বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সহজলভ্য উপকরণ হলো ইট। ইটের মডিউলার প্রকৃতির কারণে এটি অনেক স্থপতি আর প্রকৌশলীর কাছেই প্রিয়। তাই যুগ যুগ ধরে ইট ও মশলার মেলবন্ধনে গড়ে উঠছে আমাদের স্বপ্নের বাড়িগুলো।
বাড়ির কাজে হাত দেওয়ার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো ইট ও মশলা ঠিক পরিমাণে থাকার বিষয়টি। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের ভাষায় যাকে বলে ব্রিকওয়ার্ক। আজকে এই ব্রিকওয়ার্ক নিয়ে সংক্ষেপে কিছু কথা বলা যাক।
প্রকারভেদ
আমাদের দেশে ব্রিক ওয়ার্ক দুই রকমের হয়ে থাকে।
১. অর্ডিনারি ব্রিক ওয়ার্ক
২. পয়েন্টিং ব্রিক ওয়ার্ক
অর্ডিনারি ব্রিক ওয়ার্ক
আমাদের দেশে সাধারণত এই ব্রিকওয়ার্কই বহুলভাবে প্রচলিত। ইট দিয়ে গাঁথুনি নির্মাণের পর সেই পৃষ্ঠ বা সারফেসকে এদেশের মৌসুমী ঝড় বা বিরূপ আবহাওয়া থেকে রক্ষা করতে প্লাস্টার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এই প্লাস্টার সৌন্দর্য বর্ধনেও কাজে দেয় বেশ চমৎকারভাবেই।
পয়েন্টিং ব্রিক ওয়ার্ক
এই ব্রিকওয়ার্কে জয়েন্টের উপর প্লাস্টার দেওয়া হয় না। গাঁথুনি পরবর্তী জয়েন্টগুলোকে পয়েন্টিং করে দেওয়া হয়, যা সাধারণত ১০ ইঞ্চির হয়। এক্ষেত্রে মর্টার বা মশলা খুব হালকা লেয়ারে শক্তভাবে থাকে এবং বাইরে মসৃণ সারফেসের রূপ দেওয়া হয়ে থাকে।
নিয়মাবলী
ইটের গাঁথুনির কাজ শুরু করার আগে কিছু প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন, যা গাঁথুনিকে মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী করতে সাহায্য করে। চলুন এখন জেনে নেওয়া যাক গাঁথুনির কাজ শুরু হওয়ার আগে আমাদের যা যা করতে হবে।
ব্রিকওয়ার্কের ব্রিক বা ইটকে অবশ্যই ভালো মানের হতে হবে। অর্থাৎ শক্ত, মজবুত আর সেইসাথে সুষমভাবে পোড়ানো, সঠিক আকার-আকৃতি এবং রং বিশিষ্ট ইট ব্যবহার করতে হবে। ইটকে প্রথমেই ভালোভাবে ভিজিয়ে রাখতে হবে। ইটের কাজ শুরু হওয়ার একদিন আগে পানি থেকে ইটকে তুলে ফেলতে হবে। এই কাজটি করা হয় যাতে শুষ্ক ইট সিমেন্ট মসলার পানি শোষণ না করতে পারে। কেননা পানি শোষণ করা হলে সিমেন্টের হাইড্রেশন বন্ধ হয়ে যায় যার ফলাফল দূর্বল গাঁথুনি।
এছাড়াও ইটের মাঝে বেশি পানি থাকায় সিমেন্ট মশলা নরম হয়ে জয়েন্ট থেকে ইটের গা বেয়ে পড়ে যেতে পারে। মসলার পুরুত্ব কম হলে এর ফলে গাঁথুনিও দূর্বল হবে, গাঁথুনি ভার্টিক্যালি শল আউটের সম্ভাবনা বেশি থাকবে। এমনকি এই অবস্থায় মিস্ত্রিও কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করবে কেননা এতে হাতের ক্ষয় হওয়ার ঝুঁকি বেশিই থাকে।
ইট ভিজানোর পর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বালি চালা এবং ভেজানো। যদিও আর্থিক ও সময়ের ব্যাপার বিবেচনায় এই কাজ এদেশে কম করা হয়, কিন্তু কাজের মান ভালো চাইলে বালিকেও ইটের মতো ভিজিয়ে রাখার পর চেলেও নিতে হবে। এরপর আসবে চিপিং। ব্রিকওয়ার্ক শুরু করার আগে সকল ধরনের সারফেস ভালোভাবে চিপিং করা খুবই জরুরি। চিপিং এর পর ফ্লোরকে ভালোভাবে পানি দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে পরিষ্কার করার পরেই গাঁথুনির কাজে হাত দেওয়া যাবে। ইট বিছানোর আগে ফ্রগ মার্ক যাতে উপরে থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এক দিনে গাঁথুনি ১.৫ মিটারের বেশি হওয়া উচিত না। তবে ভবিষ্যতে দেয়াল বাড়ানোর পরিকল্পনা থাকলে দেয়াল টুথিং করে কাজ বন্ধ রাখা যেতে পারে।
এবার আসা যাক মশলার ব্যাপারটিতে। পানি দেওয়ার আগে ড্রাই সিমেন্ট এবং বালির ভালোভাবে মিক্সিং করাটা ভীষণ জরুরি। মনে রাখতে হবে ভালো মিশ্রণেই ভালো গাঁথুনি নিশ্চিত হবে। সাধারণত ৫ ইঞ্চি গাঁথুনিতে ১:৪ অথবা ১:৫ এবং ১০" গাঁথুনিতে ১:৬ অথবা ১:৫ মশলা প্রস্তুত করতে হয়। মশলা নরম থাকা অবস্থায় ১২ মিলিমিটার গভীরে রেকিং করা হয়, এতে প্লাস্টারিং বা পয়েন্টিং এ সুবিধা হয়। যদি দেয়াল দুই বা ততোধিক ইটের পুরু হয়, তবে মশলা প্রত্যেক কোর্সে বেডিং এবং ফ্লাশিং ছাড়াও গ্রাউটিং করতে হবে।
গাঁথুনির কাজ শেষ হলে চুন মশলার ক্ষেত্রে দুই-তিন সপ্তাহ এবং সিমেন্ট মশলার ক্ষেত্রে এক-দুই সপ্তাহ কিউরিং করা লাগবে।
সতর্কতা
গাঁথুনির কাজে যেসব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে:
১. সম্পূর্ণ বেডে ভালো করে মশলা বিছিয়ে ধীরে ধীরে চাপ দিয়ে ইট বসাতে হবে যাতে ভালো করে মশলার সাথে ইট লেগে যায়।
২. ইটের গাঁথুনির কাজে ইংলিশ বন্ড ব্যবহার করা ভালো।
৩. ইটের গাঁথুনির পর প্লাস্টারিং এর কাজ কমপক্ষে ৪ সপ্তাহ পর শুরু করা উচিৎ।
৪. প্রথমে দেয়ালের দুই প্রান্তের ইট বসানোর পর সুতা ধরে মাঝের দেয়ালের ইট বসাতে হবে। সুতা টেনে অ্যালাইনমেন্ট ঠিক রাখা হয়, যাতে সব সমান থাকে।
লোড বহনকারী সাপোর্ট হিসেবে কাজ করা ছাড়াও গাঁথুনির কারণে বড় জায়গার লোড ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়। সেই সাথে আগুন বা আবহাওয়ার সরাসরি প্রভাব থেকেও ইন্টেরিয়রকে অনেক ক্ষেত্রে রক্ষা করে। সঠিকভাবে গাঁথুনি সম্পন্ন হওয়া ইটের দেয়াল তাপ এবং শব্দ প্রতিরোধ করার পাশাপাশি ব্যক্তিগত গোপনীয়তাও রক্ষা করে৷ কাজেই গাঁথুনি ভালো হওয়া খুবই জরুরি৷ এজন্য উপযুক্ত গাঁথুনি নিশ্চিতকরণে উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে ভবিষ্যতে বাড়ির কাজে হাত দেওয়া সকলকেই।