নির্মাণশিল্পে কোভিড-১৯ এর প্রভাব এবং এর ভবিষ্যৎ

নভেল করোনা ভাইরাসের শেষ কোথায় এ সম্পর্কে কারও জানা নেই। এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে থমকে গেছে আমাদের জীবন ও জীবিকা। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোনো কিছুই এর ছোবল থেকে রেহাই পায়নি। বিশ্বব্যাপী মার্চ মাসের শুরু থেকে চলছে লকডাউন। ঘরবন্দী থাকার দিন সেই যে শুরু হলো, তার শেষ এখনো হয়নি কোনো কোনো ক্ষেত্রে। অফিস, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, বাজারসদাই সবকিছুই চলে আসছে চার দেয়ালে বন্দী থেকে।

কিন্তু কিছু কাজ রয়েছে যা কখনোই চার দেয়ালের ভেতরে থেকে করা সম্ভব নয়, আবার এই মহামারিতে করাও ঝুঁকিপূর্ণ। এক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলেও আমাদেরকে তা বন্ধ রাখতে হয়েছে। তেমন একটি হলো নির্মাণশিল্প। করোনার প্রাদুর্ভাবে সাপ্লাই চেইন থেকে শুরু করে কাঁচামাল সরবরাহ বন্ধ, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি সবকিছু মিলিয়ে এই শিল্প এক বিশাল হুমকির মুখে এসে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশের সিমেন্টশিল্প, স্টিলশিল্পসহ নির্মাণ সংশ্লিষ্ট সকল শিল্প একযোগে এই সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং স্থানীয় সকল ছোট প্রজেক্টের সাথে সাথে আন্তর্জাতিক অনুদান সম্বলিত সকল কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পদ্মা সেতু, রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট, কর্ণফুলি টানেল, ঢাকা মেট্রোরেলসহ প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের নির্মাণ কাজ, দেশি-বিদেশি শ্রমিকের সক্রিয়তা, কাঁচামালের স্বাভাবিক সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় নির্মাণ কাজে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে।

এই অবস্থায় কর্তৃপক্ষ কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাজ সমাপ্তির সময় ২০২২ সাল পর্যন্ত বর্ধনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং করোনা প্রভাবমুক্ত দেশ থেকে শ্রমিক, প্রকৌশলীসহ লোকবল আমদানির কথা পর্যন্ত আমলে নেয়। কিন্তু করোনার প্রভাবমুক্ত কোনো দেশ থেকে জনশক্তি পাওয়া সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে উৎপাদন তথা নির্মাণকাজ বহুদিন বন্ধ থাকার কারণে কাঁচামাল নষ্ট, মেয়াদ উত্তীর্ণসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি সহজেই অনুমেয়। ইতোমধ্যে নির্মাণশিল্পের সাথে জড়িত নিম্ন আয়ের মানুষ, যেমন- টেকনিশিয়ান, দিনমজুরেরা কাজ হারিয়ে বেকারত্বের শিকার। ব্যাংকগুলো থেকে লোন নেয়ার পরেও কাজে লাগাতে পারছে না মালিক সম্প্রদায়। অর্থাৎ ব্যক্তিপর্যায় থেকে শুরু করে দেশের বৃহত্তর অর্থনীতি সবকিছু নিয়েই শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

যেকোনো নির্মাণকাজের সময়সীমাকে চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম ভাগে পরিকল্পনা, নকশা অনুমোদন, সরকারি-বেসরকারি অনুদান নিশ্চিতকরণ হয়ে থাকে। দ্বিতীয় ভাগে চলে সাপ্লাই চেইনের কাজ এবং মালামাল মজুতকরণ। নির্মাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে থাকে তৃতীয় এবং চতুর্থ ভাগে। আর সেই নির্মাণ কাজ শুরুর প্রাক্কালেই শুরু হয় আমাদের লকডাউন।

নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় একদিকে যেমন মালামালের ক্ষতি হয় অন্যদিকে প্রায় ৩৫ লাখ নির্মাণ শ্রমিক এবং তাদের পরিবার অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন বলে জানান গবেষকরা। এক্ষেত্রে মালিক সম্প্রদায়সহ সংশ্লিষ্ট সকলের সুচিন্তিত পদক্ষেপ এ যাবৎকালীন হয়ে যাওয়া ক্ষতির কিছুটা হলেও লাঘব করা সম্ভব হবে।

১. যথাসম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনে পর্যায়ক্রমে শ্রমিকদের নির্মাণকাজে নিয়োগ দেওয়া যাতে পরবর্তীতে আর রোগ সংক্রমণের জন্য কাজ বন্ধ না হয়। কারণ, সরকার ইতোমধ্যে কিছু কিছু কাজ চালু করার অনুমোদন দিয়েছে।

২. সাইটে মালামাল মজুত থেকে শুরু করে কাজ শেষ পর্যন্ত একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা এবং প্রয়োজনে প্রোজেক্ট ম্যানেজার নিয়োগ।

৩. পররবর্তীতে নির্মাণকাজে প্রিফ্যাব্রিক্যাটেড উপকরণের ব্যবহার বাড়ানো এবং আগে থেকে মজুদ না করে সাইটেই অল্প সময়ে বানানো সম্ভব এরকম বিকল্প উপকরণের উপর নির্ভরশীলতা বাড়ানো। যেমন- কংক্রিট ব্লক অথবা নষ্ট হয়ে যাওয়া ইটের ব্লককে সুড়কি বানিয়ে ফেলা।

৪. এক গবেষণায় দেখা যায় প্রায় ৩০,০০০ আবাসন প্রকল্পের কাজসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নির্মাণকর্ম এর মধ্যে হস্তান্তরের কথা থাকলেও করোনার কারণে তা সম্ভবপর হয়নি। এগুলো শেষ করার পূর্বে আর কোনো নতুন প্রকল্প গ্রহণ না করে এগুলো সম্পূর্ণ করার দিকে মনোনিবেশ করা শ্রেয়।

৫. ইতোমধ্যে ঠিকাদার ও কাঁচামাল ব্যবসায়ীরা যে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন তার জন্য প্রয়োজনে আলাদা ফান্ড গঠন করা যেতে পারে সরকারি অনুদানে, কারণ, সরবরাহ সচল না থাকলে এই প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের কোনো সুযোগ নেই।

৬. পুনরায় পদ্মা ব্রিজের কাজ শুরু হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ সাইটেই ৪০০০ জন শ্রমিকের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করে, যার কারণে শ্রমিকদের অন্য এলাকায় চলাচল বন্ধ হয়। এ যাবৎ এই প্রকল্প থেকে কোনো প্রকার সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়নি। এভাবে প্রতিটি সাইটে প্রোজেক্টের স্কেল অনুযায়ী শ্রমিকদের আবাসনের ক্ষণস্থায়ী ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্মাণ কাজকে কিছুটা হলেও সচল করা যেতে পারে।

কোভিড-১৯ এর কারণে সমগ্র বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার যে প্রভাব আমাদের দেশের উপর পড়েছে তা মোকাবেলা করার জন্য সরকারের সাথে সাথে বেসরকারি খাতগুলোকেও তৎপর হতে হবে। বিগত মাসগুলোর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ মাথায় রেখে ভবিষ্যতে সুচিন্তিত উপায়ে অগ্রসর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

কোভিড পরবর্তী আবাসন- সতর্কতা ও সচেতনতা

কোভিড১৯ মহামারি ২০২০ সালে আমাদের জীবনধারাকে চরমভাবে প্রভাবিত করেছে স্থান, কাল, পাত্র, শ্রেণী, বর্ণ নির্বিশেষে। আমরা সবাই একটি পর্যায়ে ঘরবন্দী হতে বাধ্য হয়েছি এবং বর্তমানে সমস্যার পূর্ণাঙ্গ সমাধানের আগেই আমাদের বের হয়ে আসতে হচ্ছে ঘর থেকে। কিন্তু এর মধ্যেই নিজের আবাসস্থল থেকে কাজ করা, শিক্ষাগ্রহণ হোম ডেলিভারিসহ অনেক বিষয়ে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে বিশ্ববাসী। সাথে সাথে আমাদের মতো নগরবাসীর সামনে প্রমাণিত হয়েছে যে, আবাসন বিষয়ে আমাদের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনাটা আবশ্যক।

বর্তমানে আবাসন বিষয়ে ঢাকা শহরের একমাত্র পছন্দের বা বিলাসের নিয়ামক হচ্ছে স্কয়ার ফুট। এর সাথে টাইলস করা বাসা কিংবা খুব প্রাথমিক কিছু চাহিদার বিনিময়ে আমরা আমাদের সারা জীবনের সঞ্চয়ে কিনে নিচ্ছি বিভিন্ন মাপের বাক্স। সেই বাক্সগুলোতে আমাদের স্বপ্ন আমাদের প্রতিদিনের অবসর এবং পরিবারের সাথে কাটানো সেরা সময়গুলোকে করছি বাক্সবন্দী। এই জীবনধারাকে খুব বেশি হলে মাথা গোঁজার ঠাঁই বলা যায়। কিন্তু সানন্দে বসবাস করা বা একটি বিপর্যয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে নিরাপদ থাকার জন্য এই ব্যবস্থা কোনোভাবেই প্রস্তুত নয়। আমাদের এই জীবনধারার কারণে ঢাকা শহর শুধু কংক্রিটের জঞ্জালই হয়ে যায়নি বরং আবাসনের স্বাভাবিক সব সুযোগসুবিধার দামও হয়ে গিয়েছে আকাশচুম্বী। আমাদেরকে তাই অবশ্যই বদলাতে হবে।

স্থাপত্যে যেকোনো ভবনের নকশা শুরু হয় একজন মানুষের বিভিন্ন কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দূরত্বের হিসাবনিকাশের নিরিখে। সেখানে মানুষসংক্রান্ত ব্যাপারে পরিবর্তন না এনে প্রকৌশলীগণ স্ট্রাকচারাল, ইলেক্ট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল প্লাম্বিংয়ের মতো কাজগুলো যোগ করেন। এতদিন এখানে সামাজিক দূরত্ব বা দীর্ঘদিন ঘরবন্দী থাকার মতো হিসাব যেমন ছিল না, তেমনি পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতা, মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলোও বিবেচনা করতে হত না।

কোভিডের কারণে স্থাপত্য প্রকৌশলবিদ্যায় যারা শিক্ষিত তারা অবশ্যই ডিজাইন বা ভবন নকশায় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন। এমনকি যারা ভবন নির্মাণ আইন অনুমোদনের সাথে সংশ্লিষ্টতারাও মানুষের বসবাসের জন্য ন্যূনতম সুযোগসুবিধা এবং নিরাপত্তা বিধিমালায় মাথায় রাখবেন এই বিষয়গুলো। তাই হয়তো অদূর ভবিষ্যতে ইমারত সংক্রান্ত বিধিমালাতেও আমরা বিশ্বজুড়ে পরিবর্তন দেখব। 

কিন্তু ভবনের নকশা নির্মাণ করা হয় সেই ভবনে যারা বসবাস করবেন তাদের জন্য। এই কারণেই তাদের চাহিদাও ভবন নির্মাণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। তাই ভবনের নকশা কোভিডের মতো মহামারি প্রতিরোধী কিংবা সুরক্ষাবান্ধব হবে কিনা ব্যাপারে আপনাকেও হতে হবে সতর্ক সাবধান। 

কী কী বিষয় খেয়াল রাখবেন মহামারি থেকে নিরাপদ থাকতে? চলুন জেনে নেয়া যাক-

. নজর থাকুক স্কয়ার ফুটের বাইরেও

বেঁচে থাকতে হলে শুধু বেশি স্কয়ার ফুট যথেষ্ট নয়। এর সাথে চাই পর্যাপ্ত আলো বাতাস, চাই ঘরের ভেতর বাহিরের সাথে সুসম্পর্ক, চাই ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা। শুধু ঘরের স্কয়ার ফিট বাড়াতে গিয়ে বারান্দা বা টেরেসের মতো জায়গা ছোট করে ফেলবেন না। বেডরুমের একঘেয়েমি ঘরবন্দী অবস্থায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলতে পারে মানুষকে। সরকারি নিয়ম মেনে সেটব্যাক এবং প্লটের ৪০% জায়গা ছেড়ে দিয়ে বাড়ি বানান। এতে মুক্ত বাতাস বা মাটির যোগান হবে। বারান্দাগুলোর গ্রিল অত্যধিক ঘন করে ফেলতে নিরুৎসাহিত করুন। শুধু নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যতটুকু দরকার ততটুকুই নিন।

প্রত্যেক ফ্ল্যাটের প্রতিটি কোণায় আলো আসছে কিনা তা দেখে নিন। ভবনের পেছনের দিকে ফ্ল্যাটের অবস্থান হলে সেদিকে অন্য ফ্ল্যাট থেকে যথেষ্ট দূরত্ব না থাকলে সেই ফ্ল্যাট কেনা বা নির্মাণ অনুমোদন থেকে বিরত থাকুন। ছাদে বাগানসহ কম্যুনিটি স্পেস এখন সরকারি আইনের অংশ। এগুলো আপনার ক্রেতা হিসাবে অধিকারও। এই ব্যাপারগুলোতে তাই জোর দিন। 

. ফ্ল্যাটের ক্রমধারার গুরুত্ব

একটি ভালো ডিজাইনের ফ্ল্যাটে সাধারণত দুটো দরজা থাকে। একটিকে বলা হয় মূল প্রবেশপথ, আরেকটির নাম সার্ভিস প্রবেশপথ। ফার্নিচারের জায়গা বাঁচাতে গিয়ে অনেকে সার্ভিস সংক্রান্ত পথগুলো বন্ধ করে ফেলেন। এই অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে সুস্থ থাকতে। সার্ভিস ফটকের কাছে কমন ওয়াশরুম একটি বেসিন থাকাটা বাইরে থেকে এসে ঘরে প্রবেশের সময় হাত ধোয়া, জীবাণুমুক্ত হওয়া এবং বাইরে থেকে কেনা বাজারসদাইসহ অন্যান্য সামগ্রী ঘরে আনার আগেই নিরাপদ করতে সাহায্য করে। এছাড়া ময়লা নিষ্কাশন ম্যানেজমেন্টেও এই ক্রমধারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এই চিন্তাগুলো একজন প্রশিক্ষণবিহীন মানুষের জন্য আগে থেকে করা খুবই কঠিন। মনে রাখবেন এই পর্যায়কে বলা হয় Spatial Design যা আপনি নিজে এমনকি একজন প্রশিক্ষিত সিভিল ইঞ্জিনিয়ারও আপনাকে দিতে পারবেন না। এজন্য অবশ্যই IAB এর সদস্যপদপ্রাপ্ত স্থপতির নকশা গ্রহণ করুন। এরকম ছোট ছোট অনেক বিষয়ে একজন স্থপতির নকশা আপনাকে রোগব্যাধি থেকেও নিরাপদ রাখতে পারে।

. কমিয়ে আনুন গ্যারেজ এলাকা   

অনেকেই নিজের গাড়ি না থাকা সত্ত্বেও গ্যারেজ স্পেস কিনে ভাড়া দেন বা একটি গাড়ি থাকলেও ভবিষ্যতের কথা ভেবে একাধিক গ্যারেজ কিনে রাখতে চেষ্টা করেন। এতে করে অল্প কিছু অর্থনৈতিক লাভ হয়তো হয়। কিন্তু ডেভেলপার স্থপতির উপর অতিরিক্ত গ্যারেজ নকশায় অন্তর্ভুক্ত করার চাপ তৈরি হয়। এর ফলে অনেক সময় দেখা যায়, ওপরে জায়গা ছেড়ে দিলেও নিচে গ্যারেজের জন্য অনেক জায়গা পাকা করে ফেলতে হয়। এছাড়া গ্যারেজের বাইরে সেটব্যাকও অনেকে পাকা করে ফেলেন। এতে করে ভবনের বসবাসে তাপ বৃদ্ধি হয় এবং শহরজুড়ে মাটি পানি শোষণের ক্ষমতা কমে যায়। এসব কারণে কেন্দ্রীয় পানির সাপ্লাইয়ের উপরে নির্ভরতা বাড়ে। ফলনশীল গাছ পানি শোষনের জন্য এসব জায়গা ফাঁকা রাখুন। গ্যারেজ এলাকায় বরং একটি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র (যেখানে ডাক্তার এসে ভবনের অসুস্থ রোগীদের প্রাথমিকভাবে দেখতে পারবেন), একটি ফায়ার ফাইটিং কক্ষ (বাধ্যতামূলক), চাকুরিরত গার্ডের জন্য নিজস্ব থাকার ঘর ইত্যাদি নির্মাণে মনোযোগী হোন। এগুলি আপনাকে মহামারির সময় সাহায্য করবে। 

. ল্যান্ডস্কেপিং হোক স্মার্ট

নগরে সামান্য সবুজের সন্ধানে আমরা আধুনিক ভবনে সামান্য জায়গায় কিছু গাছপালা লাগাতে চেষ্টা করি। ছাদে বাগানের পাশাপাশি নিচে ভবনের সামনেও বর্ণিল গাছপালা লাগানো হয়। এর সাথে অনেক ভবনে সুইমিং পুল কিংবা বাহারী পাতাবাহার গাছের সজ্জাও আজকাল দেখা যায়। কিন্তু এই ধরনের খরচগুলোর জন্য পরে মেইনটেনেন্স খরচও দিতে হয়। শহরে সবুজ এবং নিসর্গ খুবই দরকারি এবং প্লটে গাছের পরিমাণ বাড়ানোও খুবই প্রয়োজনীয়। কিন্তু কী গাছ লাগাচ্ছেন সে ব্যাপারে সচেতন হওয়াটা আরো বেশি জরুরি। এই ফাঁকা জায়গাগুলিতে পাতাবাহার বা সজ্জাকর গাছ না লাগিয়ে ফলনশীল দেশী গাছ লাগানোটা মহামারির সময় বাইরের বাজার উপকরণের উপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পারা যায়। এছাড়া ভবনে যারা চাকরি করেন তাদের খাদ্য সংস্থানেও এগুলো হতে পারে দরকারি জায়গা। নগর কৃষি দিনে দিনে বিশ্বজুড়ে একটি বড় আন্দোলন হয়ে উঠছে নিজেরা এক হয়ে। Urban Farming-এর জন্য আপনার ভবন প্রস্তুত হলে অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যগতভাবে লাভবান হতে পারেন সকল ভবনমালিকই। সাথে সাথে কৃত্রিম এয়ার কন্ডিশন সিস্টেমের উপর নির্ভরতা কমিয়ে আপনার বিদ্যুৎ বিল কমিয়ে দিতে পারে স্মার্ট ল্যান্ডস্কেপিং। 

. সামাজিকতা হোক নিজেদের মাঝেই 

নগরে সুস্থ জীবন যাপনের জন্য সামাজিক একটি জীবন সবাই আশা করেন। অনেকেই অভিযোগ করেন, ঢাকা শহরে সামাজিক বন্ধন কমে যাচ্ছে অনেকদিন ধরেই। রোবট হয়ে পড়ছি আমরা। আমাদের ভবনের নকশাগুলি এমনভাবেই করা যাতে খুব বেশি সামাজিকতার সুযোগ থাকে না। আমরা যেটুকু সামাজিক কর্মকাণ্ড করি তাও হয়ে পড়ে পার্ক, কম্যুনিটি সেন্টার বা শপিং মল কেন্দ্রিক। অথচ এই কোভিডের সময়ে আপনি বাইরে যেতে পারছেন না আপনার সামাজিক কাজগুলোর জন্য। এটিরও নেতিবাচক প্রভাব অনেক। ভবনের একটি ইউনিট কম নির্মাণ করে কিংবা ছাদকে ব্যবহার করে গড়ে তুলুন নিজস্ব সামাজিক স্পেস। এসব জায়গায় নিজেদের অনুষ্ঠান করার সুযোগ যেমন থাকবে, প্রতিদিন বাচ্চাদের খেলাধুলা এবং বৈকালিক অবসর কাটাতেও আপনাকে জনারণ্য জায়গায় যেতে হবে না। 

. হোন শক্তি স্বনির্ভর

আধুনিক ভবনে বসবাসকারী আধুনিক নাগরিক হিসাবে আপনি নিঃসন্দেহে চান প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে। আপনার ভবনকে সেক্ষেত্রে চেষ্টা করুন শক্তির ব্যাপারে স্বনির্ভর করতে। বেরিয়ে আসুন জীবাশ্ম জ্বালানির উপর অতি নির্ভরতা থেকে। ব্যবহার করুন সৌরশক্তি। প্রকৌশলীর পরামর্শ মেনে নির্দিষ্ট সংখ্যক সোলার প্যানেল লাগিয়ে নিলে বিদ্যুৎ বিলের পাশাপাশি কমে যাবে গ্রীষ্মের তাপমাত্রাও। নকশায় প্রাকৃতিক ভেন্টিলেশন নিশ্চিত করতে স্থপতিকে উৎসাহ দিন। সঞ্চয় করার ব্যবস্থা করতে বলুন বৃষ্টির পানিনকশার কারিগরির মাধ্যমেই। আপনার বেসিনে বা গোসলে খরচ হওয়া পানি টয়লেটের ফ্ল্যাশে পুনঃব্যবহার করতে নির্দেশনা দিন প্রকৌশলীকে। আরেকটু সচেতন হলে ওয়াশিং মেশিনে কাপড় ধোয়া পানিও খুব সহজে টয়লেটের ফ্ল্যাশে ব্যবহার করতে পারেন। এতে পানি বিশুদ্ধকরণে যেমন খরচ কমবে সকলের, তেমনি আপনার পানির বিলও কমে যাবে অনেকভাবে। এই কাজগুলো করলে আপনার ভবন হবে স্বনির্ভর। তাই যেকোনো মহামারি বা দুর্যোগ অবস্থাতেও আপনি নিরাপদে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন সহজেই। 

. নকশার আওতায় আসুক এলাকাও 

আবাসিক এলাকার নকশার ক্ষেত্রে অনেক সময়ই দেখা যায়, দুই বা তিন রাস্তা জুড়ে শুধুই বাড়ি তৈরি করা হয়। এতে মুদি দোকান, সেলুন বা বাজারের মতো সুবিধা পেতে যেতে হয় বহুদূর এবং অনেক মানুষ অল্প ব্যবসার উপর নির্ভরশীল হয়ে যায়। ফলে ভীড় বাড়ে। 

কিন্তু এখন থেকেই এলাকাভিত্তিক নকশার অধীনে প্রতি ৩০ ভবনের জন্য একটি Amenity shop এর ব্যবস্থা চিন্তা করা উচিৎ। এতে করেই তৈরি হবে এলাকাভিত্তিক নিজস্ব অর্থনীতি। এই দোকানগুলি হতে পারে ভবনের ঠিক নিচেই। এমনকি স্মার্ট ল্যান্ডস্কেপ বা সামনে ছেড়ে দেয়া জায়গায় ফলনশীল গাছ লাগিয়ে, সবজির চাষ করে সেগুলো নিজেদের মধ্যে বেচাকেনা হতে পারে এসব দোকানেই। এতে করে বাজারের উপর নির্ভরতা কমবে। মানুষ নিজের এলাকার সাথে সংযুক্ত হবে আরো গভীরভাবে এবং পণ্যের দাম বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়াও হবে অনেক সহজ।

কোভিড মহামারির ফলশ্রুতিতে কোনো পরিবর্তন হঠাৎ করে চলে আসবে না। তবে শুরু করতে হবে আজই। কারণ, এই মহামারি কবে নির্মূল হবে সেটা বলা যেমন কঠিন, সেরকম আরো একবার এরকম মহামারি আসলে আপনি যদি প্রস্তুত না থাকেন তাহলে ক্ষতিগ্রস্থ হবে আপনারই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। ভবনের নকশায় নান্দনিকতা বা ডেকোরেশনের চেয়ে প্রযুক্তি নকশাগত উৎকর্ষ এখন অনেক বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে। এসব ব্যাপারে আপনি, আপনার স্থপতি, প্রকৌশলী, নির্মাতা এবং সরকারের একীভূত মনোযোগই পারে একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে।