ছোটবেলায় শহরের যেকোনো বাসার মেঝেতেই দেখা মিলত মোজাইক ফ্লোরের, নানা রঙের পাথরের ছোট ছোট টুকরো দেখা যেত ফ্লোরের মাঝে। অনেক জায়গায় সরকারি কলোনিগুলোতে এখনও ফ্লোরে দেখা মেলে প্লেইন কংক্রিট না হয় পাকা ঢালাইয়ের। গ্রামে এখনও পাকা বাড়িতে ফ্লোরে পাকা ঢালাইয়ের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। তবে সময় পাল্টে যাচ্ছে। মোজাইক ফ্লোর, প্লেইন কংক্রিট আর পাকা ঢালাইয়ের জায়গাতে গত বেশ অনেক বছর ধরে জায়গা করে নিয়েছে টাইলস। আর এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে খরচ, সহলভ্যতা আর স্থায়িত্ব।
ঘরের মাঝে আমাদের সবচেয়ে কাছাকাছি সংস্পর্শে থাকে মেঝে, সারাক্ষণ মেঝের ওপর দিয়েই চলাচল হয় সবার। তাই ফ্লোর ফিনিশিংয়ের বিষয়টি বাড়ি নির্মাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
পাকা ঢালাই
ফ্লোর ফিনিশিং-এ পাকা ঢালাই ব্যবহারের ক্ষেত্রে যেসব জিনিস মাথায় রাখতে হবে তা হচ্ছে:
১. আরসিসি কাজের জন্য কংক্রিট মিশ্রণ ১ঃ২ঃ৪ হওয়া ভালো, এক ভাগ সিমেন্ট, দুই ভাগ বালু, চার ভাগ খোয়া।
২. পানির সাথে মশলা মেশার আগপর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
৩. সেটিং শুরু করার আগেই ঢালাই হয়ে যেতে হবে।
৪. সেটিং এর জন্য এমন তক্তা অথবা প্লেট ব্যবহার করতে হবে যেন তাতে ছিদ্র না থাকে এবং ব্যবহারের আগে তাতে ডিজেল গ্রিজ লাগিয়ে নিলে ফিনিশিং ভালো হয়।
গ্রামে এখনও পাকা ঢালাইয়ের ফিনিশিং দেখা গেলেও, শহরের নতুন নির্মিত বাড়িগুলোতে এর ব্যবহার নেই বললেই চলে।
মোজাইক ফিনিশিং
বিভিন্ন রঙের ৬ মিমি. বা এর নিচের সাইজের মার্বেল পাথরের গুড়া, সাদা বা গ্রে সিমেন্ট ও পানির মিশ্রণ দ্বারা তৈরি মর্টার দ্বারা ১০ থেকে ১২ মিমি. পুরুত্বের যে ফ্লোর নির্মাণ করা হয়, সেটাই হলো মোজাইক ফ্লোর।
মোজাইক ফ্লোর নির্মাণের আগে কিছু কাজ খুবই গুরুত্বপুর্ণ। যেমন:
১. পাথরের সাইজ, কালার নির্বাচন, ফ্লোরের লেভেল নির্ধারণ, স্যানিটারি লাইন চেক, সিমেন্ট নির্বাচন, ফ্লোর সারফেস সমতল করা ইত্যাদি।
২. সাইজ ও কালার নির্বাচন করার পর পাথরগুলো বস্তা থেকে বের করে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হবে এরপর ওজন স্কেল দিয়ে প্রতি বস্তা সিমেন্টের ওজন সমান ৪০ কেজি হিসেব করে বা ৫০ কেজি হিসেবে মেপে বস্তা করে রাখতে হবে। সব রঙের পাথরকেই একইভাবে মেপে রাখতে হবে।
৩. মোজাইকের কাজ শুরু করার আগে ১:২ (১ ভাগ সিমেন্ট, ২ ভাগ বালি) অনুপাতে নিচের মূল ফ্লোরটি তৈরি করে নেওয়া হয়।
৪. এর উপর মোজাইকের মশলা অন্তত ১/২” পুরু করে প্রলেপ দেওয়া হয়।
৫. মোজাইকের এ প্রলেপটি ১৫ থেকে ২০ দিন যথানিয়মে কিউরিং করানো হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে ৪০, ৬০, ৮০, ১০০ ও ১২০ নং পাথর দিয়ে ঘষে মসৃণ করা হয়। এ কাজকে মোজাইক কাটিং ওয়ার্ক বলে।
মোজাইক ফ্লোর সাশ্রয়ী হলেও এর ব্যবহারে বেশ কিছু অসুবিধা রয়েছে, যেমন:
১. মোজাইকের কাজে অত্যন্ত দক্ষ মিস্ত্রির প্রয়োজন, যা বর্তমানে পাওয়া বেশ মুশকিল।
২. এর নির্মাণে জটিলতা বেশি।
৩. মোজাইক ফিনিশিংয়ের ডাস্ট সহজে মাটির সাথে মেশে না, ফলে পরিবেশের ক্ষতি হয়।
৪. কোনোরকম ক্র্যাক করলে রি-কাস্ট করা বেশ একটা সম্ভব হয় না।
টাইলস
সহজে ও স্বল্প সময়ে স্থাপন করা যায় এবং দৃষ্টিনন্দন বলেই নির্মাণকাজে টাইলসের ব্যবহার এখন বহু গুণে বেড়েছে। ফ্লোর, ওয়াল, ছাদ বা পার্কিংসহ জায়গাভেদে বিভিন্ন মানের ও দামের টাইলস পাওয়া যায়।
টাইলসের প্রকারভেদ
গঠনগত দিক দিয়ে ও ধরন বিবেচনায় বাসা-বাড়িতে সাধারণত দুই ধরনের টাইলস ব্যবহৃত হয়:
১. সিরামিক টাইলস
২. হোমোজিনাস টাইলস
সিরামিক টাইলস: ক্লে টাইলসের উপর সিরামিকের লেয়ার দিয়ে সিরামিক টাইলস তৈরি করা হয়ে থাকে। এটি যেকোনো দেয়ালে লাগানোর উপযোগী। এই টাইলস ছোট ও মাঝারি সাইজের পাওয়া যায়।
হোমোজিনাস টাইলস: এই টাইলস পুরোটাই একই ম্যাটেরিয়ালে তৈরি। এই টাইলস বেশি ব্যবহারে উপরে ক্ষয়প্রাপ্ত হলেও নিচে থেকে একই লেয়ারে বের হয়ে আসে। তাই ফ্লোর ও সিঁড়িতে হোমোজিনাস টাইলস বহুল ব্যবহৃত হয়। এই টাইলস বিভিন্ন শেপ ও সাইজের হয়ে থাকে।
নান্দনিকতা ও ফিনিশিংয়ের জন্য যেসব টাইলস ব্যবহার হয়ে থাকে সেগুলো হলো:
মিরর পলিশড টাইলস: বর্তমানে বাসা-বাড়িতে ফ্লোরে যে টাইলসের ব্যবহার সবচেয়ে বেড়েছে তা হলো মিরর পলিশড টাইলস। বড় সাইজের ও উজ্জ্বল হওয়াতে বাসা ও শো রুমে এটি ব্যবহৃত হয় বেশি। তবে মিরর পলিশড টাইলস অবশ্যই উন্নতমানের হতে হবে, তা না হলে অচিরেই উজ্জ্বলতা হারাবে এই টাইলস।
রাস্টিক টাইলস: ভবনের বাইরের দেয়ালে, বাউন্ডারি ওয়ালে এমনকি বাসার ভেতরেও যেকোনো এক দেয়ালে রাস্টিক ফিলিংস আনতে এই টাইলসের বিকল্প নেই। স্টোন চিপস দিয়ে তৈরি এই টাইলস বিভিন্ন সাইজ ও ডিজাইনে বাজারে পাওয়া যায়। এর ব্যবহার বাসার অন্দরে ও বাইরে আলাদা আভিজাত্য ও নান্দনিকতা যোগ করে।
ম্যাট টাইলস: সাধারণত ফ্লোরে পিচ্ছিলতা এড়াতে ম্যাট ফিনিশড টাইলস ব্যবহার করা জরুরি। লক্ষ্য রাখতে হবে বাথরুমে দেয়ালের এবং ফ্লোরে একই রকম টাইলস ব্যবহার করা উচিৎ নয়। এছাড়াও সিমেন্টের তৈরি হেভি লোড বিয়ারিং পার্কিং টাইলস রয়েছে, যা বাগান, ফুটপাথ, ছাদে ব্যবহার করা যায় ।
টাইলস বসানোর সময় লক্ষ্যণীয় বিষয়সমূহ:
১. ফ্লোর ভালো করে চিপিং করতে হবে, এরপর পরিষ্কার করে নিতে হবে।
২. রুম ভালো করে মেপে টাইলস বসানো শুরু করতে হবে, যেন কাটপিস সামনের দিকে না পড়ে।
৩. প্রথমে ওয়াল টাইলস ও এরপর ফ্লোর টাইলস বসাতে হবে।
৪। টাইলস ব্যবহারের আগেই ভালো করে ভেজাতে হবে, বিশেষত সিরামিক টাইলস অবশ্যই ভিজিয়ে ব্যবহার করতে হবে।
৫. টাইলস বসানোর কাজে রাবারের হাতুড়ি ব্যবহার করতে হবে।
৬. টাইলস বসানোর পরপরই টাইলসে লেগে থাকা বালি-সিমেন্ট পরিষ্কার করে ফেলতে হবে, যদি দেরি করা হয় তাহলে স্ক্র্যাচ পড়ে যেতে পারে। টাইলস বসানো হয়ে গেলে পরদিন ফ্লোর টাইলস কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা কিউরিং করতে হবে।
৭. টাইলস বসানোর পরে অবশ্যই ভালোমতো পয়েন্টিং করতে হবে।
টাইলস ব্যবহারে ফ্লোর ফিনিশিং হয় স্থায়ী এবং নান্দনিক। এতে মেঝে পরিষ্কার করাও সহজ। সব মিলিয়েই বর্তমানে মোজাইক আর পাকা ঢালাইয়ের বদলে টাইলসের ব্যবহার বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।