কংক্রিট ফিনিশিংয়ের রকমফের

প্রাচীনকালে বসতবাড়িসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হতো মাটি, চুন, সুড়কি, পাথর ও অন্যান্য উপাদান দিয়ে। ইতিহাসবিদদের বক্তব্য অনুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে রোমানরা প্রথম অবকাঠামো নির্মাণে বিভিন্ন বস্তুর মিশ্রণে একধরনের মিশ্রণ ব্যবহার শুরু করে। বালু, চুন, সুড়কির সাথে পরিমাণমতো পানি দিয়ে তৈরি এই মিশ্রণ কংক্রিট হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অবকাঠামো নির্মাণে। আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যেই রোমানদের মাঝে কংক্রিট অবকাঠামো নির্মাণের প্রধান উপাদান হিসেবে প্রচলিত হয় এবং কালের পরিক্রমায় কংক্রিটের মিশ্রণে চুনকে প্রতিস্থাপন করে সিমেন্ট।

কংক্রিটের ব্যবহার যেমন সহজ, তেমনই নিরাপদ ও বহুমাত্রিক। অবকাঠামোতে যেকোনো প্রকার ডিজাইন প্রয়োগেই কংক্রিট ব্যবহার করা যায়। কংক্রিটের ফিনিশিংয়ের রকমভেদের উপর অনেকাংশেই নির্ভর করে সৃজনশীল নির্মাণশৈলির নান্দনিকতা।

. ট্রোয়েল ফিনিশ

রাজমিস্ত্রী একপ্রকার হাতলযুক্ত মসৃণ স্টিলের গঠন নিয়ে কংক্রিটের ঢালাইয়ের উপর বারবার নাড়াচাড়া করে যাচ্ছেন- এই দৃশ্য আমাদের সকলের নিকটই সুপরিচিত। এরূপ ফিনিশিংকেই মূলত ট্রোয়েল ফিনিশিং বলা হয়। এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বহুল প্রচলিত ফিনিশিং। মূলত কংক্রিটের ঢালাইয়ের কাজ হয়ে গেলে পৃষ্ঠতল মসৃণ ও সমতল করে দেয়াই ট্রোয়েল ফিনিশ। রাজমিস্ত্রীদের হাতে সচরাচর দেখা ম্যানুয়াল ট্রোয়েলের পাশাপাশি আজকাল যান্ত্রিক ট্রোয়েলের ব্যবহারও বেড়েছে।

২. ব্রুম ফিনিশ

এ ধরনের কংক্রিট ফিনিশে কংক্রিটের পৃষ্ঠতল মসৃণ রাখা হয় না। অবশ্য অনেকে একে ট্রোয়েলড-ব্রুমও বলে থাকে এজন্য যে ট্রোয়েল দিয়ে প্রথমে কংক্রিট মসৃণ করে সমতল করার পরই এর উপর ব্রুম বা ঝাঁটা দিয়ে টেনে টেনে একে অমসৃণ করা হয়। ব্রুম ফিনিশিংয়ে সময়ের ব্যাপারে বিশেষ সাবাধান হতে হয়। ট্রোয়েলের কাজ শেষ হবার সাথে সাথেই ব্রুমের কাজ শুরু করে দিতে হয়, অন্যথায় সিমেন্ট শুকিয়ে গেলে তা করা সম্ভব হয় না। এ ধরনের ফিনিশিং প্রধানত পৃষ্ঠতল যেন পিচ্ছিল না হয়ে যায় সে উদ্দেশ্যে করা হয়।

. স্ট্যাম্পড ফিনিশ

নাম থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া সম্ভব, কেননা স্ট্যাম্পড কংক্রিট ফিনিশিংয়ে আক্ষরিক অর্থেই কংক্রিটের উপর স্ট্যাম্পিং করা হয়। কংক্রিটের ঢালাই যথাযথভাবে ট্রোয়েল দিয়ে মসৃণ করার পর কংক্রিট নরম থাকতেই তার উপর কোনো নমুনা বস্তু দিয়ে চেপে সেটির আকৃতি ফুটিয়ে তোলার নাম স্ট্যাম্পড ফিনিশ। এটি মূলত সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্দেশ্যেই করা হয়ে থাকে। স্ট্যাম্পড করার পর কংক্রিটের মেঝে দেখতে পাথর, স্লেট, ইট কিংবা যথাযথ উপায়ে করতে পারলে কাঠের মতোও হয়। বাসাবাড়িতে সাইডওয়াক কিংবা রাস্তায় ফুটপাতে, গাড়ির গ্যারেজে এ ধরনের ফিনিশিং দেয়া হয়।

. সল্ট ফিনিশ

সদ্য ঢালাই করা কংক্রিটের উপর এবড়োথেবড়ো ক্রিস্টাল আকৃতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথড়ের টুকরো ফেলে তা রোলার দিয়ে চেপে মসৃণ করে দেয়ার প্রক্রিয়াকে সল্ট ফিনিশিং বলে। কংক্রিট শক্ত হবার পর মেঝেটি ভালো করে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললেই সল্ট ফিনিশিংয়ের সৌন্দর্য বোঝা যায়। অবশ্য সৌন্দর্য এখানে গৌন ব্যাপার। মুখ্য হলো মেঝে পিচ্ছিলরোধী করা। সাধারণ সুইমিংপুলে এ ধরনের ফিনিশিং ব্যবহার করা হয় যার উপর সহজে শ্যাওলা পড়ে না কিংবা পিচ্ছিল হয়ে যায় না।

৫. এক্সপোজড এগ্রিগেট ফিনিশ

এটাও বহুল প্রচলিত পদ্ধতি। মূলত ট্রোয়েলড ফিনিশের উপর অতিরিক্ত একস্তরের কংক্রিট বা সিমেন্ট যোগ করাই এক্সপোজড এগ্রিগেট ফিনিশ। প্রথমে ট্রোয়েল দিয়ে কংক্রিটের ঢালাই মসৃণ করা হয়। এরপর তা থেকে কয়েক মিলিমিটারের মতো চিকন একটি আবরণ পাওয়ার ফ্ল্যাটার বা ডায়মন্ড পলিশার দিয়ে উঠিয়ে নেয়া হয়। এই আবরণ উঠিয়ে নিলে ভেতরের কংক্রিটের পৃষ্ঠতল আরো মসৃণ হয়। এরপর তার উপর সিমেন্টের মিশ্রণের একটি অতিরিক্ত লেয়ার যোগ করা হয় যা একে অত্যন্ত মসৃণ এবং তকতকে করে তোলে।

. সোয়ার্ল ফিনিশ

কংক্রিটের ফিনিশের নানা রকমভেদের মাঝে এটি সবচেয়ে সৃজনশীলগুলোর একটি। প্রথম কংক্রিটের আবরণ সমতল করার পর তার উপর জ্যামিতিক মাপ ঠিক রেখে অভিন্ন পরিমাণ এবং আকার বজায় রেখে কংক্রিট মিশিয়ে দেয়া হয়। ফলে মেঝের উপর নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে কংক্রিটের বৃত্তাকার গঠন তৈরি হয় যা মেঝের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। একইসাথে হাঁটাচলার জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক হয়, কেননা এতে পিছলে পড়ার সম্ভাবনা থাকে না বললেই চলে।

অবশ্য এটি ঘরের বাইরের মেঝেতেই সাধারণত ব্যবহার করা হয়। যেসব স্থানে অধিক হাঁটাচলা হয় এবং মানুষের পায়ের ঘর্ষণে মেঝে খুব দ্রুতই ক্ষয় হয়ে কিছুটা পিচ্ছিল হয়ে যায়, সেসব স্থানে এই প্রক্রিয়ায় কংক্রিটের ফিনিশিং দেয়া হয়। সোয়ার্ল ফিনিশিংয়ের ব্যবহার খুব একটা দেখা যায় না, কারণ এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা বেশ কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়বহুল।

. পলিশড ফিনিশ

পলিশড ফিনিশ মূলত এরূপ যে মেঝে টাইলসের মতো মসৃণ ও আরামদায়ক হবে এবং তা এতটাই চকচকে হবে যে তাতে বিভিন্ন বস্তুর প্রতিফলন দেখা যাবে। সাধারণ বড় হলঘরে, প্রদর্শনীর মেঝেতে এ ধরনের ফিনিশ ব্যবহার করা হয়। পলিশড ফিনিশ যান্ত্রিকভাবেই করা হয়।

. কালারড ফিনিশ

কালারড বা রঙিন ফিনিশ মূলত মেঝেকে রঙিন করার জন্যই করা হয়। মেঝেকে রঙিন করতে দুটি উপায় ব্যবহার করে থাকেন রাজমিস্ত্রীরা। পিগমেন্ট বা একপ্রকার বিশেষ রঞ্জক পদার্থ প্রথমেই কংক্রিটের সাথে মিশিয়ে নেয়া হয় এবং তা ফিনিশিং করলে রঙ ফুটে ওঠে। অথবা কংক্রিট ফিনিশিং সম্পন্ন করে তা শুকিয়ে যাবার পূর্বেই তার উপর পছন্দমতো রঙের স্ট্রেইন প্রয়োগ করা হয়। উল্লেখকৃত কংক্রিট ফিনিশিংগুলো হলো সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ও ব্যবহৃত কংক্রিটের ফিনিশিং। এগুলো ছাড়াও ডাইড, মার্বেলড, ফ্ল্যাশড, মাইক্রো টপিং, স্যান্ড ব্লাস্টারসহ নানা প্রকারের কংক্রিট ফিনিশিং রয়েছে।

আধুনিক অন্দরসজ্জায় কাঠের মেঝে

কাঠের মেঝে যুগ যুগ ধরে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

Continue reading

মেঝের একাল সেকাল

ঘরের মাঝে আমাদের সবচেয়ে কাছাকাছি সংস্পর্শে থাকে মেঝে, সারাক্ষণ মেঝের ওপর দিয়েই চলাচল হয় সবার। তাই ফ্লোর ফিনিশিংয়ের বিষয়টি বাড়ি নির্মাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

Continue reading

ঢালাইয়ের পর কিউরিং করার সঠিক উপায়

বাড়িঘর নির্মাণের সময় আমাদের নানান অসুবিধা এবং প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এই সকল বিষয়ে তাই আগে থেকে ধারণা থাকলে স্বপ্নের আবাসস্থল হবে নিরাপদ এবং দীর্ঘস্থায়ী। আমাদের উপমহাদেশে বাড়ির ছাদ ঢালাই করা উৎসবের উপলক্ষ্য হিসেবে পরিগণিত হয়। আর এ বাড়ি ঢালাইয়ের পর যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে কিউরিং।  

কিউরিং কী? 

কংক্রিট স্থাপন ও কম্পেকশন (জমে শক্ত হয়ে যাওয়া) করার পর কিছু দিন অবিরামভাবে কংক্রিটকে আর্দ্র রাখার পদ্ধতিকে কিউরিং বলে। 

কিউরিংয়ের পদ্ধতি

কিউরিংয়ের জন্য নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করা হয়:

১. পানি ছিটিয়ে (Sprinkling of Water)

২. মাটি দ্বারা ঘের তৈরি করে (Ponding)

৩. ছায়াময় করে (Shading)

৪. পৃষ্ঠদেশ আচ্ছাদিত করে (Covering the Surface) 

সময়কাল

কংক্রিটের মান এবং ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে ২৪ ঘণ্টা থেকে শুরু করে ২১-২৮ দিন অবধি কিউরিং করা হয়ে থাকে। সাধারণভাবে কংক্রিট জমাট বেঁধে চূড়ান্ত শক্ত অবস্থায় আসলে অর্থাৎ ৮-১০ ঘণ্টা পর কিউরিং প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়। তবে আবহাওয়া এবং পরিস্থিতি বিবেচনা করে কিউরিংয়ের যথাযথ কার্যকারিতার জন্য কংক্রিট ফিনিশিংয়ের পরপরই কিউরিংয়ের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে।

সেক্ষেত্রে ছাদ বা ফ্লোর ঢালাইয়ের পর প্রখর রোদ বা বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষার জন্য ফিনিশিংয়ের পরপরই প্লাস্টিক কাভার দিয়ে ঢালাই স্থান ঢেকে রাখতে হবে। এ সময় কংক্রিটের উপরিভাগে শতভাগ প্লাস্টিক কভার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্লাস্টিক যেন সরে না যায় এজন্য কাঠের ব্লক অথবা ইটের সাহায্যে আটকে রাখতে হবে। শুষ্ক অবস্থা পর্যবেক্ষণে কভার সরিয়ে পানি স্প্রে করে আবার প্লাস্টিক বিছিয়ে দিতে হবে। 

কিউরিং করার সময়সূচি

কিউরিং করার সময়সূচি বেশ কয়েকটি জিনিসের ওপর নির্ভর করে। এগুলো হলো:

১. মিশ্রণের অনুপাত

২. কংক্রিটের স্ট্রেংথ

৩. কনক্রিটের আকার ও আকৃতি

৪. আবহাওয়া ও পরিবেশ

৫. ভবিষ্যতে ব্যবহারের প্রকৃতি

সাধারণভাবে, আমাদের দেশে কিউরিং করার সময় নিম্নোক্ত হিসাব অনুসরণ করা হয়ে থাকে।

কাজের বিবরণকিউরিং শুরু করার সময়যতদিন কিউরিং করতে হবে
মাস কংক্রিটের কাজে (১:৩:৬)   (ফাউন্ডেশন)২০ ঘণ্টা পর৭ দিন পর্যন্ত
ইটের গাঁথুনির কাজ (সকল)২০ ঘণ্টা পর৭ দিন পর্যন্ত
ড্যাম্পপ্রুফ কোর্স সিমেন্ট কংক্রিট কাজে (১:২:৪)২০ ঘণ্টা পর৭ দিন পর্যন্ত
লিনটেল, সানশেডের কাজে২০ ঘণ্টা পর৭ দিন পর্যন্ত
ছাদ ঢালাইয়ের কাজে২০ ঘণ্টা পর২১ দিন পর্যন্ত
ফ্লোর ঢালাই সিমেন্ট কংক্রিটের কাজে   (১:৩:৬)২০ ঘণ্টা পর৭ দিন পর্যন্ত
১ ইঞ্চি পেটেন্ট স্টোন সিমেন্ট কংক্রিটের (১:২:৪) কাজে১৫ ঘণ্টা পর৭ দিন পর্যন্ত

নির্মাণ কাজের সেন্টারিং বা সাটারিং খোলার সময়সূচি:

কাজের বিবরণসেন্টারিং (সাটারিং) খোলার সময়
কলাম ও বীমের পার্শ্বদিক৩  দিন পর
বীমের তলা২১  দিন পর
ছাদের স্ল্যাবের তলা (১৫‘ স্প্যান পর্যন্ত)১৫  দিন পর
ছাদের স্ল্যাবের তলা  (১৫‘ স্প্যানের  চেয়ে  বড় পর্যন্ত)২১  দিন পর

  মোজাইক এবং জলছাদের মিশ্রণ পদ্ধতির ছক:

কাজের বিবরণমিশ্রণ সামগ্রীমিশ্রণ  অনুপাত
গ্রে-মোজাইক (০.৫ ইঞ্চি পুরু)সিমেন্ট : মার্বেল১ : ১
জলছাদ (৪ ইঞ্চি পুরু) কাজেচুন : সুরকী : খোয়া২ : ২ : ৭

কংক্রিট মিশ্রণ পদ্ধতির ছক (নমুনা)

কাজের বিবরণকাজের বিবরণ        মিশ্রণ  অনুপাত
মাস-কংক্রিট (ফাউন্ডেশনের তলায়)সিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ৩ : ৬)
ড্যাম্প-প্রুফ কোর্স (D.P.C)সিমেন্ট : বালি :খোয়া(১ : ১.৫ : ৩)
বাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোর (কংক্রিট)সিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ৩ : ৬)
১” থেকে ১.৫” পুরু (পেটেন্ট স্টোন)সিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ২ : ৪)
১” পুরু মোজাইক বেস (তলা)সিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ২ : ৪)
আর.সি.সি. (কংক্রিট) [২৬০০ পি.এস.আই]সিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ২ : ৪)
আর.সি.সি. (কংক্রিট) [২৯০০ পি.এস.আই]সিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ১.৫: ৩)
দরজা-জানালা ফ্রেম দেওয়ালে আটকানোর মশলাসিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ২ : ৪)
গ্রীলের ফ্রেম আটকানো মশলাসিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ২ : ৪)
স্যানিটারি পাইপ কংক্রিটসিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ৩ : ৬)
ড্রেন-পিটের কংক্রিট বেস (তলা)সিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ৩ : ৬)
সেপটিক ট্যাংকের কংক্রিটসিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ২ : ৪)
সেপটিক ট্যাংকের ছাদসিমেন্ট : বালি : খোয়া(১ : ২ : ৪)

(তথ্যসূত্র: বাড়ি নির্মাণ গাইড, লেখক: পুরকৌশলী মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী) 

সাধারণভাবে ছাদ বা ফ্লোর কিউরিং এর ক্ষেত্রে ঢালাইয়ের ১০ ঘণ্টা পর পুরো কাস্টিং এরিয়াতে বাঁধ দিয়ে পানি ধরে কিউরিং করা হয়ে থাকে। কলাম এবং বীমের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকরী কিউরিং পেতে ফর্ম ওয়ার্ক বা সাটার ধরে রাখতে হবে। কলামের ক্ষেত্রে সাটারিং উঠিয়ে ফেলার পরেও ভেজা চট দিয়ে জড়িয়ে রাখলে ভালো ফল পাওয়া যায়। কাঠের সাটারিং ব্যবহারের পূর্বে তা পানি দিয়ে ভিজিয়ে নেয়া উচিৎ। খেয়াল রাখতে হবে প্রতিটি ঢালাইয়ের স্থান নিয়মিত পর্যবেক্ষণে দিনে ৫ থেকে ৭ বার কিউরিং করতে হবে।  

নিয়মমাফিক কিউরিং না করা হলে ঢালাইয়ের গুণগত মান কমে আসে, ফলে সম্পূর্ণ কাঠামো দুর্বল হয়ে যায়। এছাড়া ক্ষয় আর আর্দ্রতাজনিত কারণে ক্ষতির সম্ভাবনা বহুগুণে বেড়ে যায়। তাই মনে রাখতে হবে, ভালো মানের কংক্রিট পেতে ঢালাইয়ের পর কিউরিং যথাযথ হওয়া অত্যাবশ্যকীয়। 

বাড়ির কাঠামো নিয়ে যা না জানলেই নয়

নিজের বাড়ি করার অনুপ্রেরণা নিয়ে প্রতিদিন নিরন্তর কাজ করে চলে পেশা-বয়স নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু প্রাথমিক জ্ঞানের অভাবে সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে স্বপ্নের বাড়ি করতে গিয়ে হোঁচট খান অনেকেই। বহুতল ইটের দালানই হোক বা পাকা মেঝের টিনশেড হোক, কিংবা ভবিষ্যতের কথা ভেবে ফাউন্ডেশন দিয়ে রাখা একটি ছোট বাড়িই হোক, কাঠামো সবসময়ই সেই বাড়ির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাড়ির ব্যবহার আর স্থায়িত্বের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হলো এর কাঠামো।

বাড়ির কাজে হাত দেওয়ার আগে তাই কাঠামো নিয়ে কিছু প্রাথমিক জ্ঞান সবারই থাকা প্রয়োজন। এতে যেমন বাড়ি নির্মাণে গুণগত মান বজায় রাখার ব্যাপারে সুবিধা হয়, সেই সাথে ভবিষ্যতে বাড়ির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝক্কি-ঝামেলাও কম পোহাতে হয়।  

কাঠামোর প্রকারভেদ 

একটি বাড়ির নির্মাণকালীন কাজগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।

১. স্ট্রাকচারাল (ফাউন্ডেশন, ফ্রেম, রুফ)

২. ফাংশনাল (জানালা/দরজা, প্লাম্বিং, ইলেকট্রিক্যাল, HVAC)

৩. ফিনিশিং (সাইডিং, ড্রাইওয়াল/পেইন্ট, ইন্টেরিয়র ফিনিশ কার্পেন্ট্রি, ফ্লোর ফিনিশিং)

এগুলোর ভিতর স্ট্রাকচার এবং ফাংশনের দরজা-জানালা বাড়ির কাঠামোগত অংশ। একটি বাড়ি নির্মাণের আগে তাই এসব ব্যপারে ন্যূনতম প্রাথমিক ধারণা থাকা প্রয়োজন।

স্ট্রাকচার 

যেকোনো বাড়ির স্ট্রাকচার বা মূল কাঠামোকে মোটা দাগে তিনটি ভাগে ভাগ করে ফেলা যায়। এগুলো হলো- ফাউন্ডেশন, ফ্রেম আর রুফ।

ফাউন্ডেশন

যেকোনো বাসা-বাড়ির ভিত্তিই হলো মাটির নিচ থেকে নির্মাণ করা ফাউন্ডেশন। ভবনের অবস্থানের উপর ফাউন্ডেশনের প্রকৃতি নির্ভর করে। বাড়ি যদি এমন জায়গায় নির্মাণ করা হয়, যেখানের মাটি নরম তাহলে নির্মাণের সময় অনেক গভীরে খনন করে কংক্রিট স্ল্যাব ঢেলে ব্লক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বেজমেন্ট বানানো হয়। 

ফ্রেম

ফাউন্ডেশনের পর আসুন জেনে নেওয়া যাক ফ্রেম বিষয়ে। ফ্রেমিং করতে স্থানভেদে বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন দেশে কাঠ বা স্টিলের ফ্রেমিং জনপ্রিয় হলেও আমাদের দেশে এখনও ফ্রেমিং বলতে কলাম-বীম আর ইটের দেয়ালকেই বোঝায়। ভালো বাসস্থানের জন্য ফ্রেমিং গুরুত্বপূর্ণ। এই ফ্রেমিংয়ের মাঝেই ইনস্যুলেশন, ইলেক্ট্রিক্যাল ওয়্যারিং, প্লাম্বিংয়ের অবস্থান। আবার এই ফ্রেমিংয়েই পোকামাকড় বা ছত্রাক (মোল্ড) ঠাঁই করে নেয়।  

রুফিং

ফ্রেমিংয়ের পর আসে রুফ বা ছাদ, বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে প্রতিটি ফ্লোর স্ল্যাব বা মেঝেও বটে। ছাদের প্রধান কাজই হলো রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে বাঁচানো। ছাদ ঢালাই দেওয়া তাই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ নির্মাণের সময়ে। মাঝেমধ্যে ছাদে লিক সৃষ্টি হলে মেরামতের মাধ্যমেই তা ঠিক করে ফেলা যায়।   

ফাংশন

প্রতিদিন বাসায় বসবাস করতে আমাদের যে সুবিধাগুলো ব্যবহার করা হয়, সেগুলোই ফাংশনাল এলিমেন্ট। এই ব্যাপারগুলো এত স্বাভাবিক এবং বহুল পরিচিত যে আপাতদৃষ্টিতে এগুলো নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করা হয় না।  

দরজা-জানালা

ফাংশনাল ব্যপারগুলোর ভেতরে কেবলমাত্র দরজা-জানালাই সরাসরি বাড়ির কাঠামোর সাথে সম্পর্কিত। ভারবাহী দেয়ালে জানালা দেয়ার ক্ষেত্রে এর লোড ট্রান্সফার সম্পর্কে খেয়াল না রাখলে দেয়াল দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। বড় বড় জানালা আছে এমন বাড়িঘর আমাদের সবারই কম-বেশি পছন্দ। আলো বাতাসের চলাচলের জন্য জানালা খুবই প্রয়োজনীয়। ফ্রেমের মাঝে জানালা নির্মাণ করা হয়, তাতে ট্রিম থাকে বিভিন্নরকম যা নান্দনিক চাহিদাও মেটায়, আবার বৃষ্টি থেকেও রক্ষা করে।

জানালার ক্ষেত্রে যা লক্ষ্য রাখতে হবে তা হলো জানালার ফ্রেম বসানোর সময় কোনোরকম লিক যাতে না থাকে। লিক থাকলেই বৃষ্টির পানি ঘরে প্রবেশ করবে যা দেয়াল স্যাঁতস্যাঁতে করে ফেলে আর ফ্রেমের পচনে ভূমিকা রাখে। দরজার ক্ষেত্রেও নষ্ট হওয়ার কালপ্রিট সেই বৃষ্টির পানি। এছাড়া কাঠের দরজায় পোকামাকড় সংক্রমণের ব্যাপার তো আছেই।  

বাড়ি নির্মাণের আগে বাড়ির কাঠামোগত উপাদানগুলো নিয়ে পর্যাপ্ত ধারণা না থাকলে একদিকে যেমন বাড়ির দৃঢ়তা ঝুঁকির মুখে পড়ে, তেমনি সাইটে কাজ করা ইঞ্জিনিয়ার বা মিস্ত্রীদের সাথে যোগাযোগ অনেকাংশেই বাধাগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে, অল্প একটু সাধারণ জ্ঞানই কিন্তু পারে আমাদের স্বপ্নের বাড়িকে আরও স্বস্তিময় করে তুলতে। 

আধুনিক বাড়ি নির্মাণ: ঢালাইয়ে ভাইব্রেটরের ব্যবহার

একটি দালানের নির্মাণকাজে অনেক গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়। সময়ের সাথে সাথে নির্মাণ পদ্ধতি এবং এসব যন্ত্রপাতির ক্রমাগত উন্নতি হচ্ছে। আসছে নতুন নতুন উদ্ভাবনী কৌশল, যা নির্মাণকাজকে করছে সহজতর, দ্রুত এবং বানাতে সাহায্য করছে আরো মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী দালানকোঠা ও বসতবাড়ি।

সেরকমই একটি যন্ত্র হলো ভাইব্রেটর। মূলত দালানের কনক্রিট ঢালাইয়ের কাজে ব্যবহৃত হয় ভাইব্রেটর নামের এই গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র। আসুন জেনে নেওয়া যাক কখন, কেন ও কীভাবে ব্যবহার করতে হয় এই যন্ত্র।

ভাইব্রেটর কী ও কীভাবে কাজ করে?

কনক্রিট ঢালাইয়ের সময়ে সাধারণত ফর্মার মধ্যে মশলা (সিমেন্ট, পানি ও বালুর মিশ্রণ) ঢালা হয়। আরসিসির মধ্যে সেটা পড়ার সময় কিছু কিছু জায়গায় আটকে যায়। এর মধ্যে বাতাস জমে ফাঁকা জায়গা সৃষ্টি করে কাঠামোকে দুর্বল করে ফেলে। এজন্য কলাম, বীম কিংবা মেঝে ঢালাইয়ের সময় ভাইব্রেটর ব্যবহার করা হয়। এই যন্ত্রটির উদ্ভাবন দালানের কাঠামোগত মজবুতির জন্য অনেক সুবিধা করে দিয়েছে।

বিভিন্ন রকমের ভাইব্রেটর আছে, যেগুলো বিভিন্নভাবে নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা হয়। সাইট, ভূমি, দালানের ধরন এসবের ভিত্তিতে উপযোগিতার উপর নির্ভর করে এই যন্ত্রগুলোর ব্যবহারের নিয়মনীতি আছে, যা ঠিকমত মেনে এগুলো ব্যবহার করতে হবে।

এদের কর্মপদ্ধতিতে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও মূল কার্যপদ্ধতিতে মিল পাওয়া যায়। ভাইব্রেটর মূলত ফর্মাতে কম্পন সৃষ্টি করে মশলাগুলোকে ভালোভাবে পৌঁছাতে সাহায্য করে এবং বায়ু থাকলে তা বের করে দিতে সাহায্য করে। এতে করে পরিমাণমতো মশলা আরসিসি রডের সাথে সুদৃঢ়ভাবে বন্ধন তৈরি করে।

প্রকারভেদ ও ব্যবহার

সাধারণত কনক্রিটের মিশ্রণের উপর ভাইব্রেটরের প্রকরণ নির্ভর করে। আবার কাজের ধরনের উপরেও নির্ভর করে কীভাবে কোন ভাইব্রেটর ব্যবহার করা লাগবে। দালানের প্রকারভেদ, সাইটের মাটি ও অবস্থানের উপর নির্ভর করেও ঠিক করা হয় কোন রকমের ভাইব্রেটর ব্যবহার করা হবে সেটি। আসুন জেনে নেওয়া যাক সংক্ষেপে।

ইমারসান বা নিডল ভাইব্রেটর

সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভাইব্রেটর হলো ইমারসান বা নিডল ভাইব্রেটর। এটি সাধারণত ডিজেল ইঞ্জিন চালিত ভাইব্রেটর, যাতে একদিক বন্ধ একটি নিডল বা স্টিল টিউব আছে যাতে ভাইব্রেটিং এলিমেন্ট থাকে। রিইনফোর্সমেন্ট-এর দূরত্বের উপর নির্ভর করে এই টিউবের মাপ ৪০-১০০ মিলিমিটার ব্যাসের হয়। এতে সাধারণত ৩০ সেকেন্ড থেকে ২ মিনিট পর্যন্ত ভাইব্রেট করা হয় এবং এর জন্য কনক্রিটের স্তরের মাপ ৬০০ মিলিমিটারের চেয়ে বেশি হতে পারবে না।

এক্সটার্নাল বা সাটার ভাইব্রেটর

এই ভাইব্রেটরগুলো পূর্বপরিকল্পিত পয়েন্টে ফর্মার সাথে ক্ল্যাম্প করে আটকিয়ে ব্যবহার করা হয়। এটি একটি জায়গায় লাগিয়ে রাখা হলেও পরে তা সরিয়ে সরিয়ে সব জায়গায় সমান মশলা যাওয়া নিশ্চিত করা হয়। ইন্টার্নাল ভাইব্রেটরের চেয়ে এর পাওয়ার কনজাম্পশন বেশি হয়। এটি সাধারণত প্রি-কাস্ট কনক্রিটের জন্য এবং সাইটে পাতলা সেকশনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।

সারফেস ভাইব্রেটর

অগভীর সারফেস, যার গভীরতা ২৫০ মিলিমিটারের বেশি নয়, এমন সারফেসে সরাসরি ভাইব্রেট করিয়ে মশলা ঠিকমতো কম্প্যাক্ট করার জন্য ব্যবহৃত হয় সারফেস ভাইব্রেটর। ছোট ছোট স্ল্যাব এবং পেভমেন্টের স্ল্যাবের ঢালাই ও মেরামতির কাজে সারফেস ভাইব্রেটর ব্যবহার করা হয়।

কংক্রিট ভাইব্রেটর টেবিল

ল্যাবরেটরি এবং প্রিকাস্ট কংক্রিট বানানোর ফ্যাক্টরিগুলোতে এটি ব্যবহৃত হয়।

ভাইব্রেশনের রকমফের ও কীসের ভিত্তিতে নিবেন?

ফর্মওয়ার্কের জন্য সাধারণত সারফেস ভাইব্রেটর ব্যবহার করা যায়, যা সাধারণত ১৫ সেন্টিমিটার পর পর ঢালাইয়ের গায়ে লাগিয়ে কাজ করা হয়। সর্বাধিক ৬ ইঞ্চির কাস্টিং-এ ভাইব্রেশনের জন্য বড়সড় মাপের ভাইব্রেটর ব্যবহৃত হয় যাদেরকে জাম্পার বলে। এগুলো সুন্দর মসৃণ তল তৈরি করে। আভ্যন্তরীণ ভাইব্রেটর ব্যবহার করে ভিতর থেকে বায়ু বের করে আনা হয়, যাতে মশলা সুন্দরভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

সাধারণত ভাইব্রেটর ব্যবহার করা হয় একদম সব কাজ শেষের দিকে। নিয়মমতো ব্যবহার করলে দ্রুতই এই যন্ত্রে কাজ হয়ে যায়। যদি ইন্টার্নাল ভাইব্রেটর ব্যবহার করা হয়, তাহলে ভাইব্রেশনের কাজের পরে ২.৫ সেন্টিমিটার/সেকেন্ড হারে সরাতে হয়। যদি এরপরেও ভাইব্রেট করা জায়গা থেকে বায়ু বুদবুদ বের হয় তাহলে সেই স্থানে আরও ভাইব্রেশন দিতে হবে। ভাইব্রেটর ব্যবহারের সময় খেয়াল রাখতে হয় যাতে অনেক বেশি সময় ধরে ভাইব্রেট করা না হয়, কেননা এতে করে পানি ও খোয়া আলাদা হয়ে পড়তে পারে।

এবার আসুন জেনে নেই ভাইব্রেটর ব্যবহারের সময় কী কী বিষয় খেয়াল রাখতে হবে সেগুলোর ব্যাপারে।

– যেকোনো কন্সট্রাকশন কাজের সময় এক বা একাধিক ভাইব্রেটর অতিরিক্ত রাখতে পারাটা ভালো।

– শক্ত কনক্রিটের জন্য বেশি সময় ভাইব্রেটর ব্যবহার করতে হয়।

– কোনো কোনো কনক্রিটের জন্য ভাইব্রেটর লাগে না, তাই ব্যবহারবিধি জেনে নিতে হবে।

– সবসময় নিশ্চিত করতে হবে, ভাইব্রেটর যাতে পুরাতন ঢালা কনক্রিটের স্তর ভেদ করে পরের স্তরে যেতে পারে, ন্যূনতম ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত।

– ভাইব্রেটর খাড়াভাবে ব্যবহার করতে হবে।

– এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, এক জায়গায় ভুলক্রমে একাধিকবার যাতে ভাইব্রেটর ব্যবহার না হয়।

এসব বিধি মেনে সঠিকভাবে ভাইব্রেটর ব্যবহার করতে পারলে সহজেই দৃষ্টিনন্দন, মজবুত এবং সুরক্ষিত দালান নির্মাণ করা সম্ভব যা হবে আপনার স্বপ্নের বাড়ি।

আপনার বাড়ি জীবাণুমুক্ত আছে তো? জেনে নিন উপায়গুলো

মানুষ সবসময়ই চায় নিজের বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি ও টিপটপ রাখতে। এজন্য ঘর ঝাড়ু দেওয়া, ধোয়া-মোছা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই আমরা করে থাকি। এতে করে আমাদের বাসার পরিবেশ থাকে সুস্থ, সুন্দর, পরিপাটি এবং আমাদের মন মানসিকতা থাকে শান্তিপূর্ণ। সাথে সাথে আমাদের শরীরও থাকে সুস্থ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চলমান কোভিড-১৯ মহামারির সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা উচিৎ। আসুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে আমাদের বাড়িঘর এবং এর আশেপাশের পরিবেশ জীবাণুমুক্ত রাখা যায়।

কেন পরিষ্কার রাখতে হবে?

বাতাসে চোখে দেখা যায় না এমন অনেক কিছু যেমন- ধুলাবালি, রোগজীবাণু ভেসে বেড়ায়। অসতর্ক মুহূর্তে সেগুলো আমাদের দেহে ঘরবাড়ির বিভিন্ন কিছু থেকেও প্রবেশ করতে পারে, যদি তা ঠিকমতো পরিষ্কার না করা হয়। আমাদের খাদ্যদ্রব্য আমরা কাঁচাবাজার থেকে কিনে আনি, এর সাথে চলে আসতে পারে অনেক মারাত্মক জীবাণু।

বাসার বাথরুমে, রান্নাঘরের খাবারের পাশে রাতের অন্ধকারে ঘুরে বেড়াতে পারে জীবাণু বহনকারী পোকামাকড় যেমন- তেলাপোকা, ইঁদুর ইত্যাদি। এসব জীব বহন করে অনেক মারাত্মক জীবাণু। এসব জীবাণুর হাত থেকে সুস্থ থাকতে হলে আমাদের ঘরবাড়ি ও এর আশপাশ নিয়মিত পরিষ্কার করে রাখতে হবে।

কীভাবে জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে?

সাধারণত বাসার মেঝে সবাই ঝাড়ু দিয়ে ধুলা সাফ করে। আর আসবাবপত্রের ক্ষেত্রে ধুলা ঝেড়ে সাফ করা হয়। এরপরে পানি দিয়ে মুছে শুকিয়ে যাওয়ার পরে অনেকটাই ঘর পরিষ্কার হয়ে যায়। আরও জীবাণুমুক্ত করতে পানি দিয়ে মোছার সময়, স্যাভলন বা ডেটল কয়েক ফোঁটা মিশিয়ে ব্যবহার করা হয়। এভাবে সাধারণত সারা ঘরের মেঝে পরিষ্কার করে একে জীবাণুমুক্ত করে ফেলা উচিৎ।

কিন্তু কিছু কিছু ঘরে শুধু এতটুকু করলেই সব হয়ে যায় না। আপনার ঘরের মেঝেতে কার্পেট থাকলে কার্পেট ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। যদিও আমাদের দেশে সাধারণত কার্পেট পানিতে ধুয়ে রোদে শুকানো হয় ভালমতো পরিষ্কার করার জন্য। রোদের কথা আসার সাথে একটি ছোট্ট জিনিস জেনে রাখা যাক- রোদ খুব ভালো জীবাণুনাশক, তাই ঘরে প্রচুর আলো-বাতাস আসার সুযোগ থাকা উচিৎ যাতে করে অনেক জীবাণু রোদের আলোতে ধ্বংস হতে পারে। এবার ঘরের কিছু বিশেষ বিশেষ জায়গা কীভাবে পরিষ্কার করা যায় সেরকম কিছু বিষয় আসুন জেনে নিই।

রান্নাঘর

কাঁচাবাজার থেকে মাছ, মাংস, শাকসবজি কাঁচা অবস্থায় এনে প্রথমে রান্নাঘরে রাখা হয়। কাঁচা অবস্থায় এবং বাজার থেকে এসবের সাথে অনেক জীবাণু আসে যেগুলো মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ। এজন্য রান্নাঘরকে রাখতে হয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং জীবাণুমুক্ত।

কাঁচা খাদ্যসামগ্রী কাটাকুটির পরে সে জায়গাটি জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। এসময় হাতে রাবার বা ওয়ান টাইম ল্যাটেক্স গ্লাভস ব্যবহার করা উচিৎ। সাধারণত ওয়াইপ্স বা পাতলা পরিষ্কার শুকনা কাপড় ব্যবহার করা উচিৎ এর জন্য। ডাইনিং টেবিল, চেয়ার, ফ্রিজের হাতল, কাউন্টার টপ, চুলার পাশের জায়গা, চুলা, বেসিন এসব জায়গা নিয়মিত পরিষ্কার করা অবশ্যই দরকার। সম্ভব হলে মাসে একবার ব্লিচিং পাউডার পরিমাণমতো পানিতে দিয়ে ভালভাবে পরিষ্কার করা যেতে পারে।

বাথরুম

বাসার সবচেয়ে জীবাণুযুক্ত স্থান হলো আমাদের বাথরুম। বাথরুমের পানির ট্যাপ, বেসিন, কমোড কিংবা প্যানে থাকে হাজারো জীবাণু, ব্যাকটেরিয়া। এই জায়গাগুলো খুব সচেতনভাবে আমাদের পরিষ্কার করতে হবে।

টয়লেটের ফ্লাশের ঢাকনা, হ্যান্ডেল, কমোডে বসার স্থান এবং এর ঢাকনা, বেসিন এবং শাওয়ারের হ্যান্ডেল, লাইট সুইচ (অবশ্যই অফ থাকা অবস্থায়), বাথরুমের সব উপকরণ- এসব কিছুই উপযুক্ত কেমিক্যাল দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। যেমন- বেসিন, কমোড, প্যান মাঝেমধ্যে হারপিক বা সোডা দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। এছাড়াও নিশ্চিত করতে হবে যাতে তা স্যাঁতস্যাঁতে না থাকে এবং পর্যাপ্ত আলো-বাতাস যাতে আসতে পারে।

এসব পরিচ্ছন্নতার কাজের পরে অবশ্যই সাবান দিয়ে ভালমতো হাত ধুতে হবে, যাতে আপনার হাতে জীবাণু লেগে না থাকতে পারে। ঘর পরিষ্কার করার সাথে সাথে খেয়াল রাখতে হবে যাতে আবর্জনা বাড়ির পাশে ফেলে পরিবেশ ময়লা করা যাতে না হয়। আবর্জনা ফেলতে হবে নির্দিষ্ট স্থানে।

ভাঙা টব, পাত্র, পানি জমতে পারে এমন বস্তু ভালমতো ফেলতে হবে ডাস্টবিনে, যাতে মশা না হতে পারে। এভাবে নিয়মমতো নিয়মিত ঘর এবং ঘরের আশেপাশে সচেতনভাবে পরিষ্কার করে রাখলে স্বাস্থ্য থাকবে ভালো, মন থাকবে প্রফুল্ল। আসুন সবাই নিজেদের বাড়িঘর এবং এর আশেপাশের জায়গা পরিষ্কার করে রাখি এবং সুস্থ থাকি।

বাড়ি বানাচ্ছেন? জেনে নিন ঢালাইয়ের খুঁটিনাটি!

“যেকোনো ভবন তৈরির সবচেয়ে কঠিন অংশ কী?” 

আমাদের উপমহাদেশে এই প্রশ্নের উত্তরগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে সবার উপরে থাকবে ছাদ ঢালাইয়ের ব্যাপারটি। যখন থেকেই পাকা বাড়ি বা বহুতল বাড়ি তৈরির চর্চা শুরু হয়েছে, তখন থেকেই এ ব্যাপারে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। অনেক আগে বাঁশ দিয়ে ঠেস দিয়ে ছাদ ঢালাইয়ের দৃশ্য ছিল এদেশে নির্মাণের সমার্থক। কিন্তু এখন সময় বদলে গিয়েছে। জেনে রাখা ভালো, ছাদ ঢালাইয়ের ব্যাপারটি খুবই টেকনিক্যাল এবং এর প্রতিটি ব্যাপারে নির্মাতার নজর হতে হবে সূক্ষ্ম।  

কী কী বিষয় খেয়াল রাখা উচিত ছাদ ঢালাইয়ের সময়?

  • ছাদ বা ফ্লোরের শাটারিং কোনোভাবেই ধাপে ধাপে করা যাবে না। একটি ফ্লোর বা ছাদ ঢালাই করার সময় পুরো ছাদের শাটারিং একবারে করা অত্যাবশ্যক। এর সাথে সম্পূর্ণ ফর্মা সমতল হয়েছে কিনা তা-ও একবারেই যাচাই করে নিতে হবে। 
  • ছাদ ও বীম ঢালাইয়ের কাজও করতে হবে একসাথেই। যদিও ছাদের লোড বীমের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়, তবুও তৈরির ক্ষেত্রে এদের একসাথে তৈরি করা অত্যাবশ্যক। ছাদ ৪ থেকে ৮ ইঞ্চি পুরু হতে পারে।

  • সাধারণত ২১ দিন পর ফর্মা খোলা হয়। তবে ঢালাইয়ের একদিন পরই ছাদের উপরিভাগে পানি ধরে রেখে কিউরিং করতে হবে।
  • ঢালাইয়ের জন্য যে কাঠের কাজ করা হয়, তাকে বলা হয় সেন্টারিং। এর জন্য যে তক্তা বা প্লেট ব্যবহার করা হয়, তাতে ছিদ্র থাকা চলবে না এবং তক্তার উপরে কোনো তৈলাক্ত পদার্থ (যেমন- ডিজেল বা গ্রিজ) লাগানো থাকলে তা সুন্দর হয়। তবে বর্তমানে পাতলা পলিথিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এসব প্রক্রিয়া মেনে চললে সর্বনিম্ন সময়ে শাটার খোলা সম্ভব।
  • মর্টার মেশাতে যদি মেশিন ব্যবহার করা হয়, তাহলে খেয়াল রাখতে হবে দুটি ব্যাপারে-
    ১. কমপক্ষে ২ মিনিট ধরে মেশাতে হবে।
    ২. মেশানোর সময় সম্পূর্ণ পানির সাথে মিক্সচার গুলে যাওয়া যাবে না।
  • হাতে মিক্সচার তৈরি না করাই উচিত। এতে করে গুণগত মানের ধারাবাহিকতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। মানসম্পন্ন কংক্রিট অনেকদিন স্থায়ী ছাদ তৈরিতে খুবই দরকারি।
  • ছাদ ঢালাইয়ের সময় সেটিং শুরু হবার আগেই প্রক্রিয়া শেষ করা উচিত। আধা ঘণ্টা থেকে ১ ঘণ্টা সময় নেওয়াটা ভালো মানের পরিচায়ক। দেরি হয়ে গেলে ঢালাই আবার নতুন করে তৈরি করা উচিত। অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করলে তা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
  • পিলারের শাটার তৈরির পরে তার মধ্যে ঢালাই ঢালার নিয়ম হচ্ছে, ঢালাই ১.৫ মিটারের বেশি উপর থেকে না ঢালা। এতে মিক্সচারের উপাদান আলাদা হয়ে যাবার ঝুঁকি থাকে।
  • ঢালাই করার পর যাচাই করে দেখতে হবে ঢালাই যেন নিরেট হয় ও তাতে কোনো ফাঁকফোকর না থাকে। এক্ষেত্রে নিডল ভাইব্রেটর বা লোহার রড দিয়ে ঠাসাই করা উচিত।

ছাদ ঢালাই করার নিয়ম

উপাদান – সিমেন্ট, বালি এবং নুড়ি/খোয়া।

উপাদানের অনুপাত – সিমেন্টঃ বালিঃ খোয়া – ১ঃ২ঃ৪।

এই মিশ্রণ প্রতি ৫০ কেজির সিমেন্টের বস্তার ক্ষেত্রে মেনে চলতে হবে এবং পানির পরিমাণ হবে সর্বোচ্চ ২৫ লিটার।

২ মিনিট ধরে এই মিশ্রণ মেশিনে প্রস্তুত করতে হবে। যদি হাতে তৈরি করতে হয় তাহলে পাকা মেঝেতে সিমেন্ট-বালুর মিশ্রণ তৈরি করে দক্ষ হাতে মর্টার তৈরি করতে হবে। ১ ফুট পরপর মোটা বাঁশ দিয়ে ঢেকে দিতে হবে বা ধাতব ফ্রেম ব্যবহার করতে হবে, যাতে ছাদ ও বীমের ফর্মা যথেষ্ট মজবুত হয়। আগের বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করে সেন্টারিং, শাটারিং, ঢালাই, জমাট বাঁধা ও কিউরিং ইত্যাদি ধাপ মেনে ঢালাই সম্পন্ন করতে হবে।

মেঝে ঢালাই করার নিয়ম

মেঝে ঢালাই দেবার নিয়ম অনেকটা ছাদ ঢালাইয়ের মতোই। তবে মেঝে ঢালাই তুলনামূলক সহজ, কারণ, এটি ভেঙে গিয়ে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার আশঙ্কা তুলনামূলক কম। তবে এখানেও মান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সবক্ষেত্রেই। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত যা করতে হবে তা হলো-

  • মেঝে ভিটে বালি দিয়ে ভরাট করতে হবে।
  • ভালোভাবে মুগুর দিয়ে দুরমুজ করে সমান করে নিতে হবে।
  • পানি ঢালতে হবে।
  • ঢালাইয়ের আগে ইট বিছাতে হবে।
  • ঢালাইয়ের পুরুত্ব হতে হবে তিন ইঞ্চি।

ঢালাইয়ের উপর নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব দুইই নির্ভরশীল। তাই ঢালাইয়ের আগে নকশা সম্পর্কে নিশ্চিত হোন। অভিজ্ঞ মিস্ত্রির সাহায্য তো প্রয়োজন হবেই, তবে পুরো প্রক্রিয়াতে মিস্ত্রির উপর নির্ভর না করে অবশ্যই দক্ষ প্রকৌশলীর সাহায্য নেওয়া উচিৎ।

কারণ, শুধু অভিজ্ঞতা থেকে আধুনিক পদ্ধতিতে নির্মাণকাজ পরিচালনা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ অসম্ভব। এজন্যই ঢালাইয়ের খুঁটিনাটি সম্পর্কে নিজে সম্যক ধারণা রাখুন ও পেশাদার নির্মাণ নিশ্চিতকরণে হয়ে উঠুন সতর্ক।