আপনার বাড়ির নির্মাণকাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সবচেয়ে কম আলোচিত অংশটি হলো বাড়ির ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডিজাইন, যা সাধারণভাবে ইউটিলিটি ডিজাইন হিসেবে পরিচিত। আমাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ সকল তন্ত্রের মতো, সঠিক ইউটিলিটি ডিজাইনও যেকোনো দালানের চালিকা পদ্ধতির কাজ করে।
এখন জানা যাক বাড়ির ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা ইউটিলিটি ডিজাইনের বিস্তারিত।
প্রথমেই জেনে নেই, ইউটিলিটি কী। একটি ভবনকে কার্যকর, ব্যবহারযোগ্য এবং বসবাসের উপযোগী করতে তাতে পানি, গ্যাস, ইলেক্ট্রিসিটি, পয়নিষ্কাশন, ক্যাবল লাইন, ওয়াইফাই ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সার্ভিসের প্রয়োজন হয়। এসব সার্ভিসকে সমন্বিতভাবে বাড়ির ইউটিলিটি বা ইনফ্রাস্ট্রাকচার বলে।
বর্তমান বিশ্বের স্থাপত্য চর্চার অন্যতম নতুনত্ব হলো, ইনফ্রাস্টাকচার ডিজাইন ও বিল্ডিং ডিজাইনকে সমন্বিতভাবে চিন্তা করা। এক্ষেত্রে আমরা ভবনকে শুধুমাত্র ইট-সিমেন্টের তৈরি খাঁচা হিসাবে চিন্তা না করে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে একটি শক্তির উৎস হিসাবে বিবেচনা করতে পারি। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বা রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং সিস্টেমের কথা।
বাংলাদেশের অনেক জায়গাতেই বিশুদ্ধ সুপেয় পানির অভাব পরিলক্ষিত হয়। সেক্ষেত্রে বিল্ডিং ডিজাইনের অন্যতম উপাদান হিসাবে বিবেচ্য হতে পারে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ। একইভাবে সঠিক উপায়ে সোলার প্যানেল স্থাপন বিদ্যুতের উপর চাপ কমিয়ে দিতে পারে অনেকটাই। বাড়ির বিদ্যুৎ ও গ্যাস ব্যবহার থেকে শুরু করে তাপমাত্রা কমানো পর্যন্ত নানাবিধ কাজ সঠিক ইনফ্রাস্টাকচার ডিজাইনের মধ্য দিয়ে সমাধান করা যায় অনায়াসে। যা দেশের বিদ্যমান ইনফ্রাস্ট্রাকচার সার্ভিসের উপর চাপ কমায় এবং পরিবেশবান্ধব শহর তৈরিতে সহায়তা করে।
বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে অল্প বৃষ্টিতে দেখা দেয় জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, সুপেয় পানির অভাবসহ নানা সমস্যা। এর অন্যতম প্রধান কারণ খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, একক দালান পর্যায়ে প্রতিটি দালানের সমন্বয়নিহীন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যবস্থা। ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডিজাইনকে বিল্ডিং ডিজাইনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সংযোজন হিসেবে বিবেচনা না করে, দুটোকেই ডিজাইনের অপরিহার্য উপাদান বিবেচনা করলে প্রতিটি ভবনই হয়ে উঠতে পারে শক্তি উৎপাদনের উৎস। বাংলাদেশের গ্রাম ও বিভিন্ন এলাকার মানুষজন সুপেয় পানির অভাবে থাকায় অতি স্বল্প খরচে বৃষ্টির পানি সংগহ ও সংরক্ষণের চেষ্টা করে সফল হয়েছে বিগত দশক থেকেই ।
ভূগর্ভস্থ পানির লেভেল ক্রমশ নিচে নেমে যাওয়ায় বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটাতে ‘রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং’ হতে পারে অন্যতম সমাধান। গ্যাস সমস্যা সমাধানে বায়োগ্যাস প্লান্ট, বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে সোলার সিস্টেমের ব্যবহার এবং এলাকাভিত্তিক সমস্যা বিবেচনায় অভিনব নিষ্কাশন ব্যবস্থার প্রয়োগ আমাদের এই ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহরকে বিশ্বের অন্যতম বসবাসযোগ্য শহরে পরিণত করতে পারে।
এবার আসা যাক ইউটিলিটি নির্মাণ ও স্থাপনের কাজে সঠিক পরিকল্পনার গুরুত্ব কতটুকু। ইউটিলিটি ভবনের অন্যতম প্রধান উপাদান হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা ব্যতীত গতানুগতিক ধারণার ভিত্তিতে ইউটিলিটি ডিজাইন করা হয়। যাতে নির্মাণ কাজের সময় ও পরে দেখা যায় নানাবিধ সমস্যা।
বাড়ির দেয়াল, মেঝে, ফলস সিলিং ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গার মধ্য দিয়ে একাধিক ইউটিলিটি পাইপের সংযোগ দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে সঠিক প্ল্যানিং ছাড়া সংযোগের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে সমস্যা সৃষ্টি হলে তা সমাধান করতে নির্মাণ কাজের খরচ বেড়ে যায় দ্বিগুণ বা তারও বেশি। শুধু তা-ই নয়, পাইপের সংযোগগুলো লুকায়িত থাকার কারণে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পরে তা সমাধান অনেক সময় দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। তাই সঠিক পরিকল্পনা যেমন একদিকে সকল ইউটিলিটি সংযোগ স্থাপনের কাজকে সহজ করে দেয়, তেমনি নির্মাণ খরচ এবং পুনঃ মেরামতের কাজের খরচ অনেক খানি কমিয়ে দেয়।
দেশের বিদ্যমান পরিবেশ দূষণ ও ইনফ্রাস্ট্রাকচারজনিত অব্যবস্থাপনা থেকে বের হয়ে এসে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি পরিবেশবান্ধব দেশ উপহার দিতে এলাকাভিত্তিক সমস্যাগুলোকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে ইনফ্রাস্টাকচার ও আর্কিটেকচারের সমন্বিত সঠিক ডিজাইন ও তার প্রয়োগই হতে পারে একমাত্র সমাধান।