“আমি একটি বাড়ি নির্মাণ করতে চাই। বলতে পারেন কেমন খরচ পড়বে?” এই প্রশ্নটি নির্মাণকাজের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেককে প্রায় প্রতিদিনই শুনতে হয়। একটি বাড়ি তৈরিতে খরচ কত হবে এ সম্পর্কে সরাসরি একটি উত্তর দেয়া সবসময়ই কঠিন।
কারণ, ভবন নির্মাণ একটি শিল্প যেখানে অনেক বিষয়ই একসাথে কাজ করে। জমির মাপ, ভবনের নকশা, কত বর্গফুট জায়গা, সাইটের অবস্থা ও অবস্থান, উপকরণের সহজলভ্যতা ও পরিবহন ব্যবস্থা ইত্যাদি নানা কারণে খরচ পরিবর্তন হতে পারে।
তবে ভবন তৈরি করতে হলে আপনাকে সকল দরকারি জমিসংক্রান্ত কাগজ ও সার্ভেসহ প্রথমে যেতে হবে স্থপতির বা স্থাপত্য ফার্মের কাছে। তারা আপনাকে নকশা ও খরচের প্রাথমিক হিসাব প্রদান করবেন। সেখান থেকে প্রাপ্ত ও সরকার অনুমোদিত নকশা নিয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বা ফার্ম থেকে পুরকৌশল সংক্রান্ত নকশা ও বাজেট নির্ধারণ শেষে আপনি নির্মাণে হাত দিতে পারবেন।
এখন স্থপতি ও প্রকৌশলীর ফি এবং অনুমোদনের ফি প্রদানের পর আপনি নির্মাণ বাজেটকে বিভিন্ন খাতে ভাগ করতে পারেন। এই খাত এর আনুপাতিক হার সম্পর্কে ধারণা দেয়া সম্ভব।
বিভিন্ন খাত অনুসারে আপনার নির্মাণ বাজেট খরচের শতকরা হিসাব
১. ভিত্তি ও কাঠামো = ৩৫%
২. ইটের কাজ = ৬%
৩. ফ্রেম ও কাঠের কাজ = ৫%
৪. ধাতব কাজ = ২%
৫. পয়ঃনিষ্কাশন ও পানি সরবরাহ সংক্রান্ত কাজ = ৬%
৬. বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি = ৭%
৭. প্লাস্টার = ৪%
৮. টাইলস ও ফ্লোর সংক্রান্ত কাজ = ৬%
৯. স্নানঘর ও টয়লেটের সাজসজ্জা = ৩%
১০. অ্যালুমিনিয়াম ও জানালার ফ্রেমিংয়ের সাজসজ্জা = ৪%
১১. কেন্দ্রীয় বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি (লিফট, জেনারেটর ও সাবস্টেশান)= ১০%
১২. রঙের কাজ = ৩%
১৩. বিবিধ পুরকৌশলজনিত কাজ = ৬%
১৪. নির্মাণকালীন সব ধরনের সংযোগ ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার বিল = ৩%
___________________________________________________________
মোট খরচ = ১০০%
এখন যদি আমরা প্রতিটি খাতে, বাংলাদেশের সাধারণ নির্মাণ সংস্কৃতিতে একটি ছয়তলা বাড়ির কথা চিন্তা করি (যা ৩, ৫ বা ৭ কাঠা জায়গার উপর নির্মিত হবে) তাহলে এর বিভিন্ন খাতকে আরো বিস্তারিতভাবে খরচ সাপেক্ষে নিরুপণ করা যায়। সেটা অনেকটা এরকম-
ভিত্তি ও কাঠামোগত খরচ
– ফুটিং ও কলামের ভিত্তিমূলের কাজ = ২০%
– গ্রেড বীম ও ভূগর্ভস্থ পানির ট্যাংকের উপরের স্ল্যাব = ৫%
– বেজমেন্ট-এর কলাম ও স্ল্যাব = ৪%
– ১ম ফ্লোরের স্ল্যাব = ৯%
– সাধারণ ফ্লোরের কলাম (৫x৩%) = ১৫%
– দ্বিতীয় তলা থেকে বাকি ফ্লোর সহ ছাদের স্ল্যাব (৫x৮) = ৪০%
– ছাদের কাঠামোগত খরচ = ৭%
____________________________________
ভিত্তি ও কাঠামোর জন্য মোট খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেট এর ৩৫% যেভাবে খরচ হবে।)
ইটের কাজে খরচ
– বেজমেন্ট এ ইটের কাজ = ৬%
– প্রথম ফ্লোরে ইটের কাজ= ১৮%
– দ্বিতীয় ফ্লোরে ইটের কাজ= ১৮%
– তৃতীয় ফ্লোরে ইটের কাজ= ১৮%
– চতুর্থ ফ্লোরে ইটের কাজ= ১৮%
– পঞ্চম ফ্লোরে ইটের কাজ = ১৮%
– ছাদে ইটের কাজ= ৪%
____________________________________
ইটের কাজে মোট খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেট এর ৬% যেভাবে খরচ হবে।)
কাঠের কাজ বাবদ খরচ
– দরজার ফ্রেম = ৪০%
– মূল দরজার শাটার = ১৫%
– পারটেক্সের দরজার শাটার= ৩৫%
– পোষ্য দরজা এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি = ১০%
____________________________________
দরজার কাজে মোট খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেট এর ৫% যেভাবে হবে।)
ধাতব কাজ বাবদ খরচ
– জানালার গ্রিল = ৫৫%
– বারান্দার রেলিং = ২০%
– সিঁড়ির রেলিং = ১০%
– মূল ফটক ও সকল ধরনের সেফটি গ্রিল = ১৫%
____________________________________
ধাতব কাজে পুরো খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেট এর ২% যেভাবে খরচ হবে।)
পয়ঃনিষ্কাশন ও পানি সরবরাহ সংক্রান্ত কাজ বাবদ খরচ
– উলম্ব পিভিসি লাইন ও সকল ডাক্ট এর খরচ = ২৫%
– জি আই লাইনের কাজ = ৩০%
– ফিক্সচার ও ফিটিং = ৪০%
– নিচতলার ফ্লোর এর পয়ঃনিষ্কাশনের আলাদা খরচ = ৫%
____________________________________
পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের খরচ = ১০০% ( পুরো নির্মাণ কাজের ৬% যেভাবে হবে।)
বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি বাবদ খরচ
– স্ল্যাবের ভেতর দিয়ে লাইন বহনের খরচ = ১০%
– দেয়াল ও বৈদ্যুতিক বক্সের ভেতর লাইন বহনের খরচ = ১৫%
– তার সংক্রান্ত কাজ = ৫৫%
– সুইচ ও সকেট বাবদ খরচ = ২০%
____________________________________
বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের মোট খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেটের ৭% যেভাবে খরচ হবে।)
প্লাস্টার বাবদ খরচ
– সিলিং-এর প্লাস্টার = ২০%
– ভেতরের দেয়ালের প্লাস্টার = ৫০%
– বাইরের দেয়ালের প্লাস্টার বা ইটের ফেসিং ও পয়েন্টিং = ৩০%
____________________________________
প্লাস্টার বাবদ পুরো খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেটের ৪% যেভাবে খরচ হবে।)
টাইলস ও ফ্লোর সংক্রান্ত কাজ
– সাধারণ ফ্লোর ও বারান্দার টাইলস = ৭৫%
– সিড়ি, লিফটকোর এর দেয়াল ও লবির টাইলস = ২০%
– বেজমেন্ট এর লিফটের লবি, দেয়াল এবং লবির টাইলস = ৫%
____________________________________
টাইলস ও ফ্লোর সংক্রান্ত কাজে মোট খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেটের ৬% যেভাবে খরচ হবে।)
স্নানঘর ও টয়লেট এর সাজসজ্জা সংক্রান্ত খরচ
– স্নানঘরের দেয়াল = ৬০%
– রান্নাঘরের দেয়াল = ২০%
– স্নানঘরের মেঝে = ৯%
– স্নানঘরের কাউন্টার টপ= ৪%
– রান্নাঘরের দেয়াল = ৩%
– কিচেন কাউন্টারের টপ =৪%
____________________________________
সাজসজ্জা বিষয়ে মোট খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেটের ৩% যেভাবে খরচ হবে।)
অ্যালুমিনিয়াম সংক্রান্ত কাজ বাবদ খরচ
– স্লাইডিং জানালার বাইরের দিকের ফ্রেম = ৪০%
– গ্লাসের শাটার ও স্লাইড করার ফ্রেম = ৩০%
– বারান্দার স্লাইডিং উপকরণ = ২০%
– টয়লেটের উঁচু জানালা = ৫%
– সাধারণ এরিয়া এর উপকরণ = ৫%
____________________________________
অ্যালুমিনিয়াম সংক্রান্ত মোট খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেটের ৪% যেভাবে খরচ হবে।)
কেন্দ্রীয় বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি বাবদ খরচ
– লিফট = ৫০%
– জেনারেটর =২৫%
– বৈদ্যুতিক সাবস্টেশান = ২০%
– অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জামাদি ও ইন্টারকম সংযোগ = ৫%
____________________________________
কেন্দ্রীয় সরঞ্জামাদি বাবদ খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেটের ১০% যেভাবে খরচ হবে।)
রঙের কাজ বাবদ খরচ
– পুটি লাগানো পর্যন্ত খরচ = ৪০%
– ভেতরের দেয়াল ও সিলিং এ প্রথম আস্তর = ২০%
– ভেতরের দেয়াল ও সিলিং এ পরের আস্তর= ১৫%
– বাইরের রঙ ও মোমের কোটিং = ২৫%
____________________________________
রং বাবদ মোট খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেটের ৩% যেভাবে খরচ হবে।)
বিবিধ পুরকৌশল সংক্রান্ত কাজ
– সীমানার দেয়াল সংক্রান্ত খরচ = ৩০%
– টেরাস ও ছাদের পেভিং সংক্রান্ত খরচ= ১৫%
– ছাদে বাগান, ডেভেলপারের ব্যবসায়িক অলংকরন = ৪%
– বেজমেন্ট লেভেলের বিবিসি = ১৪%
– বেজমেন্ট এর পেভমেন্ট ও জমির ভেতর ফুটপাথ সংক্রান্ত কাজ = ১০%
– লিন্টেল, ড্রপ স্ল্যাব, এফ স্ল্যাব ইত্যাদি= ২০%
– তারের ট্রে = ১%
– ডাক্ট ও সিলিং এ তারের উপরে কাভার ও তার লুকানোর খরচ= ৪%
– অভ্যর্থনা ডেস্ক ও চিঠির বাক্স = ২%
____________________________________
বিবিধ খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেটের ৬% যেভাবে খরচ হবে।)
নির্মাণকালীন সব ধরনের সংযোগ ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার বিল
– বিদ্যুৎ বিল (ডেসা ও ডেসকোর রেট অনুসারে) = ৩৫%
– গ্যাসের বিল (তিতাস এর রেট অনুসার) = ২০%
– পানির বিল (ওয়াসা এর রেট অনুসারে) = ১৫%
– অন্যান্য বিল = ৩০%
____________________________________
সম্পূর্ণ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেটের ৩% যেভাবে খরচ হবে।)
সাধারণত ঢাকায় অঞ্চলভেদে প্রতি স্কয়ার ফুট নির্মাণ কাজে আবাসিক ভবনে সর্বনিম্ন ২০০০ টাকা খরচ হয়ে থাকে। তবে নকশা ও এর খুঁটিনাটি অনুসারে এটি অনেক ওঠানামা করতে পারে।
বাড়ি নির্মাণ একটি দীর্ঘ ও সময় সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। এজন্য খরচের হিসাব সম্পর্কে শুরুতেই পরিষ্কার ধারণা নিন। আপনার স্থপতিকে শুরুতেই আপনার বাজেট সম্পর্কে ধারণা দিন ও চাহিদার কথা পরিষ্কারভাবে জানান। শুধুমাত্র এভাবেই আপনি নির্ধারিত বাজেটে আপনার পছন্দের বাড়ি পেতে পারেন।