বাড়ির সবচেয়ে ব্যস্ত ঘর কোনটি, এমনটা প্রশ্ন করলে প্রথম উত্তরে হয়তো রান্নাঘরের কথাই আসবে মাথায়। আগেকার দিনের বাড়ির বাইরের রান্নাঘরগুলোর খোঁজ গ্রামাঞ্চলে যা-ও মেলে, শহরে তা বিলুপ্ত। শহরগুলোর বহুতল আবাসগুলোয় রান্নাঘর হয়েছে আরো ছোট, অনেকাংশেই বদ্ধ। বাড়ির সবচেয়ে ব্যস্ত ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই অংশের প্রতিই অবহেলা যেন আরো বেশি। তাই ভ্যাপসা, স্যাঁতস্যাঁতে, বদ্ধ রান্নাঘরে কাজ করে করে রাঁধুনির অস্থিরতার সূচক বাড়তি থাকাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে আধুনিক সময়ে মানুষ এখন এই বিষয়কে দেখছে বেশ গুরুত্ব দিয়ে। রান্নাঘরের নকশায় তাই আসছে নতুনত্ব, যোগ হচ্ছে নান্দনিকতার ছোঁয়া।
রান্নাঘর মানেই কিন্তু এখন কাটা, বাটা আর চুলোর গরম আঁচ বোঝায় না; খুব ভারী রান্নাঘরের চল এখন কমে আসছে অনেকটাই। ছোট ও এলোমেলো রান্নাঘরে কাজের ইচ্ছেটাও বেশিক্ষণ থাকে না, বিশেষ করে এই ব্যস্ত নগরজীবনের ছোটাছুটিতে। তাই আজকাল মাঝারি ফ্ল্যাট, বড় অ্যাপার্টমেন্ট বা ডুপ্লেক্স বাড়িগুলোতে রান্নাঘরের আকার বেশ বড় রাখা হয় ক্রেতাদের চাহিদার সাথে মিল রেখে। রান্নাঘরের জায়গাটুকু সবচেয়ে ভালোভাবে কাজে লাগাতে কিচেন কেবিনেটের জুড়ি নেই বললেই চলে। তবে আধুনিক কিচেন কেবিনেট বা ওপেন কিচেন বানানোর জন্য বেশ কিছু বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। জেনে নেওয়া যাক এমন নান্দনিক কিচেন কেবিনেট নকশার কিছু খুঁটিনাটি।
রান্নাঘরের নকশায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এর আকৃতি ও ব্যাপ্তি। যদি তুলনামূলক ছোট রান্নাঘর হয় যেখানে জায়গা কম, তাহলে স্ট্রেইট কিচেন বা সমান্তরাল নকশায় আগানো উচিত বলে মনে করেন নকশাকাররা। এতে কেবিনেটগুলো যেকোনো একপাশে বা উভয়পাশে থাকতে পারে, মাঝে অবশ্যই হাঁটাচলা ও প্রয়োজনে বসতে পারার মতো জায়গা থাকতে হবে। এমন রান্নাঘরে যদি অতিরিক্ত শেলফ বা প্ল্যাটফর্ম যুক্ত করা হয় অথবা খুব বেশি উঁচু করে কেবিনেট তৈরি করা হয়, তাহলে ঘিঞ্জি বা দমবন্ধ পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। তুলনামূলক বড় রান্নাঘরে ইংরেজি ইউ (U) বা এল (L) আকৃতির নকশা কাজে লাগানো যায়, যা বেশি সুবিধাজনক। যেকোনো নকশার শুরুতেই রান্নাঘরে থাকা বৈদ্যুতিক সুইচবোর্ডগুলো এবং প্লাম্বিং পয়েন্টগুলোর অবস্থান মাথায় রাখতে হবে। এসবের ওপর কেবিনেটের কোনো অংশ যেন সরাসরি না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত, এতে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, যেমন- ব্লেন্ডার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, টোস্টার প্রভৃতি ব্যবহারে সুবিধা হবে।
রান্নাঘরের নকশা যেমনই হোক না কেন, পর্যাপ্ত আলো-বাতাস আসার জন্য যথেষ্ট ফাঁকা জায়গা থাকতে হবে। কেবিনেটের একদিকে এক্সহস্ট ফ্যান লাগানো গেলে রান্নাঘরের গরম বাতাস বা ধোঁয়া দ্রুত বের হয়ে যেতে পারে, এতে চিটচিটে ভাবটাও বেশ খানিকটা কমে যায়। খোলামেলা রান্নাঘরের জন্য তুলনামূলক বড় আকারের জানালা রাখা যায়, যা কেবিনেটের ফ্রেম ও নকশার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এতে রান্নাঘরের পরিবেশ যেমন তরতাজা থাকবে, তেমনই এর সাজে নান্দনিক ভাবও আসবে।
এবার আসা যাক কেবিনেটগুলোর নকশা কেমন হতে পারে, সেই আলোচনায়। বর্তমানে সাধারণ রান্নাঘর বা ওয়েট কিচেনের পাশাপাশি ড্রাই কিচেনের জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। তাই কেবিনেট নকশায়ও তা ব্যবহার করা হচ্ছে। কেবিনেটগুলো প্রয়োজন অনুসারে পৃথকভাবে ভাগ করে নেওয়া উচিত, এতে কোন কেবিনেটে কেমন জিনিস রাখা হবে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যেমন, মূল্যবান ক্রোকারিজ/তৈজসপত্রের জন্য, যেগুলো অপেক্ষাকৃত কম ব্যবহৃত হয়, সেসব ওপরের দিকের বায়ুনিরোধক তাকে রাখা উচিত, যাতে ধুলোবালি না ঢুকতে পারে। দৈনন্দিন ব্যবহারের তৈজসপত্র স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি তাকে রাখা যায় অথবা পুলআউট ড্রয়ারেও রাখা যায়। মশলাপাতি ও অন্যান্য দরকারি ব্যবহারি জিনিস রাখার জন্য চুলা বা বার্নার স্টোভের পাশেই কিছু খোলা কেবিনেট রাখা যায়।
আধুনিক কিচেনের জন্য বর্তমানে কেবিনেটের সাথে পুলআউট ড্রয়ারের ব্যবহার হচ্ছে। একে নাইফ ড্রয়ার, তৈজসপত্র রাখার কাজে ব্যবহার করা যায়। এছাড়াও স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি ভেজিটেবল ট্রায়াঙ্গল বক্সও তালিকায় রাখা যায়।
কিচেনের নকশায় যে দিকটির কথাও আমাদের অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে তা হলো ব্যবহারকারীর উচ্চতা। এদিকে যত্নবান হলে এর নিয়মিত ব্যবহারকারী কাজকর্মেও এক অন্যরকম স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করবেন। এজন্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন বার্নার, কিচেন হুড, সিংকসহ পুরো রান্নাঘরেই ব্যবহারকারীর উচ্চতা ও তার ব্যবহার্য জিনিসপত্রের মাঝে সামঞ্জস্য বিধান করা হয়। এর ফলে কাজে আসবে স্বস্তি, দৃষ্টিতে মিলবে শান্তি।
বর্তমানে পাশ্চাত্যধারার সাথে মিল রেখে অনেক বাসাবাড়িতে কিচেন আইল্যান্ড তৈরি করা হয়। এটি মূলত একটি গ্রানাইট বা মার্বেল পাথরের টেবিলাকৃতি অংশ যার আশেপাশে টুল বা ছোট চেয়ার দিয়ে বসা যায়। ড্রাই কিচেন বা ওপেন কিচেনে এই টেবিল ব্যবহার করা যায়। অধিক স্থায়িত্বের জন্য গ্রানাইট ও মার্বেল পাথর দিয়ে কিচেন কেবিনেটের কাউন্টার-টপও তৈরি করা যায়।
জিপসাম বোর্ডের পাশাপাশি জুট স্টিক বোর্ড, ভিনিয়ার বোর্ড, প্লাইউড বা মেলামাইন বোর্ডও ব্যবহার করা যায় কেবিনেট তৈরির উদ্দেশ্যে। এসব বোর্ডের স্থায়িত্ব যেমন বেশি, তেমনি পরিষ্কার করাও বেশ সহজ, দাগও পড়ে না। জিপসাম বোর্ড অগ্নিনিরোধক ও মেলামাইন বোর্ড পানিনিরোধক, তাই এগুলো বেশি ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও সাধারণ বোর্ডের সাথে পিভিসি ব্যবহার করেও কেবিনেট তৈরি করা যায়।
এভাবেই পরিপাটি ও ছিমছাম নকশার নান্দনিক হেঁশেলে মুগ্ধ হবে সবাই।