বর্ষাকালে নির্মাণসাইটে সতর্কতা

অনেক ক্ষেত্রেই বসন্ত আর শরৎকালকে বড় কোনো নির্মাণ প্রজেক্টের সূচনার জন্য খুব ভালো সময় মনে করা হয়। যেকোনো নির্মাণ প্রজেক্টে বাজেট প্রাপ্তি, জনবলের সুলভ সরবরাহ এবং কন্ট্রাক্টর ও সাব কন্ট্রাক্টরদের জন্য আমদানি-রপ্তানির সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে পারার সুযোগ থাকায় মার্চ-এপ্রিল ও সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের দিকে প্রচুর কাজ শুরু হতে দেখা যায়। তাই যখন কাজ শুরু হয়, তখন পরিবেশ সাধারণত সুন্দর ও সহনশীল থাকে। কিন্তু কিছুদিন পরেই শুরু হয় বৃষ্টি। আর বাংলাদেশে নির্মাণকাজ দীর্ঘ সময় জুড়ে চলার প্রবণতায় প্রায় প্রতিটি নির্মাণ প্রজেক্টকেই বৃষ্টি মোকাবেলা করতে হয় একাধিকবার। 

প্রজেক্টের কয়েকটি ধাপের কাজের ক্ষেত্রে এই বৃষ্টি কিছু সুবিধা নিয়ে আসে। মাটি নরম থাকলে ফাউন্ডেশনের জন্য মাটি খোঁড়া সুবিধাজনক হয়। এছাড়া নির্মাণকাজে ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে রাখতেও বৃষ্টির কিছু সুবিধাজনক ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু অসুবিধার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই বৃষ্টি নির্মাণকাজে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এরকম কিছু সমস্যার মধ্যে রয়েছে-

  • আর্দ্রতার জন্য কাঠের ফ্রেম বেঁকে বা ফেটে যাওয়া।
  • মাপমতো বানানো উপকরণ সংকুচিত হয়ে বা ফুলে গিয়ে জায়গামতো ফিট না হওয়া। 
  • ধাতব উপকরণে মরিচা ধরে যাওয়া।
  • সাইটের মাটি সরে গিয়ে ফাউন্ডেশন বা স্ট্রাকচারকে হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া।

এসব কারণে অনেক সময় বর্ষাকালে নির্মাণকাজ বন্ধও করে দিতে হয়। কিন্তু তাতে নির্মাণ শিল্পের ব্যবসায়িক দিকগুলোতে নেমে আসে ক্ষতি এবং মালিক বা ডেভেলপারের জন্যও এমন সময়ক্ষেপণ অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে কিছু সাধারণ বিষয় মেনে চললে বর্ষাকালেও নির্মাণ নিরাপদ ও সচল রাখা সম্ভব। চলুন দেখে নিই সেই বিষয়গুলো।

নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিন

নির্মাণে সংশ্লিষ্ট লোকবলই আপনার নির্মাণের মূল চালিকাশক্তি। সকলে সুস্থ এবং কর্মক্ষম থাকাটা যেমন আপনার নির্মাণের গতিকে ত্বরান্বিত করতে পারে, সেরকম আপনার নির্মাণের টাইমলাইন থাকা চাই দুর্ঘটনামুক্ত। যেকোনো ঋতুতেই তাই নির্মাণ নিরাপত্তা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে। কিন্তু বর্ষাকালে দুর্ঘটনার শঙ্কা বেশি বলে চিন্তাও করতে হবে বেশি। কাজের জন্য গামবুটসহ সকল নিরাপত্তা উপকরণের ব্যবহার নিশ্চিত করুন। এর সাথে অস্থায়ী রেলিং বা সেফটি নেট ব্যবহার করতে কনট্রাক্টরকে তাগাদা দিন। সাথে সাথে শ্রমিকদের বৃষ্টিতে বাইরে কাজ করতে হলে তাদের জন্য বৃষ্টি প্রতিরোধী গিয়ারও নিশ্চিত করুন যেন তারা সুস্থ ও নিরাপদ থেকে আপনার কাজটি শেষ করতে পারেন।  

আগে থেকে পরিকল্পনা করুন

ছাদ ঢালাইয়ের মতো কিছু বিশেষ কাজ বৃষ্টি চলাকালীন করাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ঢালাইয়ের পর যখন কিউরিং দরকার হয়, তখন বৃষ্টির পানি আপনার পরিশ্রম কমিয়ে দিতে পারে। তাই এসব ব্যাপারে একটি সময় নির্ধারণ করে আগেই প্ল্যান করে নিন। স্থপতি থেকে ভবনের নকশা ও ইঞ্জিনিয়ার থেকে স্ট্রাকচারাল ড্রয়িং নেবার পরই নির্মাণের টাইমলাইন নিয়ে নির্মাতার সাথে কথা বলুন। বর্ষা শুরুর আগে সংবেদনশীল অংশ, যেগুলোর পানি বা আর্দ্রতায় ক্ষতি হতে পারে, পলিথিনে সেগুলো মুড়িয়ে নিন এবং স্ক্যাফোল্ডিংসহ আলগা ভারী নির্মাণ সামগ্রী নিরাপদ করে ফেলুন।

বৃষ্টি নিরাপত্তা কাঠামো নির্মাণ

ধাতব ও কাঠের তৈরি সামগ্রীর পানিতে ক্ষতি হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। তাই বর্ষার আগেই এগুলোকে পানি থেকে নিরাপদে রাখতে অস্থায়ী শেড জাতীয় কাঠামো তৈরি করা উচিৎ। এছাড়া নির্মাণে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিও এই শেডের নিরাপত্তায় আনা উচিৎ এবং নিশ্চিত করা উচিৎ যেন পানি জমে থাকে এরকম কোনো অংশে আলগা বৈদ্যুতিক তার বা সংযোগ না থাকে। কম খরচে পানিরোধী ট্র্যাপ তৈরি করাও একটি বড় পদক্ষেপ হতে পারে। বর্তমানে খুব সহজে নির্মাণ করা যায় এরকম অস্থায়ী কাঠামো উপকরণ কিনতেও পাওয়া যায়।

সঠিক উপকরণ ও যন্ত্রাংশ ব্যবহার

আধুনিক সময়ে অনেক নির্মাণ উপকরণ ও যন্ত্রাংশই পানিরোধী। যেমন- বর্তমানে পানিরোধী রুফশিট পাওয়া যায়। যেটি দিয়ে চাল নির্মাণ করলে অনেক কম খরচে শ্রমিকদের থাকা ও বাইরে কাজ করার স্থানগুলোকে পানি থেকে নিরাপদ করা যায়। এছাড়া কাঠের উপরে বিশেষ কোটিংয়ের ব্যবহারও জনপ্রিয় হচ্ছে, যেগুলো সিজন করা বা না করা দুই ধরনের কাঠকেই পানি থেকে নিরাপদ রাখতে পারে। তাই একটু বেশি বিনিয়োগ করে এধরনের উপকরণ ও যন্ত্রাংশ কিনলেই বৃষ্টিতে কাজ বন্ধ রাখতে হয় না।

কংক্রিট ও বৃষ্টির সম্পর্ক

অবশ্যই নির্মাণের টাইমলাইন এমন হওয়া উচিৎ যেন বর্ষা আসার আগেই কংক্রিট কাস্ট করে ফাউন্ডেশন তৈরি করে নির্মাণ গ্রাউন্ড লেভেল পর্যন্ত নিয়ে আসা যায়। এই কাজ বর্ষার সময় করা যায় না। কংক্রিটের ফুটিং বসানোর আগেও পানি জমে নেই- এটা নিশ্চিত করাটা আবশ্যক। নির্মাণের অন্য অংশেও কাস্টিংয়ের জন্য কংক্রিট প্রস্তুত করা ও ঢালাই করা উচিৎ নয় বৃষ্টি চলমান অবস্থায়। এতে করে পানি ঢুকে মিক্সচারের অনুপাত পরিবর্তন করে দিতে পারে। এছাড়া কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে আলাদাভাবে। চলুন দেখে নিই সেগুলো-

১. আর্দ্রতা বেড়ে গেলে বালি ও সিমেন্ট পানি শোষণ করে আর্দ্র হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এ অবস্থায় এদের সাথে পর্যাপ্ত অনুপাতে পানি মেশালেও পানি বেশি হয়ে যেতে পারে ও মিশ্রণকে দুর্বল করে ফেলতে পারে।

২. অনেক মিক্সচার তৈরিতে অ্যাডমিক্সচার ব্যবহার করে বন্ধন বাড়ানো হয় কংক্রিটের। এগুলো কংক্রিট বা ব্লকে ফাঁপা জায়গা ও ফাটল কমাতে সাহায্য করে। মূলত কংক্রিটের ভেতর পানির কণা জমে থাকা প্রতিরোধ করে এই উপাদান, যাতে পরে পানি বের হয়ে এসে ফাটল তৈরি করতে না পারে। এই উপাদানটি বর্ষায় কাজ করতে বাধ্য হলে ব্যবহার করা উচিৎ।

৩. যখন কনক্রিট ঢালাই করা হবে সেসময় পরিবেশ আর্দ্র বা বাতাস বেশি থাকা কোনোভাবেই কাজের উপযুক্ত পরিবেশ নয়। টানা ১২ ঘণ্টা শুষ্ক আবহাওয়া থাকবে এই নিশ্চয়তা না থাকলে সেটা বন্ধ রাখাই নিরাপদ।

৪. বর্ষাকালে অনেক সময় প্রচণ্ড বাতাস বা ঝড় হতে পারে। এ সময়েও ঢালাই করা উচিৎ নয়। ঝড় বা বাতাসের কারণে শাটারিংয়ের বাইরে চুইয়ে আসতে পারে কনক্রিট। যেটি পরবর্তীতে সংকুচিত হয়ে যেতে পারে বা ফাটল তৈরি করতে পারে।

৫. প্লাস্টিকের তারপুলিন বা অন্য যেকোনো ধরনের বৃষ্টিরোধী ক্যানভাস ঢালাইয়ের সময় তৈরি রাখা উচিৎ। আর বৃষ্টির সামান্য সম্ভাবনা থাকলেও ঢালাইয়ের স্থান ঢেকে ফেলা উচিৎ আগেই। কংক্রিটের সাথে খোয়াও ঢেকে রাখা দরকারি।

৬. বৃষ্টির কারণে পানি জমে অনেক সময় কংক্রিটের সারফেসের মান নষ্ট করে দিতে পারে। সামান্য একটি স্ক্র্যাচ টেস্টের মাধ্যমেই বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার এটি বুঝতে পারবেন। এরকম কোনো সমস্যা হলে বৃষ্টি থামার সাথে সাথে একই কংক্রিট বা সিমেন্ট স্প্রে দিয়ে এটিকে মেরামত করা উচিৎ। তবে চিকন স্ল্যাবের বড় ক্ষতি হলে সেটি সরিয়ে নতুন করে কাস্ট করাটাই নিরাপদ ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। 

নির্মাণে বর্ষাকাল এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু সতর্কতার অভাব নির্মাণের অংশবিশেষ বা গোটা প্রজেক্টকেই অনেকক্ষেত্রে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। তাই যথাযথ সতর্কতা, স্মার্ট প্ল্যানিং ও বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়ে আপনাকে এই সময় নির্মাণ কাজ চালাতে হবে। ছোট ছোট স্মার্ট পদক্ষেপই পারে কঠিন আবহাওয়াতেও আপনার নির্মাণকে সচল ও স্বাভাবিক রাখতে।