আমরা শহরে-মফস্বলে কিংবা গ্রামে যেখানেই বাসা বানাই না কেন, সবাই কোনো না কোনো সড়কের পাশে বাস করি। সেটা ছোট গলি হোক কিংবা মহাসড়কই হোক- রাস্তার পাশে বাড়ির অবস্থান এমন হয়, যাতে উপযুক্ত প্রাইভেসি রক্ষা করে সড়ক থেকে আমরা নিজ নিজ বাসায় প্রবেশ করতে পারি। রাস্তার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে আবার বাসার ও প্লটের দামও নির্ভর করে।
এজন্য সরকার এবং নগর-পরিকল্পনাবিদরা বাড়ি তৈরির সময় পাশের রাস্তার মাপজোক ও প্রধান প্রবেশপথের উপর নির্ভর করে আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে কিছু নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করে থাকেন, যাতে মানুষ যথেচ্ছভাবে বাসা না বানায়, নিজের ও তার পরিপার্শ্বের সবার কথা ভেবে বানায় এবং সব রাস্তাই চলাচলের উপযোগী থাকে।
এতে করে আশেপাশের সব জায়গায় সুন্দর আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকে এবং পরিবেশ ভালো হয়। বাড়ি সংলগ্ন রাস্তাঘাটের মাপজোক বাড়ি তৈরির আগেই পরিকল্পনার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আসুন জেনে নেওয়া যাক বাড়ি সংলগ্ন রাস্তাঘাট ও এর জন্য প্রয়োজনীয় মাপ কীরকম হবে।
কোথা থেকে জানতে পারবেন?
বাংলাদেশের ছোট-বড় সব রাস্তা আলাদা আলাদা কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের অধীন। সেসব রাস্তার মেরামত, এ সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারণ থেকে শুরু করে এর পাশে কী গড়ে উঠবে এবং কত দূরে হবে ইত্যাদি সবকিছুই ঠিক করেন সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা। সাধারণত এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, সেতু বিভাগ ইত্যাদি সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে রাস্তাঘাট, সেতু নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি নির্ধারণ করে থাকে।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো এসব নীতিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ করে থাকে। এগুলোই মূলত আইন বা নীতি হিসেবে মেনে চলা হয়। এজন্য বাড়ি তৈরির আগে প্লট বা বাড়ি সংলগ্ন রাস্তার জন্য প্রযোজ্য নীতি গেজেট বা বিএনবিসি নীতিমালা অনুসারে জেনে নিতে হবে যাতে বাড়ি ও রাস্তার মধ্যে মাপজোক সঠিক থাকে।
কী কী খেয়াল রাখতে হবে?
নিয়ম-নীতিগুলো পালন করার জন্য এবং সে অনুযায়ী নকশা নির্ধারণ করতে হলে উপযুক্ত গেজেটের সহায়তা নিতে হবে। এই গেজেটের নিয়ম-কানুন অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োগ করা হবে। তবে মৌলিক কিছু বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। আসুন সেগুলো জেনে নেওয়া যাক।
বাড়িতে মূল প্রবেশপথ কোনটি হবে সেটি নির্ধারণ করতে হবে। মূল প্রবেশপথের দিকটি দালানের সম্মুখ বলে বিবেচিত হবে। সেটি থেকে দালানের সেটব্যাক, এম.জি.সি., ফার এসব থেকে নির্ধারিত হবে। সেটব্যাকের বাইরে দালানের কোনো অংশ বর্ধিত হতে পারবে না। ফুটপাথ দখল করে এর উপরে যাতে কেউ দালান তুলে না দেয় এটা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। এবং নিজের জমি থেকে সেটব্যাকের অংশ ছাড়তে হবে।
বাড়ি বা দালানের সামনের বা পাশের রাস্তায় ইমার্জেন্সি এক্সেস থাকতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্স যাতে করে নির্ঝঞ্ঝাটে প্রবেশ করতে পারে সে ব্যবস্থা থাকতে হবে। এজন্য রেসিডেন্সিয়াল, শিল্প বা কমার্শিয়াল এলাকার ভিন্নতার জন্য রাস্তার মাপ ও বাড়ি থেকে দূরত্ব সংশ্লিষ্ট এলাকার নিয়ম মেনে বানাতে হবে।
সাধারণত কোনো রাস্তার মাপ ঠিক করা হয় সেটি কতগুলো বাসাবাড়িতে প্রবেশপথ নিশ্চিত করছে তার উপর ভিত্তি করে। সেজন্য হাউজিং কমপ্লেক্স বা সাধারণ বাড়ির জন্য যাতে বাড়ির আশেপাশে পরিমিত পরিমাপের রাস্তা থাকে সেটা খেয়াল রাখতে হবে। যেকোনো রাস্তা বা রাস্তার প্রস্থ তার বিপরীতে যেকোনো প্লট আকারে পরিমাপ করা হয় অথবা মুখোমুখি প্লটের দূরত্ব থেকে পরিমাপ করা হয়। রাস্তার প্রস্থ নির্ধারণের ক্ষেত্রে, যেকোনো প্লট থেকে সরকারি বিধিনিষেধ অনুসারে রেল ট্র্যাক ছাড়া অন্য যেকোনো যাতায়াত ব্যবস্থার ন্যূনতম প্রস্থটি রাস্তার প্রস্থ হতে হবে।
রাস্তার ও বাড়ির মাঝখানে ফুটপাথ থাকলে প্রয়োজনীয় মাপে তা বানাতে হবে। বাড়ি বা দালান নির্মাণের সময় যদি কোনো কারণে সেটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তবে তা মেরামত করে দিতে হবে।
যেসব স্থানে অ্যাভিয়েশন রুল কার্যকর, সেসব স্থানে অনুমোদিত মাপের চেয়ে উঁচু দালান নির্মাণ করা যাবে না, এবং কর্তৃপক্ষের দেওয়া আইন কানুন মেনে চলতে হবে।
জেনে নিই মাপজোক
আসুন এবার আমরা জেনে নিই, বাড়ি ও রাস্তা এবং এদের সংশ্লিষ্ট অতি আবশ্যক কিছু মাপজোক। রাস্তার স্তরটির উচ্চতা, কোনো অঞ্চলের যেই এলাকায় লোকের বসবাস বেশি সেই এলাকার স্তরের চেয়ে কম হবে। যখন একটি রাস্তা জাতীয় বিপর্যয় পরিচালন ব্যবস্থার অংশ হিসাবে নকশা করা হয় এবং মনোনীত করা হয়, তখন তার গঠনের স্তরটি এখতিয়ারযুক্ত কর্তৃপক্ষ দ্বারা নির্ধারিত হবে। প্লটের গঠনের স্তরের ঢালের চেয়ে কম হবে না রাস্তার স্তর।
প্লট সংলগ্ন রাস্তা ৬ মিটার পর্যন্ত প্রশস্ত করার ক্ষেত্রে, যে সকল দিকের জন্য জমি প্রতি ০.৩ মিটার করে ছেড়ে দেওয়ার জন্য ০.০৫ করে ০.২ পর্যন্ত ফার পাওয়া যাবে, সেই ফার মূল ফারের সাথে অতিরিক্ত হিসেবে যোগ করা যাবে। ৬ মিটারের অধিক প্রশস্ততার জন্যও সমপরিমাণ ফার অতিরিক্ত হিসেবে ফারের হিসাব থেকে পাওয়া যাবে। এসব সুবিধা পাওয়ার জন্য বাড়ি নির্মাতাকে অবশ্যই কর্তৃপক্ষের দেওয়া গেজেট বা বিধানমালা অনুসরণ করতে হবে।
ফায়ার ট্রাক অ্যাক্সেসের জন্য প্রয়োজনীয় রাস্তাগুলোর অবিচ্ছিন্ন প্রস্থ হবে ৪.৫ মিটার এবং সর্বনিম্ন ভার্টিকাল ক্লিয়ারেন্স ৫ মিটার। যেসব রাস্তার উচ্চতা ও প্রস্থে এরকম ক্লিয়ারেন্স নেই তাদের প্রস্থ এবং ভার্টিকাল ক্লিয়ারেন্স ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের মতামত অনুসারে বাড়ানো যেতে পারে। আগেই বলা হয়েছে, যেকোনো এক্সেস রোডের মাপ ঠিক হয় এটি কতগুলো বিল্ডিংকে সেবা দেয় তার উপর নির্ভর করে। আসুন এরকম একটি হিসাব আমরা জেনে নিই।
নন রেসিডেন্সিয়াল প্লটে অভ্যন্তরীণ এক্সেস রাস্তার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের সম্পর্ক
চওড়া (মিটার) সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য (মিটার)
৬ ৮০
৭ ১৫০
৮ ৩০০
৯ বা বেশি অনির্ধারিত
ফুটপাথের সর্বনিম্ন প্রস্থ প্রবেশ বা প্রস্থান করার জন্য সংযুক্ত করিডোর বা কোনো বিল্ডিংয়ের ওয়াকিং র্যাম্প গণনা করা প্রস্থের চেয়ে কম হবে না, যদি এর উভয় পক্ষের সংলগ্ন দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ না হয়; অন্যথায় সর্বনিম্ন প্রস্থ হবে ১.২৫ মিটার।
এসব নিয়ম মেনে আমরা যদি বাসা বানাই, তাহলে আমাদের থাকার জায়গা হবে সুস্থ, স্বপ্নীল, শান্তিময় এবং আমাদের জীবন হবে স্বাচ্ছন্দ্যময়, সাবলীল ও সুরক্ষিত। তাই বাড়ি বানানোর আগে আমাদের অবশ্যই এই মাপজোক সুন্দর করে জেনে নিয়ে এরপর মেনে চলতে হবে।