Have any question?
Call Now: 01708158112 Email: info@homebuildersclub.org

বাড়ি তৈরিতে খরচ নিয়ন্ত্রণ করবেন যেভাবে

ঢাকা বা বাংলাদেশের যেকোনো বড় শহরে একটি বাড়ির স্বপ্ন যেন এদেশের বহু মানুষের আজীবন লালিত সাধ। কিন্তু সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় করতে পারেন এমন মানুষের সংখ্যা নিতান্তই সীমিত। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পরিচালিত একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, ঢাকা শহরের বিশাল জনসংখ্যার শতকরা ৮০ জন এখনও ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। গত দুই দশকে ফ্ল্যাটের দাম ৪ থেকে ৬ গুণ বাড়লেও চাহিদা কমেনি একটুও। বরং প্রতি বছর ১ লক্ষ ২০ হাজার বাসার চাহিদার বিপরীতে তৈরি হচ্ছে মাত্র ৩০ হাজার বাসা। সুতরাং কোনো সন্দেহ ছাড়াই বলে দেওয়া যায়, খরচের হিসেবটা একটু নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে দেশের আরও বহু মানুষ নিশ্চয়ই নিজের বাড়ি বা ফ্ল্যাট নির্মাণে আগ্রহী হবেন।
কিন্তু বাড়ি তোলার প্রশ্নে আইনি এবং কাগজপত্র সংক্রান্ত জটিলতার সাগর পার হয়ে যখন কোটি টাকার হিসেব ধরিয়ে দেওয়া হয়, তখন অনেকেই চরম নিরুৎসাহিত হয়ে যান। প্রথমেই মেনে নিতে হবে যে, ঠিকভাবে বাড়ি নির্মাণ একটি ব্যয়সাধ্য প্রক্রিয়া। তাই একটি ভালো পরিমাণ খরচের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়াটাই বাড়ি তৈরির প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু একইসাথে সঠিক পরিকল্পনা, তদারকি এবং স্মার্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে বাড়ি তৈরির খরচের অনেক খাতেই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা খুবই সম্ভব।
বাড়ি নির্মাণের সময় মূলত তিনটি পর্যায়ে খরচ কমানো সম্ভব-
১. নির্মাণ পরিকল্পনা,
২. নির্মাণ তদারকি এবং
৩. রক্ষণাবেক্ষণ।

নির্মাণ পরিকল্পনা
বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনার সময় আপনার মূলত তিনটি জিনিস দরকারি। বাড়ির নকশা, নির্মাণ খরচের হিসেব (Specification) এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন। এক্ষেত্রে অবশ্যই IAB লাইসেন্সধারী স্থপতি, নূন্যতম বিএসসি পাস করা প্রকৌশলী এবং লাইসেন্সধারী নির্মাতা নিয়োগ করুন।
অনেকেই তাদের ফি-র কথা চিন্তা করে খরচ কমাতেই হাতুড়ে পেশাজীবিদের সহায়তা নেন বা নিজেই নকশা ও নির্মাণ করতে যান। এতে প্রাথমিকভাবে খরচ বেঁচে যাচ্ছে মনে হলেও এমন অদক্ষ লোকেরা আপনার চাহিদার কথা বিবেচনা না করে কোনোভাবে একটা নকশা করে দিয়ে আপনার অর্থ নিয়ে তো যাবেনই, ওই বাড়িতে থাকতে গেলে আলো-বাতাসের অভাবে আপনাকে গুণতে হবে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ, পানি এবং গ্যাসের বিল। এছাড়া প্রাথমিক পরিকল্পনায় তথ্য-প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার থেকে আপনার সামাজিক জীবন ও ভবনের  নকশার অংশ- এগুলোর অভাবে বিনোদন লাভ থেকে শুরু করে ছোট একটা অনুষ্ঠান আয়োজনেও আপনাকে গুণতে হবে অতিরিক্ত অর্থ।
অন্যদিকে FAR ও MGC সংক্রান্ত নিয়ম মেনে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করেও খরচের বিপরীতে সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করবে প্রশিক্ষিত হাতের পেশাদার নকশা। কিন্তু ভুল মানুষের হাতের নকশায় স্ট্রাকচারে ভুল (যেমন অতিরিক্ত কলাম কিংবা দরকারের চেয়ে কম স্ট্রাকচারাল সাপোর্টের) পরিকল্পনাগতভাবে আপনাকে বিশাল ক্ষতির মধ্যে ফেলতে পারে। এছাড়া অনুমোদনের ক্ষেত্রেও দক্ষ আইনজীবী এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তির সাথে কাজ করুন। এতে অযাচিত খরচ যেমন কমাতে পারবেন তেমনি আইনগতভাবেও থাকবেন নিরাপদ।

নির্মাণ তদারকি
নির্মাণ পরিকল্পনা শেষ হয়ে গেলে শুরু হবে নির্মাণ। এখানে আপনি নিজে তদারকিতে সংযুক্ত হবেন- সেটা অবশ্যই কাম্য। কিন্তু অবশ্যই আপনার সাথে থাকতে হবে স্থপতির দেওয়া পুঙ্খানুপুঙ্খ স্পেসিফিকেশন। এটি আপনাকে প্রতিটি উপাদানের দাম ও খরচ সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেবে এবং খরচ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে। এক্ষেত্রে একজন লাইসেন্সধারী ও দক্ষ কন্ট্রাক্টরের সহায়তা নিলে অনেক সহজেই এই কাজগুলো করা সম্ভব। তদারকির ক্ষেত্রে যেসব জিনিস খেয়াল রাখতে হবে-
১. নির্মাণসামগ্রীর বাজারদর,
২. পরিবহন খরচ ও
৩. শ্রমিকের মজুরি
এসবের প্রতিটি ব্যাপারেই একজন নির্মাণকাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে সচেতন হতে হবে। এগুলোর পাশাপাশি খেয়াল রাখুন যেন শ্রমিকদের যথাযত শিফট এবং নিরাপত্তার দিকে আপনার নজর থাকে। কারণ, যেকোনো দুর্ঘটনা শুধু মানবিক ক্ষতি করে সেটাই নয়, অর্থনৈতিকভাবেও আপনার নির্মাণের জন্য হতে পারে হুমকি।

রক্ষণাবেক্ষণ
ভবন রক্ষণাবেক্ষণ হলো নির্মাণের চেয়ে অনেক বড় সময় জুড়ে চলা প্রক্রিয়া। এছাড়া অন্দরসজ্জা (Interior) বা সংস্কারের প্রয়োজন হতে পারে, কিংবা প্রয়োজন হতে পারে আপনার পরিবারের চাহিদা অনুসারে নির্মিত ভবনের পরিবর্তনও (Retrofit)। নির্মাণে স্থপতির সহায়তা নেওয়া এখানেও আপনাকে দেবে খরচ বাঁচানোর সুযোগ।
ভবনের নকশা যদি BIM পদ্ধতিতে করা হয়, তাহলে ভবনের প্রতিটি উপাদান Data আকারে জমা থাকে এবং ভবনের পারফর্মেন্স আগে থেকেই যাচাই করা যায়। এই উপায়ে আপনার ভবনের কোথায় সমস্যা বা কী ধরনের পরিবর্তন কত সময় পর হবে তা যেমন আগে থেকে যাচাই করা যায়, তেমনি সঠিক সময়ে এসে আবারো যেখানে নকশা শেষ করা হয়েছিল সেখান থেকেই অতি স্বল্প সময়ে এবং কোনো সার্ভে খরচ ছাড়াই যেকোনো রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা সম্ভব।

এই তিনটি ধাপ ছাড়াও কিছু সিদ্ধান্তে যুগোপযোগী ও স্মার্ট হলেই আপনি আরও খরচ বাঁচাতে পারেন। যেমন-

১. দেশীয় নির্মাণ সামগ্রী, যেমন- দেশে নির্মিত ইট ও সিমেন্ট এবং সম্ভব হলে পরিবেশবান্ধব উপকরণ, যেমন- মাটি, কাঠ ও বালি ব্যবহার করুন। এতে পরিবহন খরচ, ট্যাক্সসহ বেশ কিছু বিষয়ে আপনার খরচ কমে যাবে। শুধু নির্মাণেই নয়, অন্দরসজ্জাতেও শুধু চাকচিক্যের জন্য অনেকে বিদেশি টাইলস এবং স্যানিটারি সামগ্রী ব্যবহার করেন। অনেক কম খরচে প্রায় সমমানের দেশীয় সামগ্রী পাওয়া যায়, যা ব্যবহারে অনেক বেশি সাশ্রয় সম্ভব।

২. প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে বাসা নির্মাণ করলে স্থপতিকে দিয়ে নকশা করানো আপনার দায়িত্ব। তিনি আগে থেকেই আপনাকে দূর্যোগরোধী উপায়ে নকশা করে দেবেন। এতে করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও দুর্যোগ পরবর্তী সংস্কারেও আপনার খরচ কমে যাবে। এর সাথে কিছু বেশি খরচ হলেও সূর্যশক্তির প্যানেল, বৃষ্টির পানি সংগ্রহের পদ্ধতি, টয়লেটের বেসিনের পানি ফ্ল্যাশে পুনঃব্যবহার করার মতো প্রযুক্তিও ভবনে যোগ করে নিন। এতে করে মাসে মাসে বিলের পরিমাণ যত কমবে, তা নির্মাণের বিনিয়োগের পরিমাণ ১০ বছরে পূরণ করে আপনাকে দেখাবে লাভের মুখ।

৩. নির্মাণে প্রথম শ্রেণীর ভালো উপাদান ব্যবহার করুন। যেমন- প্রথম শ্রেণীর ইট যদি যথাযথ মানের মর্টারের সাথে ব্যবহার করা হয় তাহলে ইটের দেয়ালে শুধু মোমের আবরণ দিলেই চলে। প্লাস্টার না করেই আধুনিক মানের দেয়াল পাওয়ায় ভবন দেখতে যেমন সুন্দর হয়, তেমনি খরচও সাশ্রয় হয়।

৪. ভবনের ভেন্টিলেশনের জন্য প্রাকৃতিক উপায়ের চর্চা করতে উৎসাহী হোন। প্রচুর জানালা, দরজা, ভেন্টিলেটর দিতে কার্পণ্য করবেন না। এতে করে এয়ার কন্ডিশনের পেছনে খরচ যেমন কমবে, তেমনই সলিড দেয়ালের পরিমাণ কমে যাওয়ায় ইট ও কংক্রিটের খরচও কমে আসবে। নির্মাণ শেষে কম বিদ্যুৎ বিলও আপনার সাশ্রয়কে তরান্বিত করবে।

৫. দরজা-জানালায় দামী কাঠের পরিবর্তে বাইরের দেয়ালে স্টিল, অ্যাংগেল ফ্রেম এবং ধাতব শিট ব্যবহার করা যায়। বাড়ির ভেতরের দরজা দামী কাঠ দিয়ে না বানিয়ে পি.ভি.সি. বা ফ্লস কাঠের তৈরি পাল্লা ব্যবহার করে ব্যয় কমানো যায়। এছাড়া অন্দরসজ্জায় বোর্ডের ব্যবহার ও খরচ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। আপনার ইন্টেরিয়র যদি আধুনিক ও মিনিমালিস্টিক হয় সেক্ষেত্রে খুব কম খরচে অকৃত্রিম (Raw) এবং অল্প বার্নিশের রুচিশীল সজ্জাও করা খুবই সহজ।

৬. নির্মাণের শুরুতেই সাইটে বাউন্ডারি তৈরি করে ফেলুন। এতে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহারের পাশাপাশি জান-মালের নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণ এবং নির্মাণ কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা (কাজের অগ্রগতি), সাইটে পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সরবরাহ, সাইটে সহজ প্রবেশ পথ তৈরি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রতিবেশীর সাথে সদ্ভাব বজায় রাখা সহজ হবে। এর প্রতিটিই আপনার খরচ কমাতে পরোক্ষ ভূমিকা রাখতে পারে।

সবশেষে, নির্মাণের ক্ষেত্রে চিন্তা করুন দীর্ঘমেয়াদী। অল্প কিছু খরচ বাঁচাতে বেআইনি, ঝুঁকিপূর্ণ কিংবা অদক্ষ লোকের পরামর্শে কোনো পদক্ষেপ নেবেন না। এধরনের পদক্ষেপ কিছু সংক্ষিপ্ত খরচ ঠেকিয়ে রাখলেও ভবিষ্যতে ওই টাকার কয়েকগুণ বেশি খরচের শঙ্কা তৈরি করে রাখে, যা আপনাকে কোনো না কোনো সময় বহন করতেই হবে।