নির্মাণকাজে পাথরের ব্যবহার কতকাল আগে শুরু হয়েছে তা বলা মুশকিল। কেননা, পশু শিকার করতে পাথরের হাতিয়ার বানানো মানুষেরা যখন বসতবাড়ি নির্মাণ শিখলো, তা পাথর দিয়েই নির্মাণ করতো, এটি অনুমেয়। ধরে নেয়া যায়, নির্মাণকাজের সবচেয়ে আদিম উপাদান পাথর। দৃঢ়তা ও স্থায়িত্বের জন্য পাথর নির্মাণকাজে বহুল প্রচলিত। বিশেষ করে ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণ, ছাদ ঢালাই, হাইওয়ে কিংবা ব্রিজের ভায়াডাক্ট তৈরিতে পাথরের বিকল্প নেই। কেননা, এসব স্থাপনা দীর্ঘ সময়ের জন্যই নির্মাণ করা হয়। তবে স্থায়িত্ব ছাড়াও পাথরের ব্যবহার সৌন্দর্যের সাথেও সম্পৃক্ত। দেয়াল বা মেঝের নান্দনিকতা বৃদ্ধিতেও ব্যবহার করা হয় নানা রকমের পাথর।
চলুন, দেখে নেয়া যাক নির্মাণকাজে ব্যবহৃত সবচেয়ে জনপ্রিয় কিছু পাথর ও সেসবের ব্যবহারবিধি।
ব্যাসল্ট (Basalt)
নির্মাণকাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পাথরগুলোর একটি ব্যাসল্ট। এটি একপ্রকার আগ্নেয় শিলা যা ভূগর্ভস্থ উত্তপ্ত গলিত পাথর চাপে জমে কঠিন পাথরে পরিণত হয়। এরূপ প্রক্রিয়ার কারণে এর গঠন অত্যন্ত ঘন ও মজবুত, এবং নির্মাণকাজে এর ব্যবহার স্থাপনাকে দৃঢ়তা দেয়। সাধারণ রাজমিস্ত্রীর কাজ থেকে শুরু করে ব্রিজের পিলার নির্মাণ, নদীতে বাঁধ নির্মাণ, কিংবা বৃহৎ স্থাপনায় ব্যাসল্টের কংক্রিটের মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়।
ব্যাসল্ট সাধারণত ধূসর এবং কালো বর্ণের হয়। এটি অত্যন্ত দৃঢ় হওয়ায় ইচ্ছেমতো আকৃতি প্রদান করা কঠিন। এর দৃঢ়তা ২০০-৩০০ মেগাপ্যাসকেল (Megapascal) প্রেসার ইউনিট বা এমপিএ। আর্দ্রতা ও প্রতিকূল পরিবেশে ব্যাসল্টের সহনশীলতা বেশ ভালো।
গ্রানাইট (Granite)
বড় নির্মাণকাজে, যেমন- ব্রিজের পিলার, বাঁধরক্ষা দেয়াল থেকে শুরু করে বাসাবাড়ির দেয়ালে আর্দ্রতারোধী আস্তরণ, রেললাইনের স্লিপার, ছাদের বহিরাবরণ ইত্যাদি নির্মাণে গ্রানাইট ব্যবহার করা হয়। এটি ব্যাসল্টের তুলনায় কিছুটা কম হলেও বেশ দৃঢ় এবং টেকসই একটি পাথর। এর ঘনত্ব অনেক বেশি হওয়ায় এর ভেতরে দীর্ঘদিনেও পানি প্রবেশ করতে পারে না।
গ্রানাইটের দৃঢ়তা ২৫০ মেগাপ্যাসকেল। হালকা ধূসর থেকে কিছুটা গোলাপী রঙেরও হয়ে থাকে গ্রানাইট। এর শোষণক্ষমতা অত্যন্ত কম হওয়ায় যেসব স্থানে অধিক আর্দ্রতা থাকে সেখানে এটি ব্যবহার করা হয়, যেমন- রেস্টুরেন্টের খাবার টেবিলের ওপর কিংবা পিলারের আবরণ হিসেবে।
স্যান্ডস্টোন (Sandstone)
ভাবছেন স্যান্ড বা বালুর আবার পাথর হয় কী করে? স্যান্ডস্টোন আসলেই বালুর পাথর, তবে এর গঠন প্রক্রিয়া দীর্ঘ। অন্যান্য পাথরের ক্ষয় হয়ে যাওয়া ধূলিকণা আর স্ফটিক বিভিন্ন প্রাকৃতিক খনিজের সাথে মিশ্রিত হয়ে সময়ের আবর্তে জমাট বেঁধে শক্ত পাথরের রূপ নিলে তাকে আমরা স্যান্ডস্টোন বলি।
স্যান্ডস্টোন মূলত নির্মাণকাজে সাজসজ্জায় ব্যবহৃত হয়। লাল, সাদা, হলুদ, ধূসর, কালচে, পীত বর্ণসহ স্যান্ডস্টোন এর বৈচিত্র্যময় রঙের জন্য দেয়াল, সিঁড়ি বা অন্যান্য নির্মাণে সৌখিন উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অবশ্য বড় বড় নির্মাণকাজেও প্রয়োজনভেদে এই পাথরের ব্যবহার হয়ে থাকে।
চুনাপাথর (Limestone)
চুনাপাথর সকল প্রকার নির্মাণকাজে ব্যবহারের উপযোগী নয়। এর ঘনত্ব সাধারণত কম হয়, ফাটল থাকে এবং কাদামাটিতে তৈরি হওয়ায় নমনীয় ও ভঙ্গুর হয়। অবশ্য ফাটলহীন, ঘন ও মজবুত চুনাপাথর ঘরের মেঝে, ছাদ কিংবা ফুটপাতের আবরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর একটি অসুবিধা হলো- শিল্পকারখানার দূষিত বাতাসে এবং সমুদ্র তীরবর্তী লবণাক্ত বাতাসে এর ক্ষয় হয়।
মার্বেলপাথর (Marbel)
মাত্র ৭০-৭৫ এমপিএ চাপ সহনশক্তির মার্বেলপাথরের ব্যবহার অনুমিতভাবেই নির্মাণকাজে অবকাঠামো তৈরিতে ব্যবহৃত হয় না। এটি মূলত নির্মাণশৈলির নান্দনিকতার অংশ। এর সবচেয়ে বড় গুণ হলো একে চমৎকারভাবে পালিশ (Polish) করে ইচ্ছেমতো আকার দেয়া যায় এবং আরামদায়ক, চকচকে ও মসৃণ করা যায়।
মার্বেলপাথর টাইলস নামেই সর্বাধিক পরিচিত। বাসাবাড়ির মেঝে, রান্নাঘর আর গোসলখানায় মার্বেলপাথরের ব্যবহার এখন অবশ্যম্ভাবী। দেয়াল কিংবা পিলারের সৌন্দর্য বাড়াতে মার্বেলের ব্যবহারের বিকল্প নেই। মার্বেলের ওপর নানারকম ডিজাইন করিয়ে কিংবা নাম লিখিয়েও এটি ব্যবহার করা হচ্ছে নির্মাণকাজে।
স্লেট (Slate)
স্লেট হলো পাললিক শিলাজাত একপ্রকার রূপান্তরিত শিলা যা ভূগর্ভের উচ্চচাপে গঠিত হয়। গঠন ঘন হওয়ায় এই পাথর সমান্তরালে কাটা যায় এবং পালিশ করে মসৃণ করে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যায়। অত্যধিক ভার বহনে অক্ষম হওয়ায় ভবন বা বড় কোনো অবকাঠামো নির্মাণে স্লেট ব্যবহার করা হয় না। সাধারণত বাড়ির ছাদের ক্ষয়রোধী আস্তরণ, স্ল্যাব, ফুটপাতের কার্পেটিং, মেঝেতে স্লেট ব্যবহার করা হয়।
কোয়ার্টজাইট (Quartzite)
কোয়ার্টজাইটের দৃঢ়তা ৫০-২০০ এমপিএ। এতে বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান থাকায় সাধারণ নির্মাণকাজে এর ব্যবহার কম। তবে অধিক মজবুত কোয়ার্টজাইট বিল্ডিং ব্লক, স্ল্যাব, কার্পেটিং, কিংবা কখনো কখনো কংক্রিটের মিশ্রণেও ব্যবহৃত হয়।
কোয়ার্টজাইটের সবচেয়ে উপযোগী ব্যবহার হলো রেলওয়ে ব্যালাস্ট (রেললাইনে বিছিয়ে রাখা পাথর) হিসেবে। তাছাড়া শিল্পজাত সিলিকা বালু প্রস্তুত করার অন্যতম প্রধান উপাদান হলো কোয়ার্টজাইট। মেঝেতে টাইলস হিসেবে, দেয়ালে বা সিঁড়িতে কোয়ার্টজাইটের মসৃণ আকৃতি ব্যবহার করা হয়। হলুদ, ধূসর, সাদাসহ নানা রঙের কারণে ইন্টেরিয়র ডিজাইনে কোয়ার্টজাইটের ব্যবহার জনপ্রিয়। কোয়ার্টজাইটের আরেকটি বড় গুণ হলো- এতে সহজে দাগ পড়ে না, আঁচড় লাগে না, চিটচিটে হয় না। তাই কিচেন কাউন্টারটপ (রান্নাঘরে যে পৃষ্ঠের ওপর খাদ্যদ্রব্য কাটা হয় বা রান্নার উপকরণ প্রস্তুত করা হয়) তৈরিতে কোয়ার্টজাইট একটি আদর্শ উপাদান।