নির্মাণ কাজের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো কংক্রিট। কংক্রিট হলো সিমেন্টের সাথে অন্যান্য উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত একটি জটিল সংমিশ্রণ। এক্ষেত্রে পানির সাথে অন্যান্য উপাদানের সঠিক মিশ্রণের উপর নির্ভর করে কংক্রিটের গুণগত মান। তাই সঠিক উপায়ে কংক্রিট মিক্সিং ভালো কংক্রিট পাওয়ার পূর্বশর্ত।
কংক্রিট মিক্সিংয়ের কাজটি প্রথাগতভাবে মেশিন ছাড়াই করা হতো, যাতে প্রয়োজন প্রচুর সময় এবং সুনিপুণ দক্ষতা। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে এই কষ্টসাধ্য কাজটিকে সহজ করার জন্য এসেছে কংক্রিট মিক্সার। কংক্রিট মিক্সার হলো সেই মেশিন যেখানে সিমেন্ট, পানি ও অন্যান্য উপাদান একসাথে নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশ্রিত করা হয় এবং মিশ্রণের ঘনত্ব ঠিক রেখে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঢালা হয়।
এমনকি সাইটের নির্দিষ্ট জায়গায় কংক্রিট ছিটানোর ক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিক মিক্সারও বর্তমানে পাওয়া যায়। প্রয়োজনীয়তা অনুসারে বিভিন্ন সাইজের এবং প্রকারের মিক্সার বিদ্যমান। ছোট এবং মাঝারি কাজের ক্ষেত্রে সাধারণত বহনযোগ্য মিক্সার এবং বড় কাজের ক্ষেত্রে সাধারণত সাইটে মিক্সিংয়ের প্ল্যান্ট তৈরি করে নেওয়া হয়।
কংক্রিট মিক্সারের প্রকারভেদ
আমাদের দেশে ব্যবহৃত মিক্সার মেশিন সাধারণত দুই প্রকার-
১. অবিরাম মিক্সার (Continuous Mixer)
২. সবিরাম মিক্সার (Batch Mixer)
অবিরাম মিক্সার
সাধারণত ব্রিজ, টানেল এবং বড় প্রজেক্টগুলোতে অবিরাম মিক্সার ব্যবহৃত হয়। নাম থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, এই ধরনের মিক্সার অবিরাম কাজ করে যায় এবং সাইটে বিরামহীনভাবে কংক্রিট উৎপাদন করতে থাকে। এটাতে অনবরত কাঁচামাল সরবরাহের প্রয়োজন হয়। এ মেশিনে মোট তিনটি অংশ থাকে- কাঁচামাল সরবরাহের জন্য গ্রহণ করার অংশ, মিক্সিংয়ের অংশ এবং উৎপাদিত কংক্রিট বের করে দেওয়ার অংশ। তবে এক্ষেত্রে কংক্রিটে বাতাসের পরিমাণ নির্ণয় সহজ হয় না বিধায়, তদারকির প্রয়োজন হয়।
সবিরাম মিক্সার
ব্যাচ মিক্সারের ক্ষেত্রে সাধারণত প্রতি ব্যাচ হিসাবে কংক্রিট মিক্স উৎপাদিত হয়। এ মেশিনে ঘূর্ণায়মান ব্লেডের সমন্বয়ে গঠিত ড্রামে বা প্যানে কংক্রিট মিশ্রণের কাজ করা হয়। ঘূর্ণনের গতি, ড্রামের বাঁকানোর পরিমাণ এবং ব্লেডের আবর্তন কোণ এই ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণযোগ্য।
সাধারণত ছোট এবং মাঝারি ধরনের কনস্ট্রাকশন সাইটের জন্য এই ধরনের মিক্সার ব্যবহার উপযোগী।
ব্যাচ মিক্সার আবার দুই ধরনের হয়। ড্রাম (Drum Mixer) এবং প্যান মিক্সার (Pan Mixer)।
ড্রাম মিক্সার
ড্রাম মিক্সারে কোণাকৃতি ড্রাম থাকে যাতে এক সেট বা একাধিক সেট ব্লেড সংযুক্ত থাকে, যেগুলো মিশ্রণ প্রস্তুত করা, তৈরি করা এবং উৎপাদিত কংক্রিট বের করে দেওয়ার কাজ করে থাকে। ড্রাম মিক্সার আবার তিন প্রকারের হয়ে থাকে।
১. টিল্টিং ড্রাম মিক্সার (Tilting Drum Mixer)
২. নন-টিল্টিং ড্রাম মিক্সার (Non-Tilting Drum Mixer)
৩. রিভার্সিং ড্রাম মিক্সার (Reversing Drum Mixer)
নন-টিল্টিং ড্রামের ক্ষেত্রে ড্রামটি তার অনুভূমিক অক্ষের চারদিকে ঘুরতে থাকে। এক্ষেত্রে দুটি ভিন্ন পথে কাঁচামাল দেওয়া ও বের করা হয়। রিভার্সিং ড্রাম নন-টিল্টিংয়ের মতোই, তবে এক্ষেত্রে কাঁচামাল দেওয়া ও বের করার জন্য একই পথ ব্যবহৃত হয়। টিল্টিং ড্রাম মিক্সারে মেশিনটি একটি নির্দিষ্ট কোণ বরাবর উপরে নিচে কাত হতে পারে।
প্যান মিক্সার
প্যান মিক্সারের ক্ষেত্রে ড্রামের পরিবর্তে সিলিন্ডার আকৃতির প্যান ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে প্যানটি নির্দিষ্ট জায়গায় অপরিবর্তিত থাকে এবং উলম্ব অক্ষ বরাবর ব্লেডটি ঘুরতে থাকে।
মিক্সার মেশিনের ব্যবহার
ব্যাচ মিক্সার
• হাতে মিশ্রণের চেয়ে অনেকগুণ সময়সাশ্রয়ী এবং কম কষ্টসাধ্য।
• মিশ্রণের গুণগত মান হাতে মিশ্রণের চেয়ে বেশ ভালো।
• সুষম মিশ্রণের কারণে এক্ষেত্রে কংক্রিট বেশ শক্তিশালী হয়।
• এটি তৈরি সময়সাশ্রয়ী হওয়ার কারণে ঢালাইয়ে বেশি সময় পাওয়া যায়।
• বিভিন্ন অনুপাতের মিশ্রণ তৈরি করা সম্ভব।
অবিরাম মিক্সার
• যেখানে কম স্লাম্পের কংক্রিট প্রয়োজন, যেমন- রাস্তার পেভমেন্ট, সেখানে সাধারণত এটি ব্যবহৃত হয়।
• নির্মাণকাজের ক্ষেত্রে বেশ সময়সাশ্রয়ী, তবে কংক্রিট আনলোডিংয়ের প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ।
বর্তমানে বাংলাদেশে নির্মাণকাজের সিংহভাগ ক্ষেত্রেই মেশিন মিক্সড কংক্রিট ব্যবহার করা হয়। সেক্ষেত্রে যা বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন তা হলো:
• মিক্সার মেশিনের কাছে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, মালামাল প্রস্তুত রাখতে হবে।
• মিক্সার মেশিনের কাছে এক ড্রাম পানি রাখতে হবে।
• এগ্রিগেটে ময়লা থাকলে তা অবশ্যই পরিষ্কার রাখতে হবে।
• সিমেন্টের সাথে অনুপাত ঠিক রেখে এগ্রিগেট পরিমাপের যন্ত্র প্রস্তুত রাখতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে বীম-কলাম নির্মাণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে রেডিমিক্স কংক্রিটের ব্যবহার হলেও স্থানভেদে রেডিমিক্স কংক্রিট অপ্রতুল হওয়ায়, সাইটে কংক্রিট মিশ্রণই এখনও ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। আর এক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে মিক্সিং মেশিনের ব্যবহার। মিক্সিং মেশিনের বদৌলতে প্রথাগত উপায়ে কংক্রিট মিশ্রণের কাজ প্রতিস্থাপিত হয়ে দ্রুততম সময়ে নিখুঁত কংক্রিট উৎপাদিত হয়, ফলে এই পদ্ধতিতে সময় ও কষ্ট লাঘব হওয়ার মাধ্যমে নির্মাণকাজে এসেছে নতুন মাত্রা।