নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর এই দেশের বাড়িগুলোতে জানালা একটি অপরিহার্য উপাদান। উচ্চ আর্দ্রতা আর তাপের কারণে বাতাসের প্রবাহের মাধ্যমে তাপ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা সেই আদিকাল থেকেই হয়ে আসছে। এক সময়ে আমাদের বাড়িগুলোর ঐতিহ্য ছিল কাঠের খড়খড়ি দেয়া ভারী পাল্লার দরজা আর জানালা, যাতে পাল্লা আটকে দিলেও খড়খড়ির বদৌলতে ঘরের ভেতর বায়ুপ্রবাহ থাকত নিরবচ্ছিন্ন।
বাড়ির প্রতিটি ঘরে প্রাকৃতিক আলো-বাতাস নিশ্চিত করতে জানালা যেমন আবশ্যক, তেমনি নিরাপত্তার অনুষঙ্গ হিসেবে জানালার সাথে চলে আসবে গ্রিলের নাম। চলুন জেনে নেয়া যাক বাড়ির দরজা, জানালা আর গ্রিল নির্বাচনের সময় যা যা মাথায় রাখা উচিৎ।
গ্রিলের ব্যবহার
বিদেশের অনুকরণে আজকাল পাল্লা দেয়া কাঠের জানালার স্থান দখল করে নিয়েছে থাই গ্লাস। এটি একদিকে যেমন এদেশের জলবায়ুর ধরনের পরিপন্থী, তেমনি বাড়ির সৌন্দর্যেও এটি যেন ঠিক সেই আগের আভিজাত্য বজায় রাখতে হচ্ছে ব্যর্থ। তারপরও খরচ এবং প্রাপ্তির হিসেবে ক্রেতাদের ঝুঁকতে হচ্ছে থাই গ্লাসের দিকেই।
সেই ব্রিটিশ আমল থেকে স্থাপত্যের সাথে বনেদিয়ানার আভিজাত্য প্রকাশেই শুরু হয় গ্রিলের ব্যবহার। বাড়ির ছাদের রেলিং, ভেন্টিলেটর, সিঁড়ির সাথে বেয়ে ওঠা রেলিংয়ে প্রচলন ছিল ফুলেল নকশার লোহার গ্রিলের ব্যবহারের। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আজও আবাসিক, অনাবাসিক প্রতিটি ভবন নির্মাণেই জানালা, বারান্দা এবং সিঁড়ির রেলিং, কলাপসিবল গেইট ও মেইন গেইটে এমন গ্রিলের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে।
প্রকারভেদ
বাংলাদেশে বর্তমানে গ্রাম এবং শহরে সর্বত্রই বাড়ি নির্মাণে বিভিন্ন ধরনের গ্রিল ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে স্কয়ার বার, ফ্ল্যাট বার, চ্যানেল বার ইত্যাদি জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে। গত দশকে রেলিং এবং প্রবেশ দরজার ক্ষেত্রে এম এস-এর তৈরি নকশাদার গ্রিলের ব্যাপক ব্যবহার দেখা গেলেও বর্তমান সময়ে এর জায়গা দখল করছে এস এস-এর তৈরি সিম্পল স্কোয়ার বার, থাই গ্রিল এবং প্লেইন শিট। সাধারণত চার সুতার স্কয়ার বার আর দেড় সুতার পাতি দিয়ে গ্রিল প্রস্তুত করা হয়। আর বাজারদর নির্ণয়ের ক্ষেত্র হয় সাধারণত ভর হিসেবে কেজিতে হিসাব বা দৈর্ঘ্যে ফুটের পরিপ্রেক্ষিতে। কেজি হিসেবে ধরে প্রতিটি গ্রিলের দাম আলাদাভাবে পড়বে কেজি-প্রতি ৮০-৮৫ টাকা। আর ক্ষেত্রফল হিসেবে বর্গফুট-প্রতি দাম পড়বে ১৫০-১৫৫ টাকা।
দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্ব এবং বাসায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য নান্দনিক ডিজাইনের পাশাপাশি, সঠিক গুণগত মান দেখে গ্রিল নির্বাচন করা প্রয়োজন। আপনার কল্পলোকের বাড়ি নির্মাণে উৎকৃষ্ট গ্রিল নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো লক্ষ্য করা প্রয়োজন, তা হলো-
১। এর উপাদানের গুণগত মান ঠিক আছে কিনা এবং সোজা আছে কিনা দেখে নেয়া
২। মসৃণতা এবং নিখুঁত ফিনিশিং
দরজার চৌকাঠ বা ফ্রেমিং নির্মাণ
বাড়ি নির্মাণের আরেকটি অপরিহার্য কাজ হলো, দরজার জন্য নিখাদ ফ্রেমিং বাছাই। বাংলাদেশে এখনও দরজা ও ফ্রেম তৈরিতে কাঠের বহুল প্রচলন দেখা যায়। ফ্রেম বানানোর ক্ষেত্রে সঠিক কাঠ বাছাই করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
সাধারণত যেসব কাঠের বহুল ব্যবহার দেখা যায় সেগুলোর মধ্যে মেহগনি, বার্মা টিক, চিটাগং শিলকড়ই, টিক চাম্বুল, চিটাগং টিক এবং লোহা কাঠের ব্যবহার অন্যতম। ফ্রেমিং এর জন্য সাধারণত দুই ধরনের পুরুত্বের কাঠ ব্যবহার করা হয়। এক ধরনের হচ্ছে ২.২৫” x ১১.৭৫” যা ১০” দেয়ালের ক্ষেত্রে, এবং অন্যটি হচ্ছে ২.২৫” x ৫.৭৫” যা ৫” ইটের দেয়ালের জন্য নির্ধারিত। এছাড়াও নিরাপত্তা ও কাঠের আবহাওয়াগত পরিবর্তনের কারণে স্টিলের দরজার ব্যবহারও পরিলক্ষিত হয়।
কোথায় পাবেন
ঢাকার ভিতর পাইকারি দরে দরজা প্রাপ্তির স্থানগুলো হলো কুতুবখালি, নয়াবাজার, পান্থপথ, বাড্ডা, রোকেয়া সরণী ও কুড়িল বিশ্বরোড। এখানে চৌকাঠ বা ফ্রেমের দাম পড়বে ২,০০০-৪,০০০ টাকা। পাইকারি বাজার ছাড়াও বিভিন্ন স্বনামধন্য কোম্পানি দরজা প্রস্তুত ও বাজারজাত করে থাকে। এই ধরনের জায়গায় দরজার ফ্রেমের দাম আকার, উপাদান এবং ডিজাইনের প্রকারভেদে ৩,০০০ থেকে ১২,০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
স্টিল বা কাঠের দরজার পানিতে নষ্ট হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। এই কারণে বাথরুমে সাধারণত প্লাস্টিকের দরজা এবং ফ্রেমিং ব্যবহার করা হয়। বংশাল এবং পান্থপথে পাল্লাসহ এধরনের দরজার দাম পড়ে সাধারণত ২,৫০০-৪,০০০ টাকা।
আমাদের কল্পনায় থাকা স্বপ্নের বাড়িকে বাস্তব রূপ দেয়ার সময় আমাদের সামনে আসে নানা সিদ্ধান্ত নেয়ার জায়গা, আসে হরেক রকম প্রশ্নও। স্বপ্নের বাড়ি নির্মাণের সময় এর কাঠামো, সৌন্দর্য ইত্যাদির দিকে আমাদের থাকে সূক্ষ্ম দৃষ্টি। ইট, বালি, সিমেন্ট, কংক্রিটের মাঝে আমরা সঠিক গ্রিল এবং দরজার ফ্রেম নির্বাচনকে প্রায়ই গুরুত্বহীন করে দেখি। কিন্তু বাড়ির সার্বিক নিরাপত্তা এবং সর্বাঙ্গিক নান্দনিকতা নিশ্চিত করার জন্য দরজা, জানালার ফ্রেম ও গ্রিলের মতো বিষয়গুলোর দিকে গুরুত্ব দেয়া উচিৎ সমানভাবেই।