একটা সময় ঘর বানানো হতো মাটি আর ছন দিয়ে, এরপর এলো টিন, আর তারপর পাকা দালানের ইটের ঘরে প্লাস্টার করা মসৃণ দেয়াল। এখন গ্রামে বা শহরে, ইন্টিরিয়র-এক্সটেরিয়র সব জায়গাতেই দেখা মেলে প্লাস্টার করা ওয়ালের।
বাড়ির ইটের দেয়ালের উপর প্লাস্টারিং আমাদের দেশের পাকা দালানে বহুল প্রচলিত। প্লাস্টার বাড়ির আস্তরণের পাশাপাশি বাড়ির দেয়ালকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তোলে। প্লাস্টার করার পর কাঠামো মজবুত ও মসৃণ হয় এবং আবহাওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কাঠামোকে রক্ষা করে।
অন্যান্য যেকোনো ম্যাটারিয়ালের থেকে প্লাস্টারের ব্যবহার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং কার্যকরী। যেকোনো আঁকাবাঁকা সারফেইস, দেয়ালের ভেতরের ফাঁকা অংশ ভরাট করা কিংবা যেকোনো আকৃতির দেয়ালে মসৃণ ফিনিশিং দেওয়া সম্ভব প্লাস্টারের মাধ্যমে। বাড়ির ভেতরের প্লাস্টারিং বাইরের দেয়ালের প্লাস্টারিং এর থেকে পূরত্বে কম হয়ে থাকে।
প্লাস্টার করার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান
১. সিমেন্ট
২. সাদা বালি (এফ এম ১.৩ থেকে ১.৭)
৩. পানি
৪. বাঁশ
৫. প্লেইন শিট
৬. দড়ি
বালি ও সিমেন্ট মিশ্রণের অনুপাত ও নিয়ম
আর.সি.সি. পৃষ্ঠতলে সিমেন্ট ও বালির অনুপাত হচ্ছে ১:৪ এবং ইটের পৃষ্ঠতলে ১:৬ ও ১:৫। এখন জেনে নেওয়া যাক বালি ও সিমেন্ট মিশ্রণের নিয়মাবলী।
● বালি ও সিমেন্টের গুণাগুণ ঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষা করতে হবে এবং প্লাস্টারের বালি ভালো করে চালতে হবে যাতে কোনো রকমের ময়লা বালির সাথে না থাকে। এরপর উপরোক্ত অনুপাতে বালি ও সিমেন্ট মিশিয়ে নিতে হবে।
● বালি ও সিমেন্ট শুকনা অবস্থায় এমনভাবে মেশাতে হবে যেন মশলা দেখতে অভিন্ন লাগে বা ছাই রঙের মতো মনে হয়। তারপর পরিমিত পানি দিয়ে পুনরায় ভালো করে কোদাল দ্বারা কেটে মেশাতে হবে। মনে রাখতে হবে, বানানো মশলা ১ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবহার করতে হবে।
প্লাস্টার করার সময় লক্ষণীয় বিষয়
প্লাস্টার করার আগে অবশ্যই প্রয়োজনীয় সকল যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে নিতে হবে, নাহয় প্লাস্টারের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। প্লাস্টারের মাঝে কোনো ময়লা থেকে গেলে সেটি প্লাস্টার ঠিকভাবে সেট হতে বাধা দেয়, এতে প্লাস্টারে ফাটলসহ নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে। তাই অবশ্যই ব্যবহৃত সকল জিনিস প্লাস্টারের আগে ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
যে দেয়ালে প্লাস্টার করা হবে, সেই সারফেইসটি আগে পরিষ্কার করে নিতে হবে এবং হালকা পানি দিয়ে নিতে হবে। নাহলে দেয়ালের ময়লা প্লাস্টার থেকে পানি শুষে নেয়, এতে প্লাস্টার সেট হওয়ার প্রয়োজনীয় সময় পায় না। এসব কিছুই প্লাস্টারের স্থায়িত্বে প্রভাব ফেলে।
দেয়ালে প্লাস্টার করার আগে ফ্লোরে প্লাস্টিক বা পেপারের আস্তরণ দিয়ে নিতে হবে যাতে প্লাস্টার পড়ে ফ্লোর নষ্ট না হয়। কেননা প্লাস্টার ফ্লোরে পড়লে সেটি পরিষ্কার করা অনেক কষ্টসাধ্য বিষয় আর কাঠের ফ্লোর হলে প্লাস্টারের স্থায়ী দাগ থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আর.সি.সি. পৃষ্ঠতল ভালো করে চিপিং করতে হবে। চিপিং হচ্ছে হাতুড়ির সরু পাশ দিয়ে দেয়ালে খোদাইকরণ। অবাঞ্ছিত কোনো ময়লা থাকলে তুলে ফেলতে হবে। পানি দিয়ে পৃষ্ঠতল ধুয়ে ফেলতে হবে। শুকনা পৃষ্ঠতলে প্লাস্টার করলে তা ফেটে যাবে।
ব্রিক পৃষ্ঠতলে ইটের গাঁথুনির পৃষ্ঠতল আগের মতোই পরিষ্কার করতে হবে। শ্যাওলা বা লবণ থাকলে পরিষ্কার করে পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। ইটের গাঁথুনির জয়েন্টগুলো পরিষ্কার করতে হবে। দেয়ালের পৃষ্ঠতলে উঁচু হয়ে থাকা ইটের অংশ ভালোভাবে কেটে-ছেঁটে দেয়াল মোটামুটি সমতলে আনার পর প্লাস্টার লাগানোর উপযুক্ত করতে হবে।
প্লাস্টার করার আগে সিমেন্ট-বালির মিশ্রণ দিয়ে ৩”X৩” মাপের ৫’ থেকে ৬’ পর পর পায়া করতে হবে। প্রয়োজন হলে পুরুত্ব কমানোর জন্যে পায়া করার সময় দুই/এক জায়গায় ছেঁটে নিতে হবে।
আর. সি. সি. পৃষ্ঠতলে গ্রাউটিং (পানিতে শুধু সিমেন্টের মিশ্রণ) ব্যবহার করতে হবে।
ভালো প্লাস্টার করতে হলে অবশ্যই পুরুত্ব ঠিক রাখতে হবে। কোনো কারণে প্লাস্টারের পুরুত্ব বেড়ে গেলে সেই স্থানে অবশ্যই ডাবল প্লাস্টার সিস্টেমে প্লাস্টার করতে হবে। অর্থাৎ প্লাস্টারের পুরুত্ব ১.৫” হলে প্রথমবার ১” করে উলম্ব ও অনুভূমিক বরাবর লেভেল ঠিক করে প্লাস্টার করে রাখতে হবে এবং পরের দিন হাফ ইঞ্চি প্লাস্টার করে ফিনিশিং দিতে হবে।
প্লাস্টারে কখনোই ড্রাই মর্টার ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে না, আমাদের দেশের মিস্ত্রিদের মাঝে এই প্রবণতা আছে। ড্রাই মর্টার ব্যবহারে প্লাস্টার খসে পড়তে পারে, দেয়ালে ফাটল ধরতে পারে। এছাড়া রং করার আগে ঘষার সময় প্লাস্টার উঠে আসতে পারে।
একই দেয়ালের প্লাস্টারের কাজ একদিনেই শেষ করার চেষ্টা করতে হবে। একই সারফেসে কয়েকদিন ধরে প্লাস্টার করলে আগের প্লাস্টারের সাথে পরের প্লাস্টার মিশতে চায় না, বরং একটা স্থায়ী অসমতল সারফেসের তৈরি হয়।
ট্রাই স্কেল বা মাটামের সাহায্যে কলাম বা বিম উলম্ব ভাবে আছে কিনা দেখে নিতে হবে। প্লাস্টার সমান হয়েছে কিনা দেখার একটি কার্যকরী পদ্ধতি হচ্ছে লাইট টেস্ট। একটি টর্চ লাইট নিয়ে দূর থেকে সারফেসের উপর ফেললে, যে কোনো উঁচু-নিচু বা ত্রুটি ধরা পড়ে।
প্লাস্টার গুলানো অর্থাৎ মসলা ছাপানোর সাথে সাথেই প্লাস্টার করা যাবে না, অল্প কিছু সময় হালকা শুকানোর জন্য দিতে হবে। নাহলে দেয়ালে লাগানোর সাথে সাথে পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
আলাদাভাবে অনুপাত অনুসারে বালি-সিমেন্ট মিক্স করে তা নরম মশলার সাথে মেশাতে হবে, কখনোই আলাদা আলাদাভাবে বালি কিংবা সিমেন্ট দেওয়া যাবে না, এতে প্লাস্টারের মান নষ্ট হয়।
মর্টার গুলানোর পর যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ করতে হবে, নাহলে দলা পাকিয়ে প্লাস্টারের মান নষ্ট হয়ে যায়, ক্ষেত্রবিশেষে শক্ত হয়ে থাকে বসতে চাইবে না দেয়ালে।
প্লাস্টার শেষে সাধারণত ২৪ ঘন্টা পর থেকে ৭-১৪ দিন পর্যন্ত কিউরিং করতে হবে, দিনে কমপক্ষে দুইবার। কংক্রিটের মতো প্লাস্টারের মশলা তৈরিসহ কিউরিং এর কাজেও পরিষ্কার পানি ব্যবহার করা উচিত। প্রয়োজনে সময় লিখে রাখতে হবে দেয়ালে যেদিন প্লাস্টার করা হয়েছে, তাহলে হিসেব রাখতে সুবিধা হবে।
প্লাস্টারকৃত সমতল পৃষ্ঠের মধ্যে ফোস্কা সৃষ্টি হওয়াকে ব্লিস্টারিং বলে। এটা হয় মূলত সদ্য প্লাস্টারকৃত সারফেস পানির সংস্পর্শ পেলে। তাই এই বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে।
প্লাস্টারের সমতল পৃষ্ঠে এলোমেলো যে সরু ফাটলগুলো দেখা যায় তাকে ক্রেজিং বলে, একে অন্য ভাষায় চুল ফাটলও বলে। প্লাস্টারের মর্টার সঠিকভাবে প্রস্তুত না করলে এই ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
প্লাস্টার শেষে সারফেসে যে গভীর ফাটল দেখা দেয় তাকে ক্র্যাকিং বলে। ত্রুটিপূর্ন প্লাস্টারের কারণে যেমন ক্র্যাকিং হতে পারে, তেমনি ব্রিক ওয়ালের ফাটলের কারণেও ক্র্যাকিং হতে পারে। ফাটল বিভিন্ন কারণেই হতে পারে। যেমন-
● সিমেন্ট ও বালির মিক্সিং রেশিও কিংবা মেশানোর পদ্ধতি সঠিক না হলে।
● অগ্নি কিংবা অন্যান্য কারণে অত্যাধিক তাপের প্রভাবে।
● প্লাস্টারের প্রসারণ ও সংকোচনের ফলে।
● প্লাস্টারের পুরুত্ব বেশী হলে।
● পানি ও সিমেন্টের অনুপাত সঠিক না হলে।
● প্রয়োজনের অতিরিক্ত সিমেন্ট ব্যবহার করা হলে।
● সবচেয়ে বড় কারণ হলো ঠিকমত কিউরিং না করলে।
সর্বোপরি, প্লাস্টার বাড়ির দেয়ালের স্থায়িত্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই প্লাস্টার করার আগে উপরোক্ত বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝে এসব ব্যাপারে সব সময় খেয়াল রাখতে হবে।