একটু বর্ষা, একটু গ্রীষ্ম, একটুখানি শীত
সেই একটুখানি চৌকোছবি আঁকড়ে ধরে রাখি
আমার জানলা দিয়ে আমার পৃথিবী।
অঞ্জন দত্তের এই গান কে না শুনেছে? এ গানের কথার অনেক অর্থ দাঁড় করানো যাবে, তবে তা থেকে জানালা বাদ দেয়ার উপায় নেই। আক্ষরিক অর্থে ধরলে গানের লাইনগুলো তো ঘরের সর্বোচ্চ প্রয়োজনীয় একটি অংশের কথাই বলে, সেটি হলো জানালা। এই জানালা দিয়ে ঘরের বাইরে গ্রীষ্ম, বর্ষা কিংবা শীতের আগমন টের পাওয়া যায়, চার দেয়ালের মাঝে জানালাই তো বাইরের পৃথিবীর সাথে সংযোগ ঘটায়।
তাই গৃহনির্মাণে নান্দনিকতার বালাই থাকুক বা না থাকুক, জানালা নিয়ে বিশেষভাবে ভাবতেই হবে। ছোট, বড়, নাকি মাঝারি; কতটুকু উচ্চতায় স্থাপন করলে ভালো হবে, কোন দিকটায় জানালা দিতে হবে, কেমন জানালা দিলে আলো-বাতাসের সাথে সৌন্দর্যও যোগ হবে- কত প্রশ্ন জানালা নিয়ে কড়া নাড়ে মনের দরজায়! দরজা খুলে সেসব প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে যাওয়া যাক তাহলে।
যা যা ভাবতে হবে
জানালা নির্বাচনের আগে প্রথমেই এর স্থান এবং আকার আকৃতি নিয়ে ভাবতে হবে জরুরি কিছু বিষয়ে। কতটা আলো চাই আপনার ঘরে? আলোর প্রয়োজনীয়তা বুঝে জানালার সংখ্যা নির্বাচন করুন। ভোরের প্রথম আলোকে প্রতিদিন ঘরে আমন্ত্রণ জানাতে চাইলে পূর্বদিকের দেয়ালে দিয়ে দিন একটি জানালা। আবার পূর্বে না হলে পশ্চিমেও দেয়া যেতে পারে। দুপুরের পর থেকে সূর্য পশ্চিমে হেলতে শুরু করলেই ঘরে আসবে প্রচুর আলো, সাথে গরমও!
এক্ষেত্রে অনেকেই উত্তর বা দক্ষিণ যেকোনো এক বা উভয়দিকে জানালা দিতে চান, পূর্ব-পশ্চিম বাদ রেখে। কেননা, সরাসরি সূর্যালোকের প্রয়োজন হয় না দিনের বেলা ঘর আলোকিত করবার জন্য। তাছাড়া, সরাসরি সূর্যের আলো জানালায় পড়লে শত পর্দার বাধায়ও কাজ হয় না, প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই আলোকিত হয় ঘর। এতে ছুটির দিনে একটু বেশি ঘুমানোর বারোটা বাজবে যে!
সংখ্যা এবং আকারের ভাবনায় আবার বর্তমানে পরিবর্তন এসেছে বেশ। একসময় জানালার সংখ্যায় কিংবা আকারে প্রতিসাম্য বজায় রাখার কোনো বিকল্প ছিল না। অর্থাৎ সব ঘরেই একই আকারের জানালা সমান অনুপাতে (দেয়ালের আকার অনুযায়ী সংখ্যা) বসানো হতো। এখন সময় বদলেছে, বদলেছে রুচি, এবং চাহিদা। শোবার ঘরে মোটামুটি আলোর জন্য মাঝারি আকারের একটি বা দুটি জানালা হলেই চলছে। কিন্তু বসার ঘরে দেয়া হচ্ছে বিশালাকারের জানালা। রান্নাঘরের জানালা আবার বদলে যাচ্ছে চাহিদামতো।
জানালা স্থাপনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা। এমন স্থানে জানালা স্থাপন না করাই ভালো যেখানে জানালাটি সর্বদা পর্দায় ঢেকে রাখতে হবে। উদাহরণ হতে পারে জানালার মুখোমুখি রেস্টুরেন্ট, মসজিদের জানালা, কিংবা এমন কোনো স্থান যেখানে সর্বদাই জনসমাগম থাকে।
তবে বাড়ির পাশে যদি মনোরম পরিবেশ থাকে, সেদিকের দেয়ালে জানালা দিতে ভুলবেন না যেন। সবুজ বৃক্ষরাজি কিংবা নদী, বিল বা জলাশয়, অথবা চমৎকার একটি বাগান যেদিকে, সেদিকে একটি বড় জানালা দিয়ে দিন, আর ঘরে বসে সময়ে সময়ে হারিয়ে যান প্রকৃতির মাঝে।
যেসব জানালায় ডিজাইন হতে পারে
বে উইন্ডো (Bay Window)
বে উইন্ডো হলো একপ্রকার জানালা যা ঘরের মূল দেয়ালের সমতলে না থাকে কিছুটা প্রসারিত হয়ে বাইরের দিকে জায়গা করে নেয়। সহজভাবে বললে, বে উইন্ডো একপ্রকার প্রসারিত ঝুল বারান্দাই বটে। পার্থক্য হলো এই যে- এটি মূল ঘরের সাথেই থাকে।
বে উইন্ডো আকারে বেশ বড় হয়। এটি ঘরে প্রচুর আলো-বাতাস প্রবেশে সাহায্য করে, সাথে সৌন্দর্যবৃদ্ধি তো থাকছেই। বাড়ির সামনের দিকের কক্ষগুলোয়, বসার কিংবা শোবার ঘর যেকোনো ঘরই হতে পারে, সাধারণ এই জানালাগুলো স্থাপন করা হয়, যার জন্য অন্দরের সৌন্দর্যের সাথে বাইরে থেকেও বাড়িকে পরিপাটি দেখায়।
কেসমেন্ট উইন্ডো (Casement Window)
এখনও পর্যন্ত এ ধরনের জানালাই সর্বাধিক ব্যবহৃত ও প্রচলিত, যদিও থাই গ্লাস একে প্রতিস্থাপন করে চলেছে। কেসমেন্ট উইন্ডো হলো একপ্রকার জানালা যা ক্র্যাংকের সাহায্যে দেয়ালে আটকে থাকে, এবং একে সম্পূর্ণ বাইরের দিকে ছড়িয়ে দিয়ে খোলা যায়। এতে জানালার প্রায় পুরোটা দিয়ে ঘরে আলো-বাতাস প্রবেশ করে। একসময় লোহার বা অস্বচ্ছ কাচের কেসমেন্ট জানালা ব্যবহার করা হলেও এখন সেগুলোকে প্রতিস্থাপন করেছে স্বচ্ছ কাচ। এ জানালার দুটো অসুবিধা রয়েছে। প্রথমত, একে আকারে খুব বেশি বড় করা যায় না, এবং দ্বিতীয়ত, জানালার বাইরের দিকে কোনোপ্রকার শিল্ড বা ইনসেক্ট নেট (কীটপতঙ্গরোধী ঘন জালবিশেষ) ব্যবহার করা যায় না।
পিকচার উইন্ডো (Picture Window)
মূলত ছবির ফ্রেমের মতো জানালার স্থাপনই এর এরূপ নামকরণের কারণ। সব বাসায় কিংবা যেকোনো স্থানে এই জানালা ব্যবহারযোগ্য নয়। কেবল ঘরের ভেতর থেকে চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার ব্যবস্থা থাকলেই এরূপ জানালা দেয়া বাঞ্ছনীয়। অবশ্য অনেকে বাড়ির সামনের দেয়ালে পিকচার উইন্ডো ব্যবহার করেন। ছবির ফ্রেমের মতো দেয়ালে স্থির এই জানালা খোলা যাবে না। প্রচুর আলো আসলেও বাতাসের উপায় নেই। আবার খুব একটা নিরাপদ বা টেকসইও বলা যাবে না।
উইন্ডো ওয়াল (Window Wall)
অনেকটা পিকচার উইন্ডোর মতোই, তবে আকারে আরো বড়। বসার ঘর বা হলঘরের পাশে যদি দেখার মতো প্রাকৃতিক দৃশ্য থাকে, তবে সেই ঘরের বাইরের দেয়ালটি করে ফেলতে পারেন উইন্ডো ওয়াল। অর্থাৎ পুরো দেয়ালই হবে স্বচ্ছ কাচের তৈরি। এটাও পিকচার উইন্ডোর মতো স্থির, এবং খোলার ব্যবস্থা নেই এতে। একেবারে পূর্ব বা পশ্চিমমুখী দেয়ালে এরূপ জানালা করা যাবে না। এতে প্রচুর তাপ আসবে ঘরে।
স্লাইডার (Slider)
স্লাইডার বলার পর আলাদা করে পরিচয়ের প্রয়োজন আছে কি? এককথায়, বর্তমানের সর্বাধিক জনপ্রিয় এবং সহজ বিকল্প হলো স্লাইডার জানালা, যা আড়াআড়িভাবে স্লাইড করে বা পিছলে খোলা বা বন্ধ করা যায়। এই জানালা একেবারে ছোট আকার থেকে শুরু করে মাঝারি বা বেশ বড় আকারের পর্যন্ত হয়। তাই বাসাবাড়ি, অফিস বা বাণিজ্যিক ভবন- সর্বত্রই এর ব্যবহার হচ্ছে। আমাদের দেশে থাই গ্লাস নামেই সর্বাধিক পরিচিত স্লাইডার জানালা। দামে সাশ্রয়ী, টেকসই, এবং সহজে পরিষ্কার করা যায় এ জানালা। তবে মূল সমস্যা হতে পারে সম্পূর্ণ বাতাস নিরোধী না হওয়া।
আপনার চাহিদা এবং সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করে তাই সুখের নীড়ের জন্য বেছে নিন কাঙ্ক্ষিত জানালা। কারণ, ‘হোম’কে ‘সুইট হোম’ করে তুলতে যে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের প্রয়োজন, যে প্রাকৃতিক দৃশ্যের প্রাচুর্যের অবলোকনের প্রয়োজন, ঘরের ভেতরে বসে সেসব উপভোগের প্রধান উপায়