পৃথিবীর কোন প্রাকৃতিক সম্পদ সবচেয়ে বেশি দূষিত? কিংবা কোন প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার সবচেয়ে বেশি? অথবা অন্য একটি প্রশ্ন, কোন প্রাকৃতিক সম্পদের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি? অধিকাংশ মানুষই উত্তর জেনে চমকে উঠতে পারে। কেননা সবগুলোর উত্তর একই- পানি।
পানির অপচয়ের কোনো নির্দিষ্ট তথ্য উপাত্ত নেই। গবেষণা বলছে প্রতিবার টয়লেটের ফ্লাশেই খরচ হয় প্রায় ৪ লিটার পানি! অথচ সুপেয় পানির পরিমাণ কমছে প্রতিদিনই। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় উঠে এসেছে এক ভয়াবহ তথ্য- ২০২৫ সালের মাঝেই পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ পাবে না ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানি। পানি দূষণের হারও ততদিনে প্রায় দ্বিগুণ হবে। বর্তমানে বিশ্বে বছরে প্রায় ৩৪ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করে পানিবাহিত রোগ থেকে। বলা বাহুল্য, সুপেয় পানির সংকট প্রকট হলে এই সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে।
বিশুদ্ধ পানি সংক্রান্ত এতসব জটিলতার সমাধান হিসেবে বিজ্ঞানীরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন বৃষ্টির পানির কথা। বৃষ্টির পানি সংগ্রহের প্রক্রিয়াকে ‘রেইনওয়াটার হারভেস্টিং’ বলা হয়। সাধারণ ছাদে জমা হওয়া বৃষ্টির পানি দূষণমুক্তভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবহারের পুরো প্রক্রিয়াই হলো রেইনওয়াটার হারভেস্টিং।
সুবিধাসমূহ
প্রকৃতির দান বিশুদ্ধ ও সকল প্রকার খরচমুক্ত বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের রয়েছে বহুবিধ সুবিধা। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো- সঠিক প্রক্রিয়ায় এই পানি সংরক্ষণ করা গেলে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটিই সবচেয়ে নিরাপদ। তাছাড়া, সংরক্ষিত বৃষ্টির পানি বাগানের জন্য বা বাড়ির উঠানে লাগানো গাছের চারার জন্য অধিক উপকারী। কারণ ভূগর্ভস্থ পানিতে অনেকসময় ক্লোরাইডের উপস্থিতি পাওয়া যায় যা বৃষ্টির পানিতে থাকে না বললেই চলে। অন্যদিকে, প্রাকৃতিক উৎস থেকে পানি সংরক্ষণ করার ফলে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনে যান্ত্রিক শক্তি ব্যয় হয় না। এতে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়। সব মিলিয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের সুবিধা বহুবিধ। এছাড়াও টয়লেটের ফ্লাশ, গাড়ি ধোয়া, সুইমিং পুলের পানি, ইত্যাদি অদরকারি কিংবা কম দরকারি কাজে বৃষ্টির পানি ব্যবহার ভূগর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমায়, অপচয় রোধ করে।
প্রক্রিয়া
রেইনওয়াটার হারভেস্টিং অত্যন্ত সহজলভ্য এবং সুলভ একটি প্রযুক্তি। আধুনিককালে প্রযুক্তির উন্নয়নে পানির গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ আরো সহজ এবং নির্ভরযোগ্য হয়েছে। এককালীন খরচের মাধ্যমে একটি রেইনওয়াটার হারভেস্টিং প্ল্যান্ট নিজ বাসায় তৈরি করে নিতে পারলে বছরের পর বছর এর সুফল ভোগ করা সম্ভব।
রেইন ব্যারেল
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের আদিমতম এবং সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি ‘রেইন ব্যারেল’। মূলত এ প্রক্রিয়ায় কোনোরূপ জটিলতা নেই; নামের মতো এখানে কেবল প্রয়োজন একটি ব্যারেল বা পিপা। ছাদ থেকে পানি নামার নালার নীচে একে স্থাপন করলেই হচ্ছে। এক্ষেত্রে একটি বড় সুবিধা হলো এর জন্য অতিরিক্ত জায়গা, খরচ বা দক্ষতা কোনোটিরই প্রয়োজন নেই। কেবল বাজার থেকে একটি ব্যারেল কিনে আনলেই কাজ শেষ। কিন্তু সমস্যা হলো এর সক্ষমতা অত্যন্ত কম, মাত্র ২০০-২৫০ লিটার। অধিক বৃষ্টির সময় পানি উপচে পড়ে সংরক্ষণের সুযোগও অপচয় হয়।
ড্রাই সিস্টেম
এটি মূলত রেইন ব্যারেলেরই বৃহত্তর সংস্করণ। এই পদ্ধতিতে ছাদ থেকে পাইপ এনে একটি বড় আকৃতির ব্যারেলের সাথে সংযুক্ত করা হয়। বৃষ্টি শেষে পানি পাইপের নীচে থাকায় পাইপটি দ্রুত শুকিয়ে যায়; তাই একে বলা হয় ড্রাই সিস্টেম। এটি সহজে ব্যবহারযোগ্য এবং অধিক পানি সংরক্ষণের সুবিধা দিলেও ঠিক বাড়ির পাশেই ট্যাংক স্থাপন করাটা খুব বেশি আকর্ষণীয় নয়।
ওয়েট সিস্টেম
ড্রাই সিস্টেমের তুলনায় এ প্রক্রিয়াটি অধিক সুবিধাজনক কেননা এখানে সংরক্ষণ ট্যাংকটি বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে রাখারও সুযোগ রয়েছে। অসুবিধা কেবল একটিই- খরচ। এ প্রক্রিয়ায় মূলত ছাদের বা অন্য কোনো প্ল্যান্টের উপর পতিত বৃষ্টির পানি পাইপের মাধ্যমে মাটির নীচে দিয়ে স্থাপন করা পাইপে দূরবর্তী ট্যাংকে পৌঁছানো হয়। ফলে বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলেও পাইপের মাঝে সবসময় কিছু পানি রয়ে যায়।
যেভাবে করতে হবে
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য নিম্নলিখিত কাজগুলো ধাপে ধাপে করতে হবে।
-ওয়াটার-হারভেস্টিং শুরু হয় বাড়ির ছাদ থেকে। তাই বাড়ির ছাদ পরিষ্কার রাখাই প্রথম কাজ।
-পানি প্রবাহের পাইপ বা নালার মুখে অবশ্যই ছাঁকনি বা অনুরূপ কোনো সুরক্ষা সরঞ্জাম লাগাতে হবে যেন -ঝড়ের সময় উড়ে আসা বড় কোনো আবর্জনা নালায় প্রবেশ করতে না পারে।
-অতিরিক্ত ব্যবস্থা হিসেবে পানি প্রবাহের নালার মুখে ছাঁকনির পাশাপাশি নালায় একটি ফিল্টারও স্থাপন করা যেতে পারে।
-মশা-মাছি আর অন্যান্য কীটপতঙ্গ দূরে রাখতে ট্যাংক স্ক্রিন বা অন্য কোনো প্রাসঙ্গিক ব্যবস্থা নিতে হবে।
-ট্যাংকের ওভারফ্লো পাইপ (যে পাইপ দিয়ে ট্যাংক পানিতে ভরে গেলে পানি উপচে পড়ে) এর মুখেও -লাগাতে হবে কীটপতঙ্গনাশক ছাঁকনি বা অনুরূপ কিছু।
-পানি বিতরণের জন্য ট্যাংকের সাথে সংযুক্ত করতে হবে একটি পাম্প।
-ওয়াটার লেভেল মনিটরিং নামক একপ্রকার মিটার পাওয়া যায় যা ট্যাংকে উপস্থিত পানির পরিমাণ বলে দিতে পারে। এরকম মিটার তারবিহীন কিংবা তারসহ, উভয়ই বাজারে বিদ্যমান।
মোদ্দাকথা এই যে, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ অত্যন্ত সহজ এবং সুলভ একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া স্থাপনে যেমন অধিক খরচ নেই, তেমনি এর রক্ষণাবেক্ষণেও বিশেষ কোনো মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। তাছাড়া ভূগর্ভস্থ পানি অপচয় রোধের ব্যাপার তো রয়েছেই। তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে হলেও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণকে প্রাধান্য দিতে হবে, প্রতিটি উন্মুক্ত বাড়ির ছাদেই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।