গৃহনির্মাণে কারো প্রধান লক্ষ্য হয় কেবলই বসবাস উপযোগী একটি বাড়ি তৈরি করা, কারো সবটুকু মনোযোগ থাকে বাড়ির সৌন্দর্য আর নান্দনিকতা বর্ধনে। বিলাসি মনের সৌন্দর্যপ্রিয় ভাবনাগুলো ছুঁয়ে যায় ঘরের দেয়াল থেকে শুরু করে দরজা, জানালা, বেডরুম, ড্রয়িং, ডাইনিং কিংবা কিচেনে। ঘরখানি দেখে যেন মনে প্রশান্তি আসে, সেটাই তো আসল ভাবনা।
সেই ভাবনায় ঘরের রসুইখানা কিংবা কিচেনের অবস্থান কোথায়? নির্মাণশৈলির তাবৎ কারিকুরি যেন আটকে আছে বেডরুম আর ড্রয়িংরুমেই। তবে আধুনিক স্থাপত্যকলা সৌখিন মানুষের সেই ভাবনাও দূর করেছে। কিচেনের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে আবির্ভাব হয়েছে ওপেন কিচেন। বন্ধ দেয়ালের রান্নাঘরকে বিদায় বলে খোলা কিচেনে বিস্তর প্রশস্ত পারিপার্শ্বিকতায় রান্না করতে কার না ভালো লাগবে? উপরন্তু, আপনার রন্ধনশৈলির সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটার সমূহ সম্ভাবনাও আছে।
তো এই ওপেন কিচেনখানি কীভাবে আরো একটু দৃষ্টিনন্দন করে তুলবেন, সেই ব্যাপারে একটু আলোচনা হয়ে যাক তাহলে।
স্টোরেজ করুন, তবে গোপন
ওপেন কিচেন যেহেতু আপনার বসার ঘরের সাথে মিশে যাবে, তাই সাধারণ রান্নাঘরের মতো এর সাজসজ্জা হলে চলবে না। বিশেষ করে, রান্নাঘরের ব্যবহৃত সামগ্রী রাখবার শেলফ কিংবা স্টোরেজ ক্যাজুয়াল ঘরোয়া ডিজাইনে করতে হবে যেন পুরোটাই একটি ঘরোয়া পরিবেশ তৈরি করে, কিচেন বলে আলাদা না হয়। এতে করে বাড়িতে আসা মেহমানদের সাথে রান্নার মাঝে গল্প করা যাবে, মেহমানরাও ঘরোয়া পরিবেশে স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন।
লেআউট ঠিক করুন ভেবে-চিন্তে
ওপেন কিচেন ডিজাইনিংয়ে লেআউট ঠিক করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাজ ধরবার পূর্বেই মাপজোখ ঠিক করে নিন এই বিষয়গুলোর– বসার স্থান থেকে চুলার দূরত্ব, হাঁটা-চলা করবার স্থানটুকু বসার ঘরের সাথে খাপ খাচ্ছে কিনা, টিভির অবস্থানটা খুব কাছে হলো কিনা যেখানে রান্নার আওয়াজে টিভি দেখায় বিঘ্ন ঘটবে ইত্যাদি। এই সবকিছু বিবেচনা করে ঘরের আকৃতি এবং আপনার প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ও অন্যান্য বিষয়বস্তু অনুসারে ওপেন কিচেনটি ইংরেজি ইউ কিংবা এল আকৃতির হতে পারে।
জোন ভাগ করুন
ওপেন কিচেনের মানেই হচ্ছে বসার ঘর আর রান্নাঘরের তফাৎ মিটিয়ে দেয়া। কিন্তু তাই বলে হ-য-ব-র-ল হলে চলবে না। কিচেন আর বসার ঘর মিলিয়ে পুরোটাকে একটি ঘর বিবেচনা করে কয়েকটি জোনে ভাগ করুন– রান্না, ধোয়ামোছা, খাওয়া, বসা (টিভি দেখা) প্রভৃতি। ঘর একটিই, কিন্তু প্রতিটি জোন আলাদা ও স্বতন্ত্র। এবং সব জোনের মাঝে একটি কমন ফাঁকা স্থান থাকবে যেন একটিতে যেতে হলে অন্যটির সীমানা ভেদ না করতে হয়।
কিচেন জোন জানালার পাশে রাখুন
জোন ভাগ করার ক্ষেত্রে কিচেন জোনটি বহিঃস্থ দেয়াল বা জানালার দিকে রাখুন। এক্সহস্ট ফ্যান ব্যবহার করলে এই কৌশল কাজে দেবে। তাছাড়া রান্নার মাঝে যদি খানিকটা প্রকৃতির স্নিগ্ধতার ছোঁয়া চান তাহলে কিচেনের সাথের দেয়াল স্বচ্ছ কাচ দিয়ে প্রতিস্থাপন করুন। এ দেয়ালটি বাড়ির পাশে থাকা বাগানের সাথে লাগোয়া হলে তো কথাই নেই।
কিচেনে কী কী সংযুক্ত করবেন ঠিক করুন
পানির কল, চুলা, এক্সহস্ট ফ্যান, স্টোরেজের মতো মৌলিক উপাদানগুলো ছাড়া সৌন্দর্য বর্ধনে কিচেনে উন্মুক্ত জায়গা অনুযায়ী বিভিন্ন উপাদান সংযোজন করুন। যেমন– কিচেন আইল্যান্ড, ব্রেকফাস্ট বার, রেঞ্জ কুকার, স্টাইলিস ফ্রিজার ইত্যাদি।
মার্বেল, গ্লাস, স্টিল না উড?
উপরোক্ত বিষয়গুলো নির্ধারণ হয়ে গেলে ঠিক করুন আপনার ওপেন কিচেনটির বিশেষত্ব। সাধারণ নির্মাণশৈলি অনুসরণ করলে কিচেনে আনুষঙ্গিক অংশগুলো তৈরি করা যায় স্টিল দিয়েই। মার্বেল বা কাচ, উভয়ের ব্যবহারই কিচেনকে বেশ দৃষ্টিনন্দন করবে। মার্বেলের বাহারি ডিজাইন কিংবা কাচের স্বচ্ছতা ও চাকচিক্য, যেকোনো একটি বেছে নিন মর্জিমতো। তবে রাজকীয় ভাব আনতে কাঠই এখনো সবার উপরে। কালচে বা বাদামি রঙয়ের পাইন, মেপল, মেহগনি বা রোজউড হতে পারে আপনার ওপেন কিচেনের আভিজাত্যের প্রতীক।
উন্মুক্ত স্থান রাখুন যথেষ্ট পরিমাণে
ওপেন কিচেন করলে কিচেন আর বসার ঘর, অর্থাৎ পুরো ঘরে এমন কোনো স্থান থাকা যাবে না যেখানে পৌঁছতে হলে বিশেষ কসরত করতে হয়, কোনো কিছু ডিঙিয়ে যেতে হয় কিংবা কিছুটা ঘুরে যেতে হয়। ওপেন কিচেনের ধারণাই তৈরি হয়েছে খোলামেলা আবহ তৈরি করার জন্য। তাই প্রয়োজনে ‘কিচেন-এলিমেন্টস’ কম রাখুন, তথাপি ঘরকে যথেষ্ট খোলামেলা রাখবার চেষ্টা করুন।
রঙের ব্যাপারে যত্নবান হোন
কিচেনের বিভিন্ন আসবাবের রঙের ব্যাপারে যত্নবান হোন, রং নির্ধারণ করুন বুঝে-শুনে। ঘরের দেয়ালের সাথে সাদৃশ্য আছে এরকম কোনো রং বাছাই করুন। বসার সোফা, টেবিল, ঘরের দেয়াল আর কিচেনের স্টোরেজ কিংবা অন্যান্য উপাদানের রঙের সিংক হলে সেটি দেখতে বেশ দৃষ্টিনন্দন হবে। তবে রং নির্ধারণেও একটি নির্দিষ্ট নিশ খুঁজে নিতে হবে। যে রং বাছাই করবেন, পুরো ঘরের নিশ হবে সেটি। এক্ষেত্রে খুব বেশি রঙচঙে কিংবা চোখে লাগছে, এরকম রঙ না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। সাদা, অফ-হোয়াইট, ধূসর, ক্রিমি, ডার্ক ইত্যাদি ওপেন কিচেন ডিজাইনের জনপ্রিয় রঙ।
আলোকসজ্জার কথা ভুলবেন না যেন
কিচেনের জোন ভাগ করার সময়ই আলোকসজ্জা ঠিক করে ফেলতে হবে। রান্নার জোনে যতটা আলো প্রয়োজন, ধোয়ামোছা কিংবা বসার জোনে ততটা নয়। আবার বসার জোনে যেরকম আলো চাই, ডাইনিং জোনে সেরকম নয় নিশ্চয়ই। যদি আপনার ওপেন কিচেনটি যথেষ্ট বড় হয়, তাহলে অন্যসবের সাথে খেয়াল রাখুন এ বিষয়েও, ইলেকট্রিক বাল্ব কিংবা প্রাকৃতিক আলোর (জানালা, স্কাইলাইট, ইত্যাদি) ব্যবস্থা করুন যথাযথ পরিকল্পনা সহকারে।
সর্বোপরি, একটি ওপেন কিচেন ডিজাইনিংয়ের প্রধান লক্ষ্য থাকতে হবে সৌন্দর্য; অতিরিক্ত উপাদান যোগ করে হিজিবিজি করে ফেলা নয়। আপনার রুচি ও সাধ্য অনুসারে যে নকশা ধরেই এগোন না কেন, ওপেন কিচেন যেন ওপেনই থাকে, সেই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। অন্যথায় ওপেন কিচেনের মূল উদ্দেশ্যই বিফল হবে।