বাড়ির নকশায় স্থপতি ও প্রকৌশলীর ভূমিকা

আমাদের সারাজীবনের স্বপ্নের বাড়ির বাস্তবায়নের কাজ যাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ তত্ত্বাবধানে হয়ে থাকে এবং যাদের সুযোগ্য জ্ঞানে একটি সাধারণ বাসা হয়ে ওঠে স্বপ্নের আবাস তারা হলেন স্থপতি ও প্রকৌশলী। আপনার বাসা যাতে আলো-বাতাসে ভরপুর হয়ে খোলামেলা সুন্দর ও মনের মত হয়ে উঠে সেজন্য তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে থাকেন।

সাধারণত বাড়ির নকশা করার সময় থেকে নির্মাণের পুরোটা সময় এবং ক্ষেত্রবিশেষে মেইন্টেনেন্স ও এই সংক্রান্ত বিশেষ পরামর্শ ও সহায়তা দিয়ে তারা আমাদের জীবনকে করে তুলেন স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল। আসুন আমরা জেনে নিই কী তাদের ভূমিকা এবং কেন একজন বিশেষজ্ঞ স্থপতি ও প্রকৌশলী আমাদের বাসা নির্মাণের সময় নিয়োগ করতে হবে।

স্থপতির প্রয়োজনীয়তা 

দালান নির্মাণের নকশা পর্যায়ে প্রথমেই একজন স্থপতি নিয়োগ করা আবশ্যক। একজন স্থপতির অবশ্যই দালান নির্মাণ এবং নির্মাণ বিধিমালান সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান এবং দালান নির্মাণ সংক্রান্ত কাজে ক্লায়েন্ট ও অন্যান্য এক্সপার্টদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকা উচিৎ। একজন স্থপতিই আপনার সাধ ও সাধ্যের সম্পূর্ণ সমন্বয় ঘটিয়ে আপনার বাড়িকে করে তোলে কাব্যিক। স্থপতিরা এমন নকশা তৈরি করেন যা হয় নান্দনিক, সৃজনশীল এবং বাসায় বসবাসকারীদের দৈনন্দিন কাজগুলো হয়ে উঠে স্বচ্ছল, নির্ভেজাল।

 কাজ শুরুর আগে স্থপতির কাজ ক্লায়েন্টের প্রয়োজনীয়তা বোঝা, তার উদ্দেশ্য এবং প্রত্যাশা সম্পর্কে একটি যত্নশীল নোট নেওয়া, প্রকল্পটির আকার নির্ধারণ ও এর অনুপাতে প্রত্যাশিত বাজেট, সাইটের বৈশিষ্ট্য এবং সাইটের আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে আলোচনা। 

বাড়ির ডিজাইন শুরু করার আগে একজন স্থপতি যা করেন তা হচ্ছে –

– সাইটের সীমাবদ্ধতা এবং সম্ভাব্যতা বোঝা

– আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আলোচনা করা

– যদি কাজটি সংস্কার বা পুনর্বাসন বা কোনও নতুন নির্মাণ হয় তবে সম্ভাব্য সকল সমাধানের পরামর্শ ও অধ্যয়ন

– সম্ভাব্যতা সমীক্ষা আনা এবং উপস্থাপন করা

– প্রয়োজনের ভিত্তিতে সাইট বা বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন পছন্দ

– বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ্ধতিগুলি কাটিয়ে উঠতে বিভিন্ন বিকল্পের বিধান

– প্রক্রিয়া পরিকল্পনা

ড্রয়িং সংক্রান্ত দায়িত্ব

একটি প্রজেক্ট শুরু করার আগে প্রচুর ড্রয়িংয়ের প্রয়োজন হয়। সাধারণ জায়গাগুলোর অবস্থান থেকে শুরু করে সূক্ষ্মতম ডিটেইল ড্রইং সবকিছুই একজন স্থপতির করতে হয়। ড্রইং এর ভুলগুলি কাজ শুরু করার আগেই যাচাই করে নিতে হয়, কেননা ড্রইংয়ে সামান্য ভুলের জন্য ক্লায়েন্টের যেমন খরচ বেড়ে যায়, তেমনি বাড়ে সেই বাড়িতে বসবাসের সময়ের অস্বস্তিও। প্রাথমিক এই ড্রয়িং সঠিক সময়ে প্রজেক্টের কাজ নিশ্চিত করে। 

ড্রয়িংগুলোর ভিত্তিতে বিশদ অনুমান, উপাদান সংগ্রহ এবং সাইটে কাজ করা হয়। প্রাথমিকভাবে, স্কেচ ডিজাইনগুলি প্রস্তুত করা হয় যা বিল্ডিংয়ের অবস্থানটি দেখায়। এটি অভ্যন্তরের ও আশেপাশের বিভিন্ন জায়গার বিন্যাসের পাশাপাশি, পাশাপাশি বসার বিভিন্ন কানেকশন সম্পর্কে ধারণা দেয়। স্কেচ ডিজাইনের ভিত্তিতে ক্লায়েন্ট নির্দিষ্ট নীতি এবং চুক্তিতে সম্মত হন। 

বিল্ডিং বা কাঠামো নির্মাণের কাজটি এখন স্থপতি এবং একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার উভয়েরই দ্বারা সম্পাদিত হয় যদি তাদের পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা থাকে। একজন আর্কিটেক্টের যে বিভিন্ন ড্রয়িং করতে হয় তার মধ্যে ফ্লোর প্ল্যান, সাইট প্ল্যান, উচ্চতা এবং আইসোমেট্রিক ভিউ, অন্যান্য বিস্তারিত স্ট্রাকচারাল অঙ্কন, থ্রিডি মডেল এবং থ্রিডি ভিউ অন্তর্ভুক্ত।

মূলত এই কাজগুলো বা স্থপতি দ্বারা প্রদত্ত বিবরণগুলো তাকে দেয়া ক্লায়েন্টের চাহিদা ও কাজের ওপর নির্ভর করবে। কখনও কখনও এমন পরিস্থিতি আসে যেখানে আমাদের পরিকল্পনা এবং কাঠামোগত বিল্ডিংয়ের নকশা করার জন্য একজন স্ট্রাকচারাল ডিজাইনার থাকেন।

প্রদত্ত প্ল্যানিঙের জন্য আমাদের একটি ভাল এলিভেশন থাকা দরকার। আমরা সামনের উচ্চতা এবং ল্যান্ডস্কেপিংয়ের টেকনিক্যাল সমস্যা মোকাবেলায় যখন স্থপতির কাছে যাব তখন তা প্রকৌশলী এবং স্থপতি এর মধ্যে সহযোগিতা এবং আলোচনার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করবে।

এসব ছাড়াও একজন স্থপতি কস্ট এস্টিমেশন প্রদান করেন এবং তিনি যদি কোন কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হন তাহলে তাদের মার্কেটিংয়ের স্বার্থে পরামর্শ প্রদান করতে পারেন।

এছাড়াও দালান কনস্ট্রাকশনের সময়কালে প্রকৌশলীর সাথে সমন্বয় করে সুষ্ঠুভাবে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হচ্ছে কিনা এবং সাইটে সময়ে সময়ে তদারকি করতে চুক্তিবদ্ধ করা যেতে পারে। এত সব গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য বাসা নির্মাণের আগে আমাদেরকে অবশ্যই একজন লাইসেন্সপ্রাপ্ত সুযোগ্য স্থপতিকে দালানের নকশার কাজে নিয়োগ করতে হবে।

প্রকৌশলীর ভূমিকা কী?

একটি দালান বা বাড়ি ঠিকমত নির্মাণ করতে সবচেয়ে বেশি যাকে প্রতিটি পদক্ষেপে দরকার হয়, তিনি হলেন প্রকৌশলী। একটি দালানের নির্মাণ কাজে বিভিন্ন এক্সপার্ট প্রকৌশলীর সাহায্য প্রয়োজন হয়ে থাকে, যেমন- সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিনিয়ার। এদের সকলের সহায়তায় একটি বাড়ি হয়ে উঠে বসবাসযোগ্য, আরামদায়ক এবং আমাদের স্বপ্নের রঙ-এ রঙিন। তারা স্থপতির সাথে কোলাবোরেশন করে দালানের নকশা কাজ থেকে শুরু করে নির্মাণের শেষ পর্যায় এবং পরে প্রয়োজনমত মেইন্টেনেন্সের কাজের জন্য সহায়তা ও পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আসুন আমরা জেনে নেই তারা কী কী ভূমিকা পালন করে থাকেন।

স্ট্রাকচারাল সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের ভূমিকা

স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রের অধীনে একটি বিস্তৃত ক্ষেত্র। এটি সীমাহীন তত্ত্ব এবং অনুশীলন সহ একটি বিস্তৃত বিষয়। এটি এমন একটি ক্ষেত্র যা এখনও বিশাল উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং কন্সেপ্ট নিয়ে বিকাশ করছে। কাঠামোগত প্রকৌশল (স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং) কাঠামোর নকশা এবং দালানের কাঠামোগত অখণ্ডতার সাথে বেশি জড়িত। এই কাঠামোগুলি বিল্ডিং, বাঁধ, টানেল, ব্রিজ ইত্যাদি হতে পারে। স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারের প্রধান দায়িত্ব হল এমন কাঠামো নির্মাণ করা, যা দালানের দীর্ঘদিন সুরক্ষা এবং স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে।

স্থপতিরা কেবলমাত্র বিল্ডিংয়ের আকার, আকার এবং ব্যবহারের ভিত্তিতে বিল্ডিং নকশা করেন। তবে এগুলির নির্মাণের সময় এবং পরে কিছু প্রযুক্তিগত সমস্যা রয়েছে যা কেবল কাঠামোগত প্রকৌশলীরা খুঁজে পেতে এবং সমাধান করতে পারেন। কাঠামোগত প্রকৌশলীরা স্থপতিদের পরিকল্পনার জন্য তার দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে সহায়তা করে।

পদার্থবিদ্যার গভীর জ্ঞান, সৃজনশীল সমস্যা সমাধানের ইচ্ছা এবং সফটওয়্যারে ত্রিমাত্রিক ধারণাগত দক্ষতা অবশ্যই কাঠামোগত প্রকৌশলী দ্বারা অর্জন করতে হবে। এগুলি ব্যতীত স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারের ভূমিকা এবং দায়িত্বগুলির মধ্যে রয়েছে-

 কাঠামোর নকশাগত দায়িত্ব

কাঠামোগত প্রকৌশলীরা কাঠামোগত ডিটেইলস এবং তাদের বিশ্লেষণের জন্য পড়াশুনা করেন। সুতরাং, তারা কাঠামোগত ডিজাইনের ক্ষেত্রে অনেক বেশি জ্ঞানী ও দক্ষ। কাঠামোগত প্রকৌশলীরা সম্পূর্ণ স্ট্রাকচারাল ডিজাইনিং পদ্ধতির জন্য ভার এবং বিল্ডিংয়ের উপর এক্টিং স্ট্রেসগুলি গণনা করা, ভর বিশ্লেষণ, কাঠামোর অংশগুলির নকশা ভার বজায় রাখার জন্য অন্তর্ভুক্ত; যাতে নকশা করা কাঠামো নিরাপদে পূর্বাভাস দেয়া ভারগুলি সহ্য করতে পারে।

কাঠামোগত প্রকৌশলীরা কাঠামোর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত উপকরণ নির্বাচনের সাথেও জড়িত। বিভিন্ন বিল্ডিং উপকরণের গুণমানের কারণগুলি স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা বিম, কলাম বা ভিত্তিগুলির নকশায় তাদের উপযুক্ততা চূড়ান্ত করতে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। এইসব হিসাব নিকাশ তারা সফটওয়্যার ব্যবহার করে সিমুলেট করে নকশা করে থাকেন।

সাইট সংক্রান্ত কাজ

সাইট তদন্তের সাথে কাজ করার সময়, কাঠামোগত প্রকৌশলীরা প্রকল্পটি নির্মাণের জন্য মাটির অবস্থা যাচাইয়ের সাথে জড়িত। ডিজাইনার দ্বারা গণনা করা লোডগুলোর ওপর ভিত্তি করে, এটি গণনা করে ভার বহন করার জন্য মাটি উপযুক্ত কিনা তা অবশ্যই পরীক্ষা করা উচিত। এই তদন্তটি কাঠামোর জন্য অবশ্যই ব্যবহার করা যায় এমন ফাউন্ডেশন সিস্টেমের ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেবেন এই প্রকৌশলীরা। মাটির জন্য যেকোনো ধরনের পরামর্শ, প্রয়োজনীয় তদন্তের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই তদন্তটি মাটি, যা ভূ-প্রযুক্তিগত প্রকৌশলীর অংশ, তা পরীক্ষা করে পরিচালিত হয়।

এভাবে দালানের ভার বহন করা ছাড়াও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজের জন্য অন্য এক্সপার্টিজের প্রকৌশলীর সহায়তা নিতে হবে। যেমন – দালানের তড়িৎ সংযোগ ও বৈদ্যুতিক লোড বহনের জন্য সঠিক মাপের তার ও কন্ডুইট ডিজাইনের জন্য তড়িৎ প্রকৌশলীর দরকার হয়। এরকম খুঁটিনাটি নানাবিধ কাজে নানা এক্সপার্টিজের ইঞ্জিনিয়ারের সহায়তা লাগে। একটি সুন্দর দালান শুধুই খোলস, প্রকৌশলীর সহায়তা ছাড়া। তারা তাদের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে বাড়িকে করে তুলেন বসবাসযোগ্য ও কার্যকর। স্থপতিদের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে তাদের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে আমরা বানাতে পারি আমাদের স্বপ্নের বাড়ি, যাতে আমরা জীবনযাপন করতে পারি স্বচ্ছন্দে। 

বাড়ি নির্মাণ করবেন: কত খরচ পড়বে?

“আমি একটি বাড়ি নির্মাণ করতে চাই। বলতে পারেন কেমন খরচ পড়বে?” এই প্রশ্নটি নির্মাণকাজের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেককে প্রায় প্রতিদিনই শুনতে হয়। একটি বাড়ি তৈরিতে খরচ কত হবে এ সম্পর্কে সরাসরি একটি উত্তর দেয়া সবসময়ই কঠিন।

কারণ, ভবন নির্মাণ একটি শিল্প যেখানে অনেক বিষয়ই একসাথে কাজ করে। জমির মাপ, ভবনের নকশা, কত বর্গফুট জায়গা, সাইটের অবস্থা ও অবস্থান, উপকরণের সহজলভ্যতা ও পরিবহন ব্যবস্থা ইত্যাদি নানা কারণে খরচ পরিবর্তন হতে পারে। 

তবে ভবন তৈরি করতে হলে আপনাকে সকল দরকারি জমিসংক্রান্ত কাগজ ও সার্ভেসহ প্রথমে যেতে হবে স্থপতির বা স্থাপত্য ফার্মের কাছে। তারা আপনাকে নকশা ও খরচের প্রাথমিক হিসাব প্রদান করবেন। সেখান থেকে প্রাপ্ত ও সরকার অনুমোদিত নকশা নিয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বা ফার্ম থেকে পুরকৌশল সংক্রান্ত নকশা ও বাজেট নির্ধারণ শেষে আপনি নির্মাণে হাত দিতে পারবেন।

এখন স্থপতি ও প্রকৌশলীর ফি এবং অনুমোদনের ফি প্রদানের পর আপনি নির্মাণ বাজেটকে বিভিন্ন খাতে ভাগ করতে পারেন। এই খাত এর আনুপাতিক হার সম্পর্কে ধারণা দেয়া সম্ভব।

বিভিন্ন খাত অনুসারে আপনার নির্মাণ বাজেট খরচের শতকরা হিসাব

১. ভিত্তি ও কাঠামো = ৩৫%

২. ইটের কাজ = ৬%

৩. ফ্রেম ও কাঠের কাজ = ৫%

৪. ধাতব কাজ = ২%

৫. পয়ঃনিষ্কাশন ও পানি সরবরাহ সংক্রান্ত কাজ = ৬%

৬. বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি = ৭%

৭. প্লাস্টার = ৪%

৮. টাইলস ও ফ্লোর সংক্রান্ত কাজ = ৬%

৯. স্নানঘর ও টয়লেটের সাজসজ্জা = ৩%

১০. অ্যালুমিনিয়াম ও জানালার ফ্রেমিংয়ের সাজসজ্জা = ৪%

১১. কেন্দ্রীয় বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি (লিফট, জেনারেটর ও সাবস্টেশান)= ১০%

১২. রঙের কাজ = ৩%

১৩. বিবিধ পুরকৌশলজনিত কাজ = ৬%

১৪. নির্মাণকালীন সব ধরনের সংযোগ ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার বিল = ৩%
___________________________________________________________

মোট খরচ  = ১০০%

এখন যদি আমরা প্রতিটি খাতে, বাংলাদেশের সাধারণ নির্মাণ সংস্কৃতিতে একটি ছয়তলা বাড়ির কথা চিন্তা করি (যা ৩, ৫ বা ৭ কাঠা জায়গার উপর নির্মিত হবে) তাহলে এর বিভিন্ন খাতকে আরো বিস্তারিতভাবে খরচ সাপেক্ষে নিরুপণ করা যায়। সেটা অনেকটা এরকম-

ভিত্তি ও কাঠামোগত খরচ


– ফুটিং ও কলামের ভিত্তিমূলের কাজ = ২০%

– গ্রেড বীম ও ভূগর্ভস্থ পানির ট্যাংকের উপরের স্ল্যাব = ৫%

– বেজমেন্ট-এর কলাম ও স্ল্যাব = ৪%

– ১ম ফ্লোরের স্ল্যাব = ৯%

– সাধারণ ফ্লোরের কলাম (৫x৩%) = ১৫%

– দ্বিতীয় তলা থেকে বাকি ফ্লোর সহ ছাদের স্ল্যাব (৫x৮) = ৪০%

– ছাদের কাঠামোগত খরচ = ৭%
____________________________________

ভিত্তি ও কাঠামোর জন্য মোট খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেট এর ৩৫% যেভাবে খরচ হবে।)

ইটের কাজে খরচ

– বেজমেন্ট এ ইটের কাজ = ৬%
– প্রথম ফ্লোরে ইটের কাজ= ১৮%
– দ্বিতীয় ফ্লোরে ইটের কাজ= ১৮%
– তৃতীয় ফ্লোরে ইটের কাজ= ১৮%
– চতুর্থ ফ্লোরে ইটের কাজ= ১৮%
– পঞ্চম ফ্লোরে ইটের কাজ = ১৮%
– ছাদে ইটের কাজ= ৪%
____________________________________

ইটের কাজে মোট খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেট এর ৬% যেভাবে খরচ হবে।)

কাঠের কাজ বাবদ খরচ

– দরজার ফ্রেম = ৪০%
– মূল দরজার শাটার = ১৫%
– পারটেক্সের দরজার শাটার= ৩৫%
– পোষ্য দরজা এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি = ১০%
____________________________________

দরজার কাজে মোট খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেট এর ৫% যেভাবে হবে।)

ধাতব কাজ বাবদ খরচ

– জানালার গ্রিল = ৫৫%
– বারান্দার রেলিং = ২০%
– সিঁড়ির রেলিং = ১০%
– মূল ফটক ও সকল ধরনের সেফটি গ্রিল = ১৫%
____________________________________

ধাতব কাজে পুরো খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেট এর ২% যেভাবে খরচ হবে।)

পয়ঃনিষ্কাশন ও পানি সরবরাহ সংক্রান্ত কাজ বাবদ খরচ

– উলম্ব পিভিসি লাইন ও সকল ডাক্ট এর খরচ = ২৫%
– জি আই লাইনের কাজ = ৩০%
– ফিক্সচার ও ফিটিং = ৪০%
– নিচতলার ফ্লোর এর পয়ঃনিষ্কাশনের আলাদা খরচ = ৫%
____________________________________

পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের খরচ = ১০০% ( পুরো নির্মাণ কাজের ৬% যেভাবে হবে।)

বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি বাবদ খরচ

– স্ল্যাবের ভেতর দিয়ে লাইন বহনের খরচ = ১০%
– দেয়াল ও বৈদ্যুতিক বক্সের ভেতর লাইন বহনের খরচ = ১৫%
– তার সংক্রান্ত কাজ = ৫৫%
– সুইচ ও সকেট বাবদ খরচ = ২০%
____________________________________

বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের মোট খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেটের ৭% যেভাবে খরচ হবে।)

প্লাস্টার বাবদ খরচ

– সিলিং-এর প্লাস্টার = ২০%
– ভেতরের দেয়ালের প্লাস্টার = ৫০%
– বাইরের দেয়ালের প্লাস্টার বা ইটের ফেসিং ও পয়েন্টিং = ৩০%
____________________________________

প্লাস্টার বাবদ পুরো খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেটের ৪% যেভাবে খরচ হবে।)

টাইলস ও ফ্লোর সংক্রান্ত কাজ

– সাধারণ ফ্লোর ও বারান্দার টাইলস = ৭৫%
– সিড়ি, লিফটকোর এর দেয়াল ও লবির টাইলস = ২০%
– বেজমেন্ট এর লিফটের লবি, দেয়াল এবং লবির টাইলস = ৫%

____________________________________

টাইলস ও ফ্লোর সংক্রান্ত কাজে মোট খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেটের ৬% যেভাবে খরচ হবে।)

স্নানঘর ও টয়লেট এর সাজসজ্জা সংক্রান্ত খরচ

– স্নানঘরের দেয়াল = ৬০%
– রান্নাঘরের দেয়াল = ২০%
– স্নানঘরের মেঝে = ৯%
– স্নানঘরের কাউন্টার টপ= ৪%
– রান্নাঘরের দেয়াল = ৩%
– কিচেন কাউন্টারের টপ =৪%

____________________________________

সাজসজ্জা বিষয়ে মোট খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেটের ৩% যেভাবে খরচ হবে।)

অ্যালুমিনিয়াম সংক্রান্ত কাজ বাবদ খরচ

– স্লাইডিং জানালার বাইরের দিকের ফ্রেম = ৪০%
– গ্লাসের শাটার ও স্লাইড করার ফ্রেম = ৩০%
– বারান্দার স্লাইডিং উপকরণ = ২০%
– টয়লেটের উঁচু জানালা = ৫%
– সাধারণ এরিয়া এর উপকরণ = ৫%
____________________________________

অ্যালুমিনিয়াম সংক্রান্ত মোট খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেটের ৪% যেভাবে খরচ হবে।)

কেন্দ্রীয় বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি বাবদ খরচ

– লিফট = ৫০%
– জেনারেটর =২৫%
– বৈদ্যুতিক সাবস্টেশান = ২০%
– অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জামাদি ও ইন্টারকম সংযোগ = ৫%
____________________________________

কেন্দ্রীয় সরঞ্জামাদি বাবদ খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেটের ১০% যেভাবে খরচ হবে।)

রঙের কাজ বাবদ খরচ

– পুটি লাগানো পর্যন্ত খরচ = ৪০%
– ভেতরের দেয়াল ও সিলিং এ প্রথম আস্তর = ২০%
– ভেতরের দেয়াল ও সিলিং এ পরের আস্তর= ১৫%
– বাইরের রঙ ও মোমের কোটিং = ২৫%
____________________________________

রং বাবদ মোট খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেটের ৩% যেভাবে খরচ হবে।)

বিবিধ পুরকৌশল সংক্রান্ত কাজ

– সীমানার দেয়াল সংক্রান্ত খরচ = ৩০%
– টেরাস ও ছাদের পেভিং সংক্রান্ত খরচ= ১৫%
– ছাদে বাগান, ডেভেলপারের ব্যবসায়িক অলংকরন = ৪%
– বেজমেন্ট লেভেলের বিবিসি = ১৪%
– বেজমেন্ট এর পেভমেন্ট ও জমির ভেতর ফুটপাথ সংক্রান্ত কাজ = ১০%
– লিন্টেল, ড্রপ স্ল্যাব, এফ স্ল্যাব ইত্যাদি= ২০%
– তারের ট্রে = ১%
– ডাক্ট ও সিলিং এ তারের উপরে কাভার ও তার লুকানোর খরচ= ৪%
– অভ্যর্থনা ডেস্ক ও চিঠির বাক্স = ২%
____________________________________

বিবিধ খরচ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেটের ৬% যেভাবে খরচ হবে।)

নির্মাণকালীন সব ধরনের সংযোগ ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার বিল

– বিদ্যুৎ বিল (ডেসা ও ডেসকোর রেট অনুসারে) = ৩৫%
– গ্যাসের বিল (তিতাস এর রেট অনুসার) = ২০%
– পানির বিল (ওয়াসা এর রেট অনুসারে) = ১৫%
– অন্যান্য বিল = ৩০%
____________________________________

সম্পূর্ণ = ১০০% (পুরো নির্মাণ বাজেটের ৩% যেভাবে খরচ হবে।)

সাধারণত ঢাকায় অঞ্চলভেদে প্রতি স্কয়ার ফুট নির্মাণ কাজে আবাসিক ভবনে সর্বনিম্ন ২০০০ টাকা খরচ হয়ে থাকে। তবে নকশা ও এর খুঁটিনাটি অনুসারে এটি অনেক ওঠানামা করতে পারে।

বাড়ি নির্মাণ একটি দীর্ঘ ও সময় সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। এজন্য খরচের হিসাব সম্পর্কে শুরুতেই পরিষ্কার ধারণা নিন। আপনার স্থপতিকে শুরুতেই আপনার বাজেট সম্পর্কে ধারণা দিন ও চাহিদার কথা পরিষ্কারভাবে জানান। শুধুমাত্র এভাবেই আপনি নির্ধারিত বাজেটে আপনার পছন্দের বাড়ি পেতে পারেন।

নিজেই নিজের বাড়ি: তৈরি হোক পছন্দমতো

দৃশ্যপট ১

আজমল সাহেব একজন চিকিৎসক। সারাজীবন সরকারি হাসপাতালে সেবাদানের পর যখন অবসরে যান, পেনশন হিসেবে টাকাগুলোকে এক করে ঢাকার বুকে কিনে ফেলেন ৫ কাঠার এক টুকরো জমি। অনেকদিনের ইচ্ছে, নিজের জন্য নিজের মতো করে তৈরি করবেন একটি বাড়ি। বিকেল বেলা এক চিলতে রোদে ভরে থাকবে সে বাড়ির ছোট বারান্দা।

কিন্তু আশেপাশের মানুষের সাথে কথা বলতে গিয়ে নির্মাণ কাজ নিয়ে বেশ ভয় পেয়ে যান তিনি। ভবনের নকশা, একাধিক অনুমোদন, নির্মাণ সামগ্রীর বাজার সম্পর্কে সচেতন ধারণা রাখা থেকে হাজারটা চিন্তা এসে ভর করে নির্মাণ নিয়ে ভাবতে গেলেই। জমির ভবিষ্যৎ আর বাড়ির স্বপ্নের মাঝে বিশাল এক অনিশ্চয়তায় ভোগেন আজমল সাহেব।


দৃশ্যপট ২

প্রান্তিক ঢাকায় এক টুকরো জমি নিয়ে অনেকদিন ধরেই প্রায় একই ধরনের সমস্যায় ভুগছেন রফিকুল হক। আশেপাশের সবাই তৃতীয় পক্ষের সাহায্যে বাড়ি তুলে কয়েকটি ফ্ল্যাট নিয়ে বসবাস করছেন। কিন্তু রফিকুল হকের জন্য এই এক টুকরো জমি তার সারা জীবনের সঞ্চয়ের ফসল। এখানে বাণিজ্যিক চিন্তাধারায় ভবন তৈরি হলে সেটি যে তার ইচ্ছা বা পছন্দকে পরিপূর্ণ করবে না, সে ব্যাপারে তিনি প্রায় নিশ্চিত। তিনি নিজের চাহিদামতো ভবন চান নিজের জমিতে। নকশার আলোচনার অংশ হতে চান। নিশ্চিত করতে চান নিজের ও নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুযোগ সুবিধা। 

নিজের টাকায় এক টুকরো নিষ্কণ্টক জমি আর তার উপর নিজের মনমতো আরামদায়ক বাসস্থান- এ যেন এই দেশের প্রায় সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন। এই স্বপ্নের জ্বালানী যোগান দিতে সারা জীবন কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন এ দেশের অনেক অনেক মানুষ।

নিজের জমি থাকা সত্ত্বেও আজমল আর রফিক সাহেবের মতো নানারকম অনিশ্চয়তার দোলাচলে সেই জমিতে বাড়ির স্বপ্ন অধরা থেকে যাচ্ছে। কেউ কেউ তৃতীয় পক্ষের শরণাপন্ন হয়ে নিজের জমিতে বাড়ি পাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু তাতে থাকছে না নিজের চিন্তা ও চাওয়া-পাওয়ার স্বাতন্ত্র্যের ছাপ। নিজের জমিতে নিজেই বাড়ি করার ব্যাপারে অনেকেই দ্বিধায় ভোগেন কিছু নির্দিষ্ট কারণে। আধুনিক সময়ের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী নির্মাণ ও স্থাপত্য মানের বিবেচনায় এখনো নিজের বাড়ি নিজে তৈরি করাই কিন্তু সবচেয়ে প্রচলিত ও লাভজনক প্রক্রিয়া। নির্মাণের নানা ধাপে এর সুফল পেতে পারেন একজন জমির মালিক।

১. নকশা

জমির উপরে বাড়ির নকশার জন্য একজন প্রশিক্ষিত স্থপতির দারস্থ হওয়াটা খুবই দরকারি। অনেকে মনে করেন, স্থপতির শরণাপন্ন হওয়া মানেই নির্মাণে শুধুমাত্র অলংকরণ যোগ করা ও অতিরিক্ত খরচ। অথচ একটি বাড়িতে বসবাসরত মানুষের জীবনযাপনের মান থেকে শুরু করে পর্যাপ্ত জায়গা, আলো-বাতাসের পর্যাপ্ততা এবং জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারেন শুধুমাত্র একজন স্থপতি। এর জন্য আপনাকে খরচ করতে হবে আপনার পূর্ণাঙ্গ নির্মাণ বাজেটের মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ অর্থ।

কোনোরকম তৃতীয় পক্ষের সহায়তা ছাড়াই আপনি পেশাদার স্থপতির সাহায্য নিতে পারেন খুবই সহজে। আপনি নিজে যদি আপনার বাড়ির নির্মাণে নিযুক্ত স্থপতির সাথে কথা বলেন এবং তাকে আপনার নিজের বাড়ির খুঁটিনাটি চাহিদা সম্পর্কে জ্ঞাত করেন, তাহলে তিনি প্রতিটি সূক্ষ বিষয় নকশায় প্রতিফলিত করতে চেষ্টা করবেন এবং নির্মাণ শুরু হবার অনেক আগেই আপনি পাবেন বাড়ির প্রতিটি বিষয় নিয়ে তার কাছ থেকে সবকিছু জেনে নেবার স্বাধীনতা।

পেশাদার স্থপতি সরকারের সব নিয়মনীতি সম্পর্কে সচেতন এবং নকশা করা বাড়ির ডিজাইন সংরক্ষণের নিশ্চয়তাও তিনি প্রদান করবেন। এছাড়া সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের কাছে স্ট্রাকচার ও প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধা (বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির লাইনের নকশা) সম্পর্কেও আপনি জ্ঞাত থাকতে পারবেন, যা পরবর্তীতে আপনার বাড়িকে করে তুলবে পূর্ণাঙ্গভাবে আপনার নিজের।

২. অনুমোদন

রাজউকে বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নকশা অনুমোদন সহজ করতে সরকার ডিজিটাল পদ্ধতিতে আবেদন ও নকশা অনুমোদনের ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করেছে। খুব দ্রুতই সকল অনুমোদন নেবার প্রক্রিয়া হবে অনিয়ম ও ঝামেলামুক্ত। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে স্থপতির কাছ থেকে প্রাপ্ত নকশা অনুমোদনের জন্য পাঠানো যাবে এবং মোবাইল ফোনে পাবেন নিয়মিত আপডেট। নিজের বাড়ি নিজে করার ক্ষেত্রে অনুমোদন কখনোই কোনো বাধা নয় যদি আপনি সরকারি নিয়মনীতি মেনে বাড়ি তৈরি করেন। 

৩. নির্মাণ সামগ্রী, খরচ সময়

বাড়ির নির্মাণ সামগ্রীর দাম ওঠা-নামা করে প্রায় প্রতিবছরই। একারণে বাড়ি নির্মাণে ব্যয়ের পরিমাণও নির্দিষ্ট রাখা খুবই কঠিন হয়ে যায়। দক্ষ ঠিকাদার নির্বাচন করা এক্ষেত্রে একজন বাড়ির মালিকের জন্য হতে পারে সর্বোত্তম সমাধান। নিজে নির্মাণ কাজ পরিচালনার সাথে যুক্ত থাকলে এ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা থাকে এবং ব্যয়, সময় ও সামগ্রীর মানের ব্যাপারে একজন জমির মালিক নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারেন।

এছাড়া নির্মাণের সময় সম্পর্কে ধারণা একদম পরিষ্কার থাকায় বাজেট ম্যানেজমেন্টও তুলনামূলক সহজ ও সাশ্রয়ী হয়। তৃতীয় পক্ষ অনেক ক্ষেত্রেই এই ধরনের সমস্যা মোকাবেলায় দিনের পর দিন নির্মাণ কাজ বন্ধ করে রাখেন। এতে নির্মাণ সামগ্রীর যেমন অপচয় হয় তেমনি ভবনের মান ক্ষতিগ্রস্থ হয় বিভিন্নভাবে।

৪. স্বকীয়তা

প্রতিটি মানুষ যখন জমি ক্রয় করেন, নিজের মনে নিজের বাসার একটি ছবি থাকে। বাড়ি বা বাসা মানে শুধু এক টুকরো মাথা গোঁজার ঠাঁই নয়। নিজের বাসা বা বাড়ি মানে একটি পরিবারের এক চিলতে স্বপ্নও। হয়তো আপনি আপনার রান্নাঘরটি চান একটু বড়, হয়তো আপনার চাই প্রতিটি ঘরের সাথে লাগোয়া এক টুকরো বারান্দা অথবা আপনি চান আপনার পরিবারের সব সদস্যই যেন নিজের পছন্দমতো একটি ঘর বরাদ্দ যেন পায় বাড়িতে।

এসব চাহিদা মানুষের মানবিক বোধ থেকে তৈরি এবং প্রতিটি মানুষের জন্য আলাদা, প্রতিটি পরিবারের জন্য আলাদা। যদি সর্বসাধারণের মাঝে বিক্রয়ের জন্য বাড়ির নকশা করা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই এই স্বকীয় চিন্তাধারা চলে যেতে পারে আড়ালে। আপনার বাড়ি হয়ে যেতে পারে আর দশটি বাড়ির মতোই ইট-কাঠের বাক্স। তাই ব্যবসায়িক চিন্তাধারার বাইরে থেকে বাড়ি তৈরি করতে চাই নিজের শক্ত উপস্থিতি। শুধুমাত্র নিজের বাড়ি নিজে তৈরি করতে সাহস করলেই এই স্বকীয় চিন্তাধারা বেঁচে থাকতে পারে প্রতিটি বাড়ির নির্মাণ প্রক্রিয়ায়।

৫. অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

২০২০ সালে এসে রিয়েল এস্টেট বা আবাসন হয়ে উঠেছে সর্বোচ্চ মানের অর্থনৈতিক বিনিয়োগের ক্ষেত্র। ব্যাংকের লভ্যাংশের চেয়ে অনেক দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে জমির দাম, ফ্ল্যাটের দাম। নিজের জমিতে নিজের বিনিয়োগ এই লাভের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে প্রচুর পরিমাণে। বলা বাহুল্য, তৃতীয় পক্ষের নির্মাণ কাজে সংশ্লিষ্টতার কারণে এসব ক্ষেত্রে জমির মালিকের জন্য লভ্যাংশ যোগ হচ্ছে না তেমন কিছুই। নিজের বাড়ি নিজে তৈরি করা তাই অনেক দিক থেকে ঝামেলার মনে হলেও মান নিয়ন্ত্রণ ও গুণগত দিক ঠিক রাখতে পারলে ভবিষ্যতের জন্য এটি হতে পারে একটি দুর্দান্ত বিনিয়োগ।

. ভবিষ্যতের পথে

ঢাকা শহরে এক টুকরো জমি বা একটি বাড়ি শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, সামাজিকভাবেও একটি দূরদর্শী বিনিয়োগ। নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা, তাদের সামাজিক বিবর্তন বা নাগরিক সুযোগ-সুবিধা একটি কমার্শিয়াল চিন্তাধারার বাড়িতে বাধাগ্রস্থ হবে, এটি খুবই স্বাভাবিক। এ সম্পর্কে তাই চাই মানবিক চিন্তাধারা, পারিবারিক বন্ধনকে ভবনের নকশায় স্থান দেওয়া।

বাড়ির সাথে আত্মিক বন্ধন তৈরিও তাই ভবিষ্যতের পথে একটি পরিবারকে এগিয়ে দিতে পারে অনেকদূর। নিজের বাড়ি নিজে তৈরি করার মাধ্যমে একটি পরিবার একসাথে থাকার ও একভাবে সামনে এগিয়ে যাবার যে প্লাটফর্ম তৈরি হয়, তা শর্তসাপেক্ষে কয়েকটি ফ্ল্যাটের বিনিময়ে তৈরি করে দেওয়া বাড়িতে পাওয়া কি আদৌ সম্ভব?

এসব কারণেই নিজের বাড়ি নিজে তৈরি করতে আগ্রহী হতে সেরা সময়টা আসলে এখনই। তবে এজন্য চাই প্রশিক্ষিত স্থপতি ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, যারা আপনার চাহিদা বুঝবেন ও কমার্শিয়াল ধ্যান-ধারণার বাইরে এসে আপনাকে সাহায্য করবেন। আর চাই নিষ্ঠাবান ঠিকাদার। আর এসবের জন্য প্রয়োজন একটি বিশ্বমানের কনসাল্টেশন সার্ভিসও।

এই কয়টি জিনিস নিশ্চিত করতে পারলেই আপনার স্বপ্নের বাড়ি ইট-কাঠের খাঁচা ভেঙে হয়ে উঠবে চিরায়ত সেই বাসস্থান, যার মায়ায় যুগের পর যুগ আপনার মন পড়ে থাকবে এই ভৌগোলিক পরিসীমাতে। তখন বাড়ি শুধু একটি স্থাপনা নয়, হবে আপনার আবেগ, অনুভূতি আর পরিবারের সুখ-দুঃখের সূতিকাগার।

আদিকাল থেকে বর্তমান: বসতবাড়ির বিবর্তনের ইতিহাস

মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা হলো বাসস্থান। বাসস্থান মানুষকে বিরুদ্ধ শক্তি থেকে দেয় সুরক্ষা, বন্যপ্রাণীর আক্রমণ থেকে দেয় নিরাপত্তা, দেয় দিনের শেষে স্বস্তিতে ঘুমানোর জায়গা। কালের বিবর্তনে মানুষের কারিগরী দক্ষতা বেড়েছে, বেড়েছে নতুন নতুন প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও তা প্রয়োগ করার দক্ষতা। মানুষ নিজের আরাম-আয়েশের সাথে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে, নিত্য-নতুনভাবে বানিয়েছে তার বাসস্থান, যা কালের পরিক্রমায় তার স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে গেছে। আসুন দেখে নেওয়া যাক, কীভাবে কালের বিবর্তনে মানুষের বাসস্থান আদিমকাল থেকে আজকের আধুনিক রূপ পেয়েছে।

প্রস্তরযুগ

যখন মানুষ বাসা বানাতে পারত না, তারা প্রকৃতি থেকে নিজের সব চাহিদা পূরণ করত। মানুষ গাছের ছায়াতে ছোট ছোট দলভুক্ত হয়ে থাকত। ঝড়, বৃষ্টি, প্রখর রোদ থেকে বাঁচতে গাছের শীতল ছায়া তাদের দিত খুব সীমিত পরিসরের সুরক্ষা।

তারা একসময় হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ থেকে বাঁচতে গাছের উপরে আশ্রয় নেয়। যেসব স্থানে ঘন বন পাওয়া যেত না, সেসব স্থানের পাহাড়ে বা আশেপাশের গুহাতে মানুষ থাকার চেষ্টা করত। গুহা মানুষকে আবহাওয়া থেকে রক্ষা করত আরো ভালোভাবে। আগুন আবিষ্কারের পরে বন্যপ্রাণী থেকে সুরক্ষা আরো সুনিশ্চিত হলো। প্রত্নতাত্ত্বিকরা পাথরের তৈরি বাসন এবং অস্ত্র আবিষ্কার করে কার্বন ডেটিং-এর মাধ্যমে এত সব তথ্য পেয়েছেন।

তখনও মানুষ খাদ্য সংগ্রহ ও সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াত। নিজের ঘর তৈরি করতে পারত না।

মধ্য-নব্যপ্রস্তরযুগ

এসময়ে মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে থাকার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারে এবং আগুন ও চাকার আবিষ্কারের সাথে সাথে নিত্যনতুন যন্ত্রের সাহায্যে ছোট ছোট ঘর গড়ে তুলে একটি ছোট জায়গার বন সাফ করে। এসময়ে মানুষ কিছু লম্বা, সরু রকমের গাছ, যেমন- খেজুর বা সুপারি এসব গাছের মাথা বাঁকিয়ে একসাথে করে বেঁধে এর উপর ঝোপ-ঝাড় দিয়ে মানুষ তৈরি করে প্রথম বাসা।

এরকম দলভুক্ত বাসাগুলোতে বাসকারী সদস্যরা তাদের সুরক্ষার জন্য বাসার চারিদিকে বেড়া দিত। এর মধ্যে গবাদি পশু আর তারা নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারত। কিছু কিছু স্থানে বড় গাছ পাওয়া না গেলে মাটি, পাথর কিংবা শিকারকৃত পশুর হাড় দিয়ে বাসা বানাতো।

সভ্যতার উত্থান

সমাজ ব্যবস্থার অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ প্রকৃতির উপর নিজের আধিপত্য স্থাপন করতে শুরু করে। বিভিন্ন বড় বড় নদ-নদীর অববাহিকায় মানুষ গড়ে তোলে বড় বড় সভ্যতা। নীলনদের অববাহিকায় প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা, টাইবার নদীর পাশে রোমান সভ্যতা, তাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর অববাহিকায় সুমেরীয় বা আক্কাডিয়ান সভ্যতা, আমাজন বেসিনের অববাহিকায় ইনকা সভ্যতা কিংবা মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা সভ্যতার বিস্তার এই কথাটার ইঙ্গিত দেয়।

এসব অববাহিকা থেকে পাওয়া মাটি দিয়ে বানানো ইট হয়ে উঠে ঘর বানানোর প্রধান উপকরণ। বড় বড় স্থাপনা বানাতে পাথরের ব্যবহারও লক্ষ্যণীয়। পোড়ামাটি বা পোড়া ইটের বাসার সাথে অঞ্চল ভেদে ছাদে নলখাগড়া, তালপাতা, প্যাপিরাস পাতা কিংবা কাঠের ব্যবহার হতো। সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে এদের ব্যবহার ও তৈরিতে এসেছে নতুনত্ব।

মধ্যযুগ

মধ্যযুগে ইউরোপে ধর্মপ্রচার, নতুন দেশ আবিষ্কারের জন্য মানুষ নৌপথে বিভিন্ন স্থানে যেতে শুরু করে। মানুষের মধ্যে শ্রেণিবিভেদ আরো প্রকট হয়ে উঠে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং কৃষক শ্রেণির ঘর তৈরির পদ্ধতিতে আসে ভিন্নতা, মূলত অর্থনৈতিক কারণে।

শিল্প বিপ্লবের আগপর্যন্ত হাতে বানানো হতো গৃহ নির্মাণ সামগ্রী, যা শুধু ধনীরাই কিনে ব্যবহার করতে পারত। এজন্য কাঠ, খড় কিংবা পাটখড়ির ব্যবহার শুরু হয় বাড়ি তৈরিতে। বহিশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে বড় বড় দুর্গ বানানো হতো পাথর, চুন, কাদামাটি, খড় এবং কাঠ দিয়ে। পরবর্তীতে লোহার ব্যবহার শুরু হয় অল্প পরিসরে।

শিল্পযুগ

শিল্পযুগের শুরুতে কলকারখানার কার্যক্রম ও বিভিন্ন যন্ত্রের আবিষ্কার মানুষের সভ্যতার অগ্রগতির চাকাকে করে তোলে বেগবান। কম সময়ে দ্রুততার সাথে নিখুঁতভাবে নির্মাণসামগ্রী বানানো শুরু হয়।

লোহা ও কলে পোড়ানো ইটের ব্যবহার মানুষের গৃহের স্থাপত্যকলার আমূল পরিবর্তন আনতে শুরু করে। মানুষের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য এনে দেয় শিল্প বিপ্লব। রেল ও সড়ক যোগাযোগের উন্নতি হওয়ায় মানুষের কাছে দ্রুততার সাথে পণ্য পৌঁছানো সম্ভবপর হয়ে উঠে।

বর্তমান যুগ

শিল্প, বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমাগত উন্নতির সাথে সাথে মানুষ সহজে গৃহনির্মাণ সামগ্রী তৈরির জন্য গবেষণা শুরু করে। কংক্রিট হলো এর ফসল। আরসিসি স্ট্রাকচারে কনক্রিট ও লোহার মেলবন্ধনের ফলে মানুষ আজ বানাতে পারছে আকাশচুম্বী অট্টালিকা, বড় বড় ব্রিজ।

ইটের ব্যবহার হয়েছে আরো বহু বিস্তৃত। কাঁচ দিয়ে হচ্ছে জানালা, যা বড় বড় দালানকে দিচ্ছে নান্দনিক ও আকর্ষণীয় রূপ। মানুষ নিজের স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বসতি গড়ার স্বপ্ন দেখছে আজ চাঁদে কিংবা মঙ্গলে। আজকে মানুষের বাসার কোনো স্বপ্নই অলীক নয়। যা ভাবতে পারা যায়, তার প্রায় সবটাই বাস্তবে করা সম্ভবপর এখন।

এভাবেই কালের বিবর্তনে মানুষ নিজের বাসাকে আজকের স্বপ্নাতীত, কল্পনাতীত স্থানে চিন্তা করতে পেরেছে। এর পুরোটাই সম্ভব হয়েছে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং মানুষের স্বপ্ন দেখার সাহসের জন্য।

আপনার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে, একটি সুন্দর বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য স্থপতি এবং প্রকৌশলীরা কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। এভাবেই নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাসা বানানোর সাথে সাথে বিবর্তিত হচ্ছে মানুষের বাসস্থানের চাহিদা ও পূরণ হচ্ছে সভ্যতার আধুনিকতম সব স্বপ্ন।