আর কিছুদিন পরই অবসরে যাবেন আলতাফ সাহেব। কয়েক বছর আগে একটি জায়গা কিনেছেন ঢাকাতে। অবসরের সময় একটি বড় পরিমাণ অর্থ পেলেই নিজের মতো করে একটি বাড়ি তৈরি করতে চান। কিন্তু বাড়ি তৈরির আইনি ঝামেলার কথা ভেবে তিনি সবসময়ই কিছুটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন।
ঢাকা শহরে একটি জরিপ চালালে এরকম গল্প শোনা যাবে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই। ঢাকা শহরে জমি বা নির্মাণের খরচটা একটু বেশির দিকে হলেও সাধারণ মানুষ ভবন নির্মাণে আগ্রহ হারায় মূলত পদে পদে আইনি জটিলতার কথা চিন্তা করেই।
ভবন নির্মাণের কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ রয়েছে। প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য নির্দিষ্ট কিছু আইন রয়েছে। এগুলোকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
১। জমি সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া
২। নির্মাণ সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া
দুটি ভাগের বিভিন্ন পদক্ষেপ এখানে ধাপে ধাপে পর্যালোচনা করে আমরা একটি তালিকা তৈরি করতে পারি। চলুন সেটি দেখে নিই।
জমি সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া
জমি কেনা ভবন নির্মাণের প্রথম পদক্ষেপ। আইনি প্রক্রিয়ার কথা বিবেচনা করলে এটি আসলে সবচেয়ে বেশি সমস্যাপূর্ণ ধাপ। জমি ও জমির মালিকানা সংক্রান্ত ব্যাপারে আইনি ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকতে হলে আপনাকে জমি কেনার আগে থেকেই সতর্ক হতে হবে। জমি কেনার চেকলিস্টটি মূলত এরকম:
জমির তথ্য সংগ্রহ
জমি কেনার আগে জমি যে এলাকায় অবস্থিত সেখানে নিজে চলে যান কিংবা লোক পাঠান কিছু তথ্য সংগ্রহের জন্য। এটিকে আপনি যাচাই বা সার্ভে ধরে নিতে পারেন। এই ধাপে আপনাকে যা যা জানতে হবে তা হলো:
১. জমির জন্য সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভা/ইউনিয়ন পরিষদের প্রদত্ত প্লট নম্বর।
২. মালিকের নাম (বর্তমান এবং পূর্ব)
৩. মালিকানার স্থায়িত্ব (সম্ভব হলে আগের মালিকের নাম, মালিকানা পরিবর্তনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং এবং সময়কাল)
৪. ঠিকানা (সকল রোড নম্বর এবং ডাক নম্বরসহ)
এরপর আপনাকে যেতে হবে সিটি কর্পোরেশনে বা পৌরসভায়। এখানে সংরক্ষিত ডেটাবেজে থাকা তথ্যের সাথে মিলিয়ে তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিন।
দলিল নিরীক্ষণ
খোঁজ নেবার পরে আপনার দরকার হবে কাগজে-কলমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। জমির ক্ষেত্রে আইনি কাগজ হচ্ছে জমির দলিল। কেনার আগে বর্তমান দলিল সত্য ও প্রযোজ্য (Valid) কিনা তা যাচাই করে নিতে হবে।
এই ধাপে যা যা করতে হবে-
১. বিক্রেতার কাছে দলিল দাবি করুন ও ফটোকপি সংগ্রহ করুন।
২. এই কপি ও খতিয়ান নাম্বারসহ চলে যান সাবরেজিস্ট্রি অফিসে। সেখানে নির্ধারিত ফি’র বিনিময়ে মূল দলিলের একটি কপি সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে। সেটি হয়ে গেলে আপনার ফটোকপির সাথে সেটি মিলিয়ে নিন।
৩. জমি যদি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয়, সেক্ষেত্রে দলিলের মতো একটি বণ্টননামাও থাকে। সেটিও বৈধ কিনা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে জেনে নিন।
৪. জমির দলিল থাকা সত্ত্বেও জমি বন্ধক বা ইজারা থাকতে পারে। জমি বন্ধক বা ইজারা থাকলে তা বিক্রয় করা যায় না। সেটি আছে কিনা জানার জন্য সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে জমির দায়মুক্তির তথ্য পাওয়া যায়। এটি ১০ বছরের জন্য যাচাই করা যায়।
৫. খতিয়ান ও পোর্চা মিলিয়ে নিন। এই তথ্যগুলি থাকে সরকারি তহসিল অফিসে। খতিয়ান ও পোর্চা অনেক সময় রেকর্ড আপডেট করলে ভুল থাকে। সেটির ব্যাখ্যাও থাকতে হবে।
জমি কেনা
এবার আপনার জমিটি নিজের করে নেওয়ার পালা। এখানে আপনাকে যা যা করতে হবে তা হচ্ছে:
১. নতুন দলিল তৈরি করুন। সেখানে মালিকানা পরিবর্তনের জন্য সকল শর্ত এবং অর্থনৈতিক লেনদেনের ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে শর্তাদি লিখুন। একজন ভূমি আইনে দক্ষ আইনজীবীর সহায়তা নিন।
২. নিজের নামে রেজিস্ট্রি করতে হবে আপনার জমি। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে প্রদত্ত নির্দেশনা অনুসরণ করে জমির দামের বিপরীতে নির্ধারিত রেজিস্ট্রি ফি পরিশোধ করে জমির রেজিস্ট্রেশন করুন।
৩. মিউটেশনের মাধ্যমে নতুন দলিলের প্রযোজ্যতা ও পুরাতন দলিল বাতিলের বিষয়টি নথিভুক্ত করান। খতিয়ান ও পোর্চা রেকর্ডেও মালিক হিসাবে যে আপনার নাম এসেছে সেটিও আবেদন করে নিশ্চিত করুন। মিউটেশনের জন্য নামজারি জমাভাগ প্রস্তাবপত্র, ডুপ্লিকেট কার্বন রশিদ এবং মিউটেশন খতিয়ান সংগ্রহ করে নিন আপনার কাজ শেষ হলে।
নির্মাণ সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া
জমির পরে শুরু হবে ভবন নির্মাণ প্রক্রিয়া। এখানে মোট তিনটি ধাপে আপনাকে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। মনে রাখবেন, নির্মাণে আইনি প্রক্রিয়া না মানা হলে আপনার ভবন বা তার নিয়ম বহির্ভূত অংশ যেকোনো সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভেঙে দিতে পারেন অথবা ভবনের অনুমোদন বাতিল করতে পারেন। এখানে যেসকল ধাপে নিয়ম মানতে হবে তা হচ্ছে:
ভবনের নকশা
আপনার জমি যদি সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন হয়, তাহলে নকশা করার জন্য অবশ্যই আপনাকে লাইসেন্সধারী স্থপতির সাহায্য নিতে হবে। নকশায় স্থপতির স্বাক্ষর না থাকলে ভবনের নকশা পাশ হবে না। বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউট পূর্ণ সদস্য ও অ্যাসোসিয়েট সদস্য হিসেবে আর্কিটেক্টদের অনুমোদন দিয়ে থাকে। আপনার ভবনের স্কয়ার ফিট অনুসারে সেই নকশায় স্বাক্ষর করার অধিকার রাখেন এরকম কাউকে দিয়ে নকশা করাতে হবে।
এর সাথে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে কমপক্ষে ব্যাচেলর ডিগ্রিধারী সিভিল ইঞ্জিনিয়ার স্ট্রাকচারাল ও প্লাম্বিং নকশা প্রণয়ণ করবেন। নকশায় নকশাকারী স্থপতির এবং স্ট্রাকচার ডিজাইনে কাজ করা প্রকৌশলীর স্বাক্ষর থাকতে হবে এবং পরবর্তীতে ভবন নকশা সংক্রান্ত সকল ব্যাপারে তারা দায়বদ্ধ থাকবেন।
ভবনের অনুমোদন
নকশা যদি ইমারত নির্মাণ বিধিমালা এবং বাংলাদেশ গেজেটের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়, তাহলেই আপনি ভবন তুলতে পারবেন। এই ভবনের আইনানুগ ব্যাপারগুলি যাচাই করে রাজউক বা সংশ্লিষ্ট পৌরসভা। এই অনুমোদনের জন্য আপনি নিজেও আবেদন করতে পারেন অথবা আপনার হয়ে আপনার জন্য নকশা প্রণয়নকারী স্থপতি বা স্থাপত্য ফার্মের মাধ্যমেও আবেদন করাতে পারেন। নিজে আবেদন করলে সংশ্লিষ্ট সংস্থায় অনুমোদনের জন্য কী কী ড্রয়িং দরকার হবে সেটি আগে থেকেই জেনে নিন। যেমন- রাজউকে অনুমোদনের আবেদন করতে নিম্নলিখিত উপকরণ দরকার হয়:
• দলিল
• অবিকল কার্বন রশিদ (DCR)
• ভূমি ভাড়া রশিদ
• পরিব্যক্তি (মিউটেশন)
• খসড়া প্রকাশনা ফরম (ড্রাফট পাবলিকেশন ফরম)
• পরিকল্পনার ৭ কপি (৬ তলা পর্যন্ত ভবনের জন্য)
• যদি ভবনটি ৬ তলার বেশি হয়, একটি কাঠামোগত নকশার প্রয়োজন হয় এবং ২ নং প্রশ্নের উত্তরের বর্ণিত ৯টি প্রতিষ্ঠান থেকে ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়।
ভবন নির্মাণ
ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে আইনি জটিলতা নেই। তবে কয়েকটি জিনিস মেনে চলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১. অনুমোদিত নকশায় নিজের ইচ্ছামতো পরিবর্তন করবেন না। FAR (Floor Area Ratio) এবং MGC মেনে ভবনের নকশায় অনুমোদন নেয়া হয়। তাই কোনো পরিবর্তন থাকলে স্থপতিকে জানান। তিনি নিয়মের ভেতরে থেকে যদি পরিবর্তন সম্ভব হয় সেটা করে দিতে পারবেন। অতিরিক্ত বারান্দা বা জমি ও সেটব্যাকের মধ্যে ভবনের অংশ প্রবেশ করালে সেটা অবৈধ বলে পরিগণিত হবে এবং ভবনের ওই অংশ ভেঙে দিতে কর্তৃপক্ষ দায়বদ্ধ।
২. ইমারত নির্মাণের সময় শ্রমিক নিরাপত্তা আইন মেনে চলুন। শ্রমিকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে আইনি জটিলতায় ফেলতে পারে যেকোনো ছোট বা বড় দুর্ঘটনা।
৩. রাজউকের নকশা পাসের সময় অতিরিক্ত নয়টি ছাড়পত্র দরকার হয়। এর মধ্যে পরিবেশ ও নিরাপত্তা বিষয়ক কিছু বিষয় ও থাকে। নির্মাণের সময় পরিবেশ বিধিমালা মেনে চলুন।
আপনার সাইটে তৈরি হওয়া ধুলা ও বর্জ্য যেন আশেপাশের পরিবেশে মারাত্মক ক্ষতি করে না ফেলে সে ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে আপনাকেই।
অনেক ধাপ মেনে চলতে হলেও ভবন নির্মাণে প্রতিটি পদক্ষেপেই আপনাকে আসলে সচেতন হতেই হবে। আপনার জ্ঞান, সচেতনতা ও স্মার্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাই আপনাকে সকল আইনি জটিলতা থেকে রক্ষা করবে।