গতবছর ঢাকার বনানীতে এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় জনগণের জানমালের। বহু মানুষ আহত ও নিহত হন এবং আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে অগ্নিনিরাপত্তা বাহিনীকে বেগ পেতে হয়। আগুন সংক্রান্ত সমস্যায় এর আগে বসুন্ধরা সিটি বা নিমতলীর মতো ট্রাজিক ঘটনার সাক্ষীও ঢাকা। এর বাইরে রানা প্লাজা ধ্বসে পড়া বা বেগুনবাড়িতে ভবন ধ্বসে ২৫ জনের মৃত্যুর মতো ঘটনা আমাদের দেশে ঘটেছে নিয়মিতই।
বাংলাদেশে ভবন নির্মাণে নিরাপত্তা ও ভবনের বাসিন্দাদের জন্য মানসম্পন্ন অবস্থানের কথা চিন্তা করে করা রয়েছে গেজেটেড আইন, রয়েছে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিধিমালা না মানাই এধরনের দুর্ঘটনাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং ভবনে অবস্থানকারী ও আশেপাশের মানুষের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে।
ইমারত নির্মাণ আইন ও বিধিমালা কী এ সম্পর্কে প্রত্যেকেরই জানা উচিত। নিচে সংক্ষিপ্তভাবে তা তুলে ধরা হলো।
ইমারত নির্মাণ সংক্রান্ত আইনের ইতিহাস
ইমারত নির্মাণ আইন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগে ১৯৫১ সালে ‘পূর্ববঙ্গ ইমারত নির্মাণ অধ্যাদেশ’ জারি করা হয়। এই অধ্যাদেশের পর ১৯৫২ সালে ‘ইমারত নির্মাণ আইন’ করা হয়, যা ১৯৫৩ সালে কার্যকর হয়। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর এই আইন সংশোধন করা হয়। মূলত দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করতে পারে এমন এলোমেলো ইমারত নির্মাণ ও জলাধার খনন নিবারণের জন্য বিধান করতে এই আইন প্রণয়ন করা হয়।
ইমারত নির্মাণ, জলাধার খনন ও পাহাড় কাটায় বিধিনিষেধ
যেহেতু জলাধার, পাহাড় ও বনভূমি সংরক্ষণের জন্যই এই বিধিমালার প্রচলন হয়, এই আইনগুলো ছিল ইমারত নির্মাণ বিধিমালার প্রাথমিক ভিত্তি। এই আইনগুলো এখনো বলবৎ রয়েছে। এই আইন অনুসারে, কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির পূর্ব অনুমতি ব্যতীত কেউ ইমারত নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ কিংবা এতে সংযোজন বা পরিবর্তন করতে পারবেন না।
কোনো জলাধার খনন বা পুনঃখনন, পাহাড় কাটা বা ভূমিসাৎ করতে পারবে না বলে ইমারত নির্মাণ আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে DAP ও জলাধার সংরক্ষণ আইন দ্বারা ভবন নির্মাণ এর অবস্থানকে আরো সুনির্দিষ্ট ভিত্তি দেয়া হয়েছে।
৩ (ক) ধারায় বলা হয়েছে ইমারত নির্মাণ যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছে সে উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ইমারত ব্যবহার করা যাবে না। অর্থাৎ আবাসিক বাড়ির জন্য ইমারত নির্মাণের অনুমতি নিলে ওই ভবনকে অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
এই আইনে আরও বলা হয়েছে, ইমারত নির্মাণ আইন ও বিধিমালার ব্যত্যয় ঘটিয়ে কেউ ইমারত নির্মাণ করলে সরকারের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ ওই ইমারত ভেঙে ফেলার বা অপসারণের নির্দেশ দিতে পারবে।
আমাদের দেশে বর্তমানে আবাসিক ভবনের নিচতলায় দোকান বা ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে অফিস করার প্রবণতা দেখা যায়। এটি আইন অনুসারে বৈধ নয় এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালার পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিল সংক্রান্ত বিধিতেও মামলাযোগ্য অপরাধ।
আবার উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ স্ব-উদ্যোগে অবৈধ ইমারত ভেঙে ফেলতে বা অপসারণ করতে পারবে। অবৈধভাবে কোনো জায়গা দখল করে ইমারত নির্মাণ করলে তাও ভেঙে ফেলতে পারবে কর্তৃপক্ষ। ভোগদখলকারীকে উচ্ছেদও করতে পারবে। আইন অমান্যকারীকে কোনো রকম পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ কর্তৃপক্ষ গ্রেপ্তার করতে পারবে।
আধুনিক ইমারত নির্মাণ বিধিমালা
ইমারত নির্মাণ আইন, ১৯৫২ সালে প্রদত্ত ক্ষমতা বলে সরকার ১৯৯৬ সালে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা আধুনিকায়ন করে। এই নতুন বিধিমালায়,
– ইমারত নির্মাণের অনুমোদন,
– জলাধার খননের অনুমোদন ও পাহাড় কাটার অনুমোদনের আবেদন,
– অনুমোদন ফি,
– ইমারত নির্মাণের নকশা,
– ইমারত প্রণয়নকারীর যোগ্যতা,
– ইমারত নির্মাণের অনুমোদনের জন্য করা আবেদনের নিষ্পত্তি ইত্যাদির প্রক্রিয়া বলে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া কীভাবে নির্মাণ করতে হবে তারও দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইমারত নির্মাণের বিধিগুলোর সংক্ষিপ্ত রূপ আলোচনা করা হলো।
পার্শ্ববর্তী রাস্তা ও দূরত্ব
ইমারতের প্লট এর অবস্থান, ব্যবহার প্রকৃতির পাশাপাশি পাশ্ববর্তী রাস্তা
(ক) ইমারত বা বিল্ডিংসংলগ্ন রাস্তা বা এর সঙ্গে সংযোগকারী অনূ্ন্য ৩.৬৫ মিটার প্রশস্ত রাস্তা থাকতে হবে। তবে ব্যক্তিমালিকানাধীন রাস্তার ক্ষেত্রে কমপক্ষে তিন মিটার প্রশস্ত রাস্তা থাকতে হবে।
(খ) কোনো পাশে লম্বাভাবে রাস্তা শেষ হলে এর প্রস্থ পার্শ্বরাস্তার প্রস্থ বলে গণ্য হবে।
(গ) মালিকানা অনুল্লিখিত রাস্তা সর্বসাধারণের রাস্তা বলে গণ্য হবে।
(ঘ) দুই রাস্তার সংযোগ স্থলের কোণে এক মিটার জায়গা রাস্তা সরলীকরণের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে।
(ঙ) কোনো ইমারতের নিকটবর্তী কোনো রাস্তার কেন্দ্র থেকে কমপক্ষে সাড়ে চার মিটার অথবা রাস্তাসংলগ্ন সীমানা থেকে কমপক্ষে দেড় মিটার দূরে নির্মাণ করতে হবে।
চ) পার্শ্ববর্তী রাস্তার অভিমুখী দিককে ইমারতের সামনের দিক এবং এর বিপরীত দিককে পশ্চাৎ দিক হিসেবে গণ্য করা হবে।
বৈদ্যুতিক লাইন থেকে ইমারতের দূরত্ব
কোনো ইমারত খোলা বৈদ্যুতিক লাইন থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড অথবা ঢাকা বিদ্যুৎ সরবরাহ কর্তৃপক্ষের নিয়ম মোতাবেক নিরাপদ দূরত্বে নির্মাণ করতে হবে।
ভূমি ব্যবহারের নীতিমালা
(ক) সব রকম ইমারত নির্মাণ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত সংশ্লিষ্ট শহর, নগর বা মহানগরীর মহাপরিকল্পনায় নির্দেশিত ভূমি ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে।
(খ) আবাসিক বা অন্যান্য ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত স্থানে আবাসিক ছাড়াও অনধিক ১০ শয্যাবিশিষ্ট ক্লিনিক, ব্যাংক, ফাস্টফুড রেস্তোরাঁ, দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রীর দোকান, সেলুন, চিকিৎসকের চেম্বার, ঔষধালয়, সংবাদপত্র বিক্রয় কেন্দ্র, ফুলের দোকান, লাইব্রেরি, ভিডিও ক্লাব, নার্সারি স্কুল, লন্ড্রি ও টেইলারিং শপের জন্য ইমারত নির্মাণ করা যাবে। তবে এ রকম ইমারত কেবল দুটি রাস্তার সংযোগস্থলে নির্মাণ করা যাবে। যার মধ্যে একটি রাস্তা কমপক্ষে ছয় মিটার প্রশস্ত হতে হবে এবং ওই ইমারত নির্মাণের ক্ষেত্রে আবাসিক ইমারত নির্মাণসংক্রান্ত বিধান প্রযোজ্য হবে।
(গ) আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত স্থানে আবাসিক, বাণিজ্যিক, অথবা উভয় উদ্দেশ্যে ভবন নির্মাণ করা যাবে। তবে বিধিমালা অনুসরণ করতে হবে। তবে এসব ভবন ব্যবহারে গাড়ি পার্কিং, মালামাল রাখার গুদাম থাকতে হবে। থাকতে হবে প্রশস্ত রাস্তাও। রাস্তা হতে হবে কমপক্ষে ২৩ মিটার প্রশস্ত।
সীমানা দেয়াল
ইমারত পাশের সীমানা দেয়ালের উচ্চতা হতে হবে ১.৭৫ মিটার বা তার কম। ২.৭৫ মিটার উচ্চতাসম্পন্ন দেয়াল করা যাবে। তবে উপরের এক মিটার গ্রিল বা জালি হতে হবে।
ইমারতের উচ্চতা
সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে এলাকাভিত্তিক ইমারতের উচ্চতা নির্ধারণ করতে পারবে। ইমারতের উচ্চতা সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে। তবে সাধারণত ইমারতের সামনের রাস্তার প্রস্থ এবং ইমারত ও রাস্তার মধ্যবর্তী উন্মুক্ত স্থানের যোগফলের দুই গুণের বেশি উচ্চতাসম্পন্ন কোনো ভবন নির্মাণ করা যাবে না। তবে ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় FAR ও MGC এর নির্ধারিত তালিকা রয়েছে।
গাড়ি পার্কিং
ঢাকা ও চট্টগ্রামের জন্য প্রত্যেকটি ভবনে কমপক্ষে ২৩ বর্গমিটার জায়গা গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য রাখতে হবে। আর বণিজ্যিক স্থানে সরকারি কর্তৃপক্ষের নির্ধারণ করে দেওয়া জায়গা গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য রাখতে হবে।
আলো-বাতাস চলাচল
(ক) ইমারতের সব কক্ষে দরজা জানালা, ফ্যান, লাইট ইত্যাদির মাধ্যমে স্বাভাবিক আলো-বাতাস চলাচলের নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
(খ) রান্নাঘরের অবস্থান ইমারতের এক পাশে (বহির্দেয়ালে) হতে হবে।
ছাদ, কার্নিশ ও সানশেড নির্মাণ
(ক) ইমারতের ছাদ এমনভাবে নির্মাণ করতে হবে যাতে করে ওই ছাদের পানি রাস্তায় বা অন্যের জমিতে কিংবা ইমারতের কাঠামোতে পানি নিষ্কাশিত না হয়।
(খ) ইমারতের ছাদ বা কার্নিশ উন্মুক্ত স্থানের ওপর এক মিটারের অর্ধেকের বেশি বর্ধিত করা যাবে না।
(গ) ইমারতের দরজা ও জানালার ওপর ১/২ মিটার প্রস্থের বেশি সানশেড নির্মাণ করা যাবে না।
জরুরি নির্গমন পথ
ইমারতের মেঝের যেকোনো অবস্থান থেকে অনধিক ২৫ মিটারের মধ্যে জরুরি নির্গমন পথ থাকতে হবে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বা অন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা থাকতে হবে। জরুরি ইমারত ত্যাগের নির্দেশিত ফায়ার অ্যালার্মও থাকতে হবে।
বিবিধ
– ইমারতে বজ্রপাত নিরোধক ব্যবস্থা থাকতে হবে।
– আবর্জনা অপসারণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা থাকতে হবে।
– ইমারতের প্রবেশ পথে চিঠির বাক্স থাকতে হবে।
সাধারণ বাড়ি নির্মাণে এসব বিধান মেনে চলতে হবে। এর বাইরেও হাসপাতাল, বড় মার্কেট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশেষ বিধানাবলি রয়েছে। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অত্যন্ত বিস্তারিত ও প্রায় সব বিষয়েই বিস্তারিত বিধিমালা রয়েছে। তাই এই সম্পর্কে অজ্ঞ কাউকে কখনো ভবনের নকশা করার দায়িত্ব দেবেন না। আপনার বাড়ির জন্য অবশ্যই ডিগ্রীধারী ও লাইসেন্সড স্থপতির সাহায্য নিন।
ইমারত নির্মাণ আইন ও এ বিষয়ে নির্ধারিত বিধিমালা না মেনে ভবন তৈরি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। সকলে এইসব আইন মেনে চলছে কী না তা দেখার জন্য রাজউক এবং সিটি করপোরেশন বা আঞ্চলিক পৌরসভার রয়েছে আলাদা কমিটি এবং মনিটরিং সেল। কমিটির কাজ হচ্ছে স্থপতি দ্বারা প্রণীত নকশার প্রাথমিক পর্যায়েই জমা নেয়া এবং সার্বিক পর্যালোচনা করে তবেই ভবন নির্মাণ এর অনুমতি প্রদান করা।
আর মনিটরিং সেল এ ব্যাপারে সার্বক্ষণিক নজরদারী করেন। নির্মাণকালে খেয়াল রাখেন সকল নিয়ম মানা হচ্ছে কী না। কখনো কখনো ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর তা ভাঙতে নির্দেশ দেওয়া হয় বা ভাঙা হয়। যদি কোন ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটে, সেসব দুর্ঘটনার জন্য ভবন মালিকরাও যেমন দায়ী, তেমনি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও মনিটরিং কাজ পালন না করার জন্য দায়ী থাকেন।
নিজ নিজ জায়গা থেকে প্রত্যেককেই ভবনের বিধিমালা মেনে চলতে হবে কড়াকড়িভাবে। প্রত্যেকে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বা বিল্ডিং কোড মেনে বাড়ি বা ভবন নির্মাণ করলে ভবিষ্যতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা ও ঘটলেও তাতে হতাহতের ঘটনা অনেক কমে আসবে বলে আশা করা যায়।