নির্মাণশিল্পের অন্যতম প্রধান উপকরণ কংক্রিটের বহুমুখী ব্যবহার আমাদের কারও অজানা নয়। আধুনিক সময়ে রঙিন কংক্রিটের ব্যবহার একদিকে যেমন সাজসজ্জাকে করে তুলছে অর্থবহ, অন্যদিকে স্থাপনায় যোগ করছে নতুন মাত্রা। বাড়ির সজ্জা অধিকতর দৃষ্টিনন্দন করতে প্রথাগত কংক্রিটের বদলে বর্তমানে রঙিন কংক্রিটের ব্যবহার বেশ বাড়ছে।
রঙিন কংক্রিটের উদ্ভাবন ও ব্যবহার
খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ সালের দিকে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর নির্মাণের ক্ষেত্রে কংক্রিটের স্বল্পবিস্তর ব্যবহার শুরু হয়। এসময় কেবলমাত্র মৌলিক স্থাপনার মধ্যেই এর সীমা পরিসর ছিল। পরবর্তীতে প্রয়োজনের তাগিদে কিংবা নতুন নতুন নকশার উদ্ভাবনের চেষ্টাতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে রঙিন কংক্রিটের ব্যবহার। অর্থ্যাৎ রঙিন কংক্রিট যে নির্মাণজগতে নতুন কিছু, তা কিন্তু নয়। ১৮৯০ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে কংক্রিট উৎপাদনকারীরা সর্বপ্রথম পরীক্ষামূলকভাবে প্রি-কাস্ট কংক্রিটের উপর এই কাজ করেন। তখন দুই পদ্ধতিতেই রঙিন কংক্রিট প্রস্তুত করা হতো।
● কাস্টিংয়ের সময় ফ্রেশ কংক্রিটের সাথে রং মিশিয়ে’
● রাসায়নিক রঙিন দ্রব্যের মধ্যে কংক্রিট ঢেলে দিয়ে
উৎপাদনকারীরা বিভিন্ন অনুপাতে রং মিশিয়ে মৌলিক রঙের সাথে সাথে সব ধরণের রং তৈরির প্রণালী উদ্ভাবন করতে থাকেন। ১৯২০ থেকে ১৯৪০ এর মধ্যে পাশ্চাত্যে বিভিন্ন শৌখিন বাড়িঘর এবং সরকারি স্থাপনার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিই অনুসরণ করা হয়। ১৯২০ সালে কংক্রিটের সাথে মেশানোর জন্য এই রং ‘লিন ম্যাসন’ নামে একটি সংস্থা তৈরি করত। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সাইটেই ব্রোমাইট পদ্ধতি অনুসরণসহ নানা উপায়ে কাজ চলতে থাকে রঙিন কংক্রিটের।
রঙিন কংক্রিট তৈরির নিয়মাবলী
● কংক্রিটের স্তর বসানোর সাথে সাথে গুঁড়ো রং ব্রাশের সাহায্যে কংক্রিটে যোগ করা।
● কংক্রিটের স্তর ঢালার আগেই এর সাথে তরল বা গুঁড়ো রং মিশিয়ে রঙিন কংক্রিট প্রস্তুত করা।
রঙের উপাদানসমূহ কংক্রিট বা সিমেন্টের চেয়ে অনেক ছোট বিধায় এই পদ্ধতিতে তারা কংক্রিটের স্তরকে সম্পূর্ণরূপে আবৃত করে রঙিন করে তোলে। তবে উভয়ক্ষেত্রেই প্রাকৃতিক কিংবা প্রক্রিয়াজাত আয়রন-অক্সাইড ব্যবহৃত হয়।
উপরে বর্ণিত এই দুই প্রক্রিয়ার কোনটি ব্যবহার করা হবে তা নির্ভর করে নকশা ও যে তলে প্রয়োগ করা হবে তার ধরনের ওপর। কারণ, উভয় ক্ষেত্রেই বেশ কিছু সুবিধা-অসুবিধা বিদ্যমান। যেমন-
● গুঁড়ো রং ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বল্প ব্যয়ে এবং কম পরিশ্রমে কাজ করা সম্ভব হলেও এর স্থায়িত্ব কম।
● দ্বিতীয় প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে তা বেশ কষ্টসাধ্য এবং কিছুটা ব্যয়বহুল হলেও এর স্থায়িত্ব বেশি।
রঙিন কংক্রিটের ধরন
বর্তমানে ভিত্তি বা বেইজের উপর ভিত্তি করে কয়েক ধরণের রঙিন কংক্রিটের বহুল প্রচলন দেখা যাচ্ছে। যেমন- এসিড বেইজ, ওয়াটার বেইজ, কংক্রিট বেইজ ইত্যাদি। এদের রঙের তারতম্যের সাথে সাথে ব্যবহারেও কিছুটা পার্থক্য আছে। এসিড বেইজের রঙিন কংক্রিট নীলাভ সবুজ ও মাটি রং হয়ে থাকে এবং ব্যবহারেও কিছুটা ঝুঁকি রয়েছে। অন্যদিকে পানি কিংবা কংক্রিট বেইজগুলো যেকোনো রঙের হয়ে থাকে এবং ব্যবহারেও তুলনামূলকভাবে সহজ।
রঙিন কংক্রিটের সুবিধাগুলো
বাহ্যিক সৌন্দর্য ছাড়াও রঙিন কংক্রিটের জনপ্রিয়তার পেছনে আরও কিছু কারণ ক্রিয়াশীল। যেমন-
● স্থায়িত্ব: কংক্রিটের স্থায়িত্ব যেমন অন্যান্য সব উপাদানের চেয়ে বেশি তেমনি রঙিন কংক্রিটও একইরকম স্থায়িত্ব প্রদর্শন করে।
● স্থিতিস্থাপকতা: রঙের সাথে সাথে বিভিন্ন ধরনের টেক্সচার নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে এখানে।
● রঙের ভারসাম্য: এক ব্যাচে তৈরি সকল কংক্রিট একদিকে যেমন রঙের দিক থেকে অন্যান্য ব্যাচ অপেক্ষা আলাদা তেমনি একরকম কংক্রিটগুলো নিজেদের মধ্যে রঙের ভারসাম্য বহন করে।
● বৈরি আবহাওয়ার উপযোগিতা: খারাপ পরিবেশে নষ্ট না হয়ে টিকে থাকার গুণ বিদ্যমান রঙিন কংক্রিটের মধ্যে।
রঙিন কংক্রিটের ব্যবহার ও যত্ন
সাধারণ কংক্রিটের চেয়ে দামে কিছুটা বেশি হলেও এর বহুবিধ ব্যবহারের কারণে বর্তমানে নির্মাণশিল্পে রঙিন কংক্রিট বেশ ভালো জায়গা দখল করে নিচ্ছে। কয়েক লেয়ারের পথচারী চলাচলের রাস্তা, বাগানের শোভাবর্ধন, টেক্সচার মিশিয়ে ঘরের মেঝেসহ নানা কাজে রঙিন কংক্রিট ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে বিশাল রেঞ্জের রঙের সমাহার থাকায় যেকোনো রংকে নিজের নকশায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে। কেবল বাইরের দিকে নয়, বরং ঘরের ভিতরেও রঙিন কংক্রিটের সাহায্যে আলাদা করে কোনো এক জায়গা বিশেষায়িত করা সম্ভব। যেমন- ফায়ারপ্লেস, বইয়ের কর্নার ইত্যাদি।
কম প্রেশারের স্প্রেয়ার, ব্রাশ বা স্পঞ্জের সাহায্যে সাধারণত এদের প্রয়োগ কিংবা যত্ন নেয়া হয়। এক্ষেত্রে ধাতব স্পর্শ থেকে দূরে রাখার জন্য বলা হয়ে থাকে। এসিড থাকলে সেক্ষেত্রে কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করতে হয় রং শরীর কিংবা কাপড়ের স্পর্শ থেকে দূরে রাখা আবশ্যক। এক্ষেত্রে সাবধানতার জন্য রং মিশানোর ক্ষেত্রে ছোট সাইজের মিক্সার ব্যবহার করা যেতে পারে।
রঙিন কংক্রিটের ব্যবহার ধূসর রঙের কংক্রিটের ধারণা পাল্টে নতুন করে সৌন্দর্যের ধারণার সূচনা করছে। বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি ছাড়াও বর্তমানে লোকালয় কিংবা বাড়িঘরের নানা কাজে এই কংক্রিটের ব্যবহার এর বহুমুখিতারই পরিচায়ক।