ঘটনা-১: জাহিদুর রহমানের বাসার পাশেই রেললাইন। সারাদিন ট্রেনের যাওয়া-আসার শব্দে সমস্যা হয়। রাতের আন্তঃনগর ট্রেনের শব্দে তার দুই শিশু ঘুম ভেঙে জেগে বসে থাকে। এসএসসি পরীক্ষার্থী কন্যার পড়াশোনায় বেশ অসুবিধা হচ্ছে এই শব্দে।
ঘটনা-২: মাইকে ওয়াজ মাহফিল চলছে। এদিকে নীলুফার সুলতানার বাবা প্রচণ্ড অসুস্থ। প্রচণ্ড শব্দে অসুস্থ বাবার কষ্ট অসহায় হয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই নীলুফারের।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এরকম শব্দ নিয়ে অসুবিধা হতেই থাকে। আর দশটা সমস্যার মতোই এর সাথেও আমরা মানিয়ে নিই, ভাড়া বাসা হলে বাসা পাল্টানোর চিন্তা করি। অথচ, বাড়ি করার সময় সাউন্ড ইনসুলেশন ব্যবস্থার দিকে সামান্য মনোযোগ দিলে এধরনের অসুবিধা এড়ানো যায় খুব সহজেই।
সাউন্ড ইনসুলেশন
যে তরঙ্গ বায়ু বা অন্য কোনো মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হয় এবং মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণীর কানে শ্রবণের অনুভূতি জাগায় তাকে সাউন্ড বা শব্দ বলে। কোনো রুম বা জায়গাকে সাউন্ডপ্রুফ বা শব্দহীন করার পদ্ধতিকে সাউন্ড ইনসুলেশন বলে।
বাসার সাউন্ড ইনসুলেশন
হোম ইনসুলেশন বলতে বোঝায়, যেকোনো অন্তরক বা ইনসুলেটর ব্যবহার করে ঘরকে শব্দ এবং তাপ থেকে আলাদা রাখা। হোম ইনসুলেশনের একটি অংশ হচ্ছে সাউন্ড ইনসুলেশন।
আপনার বাসার অবস্থান কোন এলাকায় তার ওপর শব্দদূষণের মাত্রা নির্ভরশীল। আবাসিক এলাকায় যতটা না শব্দদূষণ হয়, তার তুলনায় বাসা যদি বাস স্ট্যান্ড, রেললাইন, এয়ারপোর্ট, হাইওয়ে, মেইন রোড, সিনেমা হল বা বাজারের পাশে হয়ে থাকে তবে শব্দদূষণের মাত্রা অত্যধিক হয়ে থাকে। এসকল এলাকায় বাসা হলে সাউন্ড ইনসুলেশনের প্রয়োজনও তাই অত্যধিক।
আমাদের দেশে বাড়ি তৈরিতে হোম ইনসুলেশনের বিষয়টিকে একেবারেই গুরুত্বের সাথে দেখা হয় না। কিন্তু অতিরিক্ত শব্দদূষণযুক্ত এলাকায় দীর্ঘদিন থাকার ফলে বাড়ির সকলের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যে স্থায়ী প্রভাব পড়তে পারে। ঘরে বয়স্ক, হার্টের রোগী বা হাই প্রেশারের কোনো রোগী থাকলে তাদের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে হোম ইনসুলেশনের প্রয়োজন রয়েছে।
বাড়ি তৈরির সময়ই এলাকার উপর নির্ভর করে হোম ইনসুলেশনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পড়ার ঘর, বেড রুমগুলো সাউন্ডপ্রুফ হওয়া জরুরি। রুম সাউন্ডপ্রুফ করার জন্য ঘরের যে স্থানগুলোতে বাইরের শব্দ প্রবেশ করে সে স্থানগুলোতে ফোমের প্যাডিং ব্যবহার করা যেতে পারে, এছাড়া ফাইবার গ্লাসের উল দিয়েও আটকে দেওয়া যেতে পারে।
এছাড়া বাড়ি তৈরির সময়ই দেয়ালে ইনসুলেটর ব্যবহার করা যেতে পারে। সাউন্ড রিফ্লেকটিভ সারফেস বাড়ির বাইরের সারফেসে সংযুক্ত করা যেতে পারে। সাউন্ডপ্রুফ করতে গিয়ে ঘর যেন আবার বেশি বদ্ধ না হয়ে যায় সে বিষয়েও নজর রাখতে হবে।
বাইরের আওয়াজ, গাড়ির হর্ন, ট্রাফিকের শব্দ, দরজা খোলার আওয়াজ, বৃষ্টি এবং আবহাওয়াজনিত কারণে সৃষ্ট শব্দ, করিডরে থাকা মানুষের আওয়াজ, কথাবার্তা এগুলো সবকিছু থেকে আলাদা করার জন্য সাউন্ড ইনসুলেশনের প্রয়োজন।
সাউন্ড ইনসুলেশন কীভাবে কাজ করে?
শব্দ এক মাধ্যম থেকে আরেক মাধ্যমে কম্পনের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়ে থাকে। শব্দের কম্পনকে রোধ করার মাধ্যমেই সাউন্ড ইনসুলেশন নিশ্চিত করা হয়।
শব্দ দুই ধরনের।
১। বাতাসে কম্পন সৃষ্টির মাধ্যমে যে শব্দ উৎপন্ন হয়-
বাইরের যেকোনো আওয়াজ, হর্নের শব্দ, ট্রাফিকের শব্দ, কথা বলার শব্দ, টেলিভিশন, রেডিও থেকে উৎপন্ন শব্দ ইত্যাদি।
২। যেকোনো কিছুর প্রভাবে সৃষ্ট কম্পন থেকে যে শব্দ উৎপন্ন হয়-
হাঁটাচলার আওয়াজ, ওয়াশিং মেশিন, ব্লেন্ডারের কম্পনের ফলে সৃষ্ট আওয়াজ, ড্রিল মেশিনের আওয়াজ ইত্যাদি।
সাউন্ড ইনসুলেশন এই দুই ধরনের শব্দের প্রভাব কমিয়ে যেকোনো স্পেসকে অপ্রয়োজনীয় আওয়াজমুক্ত রাখতে সহায়তা করে। এক স্থান থেকে আরেক স্থানে শব্দের স্থানান্তর রোধ করতে অন্তরক পদার্থ শব্দের উৎস যে জায়গাতে থাকে সেই জায়গার একটা বাধা হিসেবে কাজ করে এবং শব্দের কম্পন শোষণ করে সাউন্ড ইনসুলেশন নিশ্চিত করে।
ইনসুলেটর বা অন্তরক নির্ধারণে বিবেচ্য বিষয়
– শব্দ শোষণ বা অ্যাবজর্ভ করার ক্ষমতা
– ওজন হালকা হতে হবে
– বায়ু নিরোধক
– দেয়াল, ছাদ এবং ফ্লোরে সহজে ব্যবহার করা যায় (ইনস্টলেশন যেন সহজে করা যায়)
– আবহাওয়া
– স্থায়িত্ব
– সহজে প্রতিস্থাপন করা যায়
– খরচ
– সহজলভ্যতা
– ক্ষতিকর প্রভাব
– আগুন নিরোধক
– পরিবেশের উপর প্রভাব
সাউন্ড ইন্সুলেশনের জন্য ব্যবহৃত উপাদান
– গ্লাস উল বা ফাইবার গ্লাস
– রক উল
– গ্লাস ইনসুলেশন
– ভিনাইল বোর্ড
– ফোম প্যানেল
– জিপসাম বা পিওপি বোর্ড
– থার্মোকল
এসকল উপাদান দেয়াল, ফ্লোর ও সিলিংয়ে ব্যবহার করা হয়ে থাকে এবং যেকোনো অপ্রয়োজনীয় শব্দ কমিয়ে সাউন্ড ইনসুলেশন নিশ্চিত করে। সচেতন হয়ে বাড়ি নির্মাণ করুন, নিরাপদ থাকুন শব্দদূষণ থেকে।