যুগে যুগে নির্মাণশিল্প এবং এর কৌশল অনেক রকমের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের অবস্থায় এসেছে। আদিকালে ব্যবহৃত দীর্ঘস্থায়ী কংক্রিট থেকে শুরু করে হালের ব্রিজ এবং স্কাইস্ক্র্যাপারের ম্যাটেরিয়াল স্টিল, এসব সামগ্রী আমাদের আজকের স্থাপনাকে সমৃদ্ধ করেছে।
কংক্রিট এবং মার্বেল সময়ের সাথে অভিযোজিত হলেও নতুন আরও অনেক সামগ্রী ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে নির্মাণকাজে। বেশি শক্তিশালী, হালকা এবং আরও টেকসই এসব সামগ্রী কনস্ট্রাকশন টেকনোলজির বিশাল বাধাসমূহ দূর করতে খুবই কার্যকর হবে বলে আশা করা যায়।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন আবহাওয়াঘটিত সমস্যা এবং অকার্যকারিতা নিয়ে কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি তাল সামলাতে হিমশিম খেয়ে যায় প্রায়ই। বিভিন্ন বিল্ডিং প্রজেক্টের সামগ্রীর ৫০ ভাগের উৎস হলো প্রকৃতি। এছাড়াও অতিরিক্ত খরচ, দীর্ঘসূত্রিতা ও কাঁচামালের অপচয় ঘটে থাকে বলে চাহিদার তুলনায় ফলাফল মানসম্মত হয়ে উঠে না সবসময়। এই সকল সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে গবেষকেরা নতুন প্রজন্মের নির্মাণ সামগ্রী উদ্ভাবনের কাজে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। নতুন এসব নির্মাণ সামগ্রী যাতে আরও স্মার্ট, শক্তিশালী, স্বনির্ভর, পরিবেশবান্ধব হয় সেটাই এসব উদ্ভাবনের প্রধান উদ্দেশ্য।
নতুন সামগ্রী দিয়ে নির্মিত স্থাপনাসমূহ তাই আরও বেশি পরিবেশবান্ধব, কার্বন ফুটপ্রিন্ট আরও কম এবং বেশ ভালোরকম প্রভাব বিস্তার করছে স্থাপনাশিল্পে।
রাতারাতি আমূল পরিবর্তন আসতে আমাদের হয়তো অনেক বছর অপেক্ষা করতে হবে। আমরা তাই আজকে বর্তমানে তূলনামূলক অপ্রচলিত কিন্তু স্থাপনা শিল্পে আলোড়ন সৃষ্টিকারী কিছু সামগ্রী সম্পর্কে জানবো।
সেলফ হিলিং কংক্রিট (Self-healing Concrete)
এধরনের কংক্রিটে ওয়াটার অ্যাক্টিভেটেড ব্যাকটেরিয়া থাকে, যা ক্যালসাইট উৎপন্ন করে বিভিন্ন ফাটল নিজ থেকেই মেরামত করে। এই কংক্রিট ব্যবহারের ফলে রক্ষণাবেক্ষণ বা মেরামতের কাজ যেমন কমে যায়, তেমনি গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণের হারও কমে।
ত্রিমাত্রিক গ্রাফিন (3D Graphene)
এই নতুন রকমের কার্বন স্টিলের ঘনত্বের ৫%, কিন্তু এর শক্তির ২০০ গুণেরও অধিক। বিভিন্ন যানবাহনে গ্রাফিন ব্যবহার করা হয়, সেইসাথে স্কাইস্ক্র্যাপারের নির্মাণেও এটি ব্যবহার করা হয়।
অ্যারোগ্রাফাইট (Aerographite)
এই অ্যারোগ্রাফাইট কমপ্রেসড বা সংকুচিত অবস্থায় অধিকতর শক্তিশালী হয়ে যায়। বিভিন্ন অ্যাভিয়েশন স্থাপনা, স্যাটেলাইট ইত্যাদিতে এই উপাদান ব্যবহার করা হয়।
ল্যামিনেটেড টিম্বার (Limited Timber)
এই কাঠের পানি নিরোধক ক্ষমতা এবং শক্তি সাধারণ কাঠের তূলনায় বেশি। এই টিম্বার প্রতি ফ্লোরে ১৫০ টন কার্বন নিঃসরণ কমাতে পারে।
মড্যুলার ব্যাম্বু (Modular Bamboo)
স্বল্প খরচ এবং দ্রুত বর্ধনশীল এই উপাদান বিভিন্ন আকার ও স্ট্রাকচারে হতে পারে। এগুলো ভূমিকম্পের হাত থেকে যেমন বাঁচাতে পারে, তেমনি স্টিলের রিইনফোর্সমেন্টেও কাজে আসে।
ট্রান্সলুসেন্ট উড (Translucent Wood)
কালার স্ট্রাইপের কাঠ, যা ভালো ইনস্যুলেশন, শক্তি এবং বায়োডিগ্রেবিলিটির নিশ্চয়তা দেয়। সোলার প্যানেলের সেল, জানালের কাঁচ, ইনডোর লাইটিং ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হয়।
আলো উৎপাদনকারী কংক্রিট (Light Generating Concrete)
এই অগ্নিনিরোধক কংক্রিটে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাঁচের গোলক থাকে, যা দিয়ে আলোর প্রতিফলন ঘটে। বিভিন্ন আধুনিক স্থাপনা, আন্ডারগ্রাউন্ড লাইটিং ও বিপদজনক জায়গায় এই উপাদান ব্যবহৃত হয়।
মাইক্রোবিয়াল সেলুলোজ (Microbial Cellulose)
ব্যাকটেরিয়া, ইস্ট ও মাইক্রো-অর্গানিজমের এই মিশ্রণ বিভিন্ন লেয়ার্ড স্ট্রাকচারে কাজে দেয়। কনটেম্পোরারি স্থাপনাতে ব্যবহৃত হয় এই উপাদান।
উল ব্রিক (Wool Brick)
উল ও সিউইড পলিমার মিশ্রিত এই ইট সাধারণ ইটের চেয়ে ৩৭% অধিক শক্তিশালী। গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ যেমন কমায় এই ইট, তেমনি ঠাণ্ডা আবহাওয়া থেকেও বাঁচায়।
বায়োচার (Biochar)
এটি একধরনের ওয়েস্ট প্রোডাক্ট ম্যাটেরিয়াল, যাতে আছে উচ্চ তাপরোধের ক্ষমতা। আজকের দিনে আধুনিক স্থাপত্যকলায় অধিক স্থায়ী ও স্বনির্ভর স্থাপনা এই উপাদান ছাড়া ভাবাই যায় না।
নিজস্ব শক্তি উৎপাদনকারী উপাদান থেকে শুরু করে বড় রকমের স্থাপনার নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেওয়া এসব নতুন নতুন সামগ্রী আধুনিক নির্মাণশিল্পের এগিয়ে যাবার বার্তা বহন করে। যদিও এসবের ব্যবহার এখনও সাধারণভাবে হচ্ছে না, কিন্তু খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ঠিকই সাধারণ নির্মাণের কাজেও এদের ব্যবহার শুরু হবে। ততদিন পর্যন্ত নতুন এসব ম্যাটেরিয়াল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থেকে পরিবেশের প্রতি সচেতন থাকাটাই জরুরি আধুনিক স্থাপত্যকলার সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য।