বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তেই জমির দাম উর্ধ্বমুখী। এ অবস্থায় যারাই জমি কিনে বাড়ি তৈরি করতে চান, তাদের একটি বড় লক্ষ্য থাকে জমির বিপরীতে তৈরি বাড়িতে সর্বোচ্চ সুবিধা তুলে নেওয়া। একারণে স্থপতিদের কাছে প্রায়শই আবদার আসে সমগ্র জমি জুড়েই বাড়ির নকশা ছড়িয়ে দিয়ে বাড়ির স্কয়ার ফিটের হিসাব সর্বোচ্চ রাখার। এছাড়া নকশা করার অনুমোদন না থাকা বিভিন্ন ধরনের মানুষ নকশার কাজ করায় অনেকে না জেনেই সমগ্র জমিই নকশার আওতায় নিয়ে নেন। অথচ সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে করা বাড়িটি আইনসিদ্ধ না হলে সেটি বা তার অংশবিশেষ ভেঙে ফেলার অধিকার কিন্তু সরকারের থেকে যায়!
বাংলাদেশ ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে কোনো জমিতেই সমগ্র অংশ জুড়ে বাড়ি নির্মাণ করা সম্ভব নয়। একটি প্লটে সর্বোচ্চ কত বর্গফুট ভবন নির্মাণ করা যাবে, তার বিধান রাখা হয়েছে ‘Floor Area Ratio’ বা FAR সংক্রান্ত বিধিমালার মাধ্যমে। যদি জমির পরিমাণ দুই কাঠার মধ্যে হয়, তবে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের আইন অনুসারে জমির মালিক ফার পাবেন ৩.১৫। অর্থাৎ ২ কাঠা জমিতে ৩.১৫ ফার ৭২০ বর্গফুট = ৪৫৩৬ বর্গফুট সমপরিমাণ জায়গা ভবনে ব্যবহারের সুযোগ পাবেন। জমির আয়তন যত বেশি, ফারও তত বেশি হয়।
একটি জমিতে বাড়ি তৈরির প্রথম ধাপে স্থপতি ও ডেভেলপার মিলিতভাবে নির্মাণযোগ্য এলাকা বা Buildable Area বের করতে হবে। ফলে চারটি কাজ প্রথমেই করে নেওয়া হয়-
১. প্রথমে শহরের বিমান উড্ডয়ন বা এভিয়েশন আইন অনুসারে জায়গার হিসাব থেকে মাপ অনুসারে নির্ধারিত সেটব্যাক বাদ দিতে হয়।
২. এরপর FAR হিসাব করে কী পরিমাণ আয়তন নির্মাণাধীন হিসেবে পড়বে সেটি নির্ধারণ করা হয়।
৩. এরপর MGC বা সর্বোচ্চ ভূমি আচ্ছাদনের হিসেব যোগ করে একটি ফ্লোরের আয়তন কত হতে পারে সেটি নির্ধারিত হয়।
সব মিলিয়ে একটি জমির আয়তনের কমপক্ষে ৪০% নির্মাণযোগ্য অঞ্চলের বাইরে থাকে। এর মধ্যে ২৫% বা মূল জমির ১০% কমপক্ষে হতে হয় পানিশোষণযোগ্য বা Soakable Green Space। মূলত এই অঞ্চলটি আপনাকে ছাড়তেই হবে। জমিতে আলো-বাতাস চলাচল, বৃষ্টির পানি শোষণ এবং ফাউন্ডেশন পর্যায় থেকে ভবনকে টেকসই করতেই এই বিধিবিধান গুলো করা হয়েছে। এবং এই নিয়মগুলো মেনে বাড়ি করতে গেলে এই জায়গা যেহেতু ছাড়তেই হবে অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্ন আসে- “এই ছেড়ে দেওয়া জায়গায় কী করা যায়?”
ছেড়ে দেয়া জায়গায় হতে পারে শখের বাগান
এই জায়গার মালিক যেহেতু আপনিই, তাই পরিবেশ, প্রতিবেশী এবং নিজের ক্ষতি না করে অনেক কিছুই আপনি এই জায়গাতে করতে পারেন। তবে কিছু কাজ না করার ব্যাপারে সংবেদনশীল হলে ভালো হয়। যেমন-
১. অনেকেই সেটব্যাকের জায়গা ছেড়ে দেন ঠিকই। কিন্তু পরে পাকা করে উপরে গ্রিল দিয়ে খাঁচা বানিয়ে ফেলেন। এতে আপনি নিজে যেমন জায়গাটির কোনো সুফল ভোগ করতে পারেন না, তেমনি ছেড়ে দেওয়া জায়গা Ground Water Recharge-এও সাহায্য করে না। অর্থাৎ ছেড়ে দেওয়াটা অর্থহীন হয়ে যায়। তাই চেষ্টা করুন জায়গাগুলো পাকা না করে ফেলতে।
২. FAR মেনে বাড়ি করলে বাসার সামনে কিছু জায়গায় ফাঁকা এক চিলতে জমি পড়ে থাকে। এখানে ডেভেলপাররা কিছু দৃষ্টিনন্দন গাছ লাগিয়ে দেন। ঢাকা শহরের অবস্থা বিবেচনায় কোনো গাছই বর্তমানে ফেলনা নয়। তবে শুধুমাত্র দৃষ্টিসুখকর গাছ না রোপণ করে ফলনশীল ফল, ছায়া, কাঠ বা সবজির গাছ লাগানোর ব্যাপারে আগ্রহী হোন। বিশেষ করে কড়ই বা ছাতিমের মতো স্থানীয় গাছ রোপণ করুন বেশি করে।
৩. ঢাকা শহরে বাচ্চাদের খেলার জায়গার খুবই অভাব রয়েছে। আবাসিক এলাকাতে যদিও বর্তমানে পার্ক তৈরির কথা নতুন করে চিন্তা করা হচ্ছে অনেক এলাকায়, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট বয়সের আগে বাচ্চাদের বাসার বাইরে যেতে দিতে বাবা মা স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না। কিছুটা ঘাস দেওয়া মুখোমুখি করে ছেড়ে দেওয়া জায়গা থাকলে দুই ভবন মিলে ছেড়ে দেওয়া জায়গায় খুব সুন্দর পার্ক করা সম্ভব। যেটি জমির সীমানাপ্রাচীর এবং নিরাপত্তা সুবিধা ব্যবহার করে বাচ্চাদের উপযোগী করে গড়ে তোলা যায় সামান্য খরচেই।
বাসার সামনের এক চিলতে জায়গাতে হতে পারে বাচ্চাদের খেলার জায়গা
৪. ঢাকায় মাঠের মতো জলাধারেরও অভাব রয়েছে। ছোট জায়গায় পদ্মপুকুরের মতো ছোট আকারের জলাধারও তৈরি করতে পারেন সাধ থাকলে। এটি পরিষ্কার রাখলে এবং সাজিয়ে রাখলে আপনার বাড়ি আশেপাশের সব বাড়ি থেকে আলাদা তো হবেই, অনেকের কাছে জনপ্রিয় হলে শহরের তাপমাত্রাতেও রাখতে পারে ভালো ভূমিকা। তবে এটি পরিষ্কার ও মশামুক্ত রাখতে হবে।
৫. সব বাসায় মালী বা কেয়ারটেকার পেশার লোক অবশ্যই থাকে। এদের বেতন অনেক ক্ষেত্রেই অনেক কম এবং গ্রাম থেকে এসে শহরে কাজ করে গ্রামে টাকা পাঠাতে চেষ্টা করেন তারা। তাই আপনার ছেড়ে দেওয়া জায়গায় গাছপালা, সবজির চারা, ফুলের গাছ থেকে এদের সাহায্যে গড়ে তুলতে পারেন ছোট নার্সারিও। সবজির বাগান থাকলে এটি যেমন তাদের খাবারের জোগানে ও সঞ্চয়ে সহায়ক হবে, তেমনি নার্সারি থেকেও তাদের বেতনে আপনি যোগ করতে পারবেন একটি বাড়তি অংশ। নিচের জায়গাটিতে মাল্টি লেভেল বেড তৈরি করেও ফলন বাড়াতে পারেন আপনার চারা বা শস্যের। এছাড়া ছাদ, বারান্দা ও নিচের ছেড়ে দেওয়া জায়গাতে বাগান থাকলে আপনার বাড়িতে পাখি থেকে মৌমাছির আগমন বাড়বে এবং সমগ্র এলাকার পরিবেশ উন্নয়নে আপনার বাড়ি হয়ে উঠবে একটি রোল মডেল।
ফাঁকা জায়গাতে হতে পারে দেশীয় ফল বা মৌসুমী সবজির চাষ
৬. ছেড়ে দেওয়া অঞ্চল নিয়ে একজন বিশেষজ্ঞ ল্যান্ডস্কেপ স্থপতির পরামর্শ নিন। তিনি প্রচলিত ধারণার বাইরেও আপনার পেশা, বাড়িতে মানুষের সংখ্যা, চাহিদা, এলাকা এবং বাড়ির মূল নকশা বিবেচনায় আপনার জন্য ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইন করে দিতে পারেন। এতে আপনার শখ মেটানোর পাশাপাশি আপনি একটি সুন্দর সমাধান পাবেন সেটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।
মনে রাখতে হবে, নির্ধারিত জায়গা না ছেড়ে বাসা তৈরি করে নিজের বাড়ির ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলা যাবে না। এর সাথে পরিবেশগত হুমকি যোগ করে জোর দিয়েই বলা যায়, আগামী দশ বছরে সবাই যদি আইন মেনে বাড়ি তৈরি করেন, তাহলে ঢাকার প্রাকৃতিক, সামাজিক ও কাঠামোগত পরিবেশের উন্নয়ন শুধুমাত্র এর মাধ্যমেই অনেকটুকু নিশ্চিত করা সম্ভব।