ঘরের সিলিংয়ের সৌন্দর্য বাড়াবেন কীভাবে?

আমাদের বাসস্থান কিংবা কর্মস্থল, যেকোনো স্থানের অন্দরমহলের সৌন্দর্যবর্ধনের ক্ষেত্রে আমরা যথেষ্ট সচেতন সবসময়ই। নিত্য-নতুন নকশার সব আসবাবপত্র কিংবা রঙের পরিবর্তন, আবার কখনোবা নতুন ধরনের লাইটের সংযোজন- সবকিছু মিলিয়েই বেড়ে উঠে একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য। 

অন্দরমহলের সজ্জা বললে হয়তো সবার শেষে আমাদের বিবেচনায় আসে সিলিংয়ের নকশার কথা। কারণ, চিরকালই সিলিং বলতে আমরা কেবল মাথার উপর এক খণ্ড সাদা সরল তলকেই বুঝে থাকি। কিন্তু এটিও যে মনোযোগ দিয়ে তৈরি করার বিষয়, তা বোঝা যায় আধুনিক সময়ে এই সিলিং নকশার পেছনেও নকশাকারদের বিশদ পড়াশোনা এবং বিচার-বিবেচনা থেকে।

প্রকারভেদ

ব্যবহার ও নকশার উপর ভিত্তি করে কয়েক রকমের সিলিং বেশি দেখা যায়। যেমন-

  • কনভেনশনাল সিলিং
  • সাসপেন্ডেড সিলিং
  • ক্যাথেড্রাল সিলিং
  • শেড সিলিং
  • কোভ সিলিং
  • বীম সিলিং

সিলিংয়ের নকশার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়েই ছাদের স্ট্রাকচার বহাল রেখে ফলস সিলিং কিংবা সিলিং টাইলসের মাধ্যমে নকশা করা হয়। সিলিংয়ের নকশা রুমের কার্যকারিতা, নির্মাণকাল, লোকেশন ও নকশার বাকি রুমের সাথে সামঞ্জস্যতা এসবের উপরও নির্ভর করে। মুঘল আমলের কোনো স্থাপনার সিলিংয়ের সাথে যেমন এখনকার কোনো সিলিংয়ের মিল খোঁজা ভিত্তিহীন, তেমনি বাসস্থানের বিভিন্ন রুমের সিলিংয়ের সাথে বিপণি-বিতান বা অফিসের সিলিংয়ের সাদৃশ্যও নেই বললেই চলে।

শহর ও গ্রামভেদে সিলিংয়ের পরিবর্তন

কেবলমাত্র কংক্রিটের তৈরি বাড়িতেই নয় বরং গ্রামাঞ্চলে টিনের তৈরি ছাদের ক্ষেত্রেও সিলিং ডিজাইনে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। একসময় টিনের তৈরি ঘরের ছাদের নিচে বাঁশের চাটাই, ছন, খড় এসব দিয়ে সিলিং তৈরি হতো। কিন্তু বর্তমানে পিভিসি প্লাস্টিক সিলিংয়ের বহুমাত্রিক ব্যবহারে সিলিংয়ে পরিবর্তন এসেছে। সাশ্রয়ী মূল্যের এই সিলিংয়ের সহজ ব্যবহার, কম খরচে মেরামতযোগ্যতা, সহজলভ্যতাসহ নানাবিধ গুণ রয়েছে। 

ফলস সিলিংয়ের ব্যবহার

আমাদের বাসা কিংবা অফিসে বর্তমানে ফলস সিলিংয়ের বহুল ব্যবহার দেখা যায়। আসল সিলিংয়ের নিচে জিপসাম বোর্ড, কাঠ কিংবা প্যারিস প্লাস্টারের এক বা একাধিক লেয়ারের সিলিং সংযোজন করা হয় এধরনের সিলিংয়ে। নকশার পরিবর্তন কিংবা দৃষ্টিনান্দনিকতার পাশাপাশি আরও বিভিন্ন কারণে ফলস সিলিং ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে ওয়্যারিং ঢাকা, রুমের টিভি, হোম থিয়েটারের একুইস্টিক (শাব্দিক) সামঞ্জস্যতা রক্ষা এবং শীতপ্রধান দেশে ঘরের তাপমাত্রা সহনশীল পর্যায়ে রাখা অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচ্য। নকশা ও ম্যাটেরিয়ালের উপর ভিত্তি করে যে কয়েক রকমের ফলস সিলিং বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তা হলো- 

  • জিপসাম সিলিং
  • উডেন সিলিং
  • প্যারিস প্লাস্টার সিলিং
  • মেটাল সিলিং
  • সিন্থেটিক ফাইবার সিলিং

সিলিংয়ের নকশা এবং রং

বাড়ির কোন রুমের জন্য সিলিং ডিজাইন করা হচ্ছে তা প্রথমে দেখে নিতে হবে। সাধারণত বসার ঘর, শোবার ঘর, শৌচাগার ভেদে সিলিংয়ের নকশায় তারতম্য হয়ে থাকে। রুমভেদে সিলিংয়ের উচ্চতার পার্থক্য হয়। সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে যে ফলস সিলিং যোগ করা হয় তার অবকাশ সবসময় থাকে না। 

বিভিন্নভাবে সিলিংয়ের রঙের মাধ্যমে রুমের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা যায়। সাধারণত ছোট রুমকে বড় দেখানোর জন্য হালকা রঙের শেড ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া কম উচ্চতার সিলিংয়ে কিছুটা গ্লসি রঙ ব্যবহার করলে উচ্চতার পার্থক্য অনুভূত হয়। 

রঙের সাথে সাথে সিলিং ও ফলস সিলিংয়ের বিভিন্ন নকশা নিয়েও কাজ করা যায়। বর্তমান সময়ে সিলিং-সাইড ধরে চারকোনা নকশা কিংবা মাঝে গোল নকশা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে বিভিন্ন দিকে ও জায়গায় স্পট লাইট, রিসেসড লাইট কিংবা পেন্ডেন্ট লাইটের সংযোজন করা যেতে পারে। কিন্তু সিলিং যে কাঁচামালেই তৈরি হোক না কেন, পানিরোধক না হলে অচিরেই সিলিং অকেজো হয়ে পড়ে। সাধারণত সিলিংয়ের পানিরোধন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ভেতরের দিকে পলিইউরেথিন সিলার ব্যবহার করা হয়। বাথরুমের সিলিংয়ের স্যাঁতস্যাঁতে ভাব কমানোর জন্য সেমি গ্লসি কিংবা অয়েল বেসড রং ব্যবহার করা হয়ে থাকে। 

কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিলিং তৈরির সময় আগুনের বিষয়ে সতর্কতার কথা মাথায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত রান্নাঘর কিংবা আগুনের সংস্পর্শে আসা সিলিংসমূহের ক্ষেত্রে এটি বিবেচ্য। এক্ষেত্রে প্লাস্টারবোর্ড সিলিং, ফাইবারড সিলিং ব্যবহারের জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞরা।

সিলিং যে ম্যাটেরিয়াল কিংবা নকশাতেই তৈরি হোক না কেন, সিলিংয়ের পরিচর্যার অভাবে অনেক সময়েই সিলিংয়ের কাঠামো কিংবা বাহ্যিক সৌন্দর্য নষ্ট হতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে নিয়মিতভাবে সিলিং পরিষ্কার, ভালো মানের রং ব্যবহার ও যেকোনো সমস্যা অচিরেই মেরামত করা বাঞ্ছনীয়। সেইসাথে সিলিং বিষয়ক যেকোনো প্রশ্নের উত্তর ও নির্মাণ বিষয়ক খুঁটিনাটি জানাতে আপনাদের সাথে আছে হোম বিল্ডার্স ক্লাব। 

নিজেই নিজের বাড়ি: তৈরি হোক পছন্দমতো

দৃশ্যপট ১

আজমল সাহেব একজন চিকিৎসক। সারাজীবন সরকারি হাসপাতালে সেবাদানের পর যখন অবসরে যান, পেনশন হিসেবে টাকাগুলোকে এক করে ঢাকার বুকে কিনে ফেলেন ৫ কাঠার এক টুকরো জমি। অনেকদিনের ইচ্ছে, নিজের জন্য নিজের মতো করে তৈরি করবেন একটি বাড়ি। বিকেল বেলা এক চিলতে রোদে ভরে থাকবে সে বাড়ির ছোট বারান্দা।

কিন্তু আশেপাশের মানুষের সাথে কথা বলতে গিয়ে নির্মাণ কাজ নিয়ে বেশ ভয় পেয়ে যান তিনি। ভবনের নকশা, একাধিক অনুমোদন, নির্মাণ সামগ্রীর বাজার সম্পর্কে সচেতন ধারণা রাখা থেকে হাজারটা চিন্তা এসে ভর করে নির্মাণ নিয়ে ভাবতে গেলেই। জমির ভবিষ্যৎ আর বাড়ির স্বপ্নের মাঝে বিশাল এক অনিশ্চয়তায় ভোগেন আজমল সাহেব।


দৃশ্যপট ২

প্রান্তিক ঢাকায় এক টুকরো জমি নিয়ে অনেকদিন ধরেই প্রায় একই ধরনের সমস্যায় ভুগছেন রফিকুল হক। আশেপাশের সবাই তৃতীয় পক্ষের সাহায্যে বাড়ি তুলে কয়েকটি ফ্ল্যাট নিয়ে বসবাস করছেন। কিন্তু রফিকুল হকের জন্য এই এক টুকরো জমি তার সারা জীবনের সঞ্চয়ের ফসল। এখানে বাণিজ্যিক চিন্তাধারায় ভবন তৈরি হলে সেটি যে তার ইচ্ছা বা পছন্দকে পরিপূর্ণ করবে না, সে ব্যাপারে তিনি প্রায় নিশ্চিত। তিনি নিজের চাহিদামতো ভবন চান নিজের জমিতে। নকশার আলোচনার অংশ হতে চান। নিশ্চিত করতে চান নিজের ও নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুযোগ সুবিধা। 

নিজের টাকায় এক টুকরো নিষ্কণ্টক জমি আর তার উপর নিজের মনমতো আরামদায়ক বাসস্থান- এ যেন এই দেশের প্রায় সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন। এই স্বপ্নের জ্বালানী যোগান দিতে সারা জীবন কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন এ দেশের অনেক অনেক মানুষ।

নিজের জমি থাকা সত্ত্বেও আজমল আর রফিক সাহেবের মতো নানারকম অনিশ্চয়তার দোলাচলে সেই জমিতে বাড়ির স্বপ্ন অধরা থেকে যাচ্ছে। কেউ কেউ তৃতীয় পক্ষের শরণাপন্ন হয়ে নিজের জমিতে বাড়ি পাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু তাতে থাকছে না নিজের চিন্তা ও চাওয়া-পাওয়ার স্বাতন্ত্র্যের ছাপ। নিজের জমিতে নিজেই বাড়ি করার ব্যাপারে অনেকেই দ্বিধায় ভোগেন কিছু নির্দিষ্ট কারণে। আধুনিক সময়ের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী নির্মাণ ও স্থাপত্য মানের বিবেচনায় এখনো নিজের বাড়ি নিজে তৈরি করাই কিন্তু সবচেয়ে প্রচলিত ও লাভজনক প্রক্রিয়া। নির্মাণের নানা ধাপে এর সুফল পেতে পারেন একজন জমির মালিক।

১. নকশা

জমির উপরে বাড়ির নকশার জন্য একজন প্রশিক্ষিত স্থপতির দারস্থ হওয়াটা খুবই দরকারি। অনেকে মনে করেন, স্থপতির শরণাপন্ন হওয়া মানেই নির্মাণে শুধুমাত্র অলংকরণ যোগ করা ও অতিরিক্ত খরচ। অথচ একটি বাড়িতে বসবাসরত মানুষের জীবনযাপনের মান থেকে শুরু করে পর্যাপ্ত জায়গা, আলো-বাতাসের পর্যাপ্ততা এবং জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারেন শুধুমাত্র একজন স্থপতি। এর জন্য আপনাকে খরচ করতে হবে আপনার পূর্ণাঙ্গ নির্মাণ বাজেটের মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ অর্থ।

কোনোরকম তৃতীয় পক্ষের সহায়তা ছাড়াই আপনি পেশাদার স্থপতির সাহায্য নিতে পারেন খুবই সহজে। আপনি নিজে যদি আপনার বাড়ির নির্মাণে নিযুক্ত স্থপতির সাথে কথা বলেন এবং তাকে আপনার নিজের বাড়ির খুঁটিনাটি চাহিদা সম্পর্কে জ্ঞাত করেন, তাহলে তিনি প্রতিটি সূক্ষ বিষয় নকশায় প্রতিফলিত করতে চেষ্টা করবেন এবং নির্মাণ শুরু হবার অনেক আগেই আপনি পাবেন বাড়ির প্রতিটি বিষয় নিয়ে তার কাছ থেকে সবকিছু জেনে নেবার স্বাধীনতা।

পেশাদার স্থপতি সরকারের সব নিয়মনীতি সম্পর্কে সচেতন এবং নকশা করা বাড়ির ডিজাইন সংরক্ষণের নিশ্চয়তাও তিনি প্রদান করবেন। এছাড়া সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের কাছে স্ট্রাকচার ও প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধা (বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির লাইনের নকশা) সম্পর্কেও আপনি জ্ঞাত থাকতে পারবেন, যা পরবর্তীতে আপনার বাড়িকে করে তুলবে পূর্ণাঙ্গভাবে আপনার নিজের।

২. অনুমোদন

রাজউকে বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নকশা অনুমোদন সহজ করতে সরকার ডিজিটাল পদ্ধতিতে আবেদন ও নকশা অনুমোদনের ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করেছে। খুব দ্রুতই সকল অনুমোদন নেবার প্রক্রিয়া হবে অনিয়ম ও ঝামেলামুক্ত। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে স্থপতির কাছ থেকে প্রাপ্ত নকশা অনুমোদনের জন্য পাঠানো যাবে এবং মোবাইল ফোনে পাবেন নিয়মিত আপডেট। নিজের বাড়ি নিজে করার ক্ষেত্রে অনুমোদন কখনোই কোনো বাধা নয় যদি আপনি সরকারি নিয়মনীতি মেনে বাড়ি তৈরি করেন। 

৩. নির্মাণ সামগ্রী, খরচ সময়

বাড়ির নির্মাণ সামগ্রীর দাম ওঠা-নামা করে প্রায় প্রতিবছরই। একারণে বাড়ি নির্মাণে ব্যয়ের পরিমাণও নির্দিষ্ট রাখা খুবই কঠিন হয়ে যায়। দক্ষ ঠিকাদার নির্বাচন করা এক্ষেত্রে একজন বাড়ির মালিকের জন্য হতে পারে সর্বোত্তম সমাধান। নিজে নির্মাণ কাজ পরিচালনার সাথে যুক্ত থাকলে এ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা থাকে এবং ব্যয়, সময় ও সামগ্রীর মানের ব্যাপারে একজন জমির মালিক নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারেন।

এছাড়া নির্মাণের সময় সম্পর্কে ধারণা একদম পরিষ্কার থাকায় বাজেট ম্যানেজমেন্টও তুলনামূলক সহজ ও সাশ্রয়ী হয়। তৃতীয় পক্ষ অনেক ক্ষেত্রেই এই ধরনের সমস্যা মোকাবেলায় দিনের পর দিন নির্মাণ কাজ বন্ধ করে রাখেন। এতে নির্মাণ সামগ্রীর যেমন অপচয় হয় তেমনি ভবনের মান ক্ষতিগ্রস্থ হয় বিভিন্নভাবে।

৪. স্বকীয়তা

প্রতিটি মানুষ যখন জমি ক্রয় করেন, নিজের মনে নিজের বাসার একটি ছবি থাকে। বাড়ি বা বাসা মানে শুধু এক টুকরো মাথা গোঁজার ঠাঁই নয়। নিজের বাসা বা বাড়ি মানে একটি পরিবারের এক চিলতে স্বপ্নও। হয়তো আপনি আপনার রান্নাঘরটি চান একটু বড়, হয়তো আপনার চাই প্রতিটি ঘরের সাথে লাগোয়া এক টুকরো বারান্দা অথবা আপনি চান আপনার পরিবারের সব সদস্যই যেন নিজের পছন্দমতো একটি ঘর বরাদ্দ যেন পায় বাড়িতে।

এসব চাহিদা মানুষের মানবিক বোধ থেকে তৈরি এবং প্রতিটি মানুষের জন্য আলাদা, প্রতিটি পরিবারের জন্য আলাদা। যদি সর্বসাধারণের মাঝে বিক্রয়ের জন্য বাড়ির নকশা করা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই এই স্বকীয় চিন্তাধারা চলে যেতে পারে আড়ালে। আপনার বাড়ি হয়ে যেতে পারে আর দশটি বাড়ির মতোই ইট-কাঠের বাক্স। তাই ব্যবসায়িক চিন্তাধারার বাইরে থেকে বাড়ি তৈরি করতে চাই নিজের শক্ত উপস্থিতি। শুধুমাত্র নিজের বাড়ি নিজে তৈরি করতে সাহস করলেই এই স্বকীয় চিন্তাধারা বেঁচে থাকতে পারে প্রতিটি বাড়ির নির্মাণ প্রক্রিয়ায়।

৫. অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

২০২০ সালে এসে রিয়েল এস্টেট বা আবাসন হয়ে উঠেছে সর্বোচ্চ মানের অর্থনৈতিক বিনিয়োগের ক্ষেত্র। ব্যাংকের লভ্যাংশের চেয়ে অনেক দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে জমির দাম, ফ্ল্যাটের দাম। নিজের জমিতে নিজের বিনিয়োগ এই লাভের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে প্রচুর পরিমাণে। বলা বাহুল্য, তৃতীয় পক্ষের নির্মাণ কাজে সংশ্লিষ্টতার কারণে এসব ক্ষেত্রে জমির মালিকের জন্য লভ্যাংশ যোগ হচ্ছে না তেমন কিছুই। নিজের বাড়ি নিজে তৈরি করা তাই অনেক দিক থেকে ঝামেলার মনে হলেও মান নিয়ন্ত্রণ ও গুণগত দিক ঠিক রাখতে পারলে ভবিষ্যতের জন্য এটি হতে পারে একটি দুর্দান্ত বিনিয়োগ।

. ভবিষ্যতের পথে

ঢাকা শহরে এক টুকরো জমি বা একটি বাড়ি শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, সামাজিকভাবেও একটি দূরদর্শী বিনিয়োগ। নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা, তাদের সামাজিক বিবর্তন বা নাগরিক সুযোগ-সুবিধা একটি কমার্শিয়াল চিন্তাধারার বাড়িতে বাধাগ্রস্থ হবে, এটি খুবই স্বাভাবিক। এ সম্পর্কে তাই চাই মানবিক চিন্তাধারা, পারিবারিক বন্ধনকে ভবনের নকশায় স্থান দেওয়া।

বাড়ির সাথে আত্মিক বন্ধন তৈরিও তাই ভবিষ্যতের পথে একটি পরিবারকে এগিয়ে দিতে পারে অনেকদূর। নিজের বাড়ি নিজে তৈরি করার মাধ্যমে একটি পরিবার একসাথে থাকার ও একভাবে সামনে এগিয়ে যাবার যে প্লাটফর্ম তৈরি হয়, তা শর্তসাপেক্ষে কয়েকটি ফ্ল্যাটের বিনিময়ে তৈরি করে দেওয়া বাড়িতে পাওয়া কি আদৌ সম্ভব?

এসব কারণেই নিজের বাড়ি নিজে তৈরি করতে আগ্রহী হতে সেরা সময়টা আসলে এখনই। তবে এজন্য চাই প্রশিক্ষিত স্থপতি ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, যারা আপনার চাহিদা বুঝবেন ও কমার্শিয়াল ধ্যান-ধারণার বাইরে এসে আপনাকে সাহায্য করবেন। আর চাই নিষ্ঠাবান ঠিকাদার। আর এসবের জন্য প্রয়োজন একটি বিশ্বমানের কনসাল্টেশন সার্ভিসও।

এই কয়টি জিনিস নিশ্চিত করতে পারলেই আপনার স্বপ্নের বাড়ি ইট-কাঠের খাঁচা ভেঙে হয়ে উঠবে চিরায়ত সেই বাসস্থান, যার মায়ায় যুগের পর যুগ আপনার মন পড়ে থাকবে এই ভৌগোলিক পরিসীমাতে। তখন বাড়ি শুধু একটি স্থাপনা নয়, হবে আপনার আবেগ, অনুভূতি আর পরিবারের সুখ-দুঃখের সূতিকাগার।

সুন্দর বাড়ি চান? মনোযোগ দিন দেয়াল, লিন্টেল ও সানশেডে!

একটি ভবনের স্থাপনা নির্মাণে কাঠামোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মোটা দাগে নির্মাণ কাঠামো বলতে মানবদেহের কঙ্কালতন্ত্রের মতো বীম, কলাম ও ফাউন্ডেশনকেই বুঝে থাকি। কিন্তু কাঠামো তৈরি হলেই ভবন প্রস্তুত হয় না। একে ব্যবহার উপযোগী করতে আরো বেশ কিছু উপাদান রয়েছে।

প্রাত্যহিক ব্যবহারের জন্য দরজা, জানালা বা ফিনিশিং ফিক্সচার হিসাবে টাইলস, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, প্লাম্বিং এবং স্যানিটারি সামগ্রীর সাথে আমরা কম-বেশি পরিচিত। কিন্তু এর সাথে কিছু অপরিচিত বা কম পরিচিত বিষয়ও রয়েছে যা ভবন নির্মাণে হাত দেওয়ার আগে চেনা ও এদের সম্পর্কে জানা অত্যন্ত দরকারি।

দেয়াল

সাধারণভাবে আমরা যে চারটি দ্বিমাত্রিক তল দিয়ে একটি ঘরে আবদ্ধ থাকি তাকেই আমরা দেয়াল বলি। কিন্তু ব্যক্তিগত জায়গা তৈরিই দেয়ালের একমাত্র কাজ নয়। কাজ বা উদ্দেশ্যভেদে দেয়ালকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-

ভার বহনের ক্ষমতা অনুসারে দেয়াল দুই প্রকার-

১. ভারবাহী দেয়াল (একে শিয়ার ওয়াল বলে ও এটি কাঠামোর অংশ)

২. অভারবাহী দেয়াল (একে নর্মাল ওয়াল বলে, এটি কাঠামোর অংশ নয়)

ভারবাহী দেয়াল একবার তৈরি হয়ে গেলে, কখনোই ভবনের ক্ষতি সাধন না করে একে ভাঙা বা স্থানান্তর প্রায় অসম্ভব। তবে অভারবাহী দেয়াল খুব সহজে ও অল্প খরচে ভেঙে স্থান পরিবর্তন করা যায়। ভারবাহী দেয়ালে সাধারণত দরজা-জানালা বা কোন ধরনের বিরতি থাকে না।

কার্যভেদে দেয়াল আবার দুই ধরনের হতে পারে।

১. প্রধান দেয়াল (Main wall/Exterior Wall)

২. অপ্রধান দেয়াল (Partition wall)

প্রধান দেয়াল

প্রধান দেয়াল ভবনের চেহারা ও ভবনের সাফল্যের ক্ষেত্রে খুবই দরকারি উপাদান। এটি তৈরির সময় যা যা খেয়াল রাখতে হবে তা হলো-

  • প্রস্থের হিসাবে প্রধান দেয়ালকে অবশ্যই লিন্টেল, জানালা ও ভার বহনকারী হলে ভবনের ভারও বহন করতে পারতে হবে।
  • প্রধান দেয়াল প্রাকৃতিক (যেমন- ঝড়, বন্যা বা সাইক্লোন) ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ (যেমন- হামলা ও চুরি) থেকে অভ্যন্তরের বাসিন্দাদের রক্ষা করতে পাড়ার মতো যথেষ্ট মজবুত হতে হবে।
  • কলাম হিসেবে না থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই দেয়াল মজবুত করতে ইটের দেয়ালে ১০ ফুট বা ১২ ফুট পর পর পিলার তৈরি করা হয়।
  • সাধারণত গ্রেড বীমের উপর প্রধান দেয়াল তৈরি করতে হয় এবং এর নিচে দেয়ালের ফুটিং অবশ্যই দিতে হয়।

নির্মাণপদ্ধতি

প্রধান দেয়াল তৈরিতে প্রথমেই দেয়ালের কেন্দ্ররেখা বের করতে হবে। এরপর গ্রেড বীমের উপর গ্রাউটিং করতে হবে। এর উপরে মর্টার বসিয়ে সমান করে দিতে হবে। দেয়ালের দুই প্রান্তে দুটি ইট রেখে তাতে একটু সুতা এমনভাবে টান টান করে বাঁধতে হবে যেন তা দেয়ালের একপাশে থাকে। সুতার গা ঘেঁষে সোজাসুজি এক স্তর ইট গেঁথে দেয়াল সোজা করতে হবে।

সব ইটের মাপ সমান থাকে না, কারণ, হাতেই তৈরি করা হয় অধিকাংশ ইট। ইটের সাইজ মতো মিলিয়ে মর্টার বেশি বা কম দিয়ে মাপ ঠিক রাখতে হবে। ২৪ ঘণ্টা পর থেকে কিউরিং শুরু করতে হবে এবং কিউরিং শেষ হবার আগে প্লাস্টার করা যাবে না। প্রধান দেয়ালের ক্ষেত্রে নানা ধরনের বন্ড ব্যবহার করা যায়। তবে বাংলাদেশে স্ট্রেচার বন্ড সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়।

অপ্রধান দেয়াল

অপ্রধান দেয়ালকে সাধারণ নির্মাণ পরিভাষায় পার্টিশান দেয়াল বলা হয়ে থাকে। এটি অনেক ধরনের উপাদান বা উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়। ইট, কাঠ, গ্লাস, কমার্শিয়াল বোর্ড ইত্যাদি নানা ধরনের পার্টিশান দেয়াল দেখা যায়। এটি সাধারণত ভারবাহী হয় না। তবে কলাম বা শিয়ার ওয়াল ধরনের পার্টিশান দেয়ালও মাঝে মাঝে ব্যবহার করা হয়। এর নির্মাণ প্রক্রিয়া প্রধান দেয়ালের মতোই। তবে সাধারণত তা ৫ ইঞ্চি পুরু হয় ও এক স্তর ইট দিয়ে সাধারণভাবে তৈরি করা হয়ে থাকে।

এই প্রকারভেদের বাইরেও এক ধরনের দেয়াল রয়েছে যাকে বলা হয় প্যারাপেট।

প্যারাপেট

প্যারাপেট সম্পর্কে মূল্যবান তথ্যগুলো এরকম-

  • সমতল ছাদ হলে ছাদের সীমানা বরাবর সীমানার চারপাশের দেয়ালের উপর প্যারাপেট তৈরি করা হয়। এটি অনেক ক্ষেত্রে রেলিং এর মতোও কাজ করে।
  • ১২.৫ সেমি পুরুত্ব ও ১২.৫ সেমি উচ্চতা হচ্ছে প্যারাপেট তৈরির সর্বনিম্ন মাপ। প্রয়োজনে উচ্চতা আরো বাড়ানো যায়।

  • ইটের প্যারাপেট হলে মূল দেয়ালের সাথে একই বন্ড বজায় রেখে গাঁথুনি তৈরি করা হয়। প্রতি ১০ ফুট বা তিন মিটার পর পর ২৫ সেমি X ২৫ সেমি মাপের পিলার স্থাপন করে দেয়াল মজবুত করা যায়।
  • ছাদ ঢালাই শেষ হলে প্যারাপেট নির্মাণ করা হয়। উল্লেখ্য যে, কংক্রিটের ঢালাই লোহা বা স্টিলের প্যারাপেটও তৈরি করা যায়।

লিন্টেল

দরজা বা জানালা টিকিয়ে রাখতে ও শুন্যস্থানের উপরের ভর বহন করতে যে আনুভূমিক সমর্থন তৈরি করা হয় তাকে বলে লিন্টেল। দেয়াল ইট বা পাথরের তৈরি হলেও লিন্টেল তৈরি হতে হয় কাঠামোর উপাদান থেকেই। সাধারণত কাঠ, স্টিল বা কংক্রিট ব্যবহার করা হয় লিন্টেল তৈরিতে। সাধারণ বাংলাদেশি নির্মাণে কংক্রিটের তৈরি লিন্টেলই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

সানশেড ও লিন্টেল

সানশেড হচ্ছে সূর্যের সরাসরি আলো থেকে রক্ষা পেতে নকশায় স্থাপন করা অংশ। আমাদের দেশের গ্রীষ্মপ্রধান আবহাওয়া ও জলবায়ুর জন্য সানশেড প্রায় অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। এটি শুধু আমাদের সূর্যের তাপ থেকেই রক্ষা করে না, বরং ঘরে বৃষ্টি ঢুকতেও প্রাথমিক পর্যায়ে বাধা দেয় ও জানালা থেকে বৃষ্টিকে দূরে রাখে।

এক্ষেত্রে একটি মজার বিষয় হচ্ছে, সানশেড ও লিন্টেল অনেক ক্ষেত্রে একই সাথে তৈরি করা যায়। এক্ষেত্রে সানশেড একটি স্বাধীন ক্যান্টিলিভার হিসেবে কাজ করে, যার রিইনফোর্সমেন্টগুলো লিন্টেলের ভেতরে প্রবেশ করানো থাকে। একারণে সানশেডের ফর্মওয়ার্ক অনেক সময়ই লিন্টেলের সাথেই তৈরি করা হয় এবং ঢালাইও একবারেই করে ফেলতে হয়। কংক্রিট জমাট বেঁধে গেলে সাধারণভাবেই কিউরিং করে এর মান উন্নত করতে হয়।