আপনার স্বপ্নের বাড়ি: কেমন হবে দেখতে?

নিজের বাড়ি মানে কখনোই শুধু একটি ইট-কাঠের বাক্স নয়। নিজের বাড়ি মানে এই বিশ্বের সাত বিলিয়ন মানুষের স্বপ্ন, নতুন নতুন আশা। প্রতিদিনের কাজে যাবার পেছনে অনেকের অনুপ্রেরণাই নিজের জন্য একটি থাকবার জায়গা নিশ্চিত করা।

প্রত্যেকের মানসপটে তাই নিজের বাড়ির একটি ছবি আছে। রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু চাওয়া-পাওয়া। কারো হয়তো চাই আরেকটু বড় একটা বেডরুম, কারণ ছোট ঘরে দমবন্ধ হয়ে আসে, কারো হয়তো চাই দখিনের বারান্দায় এক চিলতে রোদে বসে বই পড়ার একটু জায়গা অথবা পুরো পরিবার বেড়াতে এলে হৈচৈ করে সিনেমা দেখার মতো একটা ড্রয়িংরুম!

একটি প্রশ্ন পেশাদার স্থপতি বা নকশাবিদরা প্রায়ই শুনে থাকেন-

কেমন দেখতে হবে আমার বাড়ি?”

এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, আপনার বাড়ি বাইরে থেকে দেখতে যেমন হবে সেটিকে বলা হয় এলিভেশন। এই এলিভেশনের নকশা নির্ভর করে বাড়ির জানালা, দরজা, ছাদের প্যারাপেটের নকশা, মূল প্রবেশপথের নকশা ইত্যাদির উপর। এছাড়া এটি আপনার ভবনের কাঁচামাল এবং আলো-বাতাস প্রবেশের পথ কীভাবে স্থপতি তৈরি করছেন তার উপরও নির্ভরশীল। তাই বাড়ির নকশা করার আগে কখনোই এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব নয়।

একজন দক্ষ স্থপতি কখনো একদিনে বা বলা মাত্রই এই প্রশ্নের উত্তর দেবেন না বা দিতে পারবেন না। আপনাকে অবশ্যই তাকে ধারণা দিতে হবে যে, বাড়িটির জন্য কতটুকু জায়গা রয়েছে, কতজন থাকবেন, কী কী চাই এবং বাড়ি থেকে আপনি কী আশা করেন।

এরপর অবশ্যই তাকে সময় দিতে হবে তার চাহিদামতো, কারণ, এটি একটি সহজে বা অল্প সময়ে করে ফেলার কাজ নয়। এটি একটি স্পর্শকাতর ও সময়সাপেক্ষ কাজ। অবশ্যই মনে রাখবেন স্থপতির ডিজাইনের মানের উপর নির্ভর করবে আপনার পরবর্তী জীবনের জীবনযাত্রার মান।

তাই, প্রথমে বাড়ির প্ল্যান দেখুন এবং মিলিয়ে নিন আপনার চাহিদা। এরপর স্থপতি বাড়ির বাহ্যিক সৌন্দর্যের দিকে নজর দিতে পারবেন। ড্রয়িং বুঝতে সমস্যা হলে আপনাকে দেখানো হবে বাড়ির ত্রিমাত্রিক ছবিও। স্থপতির কাজ শেষ হয়ে গেলে প্রকৌশলী বাড়ির স্ট্রাকচার এবং কৌশলগত সুবিধা (পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ) স্থপতির নকশার সাথে যুক্ত করবেন। প্রতিটি সুইচবোর্ডের অবস্থানও আপনার নিরাপত্তার জন্য কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই ধৈর্য ধারণ করে পেশাদার মানুষদের কাজের মান উন্নয়নের সময় দিন।

আপনার বাড়ির বাহ্যিক রূপ আপনি চাইলে পরিবর্তন করতে পারবেন। পরিবর্তন করাতে পারবেন প্ল্যানও। কিন্তু, সেটি করতে হবে নির্মাণকাজে হাত দেবার আগেই। তাই নির্মাণ শুরু করা বা নির্মাণ করা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণের আগে যথাযথ নকশা, টেকনিক্যাল ড্রয়িং শেষ করা ও সেটাতে পেশাদার সাহায্যের সাথে আপনার সামর্থ্য অনুসারে অংশগ্রহণ।

শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য গোটা নকশার খুব সামান্য অংশ। বাইরে এবং ভেতরে প্রতিটি অংশের সৌন্দর্য নিশ্চিত করতে পারলেই শুধু একটি সুসজ্জিত ও বসবাসযোগ্য বাড়ি পাওয়া সম্ভব হবে।

সুন্দর বাড়ি চান? মনোযোগ দিন দেয়াল, লিন্টেল ও সানশেডে!

একটি ভবনের স্থাপনা নির্মাণে কাঠামোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মোটা দাগে নির্মাণ কাঠামো বলতে মানবদেহের কঙ্কালতন্ত্রের মতো বীম, কলাম ও ফাউন্ডেশনকেই বুঝে থাকি। কিন্তু কাঠামো তৈরি হলেই ভবন প্রস্তুত হয় না। একে ব্যবহার উপযোগী করতে আরো বেশ কিছু উপাদান রয়েছে।

প্রাত্যহিক ব্যবহারের জন্য দরজা, জানালা বা ফিনিশিং ফিক্সচার হিসাবে টাইলস, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, প্লাম্বিং এবং স্যানিটারি সামগ্রীর সাথে আমরা কম-বেশি পরিচিত। কিন্তু এর সাথে কিছু অপরিচিত বা কম পরিচিত বিষয়ও রয়েছে যা ভবন নির্মাণে হাত দেওয়ার আগে চেনা ও এদের সম্পর্কে জানা অত্যন্ত দরকারি।

দেয়াল

সাধারণভাবে আমরা যে চারটি দ্বিমাত্রিক তল দিয়ে একটি ঘরে আবদ্ধ থাকি তাকেই আমরা দেয়াল বলি। কিন্তু ব্যক্তিগত জায়গা তৈরিই দেয়ালের একমাত্র কাজ নয়। কাজ বা উদ্দেশ্যভেদে দেয়ালকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-

ভার বহনের ক্ষমতা অনুসারে দেয়াল দুই প্রকার-

১. ভারবাহী দেয়াল (একে শিয়ার ওয়াল বলে ও এটি কাঠামোর অংশ)

২. অভারবাহী দেয়াল (একে নর্মাল ওয়াল বলে, এটি কাঠামোর অংশ নয়)

ভারবাহী দেয়াল একবার তৈরি হয়ে গেলে, কখনোই ভবনের ক্ষতি সাধন না করে একে ভাঙা বা স্থানান্তর প্রায় অসম্ভব। তবে অভারবাহী দেয়াল খুব সহজে ও অল্প খরচে ভেঙে স্থান পরিবর্তন করা যায়। ভারবাহী দেয়ালে সাধারণত দরজা-জানালা বা কোন ধরনের বিরতি থাকে না।

কার্যভেদে দেয়াল আবার দুই ধরনের হতে পারে।

১. প্রধান দেয়াল (Main wall/Exterior Wall)

২. অপ্রধান দেয়াল (Partition wall)

প্রধান দেয়াল

প্রধান দেয়াল ভবনের চেহারা ও ভবনের সাফল্যের ক্ষেত্রে খুবই দরকারি উপাদান। এটি তৈরির সময় যা যা খেয়াল রাখতে হবে তা হলো-

  • প্রস্থের হিসাবে প্রধান দেয়ালকে অবশ্যই লিন্টেল, জানালা ও ভার বহনকারী হলে ভবনের ভারও বহন করতে পারতে হবে।
  • প্রধান দেয়াল প্রাকৃতিক (যেমন- ঝড়, বন্যা বা সাইক্লোন) ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ (যেমন- হামলা ও চুরি) থেকে অভ্যন্তরের বাসিন্দাদের রক্ষা করতে পাড়ার মতো যথেষ্ট মজবুত হতে হবে।
  • কলাম হিসেবে না থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই দেয়াল মজবুত করতে ইটের দেয়ালে ১০ ফুট বা ১২ ফুট পর পর পিলার তৈরি করা হয়।
  • সাধারণত গ্রেড বীমের উপর প্রধান দেয়াল তৈরি করতে হয় এবং এর নিচে দেয়ালের ফুটিং অবশ্যই দিতে হয়।

নির্মাণপদ্ধতি

প্রধান দেয়াল তৈরিতে প্রথমেই দেয়ালের কেন্দ্ররেখা বের করতে হবে। এরপর গ্রেড বীমের উপর গ্রাউটিং করতে হবে। এর উপরে মর্টার বসিয়ে সমান করে দিতে হবে। দেয়ালের দুই প্রান্তে দুটি ইট রেখে তাতে একটু সুতা এমনভাবে টান টান করে বাঁধতে হবে যেন তা দেয়ালের একপাশে থাকে। সুতার গা ঘেঁষে সোজাসুজি এক স্তর ইট গেঁথে দেয়াল সোজা করতে হবে।

সব ইটের মাপ সমান থাকে না, কারণ, হাতেই তৈরি করা হয় অধিকাংশ ইট। ইটের সাইজ মতো মিলিয়ে মর্টার বেশি বা কম দিয়ে মাপ ঠিক রাখতে হবে। ২৪ ঘণ্টা পর থেকে কিউরিং শুরু করতে হবে এবং কিউরিং শেষ হবার আগে প্লাস্টার করা যাবে না। প্রধান দেয়ালের ক্ষেত্রে নানা ধরনের বন্ড ব্যবহার করা যায়। তবে বাংলাদেশে স্ট্রেচার বন্ড সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়।

অপ্রধান দেয়াল

অপ্রধান দেয়ালকে সাধারণ নির্মাণ পরিভাষায় পার্টিশান দেয়াল বলা হয়ে থাকে। এটি অনেক ধরনের উপাদান বা উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়। ইট, কাঠ, গ্লাস, কমার্শিয়াল বোর্ড ইত্যাদি নানা ধরনের পার্টিশান দেয়াল দেখা যায়। এটি সাধারণত ভারবাহী হয় না। তবে কলাম বা শিয়ার ওয়াল ধরনের পার্টিশান দেয়ালও মাঝে মাঝে ব্যবহার করা হয়। এর নির্মাণ প্রক্রিয়া প্রধান দেয়ালের মতোই। তবে সাধারণত তা ৫ ইঞ্চি পুরু হয় ও এক স্তর ইট দিয়ে সাধারণভাবে তৈরি করা হয়ে থাকে।

এই প্রকারভেদের বাইরেও এক ধরনের দেয়াল রয়েছে যাকে বলা হয় প্যারাপেট।

প্যারাপেট

প্যারাপেট সম্পর্কে মূল্যবান তথ্যগুলো এরকম-

  • সমতল ছাদ হলে ছাদের সীমানা বরাবর সীমানার চারপাশের দেয়ালের উপর প্যারাপেট তৈরি করা হয়। এটি অনেক ক্ষেত্রে রেলিং এর মতোও কাজ করে।
  • ১২.৫ সেমি পুরুত্ব ও ১২.৫ সেমি উচ্চতা হচ্ছে প্যারাপেট তৈরির সর্বনিম্ন মাপ। প্রয়োজনে উচ্চতা আরো বাড়ানো যায়।

  • ইটের প্যারাপেট হলে মূল দেয়ালের সাথে একই বন্ড বজায় রেখে গাঁথুনি তৈরি করা হয়। প্রতি ১০ ফুট বা তিন মিটার পর পর ২৫ সেমি X ২৫ সেমি মাপের পিলার স্থাপন করে দেয়াল মজবুত করা যায়।
  • ছাদ ঢালাই শেষ হলে প্যারাপেট নির্মাণ করা হয়। উল্লেখ্য যে, কংক্রিটের ঢালাই লোহা বা স্টিলের প্যারাপেটও তৈরি করা যায়।

লিন্টেল

দরজা বা জানালা টিকিয়ে রাখতে ও শুন্যস্থানের উপরের ভর বহন করতে যে আনুভূমিক সমর্থন তৈরি করা হয় তাকে বলে লিন্টেল। দেয়াল ইট বা পাথরের তৈরি হলেও লিন্টেল তৈরি হতে হয় কাঠামোর উপাদান থেকেই। সাধারণত কাঠ, স্টিল বা কংক্রিট ব্যবহার করা হয় লিন্টেল তৈরিতে। সাধারণ বাংলাদেশি নির্মাণে কংক্রিটের তৈরি লিন্টেলই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

সানশেড ও লিন্টেল

সানশেড হচ্ছে সূর্যের সরাসরি আলো থেকে রক্ষা পেতে নকশায় স্থাপন করা অংশ। আমাদের দেশের গ্রীষ্মপ্রধান আবহাওয়া ও জলবায়ুর জন্য সানশেড প্রায় অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। এটি শুধু আমাদের সূর্যের তাপ থেকেই রক্ষা করে না, বরং ঘরে বৃষ্টি ঢুকতেও প্রাথমিক পর্যায়ে বাধা দেয় ও জানালা থেকে বৃষ্টিকে দূরে রাখে।

এক্ষেত্রে একটি মজার বিষয় হচ্ছে, সানশেড ও লিন্টেল অনেক ক্ষেত্রে একই সাথে তৈরি করা যায়। এক্ষেত্রে সানশেড একটি স্বাধীন ক্যান্টিলিভার হিসেবে কাজ করে, যার রিইনফোর্সমেন্টগুলো লিন্টেলের ভেতরে প্রবেশ করানো থাকে। একারণে সানশেডের ফর্মওয়ার্ক অনেক সময়ই লিন্টেলের সাথেই তৈরি করা হয় এবং ঢালাইও একবারেই করে ফেলতে হয়। কংক্রিট জমাট বেঁধে গেলে সাধারণভাবেই কিউরিং করে এর মান উন্নত করতে হয়।