আধুনিককালের অবকাঠামো নির্মাণশৈলীর অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে থাই গ্লাস বা আর্কিটেকচারাল গ্লাস। বসত-বাড়ি থেকে শুরু করে অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল কিংবা শিল্প-কারখানা— সর্বত্রই এই গ্লাস ব্যবহারের ছড়াছড়ি। সৌন্দর্যের দিকটা তো রয়েছেই, আছে আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নেবার ব্যাপারও। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে নতুন যেসব বাড়িঘর বা অফিস ভবন গড়ে উঠেছে, সেসবের কোনোটিই গ্লাসের ব্যবহার ব্যতিরেকে নয়। শহরের ধুলো-ময়লা আর অত্যধিক শব্দদূষণ থেকে বাঁচিয়ে রাখে থাই গ্লাস। পাশাপাশি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভবন নির্মাণে গ্লাসের বিকল্প নেই। গ্লাস বা কাঁচ হলো এমন একটি বস্তু যা আবিষ্কারের পর থেকে অদ্যাবধি খুব বেশি পরিবর্তন ছাড়াই নিত্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যদিও গ্লাস আবিষ্কারের সঠিক ইতিহাস জানা দুষ্কর, তবে গ্লাসের ইতিহাস খুঁজতে গেলে খ্রিস্টের জন্মেরও ৭০০০ বছর পূর্বে, নিওলিথিক যুগে, এর হদিস পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের দিকে মিশরীয়দের মাঝে গ্লাসের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। অবশ্য বসতবাড়ি নির্মাণে গ্লাসের নান্দনিকতার ছোঁয়া এসেছে এর ঢের পরে।
আর্কিটেকচারাল গ্লাসের সবচেয়ে পুরাতন রূপটি হলো কাস্ট গ্লাস। পাটা লোহার মতো এই পাটা গ্লাস রেনেসাঁপূর্ব ইংল্যান্ডে ব্যবহার করা হতো। মধ্যযুগে ক্রাউন গ্লাসের আবির্ভাব এর ব্যবহার আরো বাড়িয়ে দেয়। ক্রাউন গ্লাস মূলত বিলাসবহুল জাহাজের অঙ্গসজ্জায় ব্যবহার করা হলেও দ্রুতই এটি ধনাঢ্যদের বাড়ির জানালায় স্থান করে নেয়। সিলিন্ডার গ্লাস, ড্রন শিট, কাস্ট প্লেট গ্লাস- সবই একে একে অবকাঠামো নির্মাণের সাথে নিজেদের সম্পর্ক তৈরি করতে থাকে। প্রাথমিকভাবে এসব গ্লাস মূলত গবেষণাগার, প্রাসাদ আর ধনী ব্যক্তিদের বাড়িঘরে শোভা পেত।
এরপর রোলড প্লেট গ্লাস নামে আরেক প্রকার অমসৃণ গ্লাসের উদ্ভব হয় যা মূলত বড় আকারের জানালায় ব্যবহার করা হতো। প্রিজম গ্লাসের আগমন গ্লাসের ব্যবহারে বিলাসিতার মাত্রা আরেকটু চড়িয়ে দিলেও গ্লাস ব্লকের আগমন তা মধ্যবিত্তের নাগালের মাঝে নিয়ে আসে।
এরপর ১৭ শতকে ইউরোপে লেড গ্লাস উৎপাদনের প্রযুক্তি তৈরি হলে স্থাপত্যের সাথে গ্লাসের সম্পর্ক অটুট হয়ে যায়। শুরুর দিকে যদিও কৃষি ও গবেষণার জন্য গ্রিন হাউজ এবং কনজারভেটরি নির্মাণে গ্লাস ব্যবহৃত হতো। ১৮ শতকেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাড়িঘরের জানালায় গ্লাসের ব্যবহার শুরু হয় এর সৌন্দর্যের জন্য। শুরুতে যদিও একে বিলাসিতা মনে করা হতো, শিল্পবিপ্লবের সাথে সাথে দ্রুতই ধারণা বদলে যেতে থাকে এবং বড় এক্সিবিশন হল, টাউন হলের পাশাপাশি রেলওয়ে স্টেশন আর সরকারি দালানকোঠায়ও গ্লাস উঁকি দিতে শুরু করে। দ্রুতই গ্লাসের দরজা-জানালাকে আরও টেকসই করতে স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম ও অন্যান্য ধাতব বস্তুর ফ্রেমিংয়ে আবদ্ধ করা শুরু হয়।
অবশ্য অবকাঠামো নির্মাণে গ্লাসের ব্যবহারে বিপ্লব ঘটায় কিছু যুগান্তকারী ভবনের নির্মাণ। ১৮৫১ সালে স্থপতি জোসেফ প্যাক্সটন লন্ডনে ক্রিস্টাল প্যালেস নির্মাণ করে স্থাপত্যশিল্পে গ্লাস ব্যবহারের ধারণা চিরতরে বদলে দেন। তিনি সেসময় প্রচলিত অস্বচ্ছ লেড গ্লাসের পরিবর্তে স্বচ্ছ এবং ঝকঝকে (গ্লেজি) গ্লাস দিয়ে চোখ ধাঁধানো এক দালান নির্মাণ করেন। তার এই ভবন নির্মাণই আর্কিটেকচারাল গ্লাসের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। যদিও তিনি এরূপ গ্লাস সৌন্দর্য নয় বরং ইন্টেরিয়রে সূর্যালোক ব্যবহার করে বিদ্যুৎ খরচ কমানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছিলেন। তথাপি নির্মাণ পরবর্তী সময়ে ক্রিস্টাল প্যালেস সার্বজনীন প্রশংসা পায় এর সৌন্দর্যের জন্য।
ক্রিস্টাল প্যালেসের হাত ধরে স্বচ্ছ গ্লাসের ব্যবহার শুরু হয়ে গেলেও প্রখর সূর্যালোক কিছুটা ঝামেলারও হয়ে দাঁড়ায়। এর কয়েকবছর পর লিভারপুলে ওরিয়েল চেম্বার নামে একটি ভবন নির্মাণে রঙিন গ্লাসের পরীক্ষা চালান স্থপতি পিটার এলিস। তিনি প্রথমবারের মতো গ্লাস কার্টেইন ওয়ালের ব্যবহার করেন যা ছিল স্থাপত্যে গ্লাস ব্যবহারের আরেকটি যুগান্তকারী অধ্যায়। তার এই পরীক্ষামূলক ব্যবহারের পর থেকেই বাণিজ্যিকভাবে গ্লাস নির্মিত কার্টেইন ওয়ালের ব্যবহার বেড়ে যায়।
এরপর ১৯ শতকের শেষভাগে এবং ২০ শতকের শুরুর সময়ে আমেরিকায় ‘অল-গ্লাস বিল্ডিং’ ব্যাপক প্রচলন হয়। এরূপ ভবনগুলোয় মূলত ভবনের পুরো বহিরাবরণটাই গ্লাস দ্বারা নির্মাণ করা হতো। স্বচ্ছতা আর উজ্জ্বলতাই ছিল তখন মুখ্য। ভবনের বহিরাবরণে ধীরে ধীরে কনক্রিটের জায়গা নিয়ে নিল গ্লাস, এবং সময়ের সাথে ঝকঝকে-চকচকে স্বচ্ছ গ্লাসকে প্রতিস্থাপন করলো অনুজ্জ্বল, মসৃণ ও আধা-স্বচ্ছ গ্লাস।
প্রযুক্তির উন্নয়নে বর্তমানে তৈরি হচ্ছে হাজারো রঙের, ডিজাইনের আর ভিন্ন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় তৈরি গ্লাস। এনিলিড গ্লাস, হিট স্ট্রেংদেন্ড গ্লাস, কেমিক্যালি স্ট্রেংদেন্ড গ্লাস, হিটেবল গ্লাস, ইনসুলেটিং গ্লাস, টাফেন্ড গ্লাস, ইত্যাদি। এমনকি ভূমিকম্পের কম্পন এবং উচ্চমাত্রা কম্পন বিশিষ্ট শব্দতরঙ্গ সহনশীল সাইজমিক গ্লাসও তৈরি হচ্ছে আজকাল।
বর্তমান সময়ে আর্কিটেকচারাল গ্লাস তথা রঙ-বেরঙের থাই গ্লাস ভবন নির্মাণের একটি অপরিহার্য উপাদান। বিশ্বজুড়ে এই গ্লাস শিল্পের বাজার এখন কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের। এই বাজারে ফ্রেঞ্চ বহুজাতিক কোম্পানি সেইন্ট গোবেন সর্বোচ্চ মুনাফা নিয়ে রাজত্ব করছে। এই প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক আয় ৪০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি (২০২০ সালের হিসেব)। এছাড়াও পিপিজি ইন্ডাস্ট্রি, নিপ্পন শিট গ্লাস কোম্পানি, কর্নিং ইন্টারন্যাশনালের মতো বড় বড় বৈশ্বিক গ্লাস রপ্তানিকারক রয়েছে বাজারে।