গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের গল্প। ইউরোপ জুড়ে শুরু হয়েছে শিল্প বিপ্লব। সকল শিল্পে আসছে নতুন ফর্মুলা। একই ফর্মুলাতে দ্রুত গতিতে যেকোনো কাজ সেরে ফেলার নেশায় বিভোর সারা বিশ্ব। প্রযুক্তির আশীর্বাদে তখন প্রতিটি ক্ষেত্রেই চলছে বদলের গান।
নির্মাণ শিল্পে এই ফর্মুলাকে বাস্তবায়ন করতে একের পর এক যোগ হতে শুরু করল নতুন উপকরণ। প্রথমে শুরু হল রি-ইনফোর্সড কংক্রিটের ব্যবহার যেটি তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। তারপর সামনে এলো ধাতুর ব্যবহার। সেটি একসময় রূপ নিল সংকর ধাতু স্টিলের জয়জয়কারে। আর স্টিলের হাত ধরে নির্মাণে নতুন করে ফিরে এল কাচ। স্টিলের কাঠামো ও কংক্রিটের মেঝের তৈরি ভবন দ্রুত মুড়ে দিতে কাচ হয়ে উঠল কমার্শিয়াল ভবনের পরিচায়ক। এই ঘরানার নির্মাণ এত দ্রুত ও এত সহজ যে, এখনও চলছে এর জয়জয়কার।
কাচ একটি শিল্পজাত পণ্য। প্রকৃতিতে সরাসরি কাচ পাওয়া যায় না। তবে অনেক আগে থেকেই বালি গলিয়ে কাচ তৈরি শুরু হয়েছিল। একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বালি গলালে সরাসরি কাচ তৈরি করা যায়। তবে সময় যত গড়িয়েছে এই শিল্পকে সহজতর করেছে বিজ্ঞান। রোমান প্রক্রিয়া থেকে কাচ তৈরি সহজতর করতে ইসলামি কাচশিল্পীদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে।
বর্তমানে কাচ তৈরি করা হয় সিলিকা বা কাচবালির সাথে সোডা, ডলোমাইট, চুনাপাথর, ফেলস্ফার, সোডিয়াম নাইট্রেট ও কয়লার পাউডার মিশিয়ে। বাংলাদেশের বাজারে সাধারণত দুই ধরনের কাচ দেখা যায়। সাধারণ কাচ ও ক্রিস্টাল গ্লাস। সাধারণ গ্লাস কাটলে সবুজাভ রং দেখা যায়। ক্রিস্টাল গ্লাস সেই তুলনায় একদমই পরিষ্কার। গ্লাস উৎপাদনের সময় এর পুরুত্ব (Thickness) নির্ধারণ করা হয়। সাধারণত ৩ থেকে ১২ মিলিমিটার পুরুত্বের কাচ খোলা বাজারে দেখা যায়। ৫ ও ১০ মিলিমিটার কাচ ভবনের ভেতরে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। ভবনের বাইরে ২০ মিলিমিটার পর্যন্ত পুরুত্বের গ্লাস প্যানেল ব্যবহার করা হয়।
Urban Scene Skyline Morning View Metropolis Concept
ভবনে কাচের ব্যবহার জনপ্রিয় হবার অন্যতম প্রধান কারণ এর স্বচ্ছতা। ভবনের ভেতরে ধুলা প্রবেশ বন্ধ করে একই সাথে আলোর প্রবেশ নিশ্চিত করতে প্রথমে জানালায় কাচ ব্যবহার শুরু হয়। কাচের জানালাতে খরচও কমে যায় শিল্পপণ্য হিসাবে কাচ সহজলভ্য হওয়াতেই। কাচের সহজলভ্যতা ও তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যই কাচকে এতটা জনপ্রিয় করেছে। এই সূলভ মূল্যের কারণেই কাচের জানালা ভবনের বাইরের অংশের মূল উপাদান হয়ে ওঠার শুরু।
ইট বা কংক্রিটের নির্মাণ একইসাথে যেমন একের বেশি উপাদান দাবি করে তেমনি এর পেছনে বিনিয়োগ করতে হয় প্রচুর সময়, অর্থ ও শ্রম। এছাড়া নির্মাণ শেষ হলে উপরে দিতে হয় ফিনিশিং ম্যাটেরিয়াল, যেমন- টাইলস বা মোজাইক। কাচ ব্যবহার এই তুলনায় রীতিমত ঝামেলামুক্ত। শুধুমাত্র স্থাপন ও পরিষ্কার করলেই নির্মাণ শেষ করে ফেলা সম্ভব বলে ব্যবসায়িক ভবনের ক্ষেত্রে এটি বেশি জনপ্রিয়।
তবে কাচের ব্যবহারকে তুমুল জনপ্রিয় করেছে মূলত দুটি ঘটনা।
১. কাঠামো নির্মাণ শিল্পে ধাতুর জয়যাত্রা
২. শিল্প বিপ্লবের পর নতুন নান্দনিকতার বিকাশ
প্রথমে বিশুদ্ধ ধাতু ও পরে সংকর অর্থাৎ স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের নির্মাণে বড় জায়গা করে নেওয়াতে তাদের সাথে মানানসই নির্মাণ উপকরণের চাহিদা বাড়ে। প্রথমে কংক্রিট ও ইট দিয়ে চেষ্টা করা হলেও কম ভর, নির্মাণের সহজ প্রক্রিয়া এবং বদলে ফেলার সুবিধার কথা বিবেচনায় রেখেই কাচ হয়ে ওঠে ভবনের এক্সটেরিয়রের জন্য সবচেয়ে উপযোগী উপাদান।
বর্তমানে প্যানেল আকারে আলাদা কাচ নির্মাণের জন্যই তৈরি করা হয় এবং এগুলো জুড়ে দিয়ে তৈরি হয় বিশ্বের প্রায় ৮০% বাণিজ্যিক ভবন। এছাড়া অন্দরসজ্জাতেও বিশেষ করে অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সজ্জায় কাচ হয়ে উঠেছে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
আলোর সহজাত প্রবেশ যেমন কাচের আশীর্বাদ, তেমনি এক্ষেত্রে অভিশাপ হলো বাতাসের প্রবাহ রোধ। কাচ দিয়ে তৈরি ভবনের বহির্ভাগ সাধারণত নড়াচড়া করানো যায় না। তাই সরাসরি বাতাস এতে প্রবেশ করতে পারে না। আর সূর্যরশ্মি যে তরঙ্গদৈর্ঘ্য নিয়ে প্রতিসরিত হয়ে কাচের ভেতর প্রবেশ করে ভেতরে ঢুকে সেটি অনেক বেড়ে যায়। ফলে ভেতর থেকে খুব বেশি তাপ বাইরে আসতে পারে না। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় গ্রিনহাউজ প্রক্রিয়া।
এই সমস্যার সমাধান করতে ভবনে প্রচুর পরিমাণে যান্ত্রিক তাপনিয়ন্ত্রক যন্ত্র বা এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহার করতে হয়। যেটি বাইরের বাতাসকে ঠাণ্ডা করে ভেতরে প্রেরণের পাশাপাশি ভেতরের গরম বাতাসকে সরাসরি বাইরে বের করে দেয়। এর ফলে ভবন ভেতরে ঠাণ্ডা হলেও বাইরে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে।
কাচের আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে এর প্রতিফলন। আলো এবং তাপ প্রতিসরণের পাশাপাশি প্রতিফলিতও হয় কাচে। ফলে সূর্যরশ্মির তাপ ভবনের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া কাচের আলোকচ্ছটা বা গ্লেয়ারেও (Glare) অনেক ক্ষেত্রে আশেপাশের মানুষের বেশ সমস্যা হতে পারে। আলোর প্রতিসরণ কমাতে অনেক ক্ষেত্রে টিন্টেড আউট বা অস্বচ্ছ বা আধা-স্বচ্ছ কাচ ব্যবহার করা হয়। এতে ভেতরের তাপমাত্রা কমলেও প্রতিফলনের হার বাড়ে। এই ধরনের কাচগুলো সাধারণত নীল বা সবুজ হয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভবনের চেহারাতেও বেশ খারাপ প্রভাব ফেলে এরকম অতিগ্রাসী রং।
তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করে রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি। কাচ সুলভ ও সাশ্রয়ী হলেও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ দাবি করে। বাংলাদেশে সূর্যের কৌণিক অবস্থান, বৃষ্টির আধিক্য, ঢাকা শহরের বাতাসে বিদ্যমান সাধারণের চেয়ে বেশি ধুলোবালি এবং বহুতল ভবনের রক্ষণাবেক্ষণে প্রযুক্তির অভাব বাংলাদেশে ভবনে ব্যবহৃত কাচের সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয় খুব দ্রুত। ৫-১০ বছরের মধ্যেই কাচের রং নষ্ট হওয়া এবং ফাটলের অভিযোগও শোনা যায় বেশ। তবে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে মনোযোগী হলে এ সমস্যা কাটানো সম্ভব।
ভবনের ভেতরে বর্তমানে ফুল হাইট কাচের পার্টিশনের ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এছাড়া অ্যালুমিনিয়াম প্যানেল দিয়ে স্লাইডিং দরজা ব্যবহার হচ্ছে বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে। এগুলো দামে সাশ্রয়ী ও সহজ ব্যবহার্য হলেও ঘরের বাতাস প্রবাহ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বেশ চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। তবুও পরিবর্তনের সুবিধা এবং নিয়ন্ত্রণের সারল্য একে ইন্টেরিয়র শিল্পে একই অবস্থানে রাখবে অনেকদিন।
ভবনের বাইরের ও ভেতরের পরিবেশের কথা বিবেচনা করলে কাচ দীর্ঘ সময়ের জন্য খুব উপকারী উপাদান নয়। কিন্তু নির্মাণ নান্দনিকতা, খরচের সাশ্রয় ও একই রকম স্বচ্ছ উপকরণ হিসেবে বিকল্প না থাকায় কাচের ব্যবহার অব্যাহত থাকবে আরও অনেকদিন। নির্মাণে কাচের ব্যবহারে তাই হতে হবে হিসেবি, হতে হবে পরিবেশ সচেতন এবং রক্ষণাবেক্ষণে মনোযোগী।
কাচের সাথে সোলার প্যানেল যুক্ত করে দেয়া কিংবা অপারেবল ডিজাইনের মতো কৌশল ব্যবহার করে কাচের প্রভাবকে যেমন পরিবেশবান্ধব করা যায়, তেমনি ভবনের সৌন্দর্যকে বাড়ানো যায় বহুগুণে। এছাড়া রক্ষণাবেক্ষণে মনোযোগী হলে ভবনের চেহারার পাশাপাশি দীর্ঘস্থায়ী হয় ব্যবহার উপযোগিতাও। তাই উপকরণ হিসেবে কাচের কিছু সমস্যা থাকলেও প্রশিক্ষিত স্থপতির চিন্তাশীল নকশা, দক্ষ প্রকৌশলীর নির্মাণ এবং নির্মাতার সদিচ্ছা কাচকে করে তুলতে পারে ভবনের জন্য আশীর্বাদ।