আধুনিক শহরের বাসা বাড়িগুলো এখন টাইলস ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। যে পোড়ামাটির টাইলসের ব্যবহার শুরু হয়েছিল প্রায় সাত হাজার বছর আগে মিসরীয় সভ্যতায়, তা এখনকার সময়ে মেঝে ও দেয়ালের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নির্মাণ সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। ‘টাইলে- tuile’ ফ্রেঞ্চ শব্দ থেকে টাইলস শব্দটা এসেছে, তবে এরও অনেক আগে ল্যাটিন ভাষায় ‘টেগুলা-Tegula’ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। টাইলসের বিকল্প হিসেবে ফ্লোর বা দেয়ালে আরো বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হয়ে থাকে। একসময় শুধু সিমেন্ট নেট ফিনিশিং দিয়ে ফ্লোর ফিনিশিং করা হত এবং পরে মোজাইকের কাজ খুব জনপ্রিয় ছিল। অনেক ফ্লোরে আবার মার্বেল বা গ্রানাইট ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে টাইলসের ব্যবহারই এখন সবচেয়ে জনপ্রিয়। কারণ হিসেবে রয়েছে স্থাপনের সময়, দীর্ঘস্থায়িত্ব, সৌন্দর্য, সহজ পরিচর্যা ইত্যাদি। এছাড়াও টাইলস ব্যবহারের জন্যে রয়েছে নানাবিধ কারণ। যেমনঃ
# অল্প সময়ে স্থাপন করা যায় ও সহজে যত্ন নেওয়া যায়
# দেয়ালে ব্যবহারের ক্ষেত্রে রঙ করার প্রয়োজন হয় না
# দেয়ালে নোনা ধরার সম্ভাবনা থাকে না
# মেঝে সমতল থাকে, আঘাতে সহজে ভাঙ্গে না
# সহজে স্ক্র্যাচ বা মরিচা পড়ে না এবং আগুন প্রতিরোধী
# টাইলস সহজে প্রতিস্থাপন করা যায় ও রক্ষণাবেক্ষণ সহজ
# মোজাইক ও মার্বেলের চেয়ে তুলনামূলক কম খরচ ও বেশিদিন টেকে
চিত্রঃ টাইলস বসানো হচ্ছে
বিভিন্ন টাইলসের ব্যবহার
সিরামিক টাইলসঃ যেকোন দেয়ালে লাগানোর উপযোগী।
মিরর পলিশড টাইলসঃ ফ্লোরের উপযোগী উন্নতমানের টাইলস।
হোমোজিনিয়াস টাইলসঃ ফ্লোরের জন্য সাশ্রয়ী দামের টাইলস।
রাস্টিক টাইলসঃ দেয়াল ও ফ্লোর দুই জায়গাতেই উপযুক্ত।
টাইলস কেনার সময় কি কি জিনিস খেয়াল রাখতে হবেঃ
# দুটি একই টাইলস পাশাপাশি রেখে রঙ ও শেপ মিলিয়ে নিন
# ফ্লোর টাইলস-এর ক্ষেত্রে চারটি টাইলস পাশাপাশি রেখে কোণ ও জয়েন্ট মিলিয়ে নিন
# মিরর পলিশড টাইলস-এ আলোর প্রতিফলন লাইটের নিচে ধরে দেখতে পারেন
# টাইলস কতটা পানি শোষণ করে তার একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে, আপনার পছন্দের ব্র্যান্ড সেটির ভেতরে কিনা জেনে নিন। একটি টাইলস পানির সংস্পর্শে আসলে যত ভাগ পানি শোষন করে, সেটাই পানি শোষন ক্ষমতা। যত কম পানি শোষন করবে, তত ভালো মানের টাইলস। বেশি পানি শোষনকারী টাইলস সহজে ভেঙে যেতে পারে, ধীরে ধীরে উজ্জ্বলতা হারাবে।
বিভিন্ন টাইলস–এর পানি শোষণ ক্ষমতা
• ফ্লোর টাইলস ৩-৭%
• ওয়াল টাইলস ১০-২০%
• পোরসেলিন ফ্লোর টাইলস ০.৫% এর কম
• মিরর পলিশড টাইলস ০.৫% – ৩%
টাইলস বসাতে যে উপাদানগুলো লাগবে
১। সিমেন্ট
২। টাইলস
৩। বালি
৪। পিগমেন্ট
৫। হোয়াইট সিমেন্ট
মশলার অনুপাত (সিমেন্টঃবালি)
ফ্লোরে ১:৪ এবং দেয়ালে ১:৩
এক ব্যাগ সিমেন্টের সাথে ৩ ব্যাগ বা ৪ ব্যাগ বালি মিশিয়ে শুকনা অবস্থায় এমনভাবে মিক্সিং করতে হবে যেন মিক্সারটি দেখতে ছাই রঙ এর মত হয় এবং অভিন্ন দেখায়। এরপর পরিমিত পানি দিয়ে পুনরায় ভালোভাবে মিক্সিং করতে হবে। তবে মনে রাখা জরুরি, এক ঘন্টার মধ্যেই বানানো মশলা ব্যবহার করে ফেলতে হবে। মশলার উচ্চতা ২ থেকে ৩ সেন্টিমিটার এর মধ্যে হতে হবে। সিমেন্ট মিকশ্চার ছাড়াও রেডি মিক্স সিমেন্ট মিকশ্চার ব্যবহার করা যেতে পারে।
টাইলস লাগানোর পূর্বে যে বিষয়গুলো দেখতে হবে
১। ইলেকট্রিক্যাল পাইপ বা পয়েন্টগুলো ঠিকভাবে বসানো হয়েছে কিনা।
২। MK Steel Box ঠিকভাবে লাগানো হয়েছে কিনা।
৩। পানির লাইনগুলো যথাযথভাবে বসানো হয়েছে কিনা।
৪। টাইলস বসানোর আগে অবশ্যই পানির লাইনের প্রেশার চেক করে নেয়া উচিত।
৫। যেখানে টাইলস লাগাবেন, সেই জায়গা আগে থেকে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
৬। ইটের গাঁথুনির ময়লা পরিষ্কার করতে হবে এবং জয়েন্টগুলো পরিষ্কার করতে হবে।
৭। পানি দিয়ে দেয়াল ভেজাতে হবে।
৮। টাইলস ফিটিং করার ২ ঘন্টা পূর্বে তা হাফ ড্রাম পানিতে ভিজাতে হবে এবং বসানোর আধা ঘন্টা আগে পানি থেকে উঠিয়ে রাখতে হবে।
টাইলস লাগানোর পদ্ধতি
১। ফ্লোরে টাইলস লাগানোর আগে ওয়াটার পাইপ দিয়ে পুরো ফ্লোরের লেভেল মার্ক করে নিতে হবে। এরপর মশলা দিয়ে একটি টাইলস বসিয়ে ফ্লোরে পায়া করে নিতে হবে। এরপর সুতা বেঁধে ফ্লোর টাইলসগুলো বসাতে হবে।
২। দেয়ালের ক্ষেত্রেও মশলা দিয়ে পায়া করতে হবে যেন উলম্ব সারি ঠিক থাকে। বর্ডার থাকলে তা হিসাবের মধ্যে এনে লাইন-বাই-লাইন টাইলস বসাতে হবে।
৩। টাইলস লাগানোর সময় কাঠ বা রবারের হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করতে হবে যেন ভিতরে কোন ফাঁপা না থাকে।
৪। টাইলসের মধ্যকার জয়েন্টগুলো একই রকম হতে হবে এবং যেন ২ মিলিমিটারের চেয়ে বেশি না হয়।
৫। যতটুকু সম্ভব দরজা খোলার পর টাইলসের কাটপিস যেন না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং ১.৫” এর বেশি কাটপিস যেন না হয়।
৬। টাইলস যেন চৌকাঠের উপরে না উঠে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
৭। ফ্লোর টাইলস পুরো ইউনিটে এক জয়েন্ট হতে পারে অথবা অথবা কমন এরিয়া বা রুম বাই রুম আলাদা হতে পারে।
৮। স্কার্টিং এর উচ্চতা সাধারণত ৪” হয় এবং দেয়ালে ফ্ল্যাশ হলে ভালো তা নাহলে ময়লা জমে।
৯। নূন্যতম ৭ দিন কিউরিং করতে হবে।
১০। সবশেষে দেয়াল বা ফ্লোর টাইলস এর জয়েন্টগুলো ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। টাইলসের রঙ মিলিয়ে হোয়াইট সিমেন্ট ও পিগমেন্ট দ্বারা পুটি বানিয়ে পয়েন্টিং করতে হবে।
১১। পয়েন্টিং করার পর সাদা মার্কিং কাপড় দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে এবং ২ দিন ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে টাইলস মুঝতে হবে।
সমস্যা ও সমাধান
১। টাইলস লাগানোর পর ডফডফ শব্দ করে।
এরকম সমস্যা দেখা দিলে ঐ টাইলস পুনরায় ভেঙ্গে আবার করতে হবে। লাগানোর সময় টাইলসের সবদিকে মশলা ঢুকছে কিনা দেখে নিতে হবে এবং কাঠের বা রবারের হাতুড়ি দিয়ে এরকম শব্দ যেন না হয়ে সেটা পরীক্ষা করে নিতে হবে।
২। টাইলস উঁচু-নিচু দেখা দিলে এই টাইলসও ভেঙ্গে পুনরায় আবার টাইলস বসাতে হবে। স্প্রিট লেভেল দিয়ে বারবার চেক করে নিতে হবে।
৩। টাইলসের সাইডে দাগ দেখা দিলে ছোট দাগ হলে পয়েন্টিং করে ঠিক করতে হবে কিন্তু বড় হলে টাইলস ভেঙ্গে নতুন টাইলস বসাতে হবে।
৪। পয়েন্টিং উঠে গেলে ভালো করে পরিষ্কার না করলে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৫। টাইলস লাগানোর পর চৌকাঠ টাইলসের ভিতর চলে গেলে চৌকাঠটি ঠিকভাবে বসানো হয়েছে কিনা দেখতে হবে।
টাইলসের যত্ন
# কোনো ধরনের কালচে দাগ যেন না হয়, সে জন্য প্রতিদিনই ঘর পানি দিয়ে মুছতে হবে।
# টাইলসের ওপর যেন পানি জমে না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
# সাধারণত টাইলসের জোড়া লাগানো স্থানের কোনায় কোনায় ময়লা জমে কালচে দাগ পড়ে, তাই সপ্তাহে অন্তত এক দিন ডিটারজেন্ট পাউডার গোলা পানি কিংবা ফোমে সাবান বা লিকুইড ক্লিনার ব্যবহার করা যেতে পারে। খুব শক্ত ব্রাশ ব্যবহার করা যাবে না, এতে স্ক্র্যাচ পড়ে যেতে পারে।
# তেল, চর্বিজাতীয় দাগ পড়ে টাইলস যেন নষ্ট না হয়, সে জন্য যেসব স্থানে দাগ পড়বে সঙ্গে সঙ্গে তা সাবানের পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
# দেয়ালের সিরামিক-টাইলস পরিষ্কার করার জন্য সুতির শুকনো কাপড় ব্যবহার করা যেতে পারে।
# টাইলস-এর উপর দিয়ে ভারি আসবাব টেনে সরানো যাবে না, উঁচু করে স্থানান্তর করতে হবে।