নিজেই নিজের বাড়ি: তৈরি হোক পছন্দমতো

দৃশ্যপট ১

আজমল সাহেব একজন চিকিৎসক। সারাজীবন সরকারি হাসপাতালে সেবাদানের পর যখন অবসরে যান, পেনশন হিসেবে টাকাগুলোকে এক করে ঢাকার বুকে কিনে ফেলেন ৫ কাঠার এক টুকরো জমি। অনেকদিনের ইচ্ছে, নিজের জন্য নিজের মতো করে তৈরি করবেন একটি বাড়ি। বিকেল বেলা এক চিলতে রোদে ভরে থাকবে সে বাড়ির ছোট বারান্দা।

কিন্তু আশেপাশের মানুষের সাথে কথা বলতে গিয়ে নির্মাণ কাজ নিয়ে বেশ ভয় পেয়ে যান তিনি। ভবনের নকশা, একাধিক অনুমোদন, নির্মাণ সামগ্রীর বাজার সম্পর্কে সচেতন ধারণা রাখা থেকে হাজারটা চিন্তা এসে ভর করে নির্মাণ নিয়ে ভাবতে গেলেই। জমির ভবিষ্যৎ আর বাড়ির স্বপ্নের মাঝে বিশাল এক অনিশ্চয়তায় ভোগেন আজমল সাহেব।


দৃশ্যপট ২

প্রান্তিক ঢাকায় এক টুকরো জমি নিয়ে অনেকদিন ধরেই প্রায় একই ধরনের সমস্যায় ভুগছেন রফিকুল হক। আশেপাশের সবাই তৃতীয় পক্ষের সাহায্যে বাড়ি তুলে কয়েকটি ফ্ল্যাট নিয়ে বসবাস করছেন। কিন্তু রফিকুল হকের জন্য এই এক টুকরো জমি তার সারা জীবনের সঞ্চয়ের ফসল। এখানে বাণিজ্যিক চিন্তাধারায় ভবন তৈরি হলে সেটি যে তার ইচ্ছা বা পছন্দকে পরিপূর্ণ করবে না, সে ব্যাপারে তিনি প্রায় নিশ্চিত। তিনি নিজের চাহিদামতো ভবন চান নিজের জমিতে। নকশার আলোচনার অংশ হতে চান। নিশ্চিত করতে চান নিজের ও নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুযোগ সুবিধা। 

নিজের টাকায় এক টুকরো নিষ্কণ্টক জমি আর তার উপর নিজের মনমতো আরামদায়ক বাসস্থান- এ যেন এই দেশের প্রায় সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন। এই স্বপ্নের জ্বালানী যোগান দিতে সারা জীবন কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন এ দেশের অনেক অনেক মানুষ।

নিজের জমি থাকা সত্ত্বেও আজমল আর রফিক সাহেবের মতো নানারকম অনিশ্চয়তার দোলাচলে সেই জমিতে বাড়ির স্বপ্ন অধরা থেকে যাচ্ছে। কেউ কেউ তৃতীয় পক্ষের শরণাপন্ন হয়ে নিজের জমিতে বাড়ি পাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু তাতে থাকছে না নিজের চিন্তা ও চাওয়া-পাওয়ার স্বাতন্ত্র্যের ছাপ। নিজের জমিতে নিজেই বাড়ি করার ব্যাপারে অনেকেই দ্বিধায় ভোগেন কিছু নির্দিষ্ট কারণে। আধুনিক সময়ের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী নির্মাণ ও স্থাপত্য মানের বিবেচনায় এখনো নিজের বাড়ি নিজে তৈরি করাই কিন্তু সবচেয়ে প্রচলিত ও লাভজনক প্রক্রিয়া। নির্মাণের নানা ধাপে এর সুফল পেতে পারেন একজন জমির মালিক।

১. নকশা

জমির উপরে বাড়ির নকশার জন্য একজন প্রশিক্ষিত স্থপতির দারস্থ হওয়াটা খুবই দরকারি। অনেকে মনে করেন, স্থপতির শরণাপন্ন হওয়া মানেই নির্মাণে শুধুমাত্র অলংকরণ যোগ করা ও অতিরিক্ত খরচ। অথচ একটি বাড়িতে বসবাসরত মানুষের জীবনযাপনের মান থেকে শুরু করে পর্যাপ্ত জায়গা, আলো-বাতাসের পর্যাপ্ততা এবং জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারেন শুধুমাত্র একজন স্থপতি। এর জন্য আপনাকে খরচ করতে হবে আপনার পূর্ণাঙ্গ নির্মাণ বাজেটের মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ অর্থ।

কোনোরকম তৃতীয় পক্ষের সহায়তা ছাড়াই আপনি পেশাদার স্থপতির সাহায্য নিতে পারেন খুবই সহজে। আপনি নিজে যদি আপনার বাড়ির নির্মাণে নিযুক্ত স্থপতির সাথে কথা বলেন এবং তাকে আপনার নিজের বাড়ির খুঁটিনাটি চাহিদা সম্পর্কে জ্ঞাত করেন, তাহলে তিনি প্রতিটি সূক্ষ বিষয় নকশায় প্রতিফলিত করতে চেষ্টা করবেন এবং নির্মাণ শুরু হবার অনেক আগেই আপনি পাবেন বাড়ির প্রতিটি বিষয় নিয়ে তার কাছ থেকে সবকিছু জেনে নেবার স্বাধীনতা।

পেশাদার স্থপতি সরকারের সব নিয়মনীতি সম্পর্কে সচেতন এবং নকশা করা বাড়ির ডিজাইন সংরক্ষণের নিশ্চয়তাও তিনি প্রদান করবেন। এছাড়া সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের কাছে স্ট্রাকচার ও প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধা (বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির লাইনের নকশা) সম্পর্কেও আপনি জ্ঞাত থাকতে পারবেন, যা পরবর্তীতে আপনার বাড়িকে করে তুলবে পূর্ণাঙ্গভাবে আপনার নিজের।

২. অনুমোদন

রাজউকে বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নকশা অনুমোদন সহজ করতে সরকার ডিজিটাল পদ্ধতিতে আবেদন ও নকশা অনুমোদনের ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করেছে। খুব দ্রুতই সকল অনুমোদন নেবার প্রক্রিয়া হবে অনিয়ম ও ঝামেলামুক্ত। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে স্থপতির কাছ থেকে প্রাপ্ত নকশা অনুমোদনের জন্য পাঠানো যাবে এবং মোবাইল ফোনে পাবেন নিয়মিত আপডেট। নিজের বাড়ি নিজে করার ক্ষেত্রে অনুমোদন কখনোই কোনো বাধা নয় যদি আপনি সরকারি নিয়মনীতি মেনে বাড়ি তৈরি করেন। 

৩. নির্মাণ সামগ্রী, খরচ সময়

বাড়ির নির্মাণ সামগ্রীর দাম ওঠা-নামা করে প্রায় প্রতিবছরই। একারণে বাড়ি নির্মাণে ব্যয়ের পরিমাণও নির্দিষ্ট রাখা খুবই কঠিন হয়ে যায়। দক্ষ ঠিকাদার নির্বাচন করা এক্ষেত্রে একজন বাড়ির মালিকের জন্য হতে পারে সর্বোত্তম সমাধান। নিজে নির্মাণ কাজ পরিচালনার সাথে যুক্ত থাকলে এ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা থাকে এবং ব্যয়, সময় ও সামগ্রীর মানের ব্যাপারে একজন জমির মালিক নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারেন।

এছাড়া নির্মাণের সময় সম্পর্কে ধারণা একদম পরিষ্কার থাকায় বাজেট ম্যানেজমেন্টও তুলনামূলক সহজ ও সাশ্রয়ী হয়। তৃতীয় পক্ষ অনেক ক্ষেত্রেই এই ধরনের সমস্যা মোকাবেলায় দিনের পর দিন নির্মাণ কাজ বন্ধ করে রাখেন। এতে নির্মাণ সামগ্রীর যেমন অপচয় হয় তেমনি ভবনের মান ক্ষতিগ্রস্থ হয় বিভিন্নভাবে।

৪. স্বকীয়তা

প্রতিটি মানুষ যখন জমি ক্রয় করেন, নিজের মনে নিজের বাসার একটি ছবি থাকে। বাড়ি বা বাসা মানে শুধু এক টুকরো মাথা গোঁজার ঠাঁই নয়। নিজের বাসা বা বাড়ি মানে একটি পরিবারের এক চিলতে স্বপ্নও। হয়তো আপনি আপনার রান্নাঘরটি চান একটু বড়, হয়তো আপনার চাই প্রতিটি ঘরের সাথে লাগোয়া এক টুকরো বারান্দা অথবা আপনি চান আপনার পরিবারের সব সদস্যই যেন নিজের পছন্দমতো একটি ঘর বরাদ্দ যেন পায় বাড়িতে।

এসব চাহিদা মানুষের মানবিক বোধ থেকে তৈরি এবং প্রতিটি মানুষের জন্য আলাদা, প্রতিটি পরিবারের জন্য আলাদা। যদি সর্বসাধারণের মাঝে বিক্রয়ের জন্য বাড়ির নকশা করা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই এই স্বকীয় চিন্তাধারা চলে যেতে পারে আড়ালে। আপনার বাড়ি হয়ে যেতে পারে আর দশটি বাড়ির মতোই ইট-কাঠের বাক্স। তাই ব্যবসায়িক চিন্তাধারার বাইরে থেকে বাড়ি তৈরি করতে চাই নিজের শক্ত উপস্থিতি। শুধুমাত্র নিজের বাড়ি নিজে তৈরি করতে সাহস করলেই এই স্বকীয় চিন্তাধারা বেঁচে থাকতে পারে প্রতিটি বাড়ির নির্মাণ প্রক্রিয়ায়।

৫. অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

২০২০ সালে এসে রিয়েল এস্টেট বা আবাসন হয়ে উঠেছে সর্বোচ্চ মানের অর্থনৈতিক বিনিয়োগের ক্ষেত্র। ব্যাংকের লভ্যাংশের চেয়ে অনেক দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে জমির দাম, ফ্ল্যাটের দাম। নিজের জমিতে নিজের বিনিয়োগ এই লাভের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে প্রচুর পরিমাণে। বলা বাহুল্য, তৃতীয় পক্ষের নির্মাণ কাজে সংশ্লিষ্টতার কারণে এসব ক্ষেত্রে জমির মালিকের জন্য লভ্যাংশ যোগ হচ্ছে না তেমন কিছুই। নিজের বাড়ি নিজে তৈরি করা তাই অনেক দিক থেকে ঝামেলার মনে হলেও মান নিয়ন্ত্রণ ও গুণগত দিক ঠিক রাখতে পারলে ভবিষ্যতের জন্য এটি হতে পারে একটি দুর্দান্ত বিনিয়োগ।

. ভবিষ্যতের পথে

ঢাকা শহরে এক টুকরো জমি বা একটি বাড়ি শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, সামাজিকভাবেও একটি দূরদর্শী বিনিয়োগ। নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা, তাদের সামাজিক বিবর্তন বা নাগরিক সুযোগ-সুবিধা একটি কমার্শিয়াল চিন্তাধারার বাড়িতে বাধাগ্রস্থ হবে, এটি খুবই স্বাভাবিক। এ সম্পর্কে তাই চাই মানবিক চিন্তাধারা, পারিবারিক বন্ধনকে ভবনের নকশায় স্থান দেওয়া।

বাড়ির সাথে আত্মিক বন্ধন তৈরিও তাই ভবিষ্যতের পথে একটি পরিবারকে এগিয়ে দিতে পারে অনেকদূর। নিজের বাড়ি নিজে তৈরি করার মাধ্যমে একটি পরিবার একসাথে থাকার ও একভাবে সামনে এগিয়ে যাবার যে প্লাটফর্ম তৈরি হয়, তা শর্তসাপেক্ষে কয়েকটি ফ্ল্যাটের বিনিময়ে তৈরি করে দেওয়া বাড়িতে পাওয়া কি আদৌ সম্ভব?

এসব কারণেই নিজের বাড়ি নিজে তৈরি করতে আগ্রহী হতে সেরা সময়টা আসলে এখনই। তবে এজন্য চাই প্রশিক্ষিত স্থপতি ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, যারা আপনার চাহিদা বুঝবেন ও কমার্শিয়াল ধ্যান-ধারণার বাইরে এসে আপনাকে সাহায্য করবেন। আর চাই নিষ্ঠাবান ঠিকাদার। আর এসবের জন্য প্রয়োজন একটি বিশ্বমানের কনসাল্টেশন সার্ভিসও।

এই কয়টি জিনিস নিশ্চিত করতে পারলেই আপনার স্বপ্নের বাড়ি ইট-কাঠের খাঁচা ভেঙে হয়ে উঠবে চিরায়ত সেই বাসস্থান, যার মায়ায় যুগের পর যুগ আপনার মন পড়ে থাকবে এই ভৌগোলিক পরিসীমাতে। তখন বাড়ি শুধু একটি স্থাপনা নয়, হবে আপনার আবেগ, অনুভূতি আর পরিবারের সুখ-দুঃখের সূতিকাগার।