যাতে ঘরের দীর্ঘ প্রান্তে চলে যায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

ক্ষয় নিয়ন্ত্রণ

বাড়ির ফাউন্ডেশনের চারদিকে ক্ষয় নিয়ন্ত্রণের অন্যতম সহজ উপায় হচ্ছে ল্যান্ডস্কেপিং বা সজ্জাসংক্রান্ত ব্যবস্থা, যা দুটি উদ্দেশ্যকে পরিপূর্ণ করে। মাটি যেখানে চান সেখানে রাখার জন্য ঘাস বা অন্য কোনো নিচু স্থান থেকে জমিটিতে কভার লাগান।

অন্যান্য বিকল্পের মধ্যে ল্যান্ডস্কেপ কাঠ, কংক্রিট পেভারস, লাইনারস, শিলা বা নুড়ি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যদিও গাছের ছাল ফাউন্ডেশনের বিপরীতে ভালো দেখায়, তবে বৃষ্টিপাতের জায়গায় জায়গায় থাকার পক্ষে এটি উপযোগী নয়।

ফ্রেঞ্চ ড্রেন

বাড়ির ফাউন্ডেশনের চারপাশে একটি ফ্রেঞ্চ ড্রেন সিস্টেম ইনস্টল করুন। যখন আপনার ফাউন্ডেশন মাটির পৃষ্ঠের নিচে কয়েক ফুট প্রসারিত হয়, একটি পরিখা খনন করে, নুড়ি দিয়ে রেখাযুক্ত করুন এবং ঘর থেকে পানি সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এটিতে পারফোরেশনসহ একটি বিশেষ ড্রেন রাখুন। নুড়ি দিয়ে একে ঢেকে রাখুন এবং তারপরে নুড়ি দিয়ে মাটি যুক্ত করুন। পানির প্রবাহটি ভিত্তি থেকে দূরে সরাতে একটি ৩ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ ডাউনস্লোপ রয়েছে, তা নিশ্চিত করুন।

গ্রেড মেরামত করুন

ফাউন্ডেশনের চারপাশে ঢালটি মেরামত করুন। ফাউন্ডেশনের ১০ ফুটের মধ্যে মাটি ৩ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে ঢালু হওয়া উচিৎ।

আপনি যদি গ্রেডটি মেরামত করতে না পারেন, তবে খনন করুন এবং যদি সম্ভব হয় তবে ফাউন্ডেশনে একটি আর্দ্র বাধা যুক্ত করুন। অন্যথায়, বাড়ি থেকে দূরে পানি চ্যানেল করার জন্য একটি সামান্য ডাউনস্লোপ দিয়ে একটি সোয়েল তৈরি করুন। আপনি কংক্রিট বা শিলা দিয়ে সোয়েলটি লাইন করতে পারেন। তবে শিলাটি যথেষ্ট পরিমাণে ভারী হওয়া উচিৎ।

নিষ্কাশন নজরদারি করুন

ঝড়ের সময় নিষ্কাশন নজরদারি করুন। আপনার যদি ড্রেনেজ ব্যবস্থা থাকে যা পানি প্রবাহিত করে পানি সরিয়ে ফেলে, তাহলে সেই ড্রেনগুলো পাতা এবং ময়লা মুক্ত রাখুন। আপনার ছাদে থাকা পানির ট্র্যাপ এবং ডাউনস্পাউট সিস্টেমের ক্ষেত্রেও এটি একইভাবে প্রযোজ্য।

ঢাকায় বসবাস: কেমন হতে যাচ্ছে ভবিষ্যৎ?

“ঢাকা শহরে একটি বাড়ি”- এই স্বপ্নের সাথে বাস্তবতার পার্থক্য বাড়তে বাড়তে মধ্যবিত্তের সামর্থ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে প্রতিনিয়তই। চারশরও বেশি বছরের পুরাতন রাজধানী এই নগরী সারা বাংলার মানুষের বসবাসের জন্য এর লক্ষ্য হয়ে উঠেছে, এই অঞ্চলে সভ্যতা যতই এগিয়েছে। পুরাতন ঢাকায় মানুষের বসত শুরু হয়েছিল ঢাকা রাজধানী হবারও অনেক আগে।

বুড়িগঙ্গা নদীর অববাহিকা আর মধুপুর ট্র্যাকের লালচে উর্বর মাটি কৃষির পাশাপাশি শিল্প ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ নগরীতে পরিণত করেছিল ঢাকাকে। এরপর বৃটিশ ভারত, পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশের জন্মের পর ক্রমেই বেড়েছে শহর হিসাবে ঢাকার গুরুত্ব। এর সাথে সাথে আরো বেশি মানুষ এসেছে ঢাকায় বসবাস করতে।

ঢাকা শহরে আবাসন প্রথমদিকে পরিকল্পিত ছিল না একদমই। পুরাতন ঢাকায় সেই অপরিকল্পিত কিন্তু স্বতস্ফূর্ত আবাসন এখনো দেখা যায়। কিন্তু ঢাকায় যত মানুষ বাড়তে থাকল এবং বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, টেলিফোন ও ইন্টারনেটের মতো সুযোগ সুবিধা কেন্দ্রীয়ভাবে সরবরাহের প্রয়োজনীয়তা বাড়তে থাকল, ততই পরিকল্পিত আবাসনের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়।

এ লক্ষ্যেই ঢাকার অভিজাত আবাসিক এলাকা হিসাবে প্রথমে ধানমণ্ডি গড়ে ওঠে। তবে মধ্যবিত্তের আবাসনের জন্য বড় আকারে পরিকল্পিত নগরের অংশ হয়ে ওঠে মোহাম্মদপুর। সেকেন্ড ক্যাপিটাল হিসাবে শেরেবাংলা নগরের গোড়াপত্তন এ অঞ্চলে মানুষের ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। স্বাধীনতার পরবর্তী ৫০ বছরে ঢাকা শহর বড় হয়েছে অত্যন্ত দ্রুত।

এই কারণে আবাসনের চাহিদা কয়েক বছরের মাথায় বেড়েছে প্রায় শত গুণ। এই মানুষগুলোকে আশ্রয় দিতেই নতুন অভিজাত অঞ্চল হিসাবে গড়ে উঠেছে বনানী, গুলশান ও বারিধারা। এর মধ্যে অ্যাপার্টমেন্ট ও রিয়েল এস্টেট বিপ্লবের জের ধরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের সামর্থ্যের মধ্যে চলে আসে ধানমণ্ডি। একই সাথে গড়ে ওঠে উত্তরা এবং মিরপুরের পল্লবী। বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটি।

এখন পূর্বাচল ও উত্তরার বিভিন্ন অংশ গড়ে উঠছে নতুন এলাকা হিসাবে। কিন্তু ঢাকার আশেপাশে থাকতে মানুষের গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার অঞ্চলের দিকে ঝুঁকে পড়া বা ঢাকার ক্রমেই খারাপ হতে থাকা নাগরিক অবস্থার কারণে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে- “ঢাকায় কি এখনো আবাসন সম্ভব?”

ঢাকার আবাসনের বর্তমান অবস্থা চিন্তা করলে একে খরচের হিসাবে তিনভাগে ভাগ করা যায়। সেই অঞ্চলগুলোতে দামের তারতম্য সুবিধা অসুবিধায় রয়েছে ভিন্নতা। সেগুলোই এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।

বাজেট যখন সীমিত নয়

ঢাকায় আবাসনের জন্য মানুষ মূলত পছন্দ করে সকল নাগরিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন অঞ্চলগুলো। এইসব সুযোগ সুবিধার মধ্যে রয়েছে উন্নত আঞ্চলিক যোগাযোগ, ভালো মার্কেট বা বড় সুপারস্টোরের সহজলভ্যতা, লাইফস্টাইল ব্র্যান্ডগুলোর উপস্থিতি, ভালো স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাছাকাছি দুরত্ব। এসব সুযোগ সুবিধার কথা চিন্তা করলে ঢাকায় এখনো গুলশান, বনানী, বারিধারা উঁচু বাজেটের মানুষজনের জন্য পছন্দের জায়গায় থাকবে উপরেই। এর সাথে রয়েছে ধানমণ্ডি।

এসব জায়গায় নতুন প্লটের পরিমাণ খুবই সীমিত। তবে রেনোভেশান ও ডেভেলপার দ্বারা পুরাতন বাড়ি অধিগ্রহণের কারণে এখনো উঠছে নতুন ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাট বাসার আকার বড় চাইলে ও বাজেটগত সমস্যা না থাকলে এই অঞ্চলগুলো এখনো হতে পারে ঢাকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় আবাসন অঞ্চল।

অর্থের সর্বোচ্চ বিনিময়মূল্য

ঢাকায় বাসা তৈরি করা অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ইস্যু। অনেকের কাছেই বাজেট তুলনামূলক বেশি থাকলেও পুরাতন একটি বাসার চেয়ে নতুন একটি অঞ্চলে গোছানো আবাসন ব্যবস্থার মধ্যে নিজের অর্থের সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করতে চান। তাদের জন্য পূর্বাচল, উত্তরা নতুন প্রজেক্ট এবং বসুন্ধরা অঞ্চল হতে পারে আবাসনের জন্য খুবই ভবিষ্যতমুখী কিন্তু গোছানো পছন্দ।

এসব জায়গায় প্লট বরাদ্দ একবার শেষ হয়ে গিয়েছে বেশ কিছুদিন আগে। কিন্তু জায়গার বর্তমান মালিক থেকে জায়গা কেনা বা একদম ফ্রেশ জমিতে বাসা নির্মাণের সুযোগ এখনো বর্তমান। এছাড়া এসব অঞ্চলে গড়ে উঠছে বিভিন্ন ডেভেলপারের পরিকল্পিত আবাসন, যেগুলোতে দাম একটু বেশির দিকে হলেও আগামী ১০ বছরের মধ্যে পরিকল্পিত এবং দুর্দান্ত আবাসন গড়ে ওঠাটা শুধুই সময়ের ব্যাপার।

ঢাকার নতুন আসা মেট্রো রেল প্রজেক্ট ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে মিরপুরের নতুন অঞ্চল, বেড়িবাঁধ ও ক্যান্টনমেন্ট-এর মাটিকাটা অঞ্চলেও জমির দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিদিন। এসব অঞ্চলে বিনিয়োগও হতে পারে বেশ স্মার্ট বিনিয়োগ। এসব অঞ্চলে এখনো অবকাঠামোগত উন্নয়ন কম হলেও পলিসিগত কারণে এখানে বসতি ঘন হতে অনেক সময় লাগবে এবং অনেকদিন এলাকা থাকবে খুবই পরিকল্পিত।

বাজেট আবাসনের ঢাকা

অল্প বাজেটে ঢাকায় ভালো বাসা করতে অনেকেই বেছে নিচ্ছেন বসিলাকে। আশেপাশে মোহাম্মাদপুর ও মিরপুরের অবস্থান হওয়ায় এখানে পলিসিগত বাধ্যবাধকতা একটু কম এবং অর্থনৈতিকভাবে এ অঞ্চল তুলনামূলকভাবে ধরাছোঁয়ার মধ্যেই। এর বাইরে উত্তরায় রেল লাইনের অন্য পাশে উত্তর ও দক্ষিণখানে, এয়ারপোর্ট এর আশেপাশের অঞ্চলে অনেকদিন ধরেই বাজেট ভিত্তিক আবাসন খুবই জনপ্রিয়।

১,০০০ বর্গফুটের আশেপাশে আদাবর এবং শেখেরটেক অঞ্চলেও এখনো ফ্ল্যাট পাওয়া যায়। একই অবস্থা রাজারবাগ ও ধানমণ্ডির পেছনে থাকা জিগাতলা এলাকারও। এসব অঞ্চল একটু ঘনবসতিপূর্ণ হলেও যারা ঢাকা শহরের জনসমাগমকে উপভোগ করেন তারা এসব জায়গায় থাকতে অপছন্দ করবেন না।

এর বাইরে টঙ্গীসহ চেরাগ আলী হয়ে প্রায় সমগ্র গাজীপুর শহরাঞ্চল, নারায়ণগঞ্জ, কেরাণিগঞ্জ এবং সাভার অঞ্চল বেশ জনপ্রিয়। কাজের প্রকৃতি অনুসারে অনেকে এসব জায়গা থেকেও যাওয়া আসা করে থাকেন প্রায় নিয়মিতই। সুযোগ বা যাতায়াতের সুবিধা থাকলে এ অঞ্চলগুলোও ঢাকার অনেক অঞ্চল থেকে ভালো বসবাসের সুবিধা নিয়ে হতে পারে আপনার চিন্তাভাবনার অংশ, কারণ সিটি কর্পোরেশনের বাইরে জমির দামে বেশ তারতম্য লক্ষ্য করা যায়।

আবাসন সমস্যাকে ঠিকভাবে সমাধান করতে ঢাকাকে আমাদের বিকেন্দ্রিকরণ ও পরিকল্পিত আবাসনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা খুবই দরকারি। তাই জমি বা বাড়িতে বিনিয়োগ করতে হবে আমাদের বুঝে শুনে। বাজেটের সাথে বা জীবনের প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশেই মানুষের বাড়ি তৈরির সিদ্ধান্তকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। নিজের ও সামাজিক চাহিদার মধ্যে পর্যাপ্ত ভারসাম্যই পারে আপনার বাড়ির জন্য সবচেয়ে উপযোগী অঞ্চল সম্পর্কে আপনাকে নিশ্চিত করতে।