অবকাঠামোর যে কোন অংশের ঢালাইয়ের অপরিহার্য উপাদান কংক্রিট। গতানুগতিক ধারণা রয়েছে যে কংক্রিটের ঢালাই দ্রুত রোদে শুকিয়ে গেলে ঘরও প্রস্তুত হয়ে যাবে দ্রুত, এতে অনেক সময় বাঁচবে। আসলে কি ব্যাপারটা তেমন?
উত্তর- “না”। অত্যধিক গরমে দ্রুত কংক্রিট শুকিয়ে যাওয়ায় ভালোর চেয়ে মন্দের সম্ভবনাই বেশি এবং এতে ঝুঁকির পরিমাণও বেশি। অধিক গরমে কিংবা শুষ্ক আবহাওয়ায় দ্রুত শুকিয়ে যাওয়া কংক্রিটের নিম্নোক্ত সমস্যাগুলো হতে পারে।
কংক্রিট স্ট্রেংথ কমে যায়
দ্রুতগতির খরগোশ আর ধীরগতির কচ্ছপের গল্প আমাদের সবারই জানা। বাস্তবজীবনে এ গল্পের বহু প্রয়োগের মাঝে একটি এই কংক্রিটের শুষ্ককরণ প্রক্রিয়া। অধিক তাপমাত্রা কংক্রিট যত দ্রুত শুকিয়ে যায়, এর শক্তিবৃদ্ধিও তত কম হয়। অন্যদিকে, অল্প তাপমাত্রায় ধীরে ধীরে শুকানো কংক্রিট বেশ শক্তিশালী হয়, এবং টেকেও দীর্ঘদিন।
ফাটল ধরার ঝুঁকি
দ্রুত কংক্রিট শুকিয়ে গেলে তাতে কয়েকটি কারণে ফাটল ধরার ঝুঁকি দেখা দেয়। এর একটি হলো সংকোচন। অত্যধিক গরমে দ্রুত শুকিয়ে যাওয়া কংক্রিট বেশি মাত্রায় সংকুচিত হয়ে যায়, এবং প্রাথমিকভাবে উপরিতলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফাটল দেখা দেয়। প্রথমে সেগুলো উপেক্ষণীয় মনে হলেও পরে তা দিয়ে পানি বা অন্য কোনো রাসায়নিক প্রবেশ শুরু হয়।
তবে উপরিতলের সংকোচনের চেয়ে বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করে কেন্দ্রের প্রসারণ। কংক্রিট যখন শুকোতে থাকে তখন এর কেন্দ্রে তাপ সঞ্চিত হয়। উপরিতলে বায়ু প্রবাহের কারণে ও তাপমাত্রা নিঃসরণ করতে পারায় ঠান্ডা এবং শক্ত হয়ে যায়। কিন্তু ঢালাইয়ের কেন্দ্রে কংক্রিট অধিক তাপে প্রসারিত হতে পারে। ফলে উপরের জমে যাওয়া কংক্রিটে ফাটল সৃষ্টি হয়।
স্পষ্টতই অধিক তাপে কংক্রিটের দ্রুত শুকিয়ে যাওয়া অবকাঠামোর দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য ক্ষতিকর। তাই অত্যধিক গরম আবহাওয়া এড়ানোর সুযোগ থাকলে সেটি গ্রহণ করতে হবে। যদি অবকাঠামো গরম এবং শুষ্ক আবহাওয়াতেই নির্মাণ করতে হয়, তবে জেনে নিতে হবে কীভাবে ফাটল ধরার ঝুঁকি এড়ানো যাবে।
দ্রুত ঢালাই
কাঠফাটা রোদে এবং গ্রীষ্মের শুষ্ক আবহাওয়ায় কংক্রিট ঢালাই করলে প্রথমেই যেদিকে খেয়াল রাখতে হবে তা হলো কংক্রিটের মিশ্রণ তৈরির পর সেটি দ্রুত ঢালাই করে ফেলা। তাই শুরুতেই সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করে ফেলতে হবে। কংক্রিটের মিশ্রণ তৈরি ঢালাইয়ের যথাসম্ভব নিকটে করতে হবে, এবং দ্রুত ঢালাই করে ফেলতে হবে।
ঢালাইয়ের পূর্বে পানি ঢালা
গরম আবহাওয়ায় এবং প্রখর সূর্যের তাপে ঢালাইয়ের স্থানটুকু অর্থাৎ স্টিলের কাঠামো কিংবা কোনো বেজমেন্ট যদি হয়, তা ভীষণ গরম হয়ে থাকে। এর উপর কংক্রিট ঢালা শুরুর আগপর্যন্ত কিছুক্ষণ পর পর পানি ঢেলে একে ঠান্ডা রাখতে হবে। উল্লেখ্য, পানি বাষ্পীকরণে ঢালাইয়ের পৃষ্ঠতল তাপ নিঃসরণ করে ঠান্ডা হয়।
তাপ ও বাতাস আটকানোর ব্যবস্থা
আবহাওয়া পরিবর্তন করা সম্ভব না হলেও আবহাওয়ার প্রভাব কমানো সম্ভব পর্যাপ্ত প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে। অনেক কনস্ট্রাকশন সাইটেই এখন ঢালাইয়ের পৃষ্ঠতলের উপর পাল টেনে সূর্যতাপের প্রভাব কমানোর ব্যবস্থা করা হয়। তবে গ্রীষ্মকালে অত্যধিক সূর্যতাপ যতটা ক্ষতিকর কংক্রিটের জন্য, শুষ্ক বাতাসও ঠিক ততটাই। কারণ এটি দ্রুত কংক্রিটের উপরিতলের আর্দ্রতা শুষে নেয়, এবং সংকোচন ঘটায়। তাই পুরো ঢালাইয়ের কাজের অংশকে বড় তাবু দিয়ে ঘিরে ফেলা আবহাওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব কমানোর সর্বোত্তম উপায়।
শীতল কংক্রিট
কংক্রিট শীতল করার উপায় কি বেশি করে পানি মেশানো? না। প্রয়োজনীয় অনুপাতের চেয়ে অধিক পানি মেশালে কংক্রিট শক্ত হবার পর তা যতটা শক্তিশালী হবার কথা ততটা হতে পারে না। তাই অধিক পানি মেশানো নয়, বরং পর্যাপ্ত পানিতেই কংক্রিট শীতল রাখতে হবে।
আর এর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো কংক্রিটের মিশ্রণে হিমশীতল পানি ব্যবহার করা। যদি কংক্রিটের মিশ্রণ তৈরির স্থানটি ঢালাইয়ের স্থানের কাছাকাছি না হয়, এবং তা কংক্রিট বহনকারী ট্রাকে করে আনতে হয়, সেক্ষেত্রে মিশ্রণে বরফ মেশানো উত্তম। তবে বরফ মেশাতে হবে এমন অনুপাতে যেন তা ঢালাইয়ের স্থানে পৌঁছানোর আগেই ট্রাকের ভেতরে গলে যায়। কোনো অবস্থাতেই বরফের টুকরোসমেত কংক্রিট দিয়ে ঢালাই করা যাবে না।
এয়ার ফগিং
এয়ার ফগিং (Air Fogging) হলো পানিকে ক্ষুদ্র ছিদ্রের মধ্য দিয়ে দ্রুত নির্গত করে একপ্রকার ধোঁয়াশার মতো তৈরি করা। ঢালাই হয়ে গেলে উপরিতলে এয়ার ফগিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে সাদ্য ঢালাই হওয়া কংক্রিটের উপরের বাতাস আর্দ্র থাকবে, এবং তা কংক্রিট থেকে পানির দ্রুত বাষ্পীভবন রোধ করবে।
হাইড্রেশন স্টাবিলাইজার
কংক্রিটের সাথে অধিক পানি ধরে রাখতে পারে এমন বস্তু মেশানোকে হাইড্রেশন স্টাবিলাইজার (Hydration Stabilizer) বলে। সাধারণত ছাই ব্যবহৃত হয়ে থাকে এক্ষেত্রে। উল্লেখ্য, এর ব্যবহার কংক্রিটের শক্তি ক্ষয় বা বৃদ্ধি কোনোটিই করে না। তবে পানি ধরে রেখে দ্রুত শুষ্ক হওয়া রোধ করে।
বাষ্প নিরোধক আবরণ
এটি সর্বাধিক ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলোর একটি। ঢালাইয়ের কিছুক্ষণ পর যখন পৃষ্ঠতল খানিকটা শুকিয়ে আসে, তখন এর আর্দ্রতা ধরে রাখার জন্য প্লাস্টিকের পলিথিন, শিট কিংবা সাদা সূর্যালোক প্রতিফলক আবরণ ব্যবহার করা হয়। এছাড়া, ভেজা চট ব্যবহারও জনপ্রিয় পদ্ধতি।
সন্ধ্যা কিংবা রাতে ঢালাই
ঋতুবদলের জন্য অপেক্ষা না করলেও অন্তত সন্ধ্যা বা রাত হবার জন্য অপেক্ষা করাই যায়। সারাদিনে ঢালাইয়ের সব আনুষঙ্গিক কাজ সেরে ফেলে রাতে অপেক্ষাকৃত কম তাপে ঢালাই করা শ্রেয়। তথাপি, পরদিন সকালের সূর্য থেকে বাঁচাতে বাষ্প নিরোধক আবরণ জরুরি।