বাড়িকে তাপ-নিরোধক করার কিছু উপায়

বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণ শহরগুলোর তালিকায় সম্প্রতি শুরুর দিকে নাম এসেছে ঢাকার। এতে অবশ্য কারো চোখ কপালে ওঠেনি, বরং এটা না হলেই অবাক হতে হতো। ভীষণ ভ্যাপসা গরমের কারণ ঢাকা শহরের অধিকাংশ বাড়িতেই এখন এয়ার কন্ডিশনিং ও ঘর ঠান্ডা রাখার অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ, সাথে শারীরিক ক্ষতিও হচ্ছে সমানভাবে।

কিন্তু এসি বা অন্যান্য যান্ত্রিক ব্যবস্থা, যেগুলো অতিমাত্রায় পরিবেশ দূষক, সেগুলো ছাড়াই যদি আপনার বসবাসের ঘরখানি ঠান্ডা রাখা যায়, তাহলে কেমন হয় বলুন তো? না, বিস্ময়সূচক কোনো ব্যাপার নয় এটি। অত্যন্ত সাধারণ কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আপনি আপনার বাড়িকে তাপ নিরোধক করতে পারেন, আর যান্ত্রিকতা ছাড়াই মৌসুমভেদে ঘরের ভেতর আরামদায়ক তাপমাত্রা বজায় রাখতে পারেন।

ব্লক ইনসুলেশন

এই ব্লকগুলো সাধারণ উল, কর্কবোর্ড, রাবার, গ্লাস, তুষ, ইত্যাদি উপাদানে তৈরি করা হয়ে থাকে। এগুলো বাড়ির দেয়ালে ও ছাদে লাগানো হয় বাড়িকে তাপ নিরোধক করতে। একটি কার্যকর ব্লক ইনসুলেশন সাধারণত আড়াই সেন্টিমিটার বা তার অধিক পুরু হয়। ব্লক ইনসুলেশন কেবল গরমই ঠেকায় না, বরং শীতকালে ঘরের তাপ ঘরেই আটকে রেখে আরামদায়ক উষ্ণতাও ধরে রাখে।

ব্লাংকেট ইনসুলেশন

পশুর চামড়া, লোম, তুলা কিংবা কাঠের তন্তু দিয়ে তৈরি এই ব্লাংকেট ইনসুলেশনগুলো বড়জোর ৮০ মিলিমিটারের মতো পুরু হয়। ফলে এগুলো ব্যবহার করা সহজ। ব্লক ইনসুলেশনের মতো এটাও সরাসরি দেয়ালে বা ছাদে সেঁটে দেয়া হয়।

লুজ ফিল

নাম থেকে যা অনুধাবন করা যাচ্ছে ঠিক তা-ই। এই প্রক্রিয়ায় দেয়াল তৈরির সময় তাতে ছোট ছোট শূন্যস্থান রাখা হয়। এসব শূন্যস্থানে বিভিন্ন প্রকার তাপ নিরোধক দ্রব্য দিয়ে ওপরে পলেস্তারা দিয়ে দেয়াল নির্মাণ সম্পন্ন করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় দেয়াল নির্মাণ করলে সূর্যের তাপ অনেকাংশেই আটকা পড়ে এবং ঘর ঠান্ডা থাকে। একইভাবে শীতকালে বাইরের ঠান্ডা ঘরে প্রবেশ করতে পারে না।

রিফ্লেক্টিভ শিট

আজকাল বাসাবাড়ি তাপ নিরোধক করতে আরেক প্রকার প্রযুক্তির উদ্ভব হয়েছে যাকে বলা হয় রিফ্লেক্টিভ শিট। অ্যালুমিনিয়াম শিট, জিপসাম বোর্ড, স্টেইনলেস স্টিল- অনেক রকমের রিফ্লেক্টিভ শিট বাজারে পাওয়া যায় যেগুলো মূলত সূর্যালোকের একটি বড় অংশই প্রতিফলিত করতে সক্ষম। ফলে বাসা থাকে ঠান্ডা। তবে এই শিট শীতকালে কার্যকর না।

জলছাদ

ঘরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির একটি বড় উপকরণ হলো ছাদ। সারাদিনের তাপে গরম হয়ে থাকা ছাদ রাতে তাপ বিকিরণ করে ঠান্ডা হতেও অনেকটা সময় নেয়, আর ঘরের তাপমাত্রা বেশি থাকে। এই বিড়ম্বনা থেকে মুক্তির একটি সহজ উপায় হলো জলছাদ। ছাদের উপর অন্তত ৩ সেন্টিমিটার পুরু করে ইট, সুরকি, চুন আর অন্যান্য উপাদানের যে পুরু ও মসৃণ আস্তরণ দেয়া হয়, তাকে বলে জলছাদ। এটি একে তো ঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করবে, পাশাপাশি ছাদ ও শেওলা পড়া থেকে রক্ষা করে।

ভবনের দিক নির্ধারণ

আপনার বাড়ির তাপমাত্রা কতটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে তা অনেকাংশে নির্ভর করে আপনি বাড়ি কোনদিকে মুখ করে তৈরি করছেন। পূর্ব কিংবা পশ্চিমমুখী হলে সারাদিন সূর্যালোক জানালা দিয়ে সরাসরি প্রবেশ করবে। আবার উত্তরমুখী করলে শীতকালে প্রচুর ঠান্ডা বাতাস ঘরে প্রবেশের সুযোগ থাকে। সবদিক বিবেচনায় তাই দক্ষিণমুখী করা সবচেয়ে সুবিধাজনক।

ভেন্টিলেশন

আগেকার সময়ে ঘরের দেয়ালে ভেন্টিলেটর দেয়া হতো যা বর্তমানে নেই বললেই চলে। এয়ার কুলার আর এসির বাজারে ভেন্টিলেটর এখন অচল। তবে যারা এসিতে স্বাচ্ছন্দ্য নন, তারা অবশ্য প্রাকৃতিক বাতাসেই ঘর ঠান্ডা রাখতে পারেন, তার জন্য প্রয়োজন একটু কৌশলী হওয়া। মূলত ঘরের জানালা বিপরীতমুখী দেয়ালে থাকলে ক্রস ভেন্টিলেশন করা যায়। মুখোমুখি দুই জানালা খুলে দিলে ঘরে অবাধে বাতাস চলাচল করতে পারে। এতে করে ঘরের তাপমাত্রা কমে।

রঙ

ঘরের দেয়াল রাঙানো নান্দনিকতা আর মানসিক প্রশান্তির জন্য যেমন জরুরি, তেমন জরুরি ঘর ঠান্ডা রাখার জন্যও। কিছুদিন আগেই আমেরিকার পার্ড্যু বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রফেসর পৃথিবীর সবচেয়ে সাদা রঙ তৈরি করে গিনেজ রেকর্ডসে নাম লেখান। তার এই রঙে বাড়ির বহিরাবরণ রঙ করলে শতকরা ৯৯ ভাগের বেশি সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে যাবে। ফলে যান্ত্রিকতা ছাড়া প্রাকৃতিকভাবেই ঘর থাকবে শীতল।

বহিরাবরণ নয়, ঘরের ভেতরের রঙও গুরুত্বপূর্ণ। কালো বা খুব ভারী কোনো রঙ প্রথমেই বাদ। ঘরের ভেতরটা রঙ করতে হবে হালকা, উজ্জ্বল কোনো রঙে যা একই সাথে সুন্দর এবং তাপ প্রতিফলনে সক্ষম। এক্ষেত্রে অধিকাংশের পছন্দ পেস্টেল হলুদ, জলরঙ কিংবা হালকা গোলাপি।

রুফগার্ড

রুফগার্ড, ওয়েদার কোট, রুফকোট, কিংবা অন্য যেকোনো নাম- ছাদকে তাপ নিরোধক এবং সূর্যালোক প্রতিফলনক্ষম করতে এর উপর একপ্রকার বিশেষ রঙ দিয়ে পুরু কোটিং করা হয়। এতে একসাথে দুই কাজ হয়ে যায়। একদিকে এই আস্তরণ ছাদের ওয়াটারপ্রুফিংয়ে সহায়তা করে, ছাদকে রাখে শেওলামুক্ত; অন্যদিকে এর কারণে ছাদ অপেক্ষাকৃত কম তাপ শোষণ করে এবং রাতের বেলা তা দ্রুত বিকিরণ করে ঠান্ডা হয়ে যায়।

সবুজায়ন

বাড়িকে তাপ নিরোধক করার সবচেয়ে ভালো উপায় সম্ভবত গাছ লাগানো। বাড়ির ছাদে টব কিংবা জলছাদ করে তার উপর টবের মতো বেষ্টনি তৈরি করে তাতে সরাসরি মাটি দিয়ে গাছ লাগানো বাড়ি তাপ নিরোধক করার দারুণ উপযোগী একটি উপায়। ছাদে গাছ লাগালে একে তো মন ভালো করার মতো একটি পরিবেশ তৈরি হবে, পাশাপাশি গাছের ছায়ায় ছাদও ঠান্ডা থাকবে। পাম গাছ, এলোভেরা, নানা প্রকারের ফার্ন আর সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য কিছু ফুলের গাছ লাগানো যেতে পারে ছাদে। মূলত যেসব গাছের পাতা বড় এবং প্রসারণশীল, সেগুলোই ছাদের জন্য উপযোগী যেন তা অধিক ছায়া দিতে পারে। এছাড়াও গাছের গোড়ার মাটি প্রচুর পরিমাণ পানি ধরে রাখে যা স্বাভাবিকভাবেই ছাদকে ঠান্ডা রাখে। চূড়ান্ত গরমের দিনেও এসির বাতাস ছাড়াই ঘর ঠান্ডা রাখা সম্ভব, কনকনে শীতে রুম হিটার ছাড়াই ঘরে উষ্ণ আবহাওয়া তৈরি করা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন বাড়ির আকার, অবস্থান এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়াদির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সঠিক তাপ নিরোধক ব্যবস্থা।