আদিকাল থেকেই মানুষের বাড়ি তৈরির পিছনে একটি বড় চালিকাশক্তি হচ্ছে বিভিন্ন পোকামাকড়, জীবজন্তু, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপদ থেকে নিজেদেরকে সুরক্ষিত রাখা। তাই আমরা সচেতনভাবেই মাটি থেকে কিছুটা উপরে আমাদের বাড়িটি নির্মাণের কাজ করে থাকি। এছাড়াও মাটির আর্দ্রতা এবং মাটির জৈব পদার্থ ও স্যাঁতস্যাঁতে পদার্থ যাতে দেয়ালের ক্ষতি না করতে পারে সেজন্য মাটি থেকে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় প্লিন্থ তুলে এরপরে বাসা বানানো হয়। সমতলের থেকে একটু উপরে অবস্থিত বাসায় পৌঁছানোর জন্য ব্যবহার করা হয় সিঁড়ি। এছাড়াও বহুতল দালানের উপরের তলায় ওঠার জন্যও ব্যবহৃত হয় সিঁড়ি।
সাধারণত সিঁড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই খুব বেশি পরিকল্পনা করা হয় না। ফলে অনেক সময় অতিরিক্ত উঁচু সিঁড়ি, দরজার নিচের পর্যন্ত ধাপ চলে আসা, অতিরিক্ত সরু সিঁড়ি, উপরে উঠার সময় পর্যাপ্ত বিশ্রামের জায়গা না থাকা ইত্যাদি নানাবিধ অসুবিধা বেশিরভাগ বাসাতেই দেখা যায়। বাড়ি তৈরি হয়ে গেছে বিধায় এ ধরনের অসুবিধা মেনে নিয়েই আমরা সেসব বাসাতে বসবাস করতে থাকি। কিন্তু বাড়ি বানানোর আগে একটু খেয়াল করলে এ ধরনের সমস্যা এড়ানো যেতে পারে খুব সহজেই।
সিঁড়ির ফ্লাইট ও ল্যান্ডিং
সাধারণত একটি সিঁড়ি নির্মাণের জন্য একটা হেলানো তলের উপর কিছু ধাপ নির্মাণ করা হয়। এরকম কিছু ধাপসহ একটা হেলানো তলকে সিঁড়ির ফ্লাইট বলে। মানুষ সিঁড়ি বেয়ে হেঁটে ওঠার সময় একটানে অনেকটা উঠতে পারে না, হাঁপিয়ে উঠে। এসময় তাকে সমতলে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিতে হয়। এই সমতলকে ল্যান্ডিং বলে। মানুষের সুবিধা ও আরামের জন্য সাধারণত একটা ফ্লাইটে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক ধাপ দেয়া হয় এবং এর পরেই একটি ল্যান্ডিং দিতে হয়। মানুষের শারীরিক ও মনস্ত্বাত্তিক স্বস্তির জন্য এই ধাপ সংখ্যা ও ফ্লাইটের সর্বোচ্চ উত্থানের পরিমাপ সঠিক হতে হবে।
সিঁড়ির মাপ
মানুষের নিজের ওঠা ও তার সাথে বস্তুসামগ্রী সিঁড়ি দিয়ে ওঠানোর জন্য উপযুক্ত মাপের সিঁড়ি অত্যন্ত প্রয়োজন। সিঁড়ির যে স্থানে পা ফেলা হয় তার এবং ধাপের উন্নতির একটি উপযুক্ত মাপ আছে। সেই মাপের ভিন্নতায় সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে, মানুষ অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠে। এই মাপ বাসা-বাড়ির জন্য একরকম, আবার অফিস বা অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ভবনের জন্য ভিন্ন। সিঁড়ির ধাপের এই নির্দিষ্ট মাপের চেয়ে একটু কম বেশি হলে, কিংবা ফ্লাইটের প্রশস্ততা, উন্নতি ইত্যাদির মাপের তারতম্যের জন্য মানুষের সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্য সঠিক মাপের সিঁড়ির নকশা এবং নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি।
এছাড়া সিঁড়িতে ওঠার সুবিধার জন্য এক দিকে অথবা ক্ষেত্রবিশেষে দুই দিকে রেলিং ব্যবহার করা হয়। ধরার সুবিধার জন্য এর একটি সুবিধাজনক উচ্চতা এবং হাতলের মাপ আছে। এই রেলিং ধরার জন্য সুবিধাজনক মাপ ব্যবহার করতে হয়। সাধারণত কাঠ, স্টেইনলেস স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম বা এমএস স্টিল দিয়ে সিঁড়ির রেলিং নির্মাণ করা হয়। উপযুক্ত মাপের রেলিং কিংবা রেলিং এর নির্মাণ উপকরণ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। সিঁড়ি নির্মাণের সময় এসব বিষয় সূক্ষ্মভাবে খেয়াল রাখতে হয়।
সিঁড়ির নির্মাণ উপকরণ ও নির্মাণ কৌশল
সাধারণত কংক্রিট, লোহা কিংবা ইট দিয়ে সিঁড়ি নির্মাণ করা হয়। সিঁড়ির আকৃতি ও অবস্থানের উপর নির্ভর করে নির্মাণ কৌশল নির্ধারণ করতে হয়। সিঁড়ি নির্মাণের সময়, সিঁড়ির অবস্থান ও নির্মাণ ব্যবহারের পরিমাণের উপর সিঁড়ির ফিনিশ ম্যাটেরিয়াল বাছাই নির্ধারণ করতে হয়। বাইরের সিঁড়ির জন্য সাধারণত খসখসে সারফেস যুক্ত তল বাছাই করতে হয়, যাতে পিচ্ছিল না হয়ে যায় এবং মানুষ অসাবধানতায় পড়ে গিয়ে আঘাত না পায়। সাধারণত বাইরের জন্য আলাদা টাইলস বা খসখসে তলযুক্ত ম্যাটেরিয়াল বাজারে সহজলভ্য। অভ্যন্তরের সিঁড়ির ধাপের ফিনিশ প্রোডাক্ট স্মুথ বা পছন্দসই হতে পারে, কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যাতে তাতে পানি জমে না থাকে।
এখন একেক ম্যাটেরিয়ালের সিঁড়ির নির্মাণ কৌশল একেক রকম। সাধারণত বাসা-বাড়ির জন্য ইট কিংবা কংক্রিটের সিঁড়ি নির্মাণ করা হয়। এজন্য প্রথমে নির্দিষ্ট মাপের ও উচ্চতার ফ্রেম বানাতে হয়। কাঠের কিংবা লোহার তৈরি হয়ে থাকে এই ফ্রেম। এরপরে এর উপর ধাপে ধাপে প্রয়োজনীয় উপকরণ, যেমন- বালু, রড, সিমেন্ট, কাঁকড় কিংবা ইট দিয়ে তা ঢালাই করা হয়। ইট কিংবা লোহার সিঁড়ির নির্মাণশৈলী আলাদা। সাধারণত এগুলো বাইরে থেকে এনে সাইটের উপযুক্ত আর নকশাকৃত স্থানে বসানো হয়।
সিঁড়ি-ঘর সম্পর্কে যা যা জানতে হবে
সিঁড়ি দালানের কোথায় নির্মাণ করতে হবে সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। সাধারণত সিঁড়ি নির্মাণের জন্য এর দুই পাশে কিংবা চার পাশে স্ট্রাকচারাল এলিমেন্ট যেমন- কলাম কিংবা শিয়ার ওয়াল থাকে। আজকাল আধুনিক নকশার জন্য সিঁড়ি স্টিল কেবল দিয়েও ঝুলিয়ে দেয়া সম্ভব হয়। সিঁড়ির এই পরিবেষ্টিত অংশকে সিঁড়িঘর বলে। আমাদের দেশের সাধারণত চেষ্টা করা হয় দালানের পশ্চিম বা দক্ষিণ দিকে সিঁড়ি দেওয়ার। এটি দিনের একটি বড় অংশ খালি, অব্যবহৃত থাকে বলে এই স্থানে তাপমাত্রা বৃদ্ধি দালানের সামগ্রিক তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্য খুব একটা প্রভাব ফেলে না।
সিঁড়ি ঘরে পর্যাপ্ত আলো বাতাসের যাওয়া-আসার সুবিধা অবশ্যই থাকতে হবে। এছাড়া স্যাঁতস্যাঁতে, অন্ধকারাচ্ছন্ন সিঁড়িঘর দালানের গায়ের আর্দ্রতা বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, এই সিঁড়ি-ঘরে যাতে পানি না ঢুকে বা ঢুকলেও দ্রুত শুকিয়ে যায়। সিঁড়ি-ঘরের তলার জায়গাটা আমরা অনেকে ফেলে রেখে দেই। কিন্তু এই স্থানটির সঠিক ভাবে নকশা করতে পারলে তা খুব সুন্দরভাবে ব্যবহারযোগ্য হয়ে উঠবে।
এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের বাসা-বাড়ির সিঁড়ি নির্মাণ ও ব্যবহারের সময় খেয়াল রাখতে পারলে সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠা-নামা করা আমাদের জন্য যেমন স্বাস্থ্যকর ও আরামপ্রদ হয়ে উঠবে, ঠিক তেমনিভাবে তা দালানের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজেও সহায়তা করবে।